somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

মরীচিকা (পর্ব-২৩)

০১ লা মে, ২০১৯ সকাল ৯:৪৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



মরীচিকা (পর্ব-২৪)

-জানেন দাদা, মাস ছয়েক আগে কলকাতা থেকে একদল লোক এসেছিলেন এখানে শুটিং করবেন বলে। চারিদিকে তাবু খাটিয়ে আলোয় আলোকিত করে ওনারা এক অন্য পরিবেশ তৈরি করেছিলেন। দূর থেকে দলে দলে লোক আসতেন শুটিং দেখতে। আমি নিজে এরকম কত লোককে এখানে ভাড়া নিয়ে এসেছি তার কোন হিসেব নেই। কদিনের মধ্যেই স্থানটির নাম হয়ে গেছিল সিনেমাতলা। তারপরে হঠাৎ একদিন আশপাশের গ্রামের লোকেরা দলবেঁধে এসে ওনাদেরকে এস্থান থেকে চলে যাওয়ার জন্য চাপ দিতে থাকেন। স্থানটিতে অনাচার হচ্ছে যুক্তি দেখিয়ে এলাকাবাসীরা সম্মিলিত ভাবে থানা- পুলিশের দ্বারস্থ হন এবং অবশেষে পুলিশের সাহায্যে ওনাদেরকে শুটিং বন্ধ করাতে সমর্থ হন।
কথা বলতে বলতে হঠাৎ রোহিত জোরে ব্রেক কষলো।
-দাদা! আমরা একদম নিকটে চলে এসেছি। ইঞ্জিনের গাড়ি আর ভিতরে নিয়ে যাওয়া ঠিক হবে না। বাকি রাস্তাটা আমরা একটু হেঁটেই যাব।আমরা রোহিতের নির্দেশমতো গাড়ি থেকে নেমে এলাম।ও আমাদের রাস্তা দেখাতে লাগলো। পাইন ইউক্যালিপটাস ও দেবদারু সহ অজানা বৃক্ষরাজির ঘন জঙ্গলের ভিতর দিয়ে শুকনো পাতার উপরে মচমচ করে হাঁটতে হাঁটতে আমরা ক্রমশ এগিয়ে চললাম। হঠাৎ সাপের প্রসঙ্গ আসাতেই আমার সারা শরীরে শীতল স্রোত প্রবাহিত হলো। ছোট থেকেই আমি সাপকে প্রচন্ড ভয় পাই। গ্রামে থাকাকালীন স্নান করার সময় পুকুরে ঢোঁড়া সাপ দেখলে সেই ভয়ে আমি পরবর্তী এক সপ্তাহের মতো ঐ পুকুরে যেতামই না। রোহিত আমার মানসিক অবস্থা বুঝতে পারল,
- দাদা! আমি সামনে যাচ্ছি, আপনারা আমার পিছন পিছনে আসুন।
আগে বেশ কয়েকবার কথা বলতে বলতে এগিয়ে গেলেও এবার রোহিতকে সামনে রেখে আমরা ওর পদাঙ্ক অনুসরণ করে চললাম। কিন্তু আশ্চর্য হলাম শান্তনুর চোখেমুখে কোন পরিবর্তন না দেখে। আরো কিছুটা এগোতেই অবশেষে মন্দিরটি দেখতে পেলাম। পুরানো জীর্ণ মন্দিরটির সারা গায়ে পলেস্তারা নেই বললেই চলে। মোটা মোটা দেয়ালগুলি মধ্যযুগের স্থাপত্য রীতির সাক্ষ্য বহন করছে। সারা শরীরে ছত্রাক ও নানান আগাছা বাসা বেঁধেছে। চার পাশে উঁচু উঁচু গাছ মাথা তুলে দাঁড়াতে মন্দির চত্বরটি চূড়ান্ত অস্বাস্থ্যকর ও স্যাঁতসেতে লাগলো।বৃক্ষগুলি সম্মিলিত ভাবে যেন মন্দিরে সূর্যালোকের প্রবেশকে নিষিদ্ধ করে দিয়েছে। এহেন মন্দিরের পাশে কিছুক্ষণ দাঁড়াতেই গা ছমছম করে উঠলো। আশপাশে অসংখ্য পাখির কিচিরমিচিরে মনে হলো সকাল নয় এখন যেন সবে সন্ধ্যে হতে চলেছে।আপন মনে এক জায়গায় দাঁড়িয়ে আশপাশে দেখতে দেখতে যখন এসব ভাবছিলাম তখন শান্তনু বলে উঠলো,
-আমি একটু মন্দিরের ভেতরটা দেখব।
আমার ভেতরের অস্বাভাবিকত্ব শান্তনুকে বুঝতে দিলাম না। মুখে বললাম,
-তোমাকে নিরাপদে হোস্টেলে পৌঁছে দেওয়া আমার কর্তব্য। শুনলে তো এখানে সাপ -খোপের উপদ্রব আছে।
আমার কথার প্রতিধ্বনি তুলে রোহিতও একই কথা বললে শান্তনুর চোখেমুখে বেশ বিরক্তির চিহ্ন ফুটে উঠলো। আমি ওর মনোভাবটা বুঝতে পেরে স্থান ত্যাগ করাটা জরুরী মনে করলাম। একটু দূরে ঝিলটিকে আঙ্গুল দেখিয়ে,
-রোহিত এবার আমরা ওই ঝিলটার দিকে একটু যাব।
-হ্যাঁ দাদা চলুন।

