somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

মরীচিকা (শেষ-পর্ব)

২৩ শে নভেম্বর, ২০১৯ রাত ১২:৩০
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :




কথা বলতে বলতে সরুরাস্তা ফেলে অপেক্ষাকৃত বড়রাস্তা ধরতেই স্থানটি একটু চেনা চেনা বলে মনে হল। চলন্ত অটোর ভেতর থেকে একটু মুখ বাড়িয়ে উঁকি মারলাম। শহরের একটু নির্জন বড়রাস্তাগুলি ও আশপাশের বসতিগুলোকে দেখে আমি বেশ তালগোল পাকিয়ে ফেলি। কেন জানি প্রায়ই ক্ষেত্রে রাস্তাগুলিকে আমার একই রকম লাগে। যাইহোক কিছুটা মিল অনুভব করে খুব জোরে না বললেও একটু মৃদুস্বরে চালককে বললাম,
- ভাইয়া গাড়িটা একটু আস্তে চালাও দেখি।
-কেন দাদা আপনি কি স্থানটি চিনতে পেরেছেন?
-অনেকদিন আগে এসেছিলাম,অতটা মনে নেই। তবে এলাকাটা একটু চেনা চেনা লাগছে বৈকি।
ও আমার কথা মত সঙ্গে সঙ্গে গাড়িটির বেগ অনেকটা কমিয়ে দিল। নাহ! আমার রাস্তা চিনতে ভুল হয়নি। আমি অস্ফুটে বলে ফেললাম,
-এইতো আমরা ঠিক জায়গায় চলে এসেছি।
-দাদা এখানে তো কোন মিষ্টির দোকান দেখছিনা।
-আর মিষ্টির দোকানের প্রয়োজন নেই ভাইয়া। ওটাকে আমি ল্যান্ডমার্ক হিসেবে খুঁজছিলাম। আমরা পিছন দিক থেকে আমাদের লক্ষ্যস্থলে পৌঁছে গেছি।এই রাস্তা ধরে একটু এগিয়ে গিয়েই দেখবে ডান হাতে বড় একটা মিষ্টির দোকান আছে। যাইহোক অটো থেকে নেমে একটু আড়মোড়া খেয়ে চালককে তার প্রাপ্য বুঝিয়ে দিয়ে বিদায় দিলাম। ওদের বাড়ির বাইরের দিকটা এক ঝলক দেখে নিয়ে একটু ধীর স্থির ভাবে এক-পা দু-পা করে ক্রমশ গেটের সামনে এগিয়ে এলাম। কলিংবেলের সামনে এসে না টিপে বেশ কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে ভিতরের কোন সাড়াশব্দ পাওয়া যায় কিনা সচেষ্ট হলাম। নাহ! কোন শব্দ বাইরে আসছে না। তবে বাইরে তালা ঝোলানো নেই মানে ভিতরে নিশ্চয়ই লোক আছে- এটা নিশ্চিত হয়ে এবার বেলে চাপ দিলাম। তবুও কোন সাড়াশব্দ পাওয়া গেল না। খানিক বাদে আবার একবার চাপ দিলাম।এবার অবশ্য ভেতর থেকে পা ঘষার শব্দ কানে এলো। সাথে সাথে একটি কমবয়সী মেয়ে বাইরে বেরিয়ে এলো। খুব করুণ স্বরে নাকে তুলে জানতে চাইলো,
- আপনি কোথা থেকে আসছেন?
আমার কি উত্তর হবে বুঝতে না পেরে পাল্টা প্রশ্ন করলাম,
- এটা শেফালী ম্যাডামের বাড়ি না?
-আজ্ঞে!
-উনি কি বাড়িতে আছেন?
যথারীতি আদুরে গলায় নাকে তুলে বললো,
-না আআআ...। দিদি একটু বার হয়েছেন।
-কখন আসবেন বলে গেছেন?
-না আ আ ... । তেমন কিছু বলে যাননি।
উল্লেখ্য আমারও একটু ইচ্ছে হচ্ছিল ওর মত নাকে তুলে কথা বলি। কিন্তু নিজেকে সংবরণ করে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন করি,
-উনি তোমার কি হন?
