মরীচিকা (পর্ব-২৫)
(গত পর্বের শেষে ছিল, লিনাপিসি আমার ক্ষতস্থানে ও মাথায় হাত বোলাতে থাকেন। বাবা বাড়িতে না থাকায় মা চলে আসেন আমার পাশে। এবার মাকে উদ্দেশ্য করে বলেন, )
-তুমি ও তোমার ছেলে কি না মরা পর্যন্ত এ বাড়ি ছেড়ে যাবে না? খাচ্ছো দাচ্ছো এখানে আর চড়ে বেড়াচ্ছ ওই বখাটে অতনুর সঙ্গে? তুমি কি ভেবেছো তোমার কেচ্ছা আমরা কিছুই জানি না? দেখো বাপু যদি বাঁচতে চাও তাহলে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ছেলেকে নিয়ে এ বাড়ি থেকে বিদেয় হও।
মাকে এই প্রথম সামনাসামনি কাঁদতে দেখেছিলাম। প্রথমে মা পিসির হাত ধরলে, জোরে ঝাঁকিয়ে হাত ছাড়িয়ে নিলেন। মা হাউমাউ করে কেঁদে উঠলেন। ছেলের সামনে এত বড় মিথ্যা অপবাদ না দিতে বারবার অনুরোধ করলেন। কিন্তু পিসি তো মায়ের কথা শুনলেন না, উল্টে মিথ্যা অপবাদের কথা বলতেই এই মারে সেই মারে করে বিরাট হম্বিতম্বি করতে লাগলেন। মা পিসিকে বোঝাতে ব্যর্থ হয়ে পা ধরতে গেলে পিসি মারলেন সজোরে এক লাথি। টাল সামলাতে না পেরে মা হুমড়ি খেয়ে পড়লেন দরজার চৌকাঠের উপর। হঠাৎ মাথায় হাত দিয়ে মা চুপ হয়ে গেলেন। আমি এতক্ষণে দুহাতে চোখ ঢেকে আঙ্গুলের ফাঁক দিয়ে দেখছিলাম। মায়ের মাথা রক্তে ভেসে যাচ্ছে। এবার আমিও হাউ মাউ করে কেঁদে ঝাপিয়ে পড়লাম মায়ের কোলে। মা আমাকে বুকে আগলে ধরলেন। কোনোক্রমে মায়ের হাত থেকে ছাড়িয়ে আমার ছোট ছোট হাত দিয়ে মার ক্ষতস্থান চিপে ধরলাম। মা আমার হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করতে করতে প্রলাপের মতো বকতে লাগলেন,
-ও কিছু হবে না বাবা। দুই এক ফোঁটা রক্ত বার হলেও আমরা মরবো না। উপরওয়ালা আমাদের নেবেন না, এভাবে পুড়িয়ে পুড়িয়ে মারবেন।
আমি আমার সাধ্যমত মায়ের ক্ষতস্থান শক্ত করে টিপে ধরলাম। মুখের অঙ্গভঙ্গিতে বুঝতে পারলাম মায়ের যন্ত্রণাটা ক্রমশ বেড়ে গেছে। আমি কেঁদে যাচ্ছি ভয়ে আর মা কাঁদছেন যন্ত্রণায়। আর তার মধ্যে পিসি চিৎকার করে বড় বড় চোখ করে বলতে লাগলেন,
-সেবার বুড়োটার চাপের কাছে হার মেনে ছিলাম। এবার আর বুড়োটা নেই। তবে মাঝে কোন কাঁটা রাখতে চাই না। ভিখারির বাচ্চা! রূপ দিয়ে কি মনে করেছিস তুই ওকে ভুলিয়ে রাখবি?