যেতে যেতে রোহিতকে উদ্দেশ্য করে বললাম,
-বট গাছটিকে লক্ষ্য করলাম অসংখ্য ঝুড়ি নেমেছে। কিন্তু আসল গাছ কোনটা সেটাই বুঝতে পারছি না। আমি ইতিপূর্বে এমন বটবৃক্ষ হাওড়ার শিবপুরের বোটানিক্যাল গার্ডেনেও দেখেছি। এই গাছটি আকারে অনেক ছোট কিন্তু দেখে মনে হল যেন বোটানিক্যাল গার্ডেনের গাছটির ছোটোভাই।
আমি আবার বললাম,
-আচ্ছা শান্তনু! তুমি কখনো শিবপুরের বোটানিক্যাল গার্ডেনে গেছো?
-না। আমার ওখানে যাওয়ার সুযোগ হয়ে ওঠেনি।
-ওকে ঠিকই তো! তোমার মত ছোট বয়সে অনেকেরই ওখানে যাওয়ার সুযোগ হয়ে ওঠে না। এই যেমন আমি নিজেও ওখানে গেছি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীন। তবে জীবনে যদি কখনো সুযোগ আসে তাহলে অবশ্যই জায়গাটিতে একবার যাবে এবং দেখবে কি বিশাল গাছ; কতটা জায়গা বিস্তার করে সে দাঁড়িয়ে আছে। অসংখ্য ঝুড়ির মাঝে আসল গাছটিকে খুঁজেই পাবে না। তবে এখানে একটি শিক্ষণীয় দিক কি জানো শান্তনু? মানুষের সমাজে আমরা আসল নকল খুঁজে বেড়াই। কিন্তু উদ্ভিদ কূলে বোধ হয় ওসব তুচ্ছ ব্যাপার। কে প্রাচীন কে নবীন, কে আসল কে নকল -এসব বাছ বিচার না করে বিরাট গাছের বোঝা তারা সম্মিলিত ভাবে বহন করে। আর আমরা বোকা মানুষ, কেবল আসল নকল খুঁজে বেড়াই।