এবার ও নিরবে মুখ নিচু করে রইলো। বুঝতে পারলাম ও বেশ অস্বস্তিতে পড়েছে। আমি আবার প্রশ্ন করলাম,
- তোমার নাম কি?
-আজ্ঞে মুনিয়া আ আ.. ।
-মুনিয়া বাড়িতে আর কে কে আছেন?
-মাসিমা আ.. আর বড়দি ই..।
এমন সময় মাসীমা বেরিয়ে এলেন। আমি প্রণাম জানালাম। কিন্তু উনি আমাকে প্রথমে চিনতে পারলেন না। এবার মেসোমশায়ের অসুস্থতার কথা বলতেই তৎক্ষণাৎ চিনতে পারলেন এবং জিহবা কেটে দুঃখ প্রকাশও করলেন। আমি শ
প্রণাম করতেই, আমার মাথায় হাত বুলিয়ে মুনিয়াকে বকা দিলেন, কেন আমাকে এভাবে বাইরে দাঁড় করিয়ে রেখে কথা বলছে বলে। আমি আপত্তি করলাম,
-না মাসিমা মুনিয়ার কোন দোষ নেই। ও আমাকে প্রথমে বলেছিল বসার কথা। কিন্তু আমিই ভিতরে ঢুকতে চাইনি।
আমার কথা শেষ হতেনা হতেই মাসিমা আমার হাত ধরে ভিতরে নিয়ে গেলেন। ড্রয়িংরুমটা বেশ ছিমছাম করে সাজানো গোছানো। দুটি সুদৃশ্য ভাস ঘরের দুদিকে শোভা বর্ধন করছে। এক ঝলকে ভিতরে চারদিকে দেখে নিলাম। ঘরের টিপটপ সাজগোজ যে কারও ভালো লাগারই কথা। এমন সময় পাশের ঘরে থালাবাসনের ঝনঝনানি কানে এলো। বুঝতে বাকি থাকলো না যে পাশের ঘরে নিশ্চয়ই কিছু একটার প্রস্তুতি চলছে। হঠাৎ পায়ের খসখস শব্দে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখি মাসিমা।
আদরমাখা ভঙ্গিতে ইশারা করলেন ওনার সঙ্গে যেতে।
আমি মাসিমার নির্দেশ পালন করতে সোফা ছেড়ে উঠলাম। দু-পা বাড়াতেই দেখি পাশের ঘরে জানালা লাগোয়া ডাইনিং টেবিল, যেখানে ইতিমধ্যে প্লেটে খাবার রেডি করা আছে। আমি মৃদু আপত্তি করলাম,
-এসব ঝামেলাই বা কেন করতে গেলেন মাসিমা?
এবার উনি ঠোটে আঙ্গুল দিয়ে ইশারায় শব্দ না করে, আমার হাত ধরে চেয়ারে বসিয়ে দিলেন। এবারও আমি বাধ্য ছেলের মত ওনার নির্দেশ পালন করলাম। ওনার আন্তরিকতায় মুগ্ধ হয়ে হাত মুখ ধুয়ে খাওয়া শুরু করলাম। খেতে খেতে নানান গল্প সমানে চলতে লাগলো। হঠাৎ কলিংবেল বেজে উঠতেই অনুমান করলাম নিশ্চয়ই শেফালী ম্যাডাম বাড়ি ফিরেছে। আমার অনুমানে ভুল ছিল না। মুনিয়া গেট খুলতেই শেফালী ম্যাডাম ঘরে ঢুকলো। দূর থেকে এক ঝলক বিশুদ্ধ হাসি নিয়ে একেবারে পাশে চলে এলো। কি বলে ডাকবো শুরুতেই আমি একটু সংশয়ে ছিলাম। আমার সংশয়কে নিরসন করে শেফালী ম্যাডাম বলে উঠলো,
-কতদিন পরে আবার দেখা তোমার সঙ্গে। ভেবেছিলাম এ জীবনে বুঝি আর দেখা হবে না।
মুখের মধ্যে খাবার চিবাতে চিবাতে অস্পষ্টভাবে আমিও পাল্টা বললাম,
-আমি কিন্তু এরকম ভাবিনি কখনও। আমার ভাবনা ছিল, সময়ে নিশ্চয়ই দেখা হবে একদিন।
মিষ্টি হাসি দিয়ে জানতে চাইল,
-তো কেমন আছো তুমি? স্কুল কেমন চলছে?
