মরীচিকা (শেষ-পর্ব)
সেদিন সন্ধ্যার বেশকিছু পরে বিদ্যালয়ের অফিসে গিয়ে দেখি সভাপতি মহাশয় চেয়ারে বসে কাজ করছেন। আমি আস্তে করে দরজাটা ঠেলে মুখ বাড়িয়ে মৃদু স্বরে জিজ্ঞাসা করি,
-স্যার আপনি কি আমাকে দেখা করতে বলেছেন?
-আরে! আরে! এসো এসো, বলে নিজেই চেয়ার ছেড়ে আমাকে জড়িয়ে ধরে বলতে লাগলেন,
-আজ আমার বড় আনন্দের দিন।চৌধুরীবাবু আমি আর আপনাকে আটকাতে পারব না। মহামান্য সরকার বাহাদুরের নেকনজর যার উপর পড়েছে তাকে আমি আটকে রাখি কোন যুক্তিতে, বলে উনি আবার একবার বুকে টেনে নিলেন। অস্বীকার করব না যে ওনার তলবে অজানা আশঙ্কার এক ঘন মেঘ যা বুকের মধ্যে দুরুদুরু করছিল মুহূর্তে তা উধাও হয়ে গেল। নিশ্চিত হলাম ভালো কিছু তবে একটা ঘটেছে। আপ্রাণ চেষ্টা করলাম যতটা সম্ভব নিজের উচ্ছ্বাস চেপে রাখার। কিন্তু ভিতরে ভিতরে অস্থির হয়ে উঠলাম ওনার মুখ থেকে সুখবরটি কি তা শোনার জন্য। সভাপতি মহাশয় ঘাড় ঘুরিয়ে টেবিলের উপরে হাজারো কাগজের মধ্যে একটিকে টেনে নিয়ে আমার দিকে এগিয়ে ধরলেন। আমি উৎসুক দৃষ্টিতে একবার তাকিয়েই লক্ষ্য করলাম এটি একটি সরকারি বিদ্যালয়ের নিয়োগ পত্র। নিজের চোখকে যেন বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। আমি ঠিক দেখছি তো? যদিও ঘোর কাটতে বেশিক্ষণ লাগলো না। স্বপ্নের লক্ষ্য পূরণে আমি আনন্দে বিহ্বল হয়ে পড়লাম। আনন্দাশ্রু চোখের বাঁধ মানলো না। চোখের সঙ্গে সমানে পাল্লা দিয়ে ঠোঁট দুটিও অনবরত কম্পিত হতে লাগলো। আনন্দের ঢেউ সুনামির ন্যায় আমার বুকের ভেতর তোলপাড় করতে থাকে। আমি শিশুর মতোই বিহ্বল দৃষ্টিতে ওনার সামনে হাঁটু গেড়ে বসে পড়লাম। সভাপতি মহাশয় নিচু হয়ে আমাকে তুলে আবার বুকে জড়িয়ে নিলেন।
সদ্য পাওয়া নিয়োগপত্রটি হাতে নিয়ে হোস্টেলের ফোন থেকে গ্রাম সম্পর্কের এক দাদাকে খবরটা জানিয়ে দেই।উনি খুব খুশি হলেন এবং তৎক্ষণাৎ বাবা-মাকে খবরটি পৌঁছে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিলেন। বিনিময়ে উনি পেটভরে মিষ্টি খাওয়ার আবদার করলেন। আমি সহাস্যে ওনার দাবিকে মান্যতা দিই।বাড়িতে যথা সম্ভব দ্রুত খবরটি পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা করতে পেরে আমিও অনেকটা নিশ্চিন্তবোধ করি। সেদিনই ব্যাগপত্র গুছিয়ে নিয়ে পরদিন সকালে সকলকে বিদায় জানিয়ে স্বগৃহে প্রত্যাবর্তনের উদ্দেশ্যে যাত্রা করি।