বটবৃক্ষ পার করে আমরা এবার ঝিলের সামনে এসে দাঁড়ালাম। বেশ বড় ঝিল, পরিষ্কার এবং শান্ত জলরাশি। এক নজরে ঝিলটিকে দেখে গায়ে যেন শিরশির করে উঠলো। এরকম নির্জন স্থানে এমন স্নিগ্ধ ঝিলের উপস্থিতির মধ্যে কিছুটা অজানা ভালোলাগা মনে হতেই জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে রোহিতের দিকে তাকাতেই দুহাত কোমরে দিয়ে দাঁড়িয়ে দূরে দৃষ্টি দিয়ে বলতে লাগলো,
-দাদা এই ঝিলের একটা মহত্ত্ব আছে। আশেপাশের গ্রামের লোকেরা নানান দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে মায়ের কাছে মানত করেন এবং ঝিলে বড় বড় মাছ ছেড়ে দেন। মাকে ভক্তিভরে নিবেদন করলে মা তাদেরকে রোগ ব্যাধির বিনাশ ঘটান। মায়ের নামে ছাড়া মাছ কেউ কখনো ধরেন না। ঝিলের আরো একটি বিশেষত্ব হল একে কেউ কখনো প্লাবিত হতে দেখেননি। আপনি আজ যে পাতাগুলি পুকুর পাড়ে পড়ে থাকতে দেখছেন আগামীকাল এসে দেখবেন এখানে একটি পাতাও নেই। প্রতিদিন আশপাশের গাছ থেকে এতো পাতা পড়ে কিন্তু সেগুলো কোথায় যায় কেউ বলতে পারেন না। কোন মানুষের পক্ষে এভাবে পরিষ্কার রাখাটাও বাস্তবে অসম্ভব।

কথা বলতে বলতে দেবীর মহাত্মায় রোহিত আবেগময় হয়ে উঠলো। শেষের কথাগুলো বলতে গিয়ে রীতীমতো গলা ধরে এল। শান্তনু বাচ্চাদের মত প্রশ্ন করলো,
-আচ্ছা এত পাতা কারা নিয়ে যায়?
-কারা আবার! মায়ের আশীর্বাদে মুহূর্তেই সব পরিষ্কার হয়ে যায়।
-উনি কখন পরিষ্কার করেন?
-আরে বোকা ছেলে! মা কি কখনো তোমার আমার দেখিয়ে করবেন?
-আচ্ছা আমি যদি একদিন সারাদিন বসে থাকি ওনার কাজটি দেখার জন্য।
- চোখের পলকের মধ্যে কখন উনি কাজটি করবেন তুমি টেরই পাবে না। আর তাছাড়া এখানে সন্ধ্যার পরে থাকাটাও নিরাপদ নয়।
-কেন নিরাপদ নয়?
-তুমি এখনো অনেকটা ছোট আছো। আরেকটু বড় হও বিষয়টি বুঝতে পারবে।