-মাঝে খুব সমস্যার মধ্যে ছিলাম, এখন অনেকটা কাটিয়ে উঠেছি। তবে এই মুহূর্তে খুব ভালো আছি। স্কুলও বেশ ভালো চলছে।
-বাহ! তোমরা সকলে ভালো আছে শুনে খুব ভালো লাগছে।
শেফালী ম্যাডামের কথা শেষ হতেই এবার আমি বলে ফেলি,
-আমি অবশ্য স্কুলটা ছেড়ে দিয়েছি।
- অ্যাঁ! স্কুল ছেড়ে দিয়েছ মানে? কেন ছাড়লে?
-আরে! এতটা ঘাবড়াচ্ছ কেন? তোমাকে একটা ভালো খবর দিতেই তো এলাম এখানে।
-কি খবর? এক্ষুনি বল!
-আমি একটা সরকারি স্কুলের নিয়োগ পত্র পেয়েছি।
-ওয়াও! দারুণ খবর! তবে এতক্ষণ জানাওনি কেন?
-আসলে খবরটা বলার মতো পরিস্থিতি তৈরি করার জন্যে অপেক্ষায় ছিলাম।
-না না। শুধু শুধু শুকনো মুখে খবর দিলে হবে না। মিষ্টিমুখ করাতে হবে।
- নিশ্চয়ই! বল কি মিষ্টি খাবে?
চোখে মুখে প্রচন্ড আনন্দ নিয়ে এবার ম্যাডাম মাকে উদ্দেশ্য করে,
-মা দেখো ওর চাকরিটা হয়ে গেছে। ভীষণ দরকার ছিল চাকরিটা ওর।
মাসিমা পাশে দাঁড়িয়ে এতক্ষণ আমাদের কথোপকথন শুনছিলেন। এখন শেফালী ম্যাডাম বলাতে আবার নতুন করে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করে আমাকে আশীর্বাদ করলেন। আমি আরো একবার মাসিমাকে প্রণাম করলাম। এবার আমি শেফালী ম্যাডামের কাছে জানতে চাইলাম,
- এবার তোমার খবর বল। সেদিন তোমার ওভাবে চলে আসার কারণটা জানতে না পারায় মনের মধ্যে যে খচখচানি তৈরি হয়েছিল তা আজও রয়ে গেছে।
আমার কথা শেষ না হতেই মুহূর্তেই শেফালী ম্যাডাম মানে আমার ফিরে পাওয়া শেলীর মুখ থেকে বয়ে চলা নির্মল হাসি মুহূর্তে উধাও হয়ে গেল। সঙ্গে পরিবেশটিও একেবারে বদলে গেল। একটা গুমোট পরিবেশে মাঝে মাঝে কয়েকটি দীর্ঘশ্বাস ছাড়া আর কোন শব্দ কানে এলো না। মনে মনে প্রশ্ন জাগছে তাহলে কি কোনো অপ্রীতিকর প্রশ্ন করে ফেলেছি? নতুন করে কিছু জিজ্ঞাসা না করে চুপচাপ বসে রইলাম। কিছুক্ষণ পর শেলীই নীরবতা ভঙ্গ করলো,
-আসলে বাড়িতে বাবার শরীরটা সে সময় এতটাই খারাপ হয়েছিল যে বাবাকে ফেলে ওভাবে হোস্টেলে পড়ে থাকাটা আর সম্ভব হচ্ছিল না। তবে এসেই বা কি করলাম। বাবাকে তো আর ধরে রাখতে পারলাম না। এখন আমি একটা ছোটখাটো হসপিটাল সামলাচ্ছি। দিদি তো আগে থেকেই অসুস্থ ছিল। বাবা চলে যাওয়ার পর মায়ের নানান উপসর্গ লেগেই আছে। নতুন করে যোগ হল মুনিয়া। মুনিয়ার পরিচয় জানার জন্য মনে একটা কৌতূহল তৈরি হয়েছিল। প্রসঙ্গ উঠতেই বলে ফেলি সে কথা।
-অনির্বাণের বোন। কিছুদিন আগে মেসোমশাই মারা গেছেন। ওদের তেমন কোন আত্মীয়-স্বজন নেই ওখানে। যে কারণে দেশে ফিরে অনির্বাণ বোনকে আমার কাছে রেখে গেছে।
এত বিষন্নতার মাঝে অনির্বাণের প্রসঙ্গ উঠতেই আমি কিঞ্চিৎ প্রসন্ন হলাম। শেলী আবার বলতে লাগলো,