যাওয়ার আগে পিসি আবার শাসিয়ে গেলেন দ্রুত বাড়ি ছেড়ে দেওয়ার।
লিনাপিসির শাসানির পর সত্যিই খুব আতঙ্কে ছিলাম এবার বুঝি আমাদের বাড়িটা ছেড়েই দিতে হবে ভেবে। কিন্তু খুব অবাক হলাম বাবার আচরণ সম্পূর্ণ বদলে যাওয়া দেখে। বাবা আর আমাকে আগের মত মারধোর করেন না। যদিও একেকটা দিন খুব ভয়ে ভয়ে থাকতাম এইবুঝি বাবার ডাক আসবে, আর পিঠে উত্তম-মধ্যম পড়বে। আমার মতো মাও বাবার অত্যাচার থেকে রেহাই পেয়েছিলেন। বাবা সন্ধ্যার পরে আগের মতই ড্রিঙ্ক করে ফিরলেও মায়ের চিৎকারে শুনতাম না। মায়ের চোখেমুখে এ সময় অদ্ভুত একটা প্রশান্তি খুঁজে পেয়েছিলাম। একদিন আমি হ্যাংলার মতো তাকিয়ে থাকায় অমন করে তাকিয়ে কি দেখছি মা প্রশ্ন করাতে,কিছু না! বলে লজ্জা পেয়ে পাশের ঘরে বিছানায় মুখ লুকিয়েছিলাম।
বাবার এই পরিবর্তনে এতই খুশি হয়েছিলাম যে একটু একটু করে সাহস সঞ্চয় করেছিলাম লিনাপিসির ঘটনাটা বাবাকে একদিন বলবো বলে। যদিও শেষ পর্যন্ত আর লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারিনি। ঘটনাটা মনে অবরুদ্ধ রাখতে বাধ্য হয়েছিলাম। আমি তখন সবে ক্লাস ফাইভে উঠেছি। এই প্রথম পড়াশোনা, স্কুলে যাওয়ার মধ্যে আমি একটি আনন্দ খুঁজে পেয়েছিলাম। মাকে দেখতাম কখনো কখনো আমার আগে বেরিয়ে যেতেন। বাড়িতে কাজের মাসিই আমাকে খাবার দিত। স্কুল ছিল বাড়ির পাশেই। কাজেই স্কুলে যাওয়া-আসার জন্য মায়ের সহচর্যের দরকার হতো না। কিন্তু প্রায়ই সাজগোজ করে মায়ের বার হওয়া দেখে শুধু অতনু আঙ্কেলের কথা মনে পড়তো। মা যেন উনার সঙ্গে দেখা করবেন বলে সাত সকালে বেরিয়ে যান। একদিকে মনে মনে মা ও অতনুআঙ্কেলের উপর একটা ঘৃণা বোধ তৈরি হলেও আঙ্কেলকে দেখার জন্য সেই সময়ে যে একটা কৌতুহল তৈরি হয়েছিল সে কথা অস্বীকার করবো না।
হাই স্কুলে নিচু ক্লাসে পড়াই আমার ছুটি একটু আগেই হত। কোন কোন দিন বাড়ি ফিরে দেখতাম মা আগেই বাড়ি চলে এসেছেন। আবার কখনোবা আমার ফেরার কিছুক্ষণের মধ্যেই মা ফিরে আসতেন। মা প্রত্যহ কোথায় যান? ছোট মানুষ অত জানার দরকার কি- আগেও এমন প্রশ্নে মায়ের বেশ কালো মুখ দেখেছি। কাজেই মুখ বুজে কেবল মায়ের আসা যাওয়া লক্ষ্য করতাম। একদিন স্কুল থেকে ফিরে দেখি মা বাড়িতে নেই। জানতাম অন্যান্য দিনের মতোই একটু পরেই এসে পড়বেন। ক্রমশ সন্ধ্যা গড়িয়ে গেল তবুও মা ফিরলেন না। মাকে ফিরতে না দেখে ভিতরে ভিতরে বেশ অস্থির হয়ে পড়েছিলাম। সন্ধ্যার বেশ পরে বাবা বাড়ি ফিরলেন। আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন মা ফিরেছেন কিনা। আমি না বলতেই