শান্তনুর প্রশ্নগুলির মধ্যে যেমন সরলতা ছিল তেমনি ছিল যুক্তিবোধ। বিষয়টির প্রতি তার আগ্রহ, প্রশ্ন করার ধরন, আমাকে বেশ পুলকিত করলো। অথচ এই ছেলেটিকেই হোস্টেলে অন্য রূপে দেখেছি। ওর সম্পর্কে আমরা তাহলে কতই না ভুল ধারণা পোষণ করেছি। ওর সঙ্গে কথোপকথনকালে রোহিত নিজের ধর্মীয় আবেগকে ধরে রেখে যতটা সম্ভব উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করলেও একটা সময় সে কিছুটা বিরক্ত হয়ে বড় হওয়ার প্রসঙ্গ তুলতেই শান্তনুর চোখে মুখে একটা চূড়ান্ত হতাশা বেরিয়ে এলো। কথা বলছিলাম আমরা ঝিলের বাম দিকে কিছুটা ফাঁকা জায়গা দেখে ঘাসের উপর বসে। বেশ কিছুক্ষণ কারো মুখে কোন কথা নেই। এবার আমিই শান্তনুকে জিজ্ঞাসা করলাম,
-শান্তনু একটা কথা তোমাকে জিজ্ঞাসা করব বলে ভেবেছি। অবশ্য তুমি যদি আমাকে তোমার বন্ধু বলে মনে করো তবেই।
শান্তনু চুপ করে রইলো।
-কি? আমাকে তুমি তোমার বন্ধু ভাবো না?
-আপনি কি জিজ্ঞাসা করবেন?
-এই তো লক্ষী ছেলে আমার! আচ্ছা বাবা সকালে চায়ের দোকানে বাবা-মায়ের প্রসঙ্গ তুলতেই কেমন করে উঠলে। এখন আবার বড় হবার প্রসঙ্গ তুলতেই তোমার চোখে মুখে বিরক্তির চিহ্ন ফুটে উঠলো। বুঝতেই পারছি তোমার মনের মধ্যে পাহাড় প্রমাণ কষ্ট আছে। সত্যিই কি তোমার বাবা- মা তোমাকে ভালোবাসেন না?
শান্তনু যথারীতি চুপ করে রইলো। রোহিত বিষয়টি কিছুই জানে না। সে আমার কথা কিছুটা উপলব্ধি করে একবার আমার দিকে আর একবার শান্তনুর দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে রইল। পাশে শান্তনুর দৃষ্টি দূরে ঝিলের জলরাশির দিকে। আমি আবার বললাম,
-ঠিক আছে। তোমার যদি ইচ্ছে না করে তাহলে আজ থাক। পরে অন্য একদিন এলে সেদিন না হয় তোমার কথা শুনবো। চলো তবে আজ আমাদের ফেরা যাক। রোহিতকে চোখের ইশারা করতেই ও উঠে দাঁড়ালো এবং বলে গেল,
-দাদা আপনারা আসুন। আমি একটু আগে গিয়ে দেখি গাড়িটা ঠিকঠাক আছে কিনা।
রোহিত চলে যেতেই আমি শান্তনুর আরো একটু কাছে এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞাসা করি,
-আচ্ছা শান্তনু! তুমি চায়ের দোকানে বললে তোমার কোন আত্মীয়-স্বজন নেই বা কেউ তোমাকে ভালোবাসে না।অথচ শুরুতে অ্যাডমিশন রেজিস্টারের খোঁজ নিয়ে জানতে পারি তোমার বাবার নামের জায়গায় সৌমিক দে লেখা আছে। আর অভিভাবিকা হিসেবে লেখা আছে শ্রীমতি নলিনীবালা দত্তের নাম- বিষয়টি ঠিক বুঝলাম না।
-উনি আমার মাসি হন।
-তবে অভিভাবক অ্যাটেনডেন্স শিটে দেখলাম সব কটি সই নলিনী বালা দেবীর। তাহলে বাবা কি তোমার সঙ্গে দেখা করতে আসেন না?
শান্তনু আবার চুপ করে রইল। আমি আবার জানতে চাইলাম,
-তোমার বাবা কি করেন শান্তনু?
-বাবা একজন আইনজীবী। আসানসোল আদালতে প্রাক্টিস করেন। সঙ্গে কয়লার ব্যবসাও আছে।
-তাহলে তো তোমার বাবা একজন সম্পন্ন ব্যাক্তি বলতে হয়। বাড়িতে আর কে কে আছেন?
আবার চুপ করে রইলো।
-চলো।এবার তাহলে আমাদের ফেরা যাক । রোহিত অপেক্ষা করছে। বলতেই,
-আমার বাবা অত্যন্ত বদ মেজাজী মানুষ। ছোট থেকে দেখে আসছি সামান্যতেই বাবা প্রচণ্ড রেগে যেতেন। আর সেই রাগ গিয়ে পড়তো আমার আর মায়ের উপরে। সকালে আমি আর রাতে মা ছিলেন বাবার আক্রমণের নিশানা । বাবা বাড়িতে থাকলে অন্তত তিন- চার বার আমার পিঠে ঘা পড়তো। সঙ্গে প্রবল বকাবকিতে বাড়ি মাথায় করে তুলতেন। একটু বড় হতেই বাবার হাত থেকে রক্ষা পেতে ছুটে গিয়ে বক্স খাটের তলায় ঢুকে পড়তাম। আমাকে ধরতে না পেরে বাবা সিংহের মতো গর্জন করতেন। তবে বাবাও হারার পাত্র নন। কোর্টে যাওয়ার আগে বাইরে থেকে শিকল তুলে দিতেন কখনোবা। মাঝে মাঝে দুপুরের দিকে ড্রাইভার কাকু এসে ঘরের শিকল খুলে আমাকে মুক্তি দিতেন । তবে ছোট থেকেই এরকম অবরুদ্ধ হয়ে জল খাবার না খেয়ে বেশ কয়েকবার পার করেছি। মারের চোটে কাতরাতে কাতরাতে বেশ কয়েকবার খাটের তলায় বেঘোরে ঘুমিয়েও গেছি। খিদে আমার তেমন পেত না তবে প্রচন্ড তৃষ্ণা পেত। রবিবার বা যে কোন ছুটির দিন আমার কাছে ছিল বিভীষিকাময়। ছুটির দিনে বাবার নির্যাতন আমার সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে যেত। খাটের চারটি পা ও তলা হয়ে উঠেছিল তখন থেকে আমার বিশ্বস্ত বন্ধু। তবে এই পিছনেও একটি কাহিনী আছে।