বাসস্ট্যান্ডে পৌঁছে নির্দিষ্ট রুটের বাসে উঠে পড়ি। সুবিধামতো জানালার ধারে একটি সিটও পেয়ে আরামসে বসে পড়ি।এক বিমোহিত শান্তি আজ আমাকে শিশুসুলভ ফুরফুরে মেজাজে ভরিয়ে তুলেছে। আপন মনে হোস্টেলের বিগত দিনগুলির কথা ভাবতে থাকি। কিন্তু হঠাৎ শেলীর কথা মনে হতেই আনন্দের জোয়ারে যেন ভাটা পড়ল। সুখবরটি তাকে না জানাতে পারার যাতনায় মনে মনে হুল বিঁধতে থাকে। দেখতে দেখতে বেশ কয়েক মাস অতিক্রান্ত হল রহস্যময় ভাবে সে হোস্টেল ছেড়ে চলে গেছে। তারপর আজ এতদিন হল তার কোন খবরাখবর নেই। পুরানো স্মৃতিগুলো যেন চোখের সামনে ছবির মতো দৃশ্যমান হতে লাগলো। ইতিমধ্যে বাসটি যাত্রা শুরু করেছে। দু-পাশে সবুজের বুক চিরে তিরতির করে ক্রমশ এগিয়ে চলেছে। প্রকৃতির অপরূপ রূপের সঙ্গে অন্তরের আনন্দধারার সঙ্গমে মন দোলায়িত হয়ে উঠলো। চলন্ত বাসের কোলাহল আজ আর আমার কর্ণকুহরে পৌঁছালো না। গোটা বাসে যেন আজ আমি একাই যাত্রী। যুদ্ধক্ষেত্রের বীর সেনানী যেমন বিজয় বার্তা বহন করে চলে যথা দ্রুত সম্ভব নির্দিষ্ট স্থানে পৌঁছে দেওয়ার।কিন্তু প্রেমিকার নিরুদ্দেশের খবর হঠাৎ করে তার উদ্যোমকে করে নিরুৎসাহিত; পদযুগলকে করে স্তব্ধ, তদ্রুপ শেলীর চিন্তা আমার দেহমনকে নিষ্ক্রিয় করে আনন্দের জগৎকে যেন পানসে করে দেয়। আমি হতোদ্যম হয়ে পড়লাম। আচমকা আমার কল্পনার জগতে ছেদ পড়লো।
-দাদা ভাড়া দিন।
একটি পঞ্চাশ টাকার নোট টিকিট পরীক্ষকের হাতে ধরিয়ে দিতেই ও আবার জানতে চাইল,
-দাদা কোথায় নামবেন?
-বলছি একটু পরে।
-তাহলে টাকাটা রাখুন। আগে ঠিক করে নিন কোথায় নামবেন।
আমি হাত বাড়িয়ে টাকাটা নিলাম ঠিকই কিন্তু স্থির করতে পারলাম না যে এমনো দিনে আমার বাড়িতে যাওয়ার আগে একবার শেলীর খোঁজ নেওয়া উচিত কিনা। শেলীদের বাড়িতে যাওয়ার সরাসরি বাস রুট থাকলেও সে সম্পর্কে সম্যক ধারণা না থাকায় ট্রেনে যাওয়ায় নিরাপদ ও সময় সাশ্রয় হওয়াতে আমি রেল স্টেশনে নেমে পড়ি। লোকাল ট্রেনে ফুলেশ্বর স্টেশনে নেমে ওভারব্রিজের দিকে এগোতে লাগলাম।এতদিন পরে অজানা স্থানে এভাবে যাওয়াটা ঠিক হচ্ছে কিনা তা ভেবে মনের মধ্যে একটা আশঙ্কা খচখচ করতে লাগলো। একই সঙ্গে এত বড় শহরে উপযুক্ত নাম পরিচয়হীন কোন একজনের বাড়ি খুঁজে পাওয়াটা কতটা সম্ভব সে ভাবনাও মাথায় চেপে বসলো। সেবার ওর বাবার অসুস্থতার সময় গিয়েছিলাম ঠিকই কিন্তু কোন রাস্তা দিয়ে গিয়েছিলাম ঠিক লক্ষ্য করেনি। এতগুলো ভাবনা মাথায় রেখে ওভারব্রিজ থেকে নেমে ক্রমশ স্টেশনের বাইরে চলে আসি। নাগালের মধ্যেই অটো স্ট্যান্ডের সন্ধান পেলাম।