বাবা আবার বেরিয়ে গেলেন। সেদিন রাতে মা আর ফেরেন নি। পরদিন সকালে বাড়িতে একগাদা পুলিশ এলেন। পুলিশ কাকুরা আমাকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন মা কোথায় গেছেন বা আমাকে কিছু বলে গেছেন কিনা। লিনাপিসিকে দেখছিলাম পুলিশের কানে কানে ফিসফিস করে কি সব বলতে। পুলিশকাকুরা লিনাপিসির সঙ্গে খুব হেসে হেসে কথা বলছিলেন। ওনারা চলে যেতেই পিসি এগিয়ে এসে আমাকে বললেন,
-শান্তনু আমি তোমার জন্য দুঃখিত বাবা। তোমার সঙ্গে একটা কথা বলতে আমার ঘেন্না লাগছে, কিন্তু না বলেও যে উপায় নেই। তোমার মা সেই লোফারটার সঙ্গে ঘর বাঁধবে বলে পালিয়েছে। কারণ লোফারটাকেও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। তোমার বাবা সাধ্যমত চেষ্টা করেছেন মায়ের সন্ধানে। যাওয়ার সময় তোমার মা বিয়েতে বাবার দেওয়া গয়না গাটি সব নিয়ে গেছেন। তবে যেভাবে পুলিশ খুঁজছে তাতে বেশি দিন লুকিয়ে থাকতে পারবে না। ধরা একদিন পড়বেই।
মায়ের নিরুদ্দেশের পর বাড়িতে এত পুলিশের আগমন হলেও বাবাকে একবারও সামনে আসতে দেখি নি। লিনাপিসিই সব সময় পুলিশকে সামলাতেন। বাবাকে থানায় দেখা করার কথা বলে পুলিশকে চলে যেতে দেখতাম। পিসি হাত নেড়ে তাদেরকে আশ্বস্ত করতেন যে সন্ধ্যেবেলা বাবা ফিরলে থানায় পাঠিয়ে দেবেন। ঘটনার ঠিক দুদিন পরে সন্ধ্যেবেলা বাবা বাড়ি ফিরে আবার সেই আগের মূর্তি ধারণ করলেন।
-জারোজ সন্তান! দুশ্চরিত্রা, কুলাঙ্গার মহিলা আমার জীবনটাকে শেষ করে দিয়েছে। নিজে থেকে ভেগেছে যখন সেই পাপের কোন চিহ্নই আমি রাখবো না বলে, আমাকে সমানে ঘুষি ও চড় মারতে লাগলেন। বাবার আচমকা আক্রমণে আমি ঠিক বুঝে উঠতে পারিনি আমার অপরাধ কি বা আমার করনীয় কি? খাটের উপর দাঁড়িয়ে এবার সজোরে লাথি মারতে লাগলেন আমাকে। আমি প্রচন্ড দম ধরে মার খেতে লাগলাম। মাথার মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে, মা যখন আমাকে ফেলে পালিয়েছেন তখন আমি আর বাঁচতে চাই না। এভাবে মার খেয়েই আমি মরতে চাই। আসলে আমি মরেই যেন বাঁচতে চাইছিলাম। বাবার লাথির ঘায়ে আমি খাটের এ মাথা থেকে ও মাথা গড়াতে থাকলাম। আমার তখন মার খাওয়ার অসম্ভব একটি শক্তি চলে এসেছিল। একসময় বাবা যেন হার মানলেন। বসে পড়ে কুকুরের মত হাঁপাতে হাঁপাতে আমার মাথা ধরে ঠুকে দিলেন ঘাটের গায়ে। না বাবারা কখনো হারতে পারেন না। মাথা ঠুকে দিতেই অসম্ভব যন্ত্রনা শুরু হল। মনে হল আমার প্রাণটা যেন বেরিয়ে গেল। আমিই আর নিজেকে ধরে রাখতে পারলাম না । গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে কাঁদতে লাগলাম। আমার হাত মুখ তখন রক্তে রক্তাক্ত। কাঁদতে কাঁদতে বাবার কাছে প্রাণভিক্ষা চাইছিলাম, তুমি যা চাইবে আমি সেটাই করব। প্লিজ অন্তত আমাকে জাহানে মেরো না। লিনাপিসি আগেই আমাদের বাড়ি ছেড়ে চলে যাওয়ার কথা বলেছিলেন। আমি আজি বাড়ি ছেড়ে চলে যাচ্ছি। আমার চিৎকারে আশপাশের পড়শীরা ছুটে এসে দরজায় ধাক্কা দিতেই বাবা দরজা খুলে অন্যত্র চলে গেলেন।
পড়শী আঙ্কেল, আন্টিরা আমাকে উদ্ধার করে মহকুমা হাসপাতালে ভর্তি করেন। পরে শুনেছিলাম সে সময় বাহাত্তর ঘন্টা আমি অত্যন্ত সংকটাপন্ন ছিলাম। ঘাড় ও মাথায় মারাত্মকভাবে লেগেছিল। কানের পর্দা ছিড়ে গেছিল। পরে একটা অপারেশন করতে হয়েছিল। ডান হাতের কব্জিতেও চোট লেগেছিল। কয়েকদিন পর হসপিটালে পুলিশ কাকুরা আমার জবানবন্দি নিতে আসেন। সে সময় শরীরের একাধিক স্থানে ক্ষত ও ব্যান্ডেজ বাঁধা থাকায় আমার কথা বলার মত শক্তি ছিলনা। ওনারা সেদিন চলে যান। কয়েকদিন পর আবার আসেন। ওনাদের সব প্রশ্নের উত্তর আজ আমার মনে নেই। তবে সুস্থ হলে যে আর কখনো বাবার কাছে ফিরবো না সে কথা পুলিশ কাকুদের বলেছিলাম। উল্লেখ্য এ সময় বাবা একদিনও হসপিটালে আসেন নি বা আমি নিজেও চাইনি বাবা আমাকে দেখতে আসুক। পুলিশ কাকুরা আমাকে জানিয়েছিলেন সুস্থ হলে আমাকে ওনারা কোন সরকারি হোমে পাঠাবেন। আমি তাদের কথায় সম্মতি দিয়েছিলাম। এর মধ্যে একদিন নলিনীমাসিকে দেখে অবাক হয়েছিলাম। আমার মায়ের ছোট বোন নলিনীমাসি ছোটবেলায় বেশ কয়েকবার আমাদের বাড়িতে এলেও বাবার আপত্তিতে পরে আসা বন্ধ হয়েছিল। সুস্থ হলে মাসি আমাকে ওনার বাড়ি নিয়ে যাবেন বলাতে খুব আনন্দ হয়েছিলো। আমার বয়সী মাসির দুটি ছেলে ছিল। খুব ছোটবেলায় ওদেরকে দেখেছি। হঠাৎ মাসির প্রস্তাবে ওদের সঙ্গে খেলতে পারার আনন্দে মনের মধ্যে বেশ উৎফুল্ল হয়ে উঠলাম।
হসপিটালে টানা দেড় মাস থাকার পর আমি কিছুটা সুস্থ হই। রিলিজ পাওয়ার পরও অনেকদিন আমাকে ওষুধ খেয়ে যেতে হয়েছিল। নলিনীমাসি এসময় আমাকে নিজের ছেলের মতোই দেখাশোনা করতেন। যদিও নলিনীমাসির বাড়িতে সুখ আমার বেশি দিন স্থায়ী হয়নি। আমার মত আপদকে বাড়িতে তোলার জন্য মেসো প্রকাশ্যে মাসিকে গালমন্দ করতেন। মাসির দুই ছেলেকে আমার সঙ্গে কথা বলতেও বারণ করে দিয়েছিলেন। বুঝতে পেরেছিলাম যে আমার আগমনে মাসির সংসারে অশান্তি শুরু হয়েছে। মাসি খুব চেষ্টা করছিলেন একে তাকে ধরে আমাকে কোন একটা আশ্রমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি করে দেওয়ার। অবশেষে কোথা থেকে একটি সন্ধান নিয়ে একদিন ভোরবেলা আমাকে নিয়ে বার হলেন। দুপুরে আমরা পৌঁছালাম বর্ধমানের একটি আবাসিক বিদ্যালয়ে।