মায়ের প্রসঙ্গে পরে আসছি, তবুও একটুখানি জানিয়ে রাখি। মাকে কোনদিন আমাকে সাহায্য করতে এগিয়ে আসতে দেখি নি। মা অত্যন্ত কম কথা বলতেন তবে বাবার ভয়ে যে সব সময়ে যে এমন আচরণ করতেন তা নয়। তবে কেন করতেন সে কারণটি আজও আমার কাছে পরিষ্কার নয়। আমার প্রতি মায়ের আচরণ ছিল অনেকটা নির্লিপ্ত প্রকৃতির। কখনো কখনো খুব মার খেয়ে মাকে অভিযোগ করলে মা উদাসীনভাবে বলতেন,
-আমার কিছু করার নেই বাবা। তুমি বরং আশপাশের গাছপালা বা প্রকৃতিকে বলে তোমার রাগ কমাতে পারো। মায়ের কথাতে যেন সত্যতা খুঁজে পেতাম। তখন থেকে প্রকৃতির সঙ্গে আমার একটা একাত্মতা তৈরি হয়। কালু মুনিয়া বুবাই ছিল আমার বন্ধু। মায়ের মতো আমিও নাকি পাগল, গাছের সঙ্গে কথা বলি জানতে পেরে বাবা একদিন লোক দিয়ে তিনটে গাছকেই কেটে ফেললেন। সেই কাকুকে কত করে অনুনয়-বিনয় করলাম। কিন্তু শুনলেন না। বললেন বাবার নির্দেশে গাছ কাটছেন। বাড়িতে পাগলদের সঙ্গে বাস করে উনি নাকি ক্রমশ পাগল হয়ে উঠছেন। কালু ও মুনিয়া ছিল মায়ের হাতে বসানো দুটি পেঁপে গাছ,আর বুবাই ছিল উঠোনের এক প্রান্তে পুরানো একটি শিউলি ফুলের গাছ। পেঁপে গাছ দুটির নামকরন মা করেছিলেন। আর শিউলি ফুল গাছটির নামকরণটি আমি করেছিলাম। ছোটবেলায় আমার এক মাসি আমাকে বুবাই বলে ডাকত। কিন্তু বাবা তা পছন্দ করতেন না।বাবা চাইতেন না আমাদের সঙ্গে কারো সম্পর্ক থাকুক। ফলে পরের দিকে বাবার ক্রমাগত দুর্ব্যবহার কারণে মাসির আমাদের বাড়িতে আসা বন্ধ হয়ে যায়। আর তখন থেকেই আমি মাসির দেওয়া ওই নামটির খুব অভাব ফিল করতাম। যে কারণে শিউলি গাছের অমন নামকরণ করা। অস্বীকার করবো না যে বাবা আমাকে প্রহার করলেও যত না শারীরিক কষ্ট পেয়েছি তার চেয়ে বহুগুণ বেশি মানসিক আঘাত পেয়েছিলাম আমার সেই ছোট্ট শৈশবে গাছ তিনটিকে হারিয়ে।