-মৃত্যুশয্যায় থাকাকালীন বাবা আমাকে বিয়ে দিতে না পারার যন্ত্রণায় কথা জানিয়ে শিশুর মত কাঁদতেন।একদিন তো আমার হাত ধরে বেশ কয়েকবার ঝাঁকুনি দিয়ে প্রতিশ্রুতি চাইছিলেন যাতে আমি বিয়ে করতে সম্মতি দেই। আমি বাবাকে বোঝাতে ব্যর্থ হই যে মা দিদিকে অসহায় ভাবে ফেলে রেখে স্বার্থপরের মতো বিয়ে করে সংসার ধর্ম পালন করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। বরং এসব অহেতুক চিন্তা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলতে বাবাকে কত করে বোঝাতে থাকি। কিন্তু কিছুতেই ওনাকে বোঝাতে পারেনি। একদম শেষের দিকে আমি পাশে গেলে বাবার নির্লিপ্ত আচরণ আমাকে যেন কুরে কুরে খেত। আমার অসহায়ত্ব কিছুতেই বাবাকে বোঝাতে পারিনি।
শেষের দিকে কথাগুলি বলার সময় শেলীর গলা রীতিমতো ধরে এলো। বুঝতে পারছিলাম কিছুতেই নিজেকে স্বাভাবিক রাখতে পারছে না। বেশ কয়েকবার গলা খাকারি দিয়ে গলা পরিষ্কার করেও নিলো। আমি মাথা নিচু করে মেঝের দিকে তাকিয়ে রইলাম। একটু দূরে একটা চেয়ারে মাসিমা বসে আছেন। ঘরে অদ্ভুত রকমের নীরবতা। শেলী আবার বলতে লাগলো,
-বিয়ের পিঁড়িতে বসতে আমার আপত্তি ছিল না। কিন্তু দিদি ও মায়ের কথা ভেবে ও পথ না মাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিই।সে সময় বাবাকে কথা দিতে না পারলেও উপরওয়ালা বোধহয় বাবার প্রার্থনা মঞ্জুর করেছিলেন।তাই বাবার মৃত্যুর কয়েক মাস পরে হঠাৎ একদিন অনির্বাণ মুনিয়াকে নিয়ে হাজির হয়। দুই ভাই-বোনের এমন অপ্রত্যাশিত আগমনে প্রথমে অবাক হয়েছিলাম।পরে জানতে পারি মেসোমশাই তার কিছুদিন আগে পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছেন। অনির্বাণেরও জাপানে বেশ কিছু কাজ এখনো পড়ে আছে। ওর কথা অনুযায়ী আগামী কয়েক মাসের মধ্যে জাপানের পর্ব পাকাপাকিভাবে শেষ হয়ে আসবে। তখন পাকাপাকিভাবে দেশে ফিরে আসবে।একসময় তো অনির্বাণকে নিয়ে স্বপ্ন দেখতাম। কাজেই ও যদি দেশে ফিরে আসে তাহলে আর একাকী থাকার কারণ দেখিনা। আর ততদিনে বাবা-মা হারা ছোট্ট মুনিয়ার আমাদের সংসারে নতুন সদস্যে পরিণত হওয়া। শেলীর কথা শুনতে শুনতে বড় একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি সময় অনেকটা অতিবাহিত হয়েছে। পাশে রাখা সাইড ব্যাগটি কাঁধে নিয়ে,
-না আর বসবো না। এবার আমাকে উঠতে হবে বলতেই,