এই বিদ্যালয়ে আমি প্রথম শান্তি খুঁজে পেয়েছিলাম। আশ্রম থেকে আমরা জামাকাপড় পেতাম।তাছাড়া মাসিও পুজোর সময় আমাকে জামা কাপড় দিতেন। দু-তিন মাস বাদে বাদে মাসি আমার সঙ্গে দেখা করতে আসতেন। এখানে থাকাকালীন দুটি পুজো পেয়েছিলাম। মাসি খুব করে চেয়েছিলেন আমাকে বাড়ি নিয়ে যেতে। কিন্তু আমি আশ্রম ছেড়ে কোথাও যেতে চাইনি। এমনো হয়েছে পুজোর কটা দিন গোটা আশ্রম এক্কেবারে জনশূন্য। একদিকে মহারাজ ও সামান্য কিছু স্টাফ, অপরদিকে ছাত্র বলতে আমি একা। এত বড় বিল্ডিংয়ে আমার একাকী থাকাতে ভূতের ভয়ের প্রসঙ্গে আমি নির্লিপ্ত থাকতাম।মানুষের অত্যাচার ও আতঙ্ক আমাকে এতটাই পেয়ে বসেছিল যে কোনো ভূত-প্রেতের আতঙ্ক আমার কাছে ভাবনার বিষয় ছিল না।
নতুন জায়গায়, নতুন স্কুলে আমি বেশ মানিয়ে নিয়েছিলাম। মহারাজ আমাকে খুব ভালোবাসতেন। কিন্তু সেখানেও সুখ আমার জীবনে বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। দু বছরের মতো আমি এই বিদ্যালয়ে ছিলাম। কোন এক বিকেলে এক গাড়ি পুলিশের সঙ্গে মাসিকে আসতে দেখে আবার ঘাবড়ে গেলাম। মাসি দুটি মার্কশিট এগিয়ে ধরতেই দেখি মায়ের নাম লেখা বি এ পার্ট ওয়ান ও পার্ট টুয়ের মার্কশিট। উপরে জ্বলজ্বল করছে ইউনিভার্সিটি অফ বার্ডওয়ান। মা নাকি গোপনে এম এ পার্ট ওয়ানের প্রস্তুতিও নিচ্ছিলেন। বাবার অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে নিজের পায়ে দাঁড়াতেই গোপনে পড়াশোনা চালিয়ে যাচ্ছিলেন। আর লিনাপিসি সেটাকে নোংরা ভাবে পরিবেশন করে মায়ের চরিত্র নিয়ে বাবার কান বিষিয়ে তুলেছিলেন। বাবা তাই প্রত্যেক দিন মদের আসরে ব্যবসায়ীক পার্টনার অতনুআঙ্কেলকে নিজের বৌকে দিয়ে দেওয়ার স্বপ্ন দেখাতেন। আর আঙ্কেলও নাকি বুঁদ হয়েছিলেন কোন না কোন দিন মাকে পাওয়ার অলীক স্বপ্নে।
নলিনীমাসির সঙ্গে পুলিশ আমাকে আসানসোলে নিয়ে যায়। কয়েকদিন আগে একটি পরিত্যক্ত খনির ভিতর থেকে দুটি কঙ্কাল উদ্ধার হয়। ডিএনএ টেস্টে প্রমাণ হয় যাদের মধ্যে একটি কঙ্কাল মায়ের। বাবা ভাড়াটিয়া গুন্ডা লাগিয়ে মাকে খুন করিয়ে খনিগর্ভে ফেলে দিয়ে লিনাপিসির আগমনকে সুনিশ্চিত করেছেন। অতনুআঙ্কেলকেও বাবা বঞ্চিত করেন নি। প্রচুর মদ খাইয়ে বেহুঁশ করে সেদিন তাকেও খুন করিয়ে মায়ের মরদেহের সঙ্গে খনির মধ্যে ঢুকিয়ে দিয়েছিলেন। নিজের বউয়ের সঙ্গে অতনুআঙ্কেল পালিয়েছে প্রচার করে এলাকায় বাড়তি সহানুভূতি আদায় করে গোটা ব্যবসাটা হাতিয়ে নিয়েছিলেন।