এরপর থেকে খাটের তলা হয়ে উঠেছিল আমার কাছে সবচেয়ে নিরাপদ আশ্রয়। বাবার তাড়া খেয়ে ছুটে যেতাম খাটের দিকে, অমনি চারটি পা যেন অনেকটা উঁচু হয়ে মুহূর্তে আমাকে গার্ড করে বাবার হাত থেকে রক্ষা করত। ওরাই ছিল সারাদিনে আমার খেলার সাথী। আমার দুঃখ কষ্ট ওরাই প্রকৃত বুঝত। আমি ঘুমিয়ে পড়লে মনে হতো ওরা যেন আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। আমি যখন একাকী কাঁদতাম, একটু ঝিমিয়ে পড়লে ওরা আমাকে সান্ত্বনা দিত। আমি বহুদিন ওদের এমন সুহৃয়ের পরিচয় পেয়েছি। ওদের সহচর্যে কখনো কখনো খুব আবেশে থাকতাম। চোখ খুলে অসহায় বোধ করতাম। ওরা যেন বলত, প্লীজ চোখ বন্ধ কর। কারণ চোখ খুললে আমরা যে থাকতে পারি না।একই সঙ্গে চোখ বন্ধ করলে যে তুমি আমাদের উপস্থিতিও বুঝতে পারবে। আমরা সর্বদাই তোমার পাশেই আছি। একদিন যেন ওরা আমাকে বলল, যাও ওঠো স্কুলে যাওয়ার সময় হয়ে গেছে। পরে কোন একদিন বাবা আমার গায়ে হাত দিলে আর আমি পালালাম না। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মার খেলাম। বাবা পাল্টা জিজ্ঞাসা করলেন,
-কিরে আজ আর পালাবি না?
আমি কাঁদতে কাঁদতে বলেছিলাম,
-আমি স্কুলে যাব। তুমি আমাকে আর আটকে রেখো না। প্লিজ! বাবা প্লিজ!
সেদিন কি মনে হয়েছিল, বাবা আমাকে আর মারেননি।

আগেই বলেছি বাবার হাতে এত মার খেলেও মাকে তেমনভাবে কোনদিনই এগিয়ে আসতে দেখি নি। চোখে মুখে মায়ের একটা অসহায়ত্ব থাকতো ঠিকই কিন্তু সেই অসহায়ত্ব যতটা অন্তরের তার চেয়ে অনেক বেশি লোক দেখানো বলে আমার মনে হতো। মাকে দেখতাম প্রায়ই সাজগোজ করে বার হয়ে যেতেন। তবে চলে আসতেন সন্ধের আগেই। অথচ মা চাকুরী করতেন না বলে জানতাম।স্কুলের অনেক সঙ্গী সাথীদেরকে দেখেছি তাদের বাবা-মায়েরা তাদেরকে কত আদর যত্ন করেন। কিন্তু ওই শব্দটি আমার কাছে ছিল সম্পূর্ণ অধরা। মায়ের কাছে আদর না পেলেও বকাবকি যে পাইনি, একথা সত্য। কিন্তু বাবার কাছে আদর বস্তুটি ছিল সম্পূর্ণ অকল্পনীয়। অতিরিক্ত ছিল যখন তখন প্রহার । আর এই ভাবেই আমি ক্রমশ বড় হচ্ছিলাম। একদিন মা সাজগোজ করে বার হলে বায়না করেছিলাম মায়ের সঙ্গ নেওয়ার।সেদিন প্রথম মাকে রাগতে দেখেছিলাম। মায়ের এমন মূর্তি দেখে প্রচন্ড ভয় পেয়েছিলাম। পরে মান ভাঙানোর চেষ্টা করে ক্ষমা চেয়ে নিই যে আর কখনো সঙ্গে যাওয়ার অন্যায় বায়না করব না। মাকে যে অন্তত বাবা হিসেবে দেখতে চাই না, সেটাই ছিল সেদিনের আমার আকুতির মূল লক্ষ্য।