সবার সামনে বলাটা হাস্যকর হবে বিবেচনা করে অপেক্ষাকৃত কমবয়সী একজন অটোচালককে একটু নির্জন স্থানে ডেকে তার চাহিদামত ভাড়ায় রাজি করালাম। শহরের বড় বড় রাস্তার উপরে যতগুলি মিষ্টির দোকান থাকবে সেই সব স্থানে আমাকে নিয়ে যাবে, কিন্তু তিন ঘন্টার অধিক নয়। সে ক্ষেত্রে ও পরবর্তী ঘন্টার জন্য আলাদা ভাড়ার দাবি করল। আমি ওর সব শর্ত মেনে নিলাম। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে সময়টি নোট নিলাম। শুরু হলো অজানা স্থানে অন্বেষণ। ড্রাইভার আমাকে হিন্দিতে বেশ কিছু প্রশ্ন করেছিল। কিন্তু শুরুতেই হিন্দি তেমন বুঝি না বলতেই বাংলাতেই কথা বলা শুরু করলো। কথা বলতে বলতে হঠাৎ ওর একটি ফোন আসে।কোথায় ভাড়া নিয়ে যাচ্ছে সে প্রসঙ্গে পরিষ্কার হিন্দিতে অপরপ্রান্তের ব্যক্তিকে যেটা উত্তর দিল সেটা এরকম,
-এক উজবুকের পাল্লায় পড়েছি। হ্যাঁ, মহিলা ঘটিত ব্যাপার তো অবশ্যই হবে। আমার আর কি! বেশ ভালো একটা খসিয়েছি। তাও আবার তিন ঘন্টার জন্য। বলেছি এই সময়ের মধ্যে খুঁজে না পেলে পরবর্তী ঘন্টার জন্য আলাদা ভাড়া লাগবে। ব্যাটা সব শর্ত-ই নির্দ্বিধায় মেনে নিয়েছে।
ড্রাইভার দিকে কান রেখে আমি হাসি হাসি মুখে বাইরে তাকিয়ে আছি। অটো ক্রমশ এগিয়ে চলেছে। জায়গায় জায়গায় সামান্য জ্যাম আছে। এর মধ্যে ওর নির্দেশিত গোটা চারেক মিষ্টির দোকান ফেলে এসেছি। আমি চাইছিলাম মেইনরোড ধরে আরও কিছুটা অগ্রসর হতে। সে কথা জানাতেই ড্রাইভার রাজি হলো না। উল্টে,
-দাদা আমাকে আমার মত চালাতে দিন।আমি ঠিক আপনার নির্দিষ্ট দোকান খুঁজে বার করবোই। আর যেটা করতে গেলে যে কোন একটা সাইড ধরে খোঁজাটা জরুরি।
বন্ধুর সঙ্গে ড্রাইভারের কথোপকথন না শুনলে হয়তো আমি ওর যুক্তিতে আস্বস্ত হতাম। কিন্তু এক্ষেত্রে ওর মতটি বিনা বাঁধায় মেনে না নিয়ে চোখে মুখে সামান্য বিরক্তি প্রকাশ করলাম। বুঝতে বাকি থাকল না যে টেলিফোনের কথোপকথন অনুযায়ী কাজ করা শুরু করেছে। কিন্তু এক প্রকার নিরুপায় হয়ে ওর অটোর সওয়ারি হলাম। এবার আমরা শহরের বড় রাস্তা ছেড়ে একটি সরু রাস্তায় ঢুকলাম। এলাকাটা অনেকটা নির্জন, বাড়ি গুলো দেখে মনে হচ্ছে আর্থিকভাবে পিছিয়ে পড়া মানুষের বাস। আমি আবার আপত্তি জানিয়ে বললাম,
-এই রাস্তাতে আসার কোন প্রয়োজন ছিলনা।