পুলিশের জেরায় বাবা স্বীকার করেন মায়ের নিরুদ্দেশের খবরটি ঘুরিয়ে দিতেই আমাকে অর্ধমৃত করার চেষ্টা করেন। উদ্দেশ্য ছিল কেসের মোটিভটাকে ঘুরিয়ে দেওয়া। প্রাথমিকভাবে বাবা সফলও হয়েছিলেন। আমাকে অর্ধমৃত করায় বাবার বিরুদ্ধে একটি পুলিশবাদী কেস হয়। কিন্তু আমি কোনো অবস্থায়ই বাবার শাস্তি না চাওয়াতে সাময়িক পুলিশি ঝামেলা কাটিয়ে বাবা ও লিনাপিসি আবার বিবাহ করেন। বাবা একজন সফল আইনজীবী। জীবনের অংক মেলাতে গুটিগুলো খুব ভালো করেই সাজিয়ে ছিলেন। কিন্তু লিনাপিসির সঙ্গে বাবার সম্পর্কটি না টেকাতেই বিপত্তি দেখা দিল । বছর দুয়েকের মধ্যে সম্পর্ক ভাঙতেই লিনাপিসি পুলিশের কাছে আত্মসমর্পণ করে রাজসাক্ষী হন। কিছুদিন পর লিনাপিসি ছাড়াও পান আর আমার বাবা এখনো জেলেই আছেন।
এদিকে আমার আবাসিক স্কুলে বারে বারে পুলিশ আসাতে স্কুলের ছোট বড় প্রায় সবাই জানতে পারে আমার আসল পরিচয়। ভুলটা আমারই হয়েছিল।একদিন ক্লাসে অকপটে আমার বাবা-মায়ের সম্পর্কের কথা বলে ফেলি। কিন্তু সমস্যা হল এর পরে। সহপাঠীরা আমাকে সময়ে অসময়ে খুনির ছেলে বলে খেপাতে লাগলো। প্রথমে ক্লাস টিচারকে বিষয়টি জানিয়ে ছিলাম। কিন্তু কোনো সুরাহা হলো না। সবার কাছ থেকে মুক্তি পেতে বাধ্য হয়ে আমি নিজেকে গৃহবন্দী করে রাখতাম। আমার মানসিক অবস্থা নিয়ে কর্তৃপক্ষ খুব চিন্তিত ছিলেন। ওনারা দ্রুত মাসিকে খবর দিলেন। সেইমতো মাসি আমাকে ছাড়িয়ে নিয়ে বর্তমান স্কুলের ঠিকানায় নিয়ে আসেন। মাসির পরামর্শে আর কখনো অন্যের কাছে মুখ না খোলার সিদ্ধান্ত নিই। আমি জানি আজ আপনি আমাকে যেভাবে মুখ খোলালেন তাতে শীঘ্রই আমাকে এই বিদ্যালয় থেকেও চলে যেতে হবে।
-না না শান্তনু, একদম না। তুমি নিশ্চিত হও তোমার ঘটনা আর কেউ জানতে পারবে না।
এতক্ষণে শান্তনুর গল্প শুনতে শুনতে বিষন্নতায় কাঠ হয়ে গেছিলাম। পাশে দেখলাম রোহিত দাঁড়িয়ে, চোখ দিয়ে টপটপ করে জল পড়ছে। আমারো ঠোট কেঁপে উঠলো। পকেট থেকে রুমাল বার করে কোনোমতে নিজেকে সংযত করলাম। ফেরার পথে আর একটি কথাও বলতে পারলাম না। অটোর ঝাঁকুনিতে বেশ কয়েকবার শান্তনু আমার গায়ের উপর ঝুঁকে পড়েছিল। মনে মনে স্যালুট জানাচ্ছিলাম, সাবাস! বেটা সাবাস! ছোট্ট জীবনে পাহাড়প্রমাণ বাঁধা তুমি অতিক্রম করেছে। আগামী দিনে এমন ছোট্ট ছোট্ট বাঁধা গুলি পাশ কাটিয়ে যাক। তুমি এগিয়ে চলো সাফল্যের চূড়ায়।
বিশেষ দ্রষ্টব্য:-
আনুষ্ঠানিকভাবে মরীচিকা শেষ হলো। তবে পাঠকের চাহিদা অনুযায়ী বিষয়টি পুনর্বিবেচনা করা যেতে পারে।
মরীচিকা (পর্ব-২৩)
সর্বশেষ এডিট : ০২ রা জুন, ২০২০ দুপুর ২:৫৯