মায়ের সঙ্গে বাবাকে কোনদিন স্বাভাবিকভাবে কথাও বলতে দেখিনি। বাবা প্রায়ই ড্রিঙ্ক করে বাড়ী ফিরতেন এবং কোট প্যান্ট খুলতে খুলতে বড় অ্যাম্বাসাডর জুতো দিয়ে মাকে প্রচন্ড পেটাতেন। আমি ভয়ে কুঁকড়ে যেতাম, লুকিয়ে পড়তাম পাশের ঘরে। সেকেন্ডের ব্যবধানে মায়ের ওরে বাবারে! চিৎকার শুনে বুঝতাম মায়ের পিঠে কতগুলো অ্যাম্বাসাডর পড়েছে।এক সময় শব্দ বন্ধ হয়ে যেত। খানিক বাদে বাবা বৈঠকখানায় মক্কেল সামলাতে চলে যেতেন। মাকে দেখতাম সারা শরীর ও মুখে নতুন নতুন কালশিটে নিয়ে রাতের খাবার তৈরি করতে।

লীনাপিসি ছিল বাবার বন্ধু। মায়ের কাছ থেকে শুনেছিলাম লীনাপিসির সঙ্গে স্বামীর ছাড়াছাড়ির পিছনে বাবার অবদান ছিল। আর পিসির আগমনের পর থেকে আমাদের উপরে বাবার অত্যাচারের মাত্রাটা লাগামহীনভাবে বেড়ে গেছিল। প্রায়ই লীনাপিসি কারণে -অকারণে আমাদের বাড়িতে আসতেন। আমি ও মা লুকিয়ে পড়তাম কোন একটা ঘরে। সামনাসামনি হলে আবার নেমে আসবে বাবার নির্যাতন। লুকিয়ে লুকিয়ে দেখতাম লীনাপিসির গলা জড়িয়ে বাবা আদর করতেন। যেদিন প্রথম দেখেছিলাম বাবা লীনাপিসিকে জড়িয়ে হেসে হেসে কথা বলছেন, নিজের চোখকে যেন বিশ্বাস করতেই পারছিলাম না যে একজন রাগী লোক এমন হেসে হেসে কথা বলতে পারেন ভেবে। একদিন বাবার হাতে মার খেয়ে কাঁদতে কাঁদতে স্কুলে যাবো বলে ব্যাগ গোছাচ্ছি, এমন সময় লীনাপিসি চলে এলেন।
-শান্তনু আজ তোকে নাকি বাবা আবার মেরেছে?
পিসির এমন করুন সুরে কথার অর্থ আমি ঠিক বুঝতে পারিনি। আবেগ ধরে রাখতে না পেরে ডুকরে কেঁদে উঠেছিলাম।
-আহারে! বাবাটির তাহলে সত্যিই খুব লেগেছে। বলে ক্ষতস্থানে হাত বোলাতে থাকেন।
বাবা বাড়ি না থাকায় মা চলে আসেন আমার পাশে। এবার মাকে উদ্দেশ্য করে বললেন,