-দাদা আপনি কত মিষ্টির দোকান চান, সবগুলো ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখাবো।
আমি আবার সুবোধ বালকের মতো ওর আপ্তবাক্যে ভুলে গেলাম। ইতিমধ্যে একটি জ্যামে এসে গাড়ি দাঁড়িয়ে গেল। চালক হাতে কিছু খৈনি ঘষে মুখে পুরে দিল। কাজেই এবার ওর সব কথা বুঝতে অসুবিধা হওয়ায় আর না ঘাটিয়ে চুপচাপ বসে থাকলাম। উল্লেখ্য সেদিনের এই যাত্রাকালে শহরের কিছু পরিচ্ছন্ন মিষ্টির দোকানের পাশাপাশি পাড়ার কিছু পুরানো অপেক্ষাকৃত নোংরা মিষ্টির দোকানও চোখে পড়লো।মনে প্রশ্ন জাগছিল আজকের দিনে এরকম দোকানের খরিদ্দার কারা বা দোকানগুলি চলেই বা কি করে? এমনই একটি দোকানের একটু দূরে প্রকৃতির নিয়মে জল বিয়োগ করতে করতে লক্ষ্য করছিলাম কোন খরিদ্দার আসে কিনা। নাহ, আমার প্রতীক্ষমান কালে কোন খরিদ্দারের দেখা পেলাম না।অনেকক্ষণ অটোর ভিতরে একভাবে বসে থেকে এবার বাইরে একটু হাত-পা ছড়ানোর সুযোগ হওয়াতে আরো কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলাম। ইচ্ছা হল দোকানীর সঙ্গে একটু কথা বলতে। এগিয়ে গিয়ে উঁকি মারতেই মাঝবয়সী ভদ্রলোক বেরিয়ে এলেন। কিছু নেব কিনা জিজ্ঞাসা করতেই,
-আসলে আমি একটি মিষ্টির দোকান খুঁজছিলাম।
-বেশতো! আপনি কি মিষ্টি নেবেন? আমার দোকানের রসগোল্লা আর ছানাবড়া গোটা ফুলেশ্বরের কোথাও মিলবে না। আমাদের তিন পুরুষের ব্যবসা।
আমি পড়েছি তখন বেশ বিপদে। কি করে বলি ওনাকে আমার মনের কথা। সেধে পড়ে অপদস্ত হওয়া আর কি। নতুন করে আর কোন প্রশ্ন না করে বরং অটোচালককে ডাক দিলাম। ও চলে আসতেই দুটি রসগোল্লা ও দুটি ছানাবড়ার অর্ডার করলাম।চালক অপ্রত্যাশিত মিষ্টি খাওয়ার সুযোগ পেয়ে ভীষণ খুশি হলো।দোকানী আমার উদ্দেশ্যে আরো একটি প্লেটে সমসংখ্যক মিষ্টি দিলে, সুগারের কারণ দেখিয়ে বিনয়ের সঙ্গে আমি প্রত্যাখ্যান করি। পরে দোকানের বিল মিটিয়ে অটোতে বসতে অটো আবার চলতে থাকে।
ইতিমধ্যে দেড় ঘণ্টার বেশি সময় অতিক্রান্ত হয়ে গেছে। নয় নয় করে গোটা পনেরো মিষ্টির দোকানের দর্শন সম্পন্ন হলেও শেলীদের বাড়ির কোন হদিস না পাওয়ায় অস্পষ্ট স্বরে নিজে নিজেরই হতাশার কথা ব্যক্ত করতে, চালক নিরাশ না হওয়ার পরামর্শ দিল। খুব আন্তরিকতার সঙ্গে জানালো,
-দাদা একটু ধৈর্য ধরুন আমি ঠিক খুঁজে বার করবোই।
বিনিময়ে আমি একটা শুকনো হাসি উপহার দিলাম। অটো ক্রমশ এগিয়ে চলল...
মরীচিকা (পর্ব-৩১)
সর্বশেষ এডিট : ১৮ ই সেপ্টেম্বর, ২০২০ দুপুর ১:১৯