বিশেষ দ্রষ্টব্য-১, পর্বটি উৎসর্গ করা হল ব্লগে আমাদের সকলের প্রিয় শ্রদ্ধেয় আহমেদ জী এস ভাইকে।

২,সুধী পাঠক বৃন্দের কাছে ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি যে পর্বটি একটু বড় হওয়াতে দুটি পর্বে ভাগ করতে বাধ্য হলাম। আগামী কয়েকদিনের মধ্যেই এই পর্বের বাকি অংশটি প্রকাশিত হবে। সাথে সাথে আনুষ্ঠানিকভাবে শেষ হবে মরীচিকা সিরিজটি। মলাট বদ্ধ করার আশাতে অপ্রকাশিত তিন-চারটি পর্বকে ব্লগে প্রকাশ না করার সিদ্ধান্তের সঙ্গে সকলকে সহযোগিতা করতে অনুরোধ করা হচ্ছে।

মরীচিকা (পর্ব-২২)

সর্বশেষ এডিট : ০২ রা জুন, ২০২০ দুপুর ২:২৪
২৮টি মন্তব্য ২৮টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

কুড়ি শব্দের গল্প

লিখেছেন করুণাধারা, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:১৭



জলে ভাসা পদ্ম আমি
কোরা বাংলায় ঘোষণা দিলাম, "বিদায় সামু" !
কিন্তু সামু সিগারেটের নেশার মতো, ছাড়া যায় না! আমি কি সত্যি যাবো? নো... নেভার!

সানমুন
চিলেকোঠার জানালায় পূর্ণিমার চাঁদ। ঘুমন্ত... ...বাকিটুকু পড়ুন

ধর্ম ও বিজ্ঞান

লিখেছেন এমএলজি, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ ভোর ৪:২৪

করোনার (COVID) শুরুর দিকে আমি দেশবাসীর কাছে উদাত্ত আহবান জানিয়ে একটা পোস্ট দিয়েছিলাম, যা শেয়ার হয়েছিল প্রায় ৩ হাজারবার। জীবন বাঁচাতে মরিয়া পাঠকবৃন্দ আশা করেছিলেন এ পোস্ট শেয়ারে কেউ একজন... ...বাকিটুকু পড়ুন

তালগোল

লিখেছেন বাকপ্রবাস, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৩৫


তু‌মি যাও চ‌লে
আ‌মি যাই গ‌লে
চ‌লে যায় ঋতু, শীত গ্রীষ্ম বর্ষা
রাত ফু‌রা‌লেই দি‌নের আ‌লোয় ফর্সা
ঘু‌রেঘু‌রে ফি‌রে‌তো আ‌সে, আ‌সে‌তো ফি‌রে
তু‌মি চ‌লে যাও, তু‌মি চ‌লে যাও, আমা‌কে ঘি‌রে
জড়ায়ে মোহ বাতা‌সে ম‌দির ঘ্রাণ,... ...বাকিটুকু পড়ুন

মা

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৩


মায়াবী রাতের চাঁদনী আলো
কিছুই যে আর লাগে না ভালো,
হারিয়ে গেছে মনের আলো
আধার ঘেরা এই মনটা কালো,
মা যেদিন তুই চলে গেলি , আমায় রেখে ওই অন্য পারে।

অন্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

কপি করা পোস্ট নিজের নামে চালিয়েও অস্বীকার করলো ব্লগার গেছে দাদা।

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ২:১৮



একটা পোস্ট সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেশ আগে থেকেই ঘুরে বেড়াচ্ছে। পোস্টটিতে মদ্য পান নিয়ে কবি মির্জা গালিব, কবি আল্লামা ইকবাল, কবি আহমদ ফারাজ, কবি ওয়াসি এবং কবি... ...বাকিটুকু পড়ুন

×