বেশ চপলতার সঙ্গে বসতে বলে শেলী আবার পাশের ঘরে চলে গেল।ওর এখনো কিছু বলা বাকি আছে ভেবে ব্যাগটি আবার নিচে নামিয়ে মাসিমা ও মুনিয়ার সাথে গল্প করতে লাগলাম। হাবিজাবি গল্পও একসময় শেষ হয়ে গেল তবুও শেলী না আসায় এবার একটু একটু করে অধৈর্য হতে থাকি। ঘরের দরজাটা সরিয়ে একটু দূরে তাকাতেই দেখি পাশের ঘরে ম্যাডাম কি সব লেখালেখিতে ব্যস্ত। দূর থেকে চোখাচোখিও হয়ে গেল। ইঙ্গিত করে অনুরোধের সুরে আরও একটু বসতে বলল। আমি আবার চেয়ারে এসে বসলাম। আরও কিছুক্ষণ পরে ধীর স্থির ভাবে হাসতে হাসতে ম্যাডাম পাশে এসে দাঁড়ালো। ঠোঁটের ফাঁকে মৃদু হাসি নিয়ে দুটি এনভেলাপ আমার হাতে দিয়ে বলল,
-বিধিসম্মত সতর্কীকরণ।এখানে খোলা যাবে না।পথে যেতে খুলতে হবে মশাই।
আমি তার রসাত্মক কথার বিনিময়ে পাল্টা হাসি উপহার দিয়ে, এনভেলাপ দুটি ব্যাগের মধ্যে নিরাপদ স্থানে রেখে সকলকে বিদায় জানিয়ে দ্রুত বাইরে বেরিয়ে আসি। রাস্তায় নামতেই সঙ্গে সঙ্গে একটি চলমান অটো পেয়ে যাই। স্টেশন যাবে কিনা জিজ্ঞাসা করতেই রাজি হওয়াতে চড়ে বসলাম অটোতে। দেখতে দেখতে অটোটি চলে এলো স্টেশনে। ওয়েটিং রুমে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতেই ট্রেনের খবর হল। ভিড় তেমন ছিল না বললেই চলে। সুবিধামতো একটা বসার জায়গাও পেয়ে গেলাম। দেখতে দেখতে ট্রেনটি ছেড়ে দিল। আমার মন পড়েছিল এনভেলাপের ভিতরে। কাজেই ধীরেসুস্থে এবার প্রথম চিঠিটি খুললাম,

প্রিয় বন্ধু,

জানিনা এই চিঠিটি কোনদিন তোমার হাতে পৌঁছাবে কিনা। কিন্তু যদি কোনদিন পৌঁছায়, তাহলে সেদিন তোমার মনের অনেকগুলি জিজ্ঞাসার উত্তর পেয়ে যাবে।
সেদিন হোস্টেল ছেড়ে চলে আসার সময় খুব করে বিষয়টি তোমাকে জানাতে ইচ্ছে করছিল। যদিও শেষ মুহূর্তে নিজের সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসি।মনে হয়েছিল তোমাকে জানাতে গিয়ে উল্টে যদি চিঠির বিষয়টি জানাজানি হয় তাহলে লোকলজ্জার পাশাপাশি তোমার উপরেও নেমে আসতে পারে আক্রোশের খাঁড়া। অথচ তোমাকে জানানোর জন্য আমি উদগ্রীব হয়ে উঠেছিলাম। একারণেই ওরকম চিঠি লেখার নাটক করে চিঠি দিই। যেখানে কেবলমাত্র একটিই শব্দ লেখা ছিল 'সরি'। আমার ভাবনা ছিল হয়তো রহস্য উন্মোচন করতে গিয়ে চিঠির কিনারা ধরে তুমি শেষ পর্যন্ত আমার বাড়ি চলে আসবে। যদিও আমার সে প্রত্যাশা সে সময় পূরণ হয়নি।

শিক্ষক প্রশিক্ষণের নাম করে সভাপতি মহাশয় আমাকে নিয়ে গেছিলেন উড়িষ্যার ভুবনেশ্বরে। মনে একরাশ প্রত্যাশা নিয়েই প্রশিক্ষণের উদ্দেশ্যে রওনা দিয়েছিলাম। উনিও গেছিলেন আমার সঙ্গে একজন আয়োজক হিসেবে। আমরা হোটেলে পৃথক রুম নিলেও ঘটনার দিন একটু রাতের দিকে বিশেষ দরকারে উনি আমার রুমে আসেন। নেহাৎই বিদ্যালয় প্রধান,সৌজন্যবশত আমি ওনাকে ভিতরে ঢুকতে বলি।ওনার ইপ্সিত লক্ষ্য কি সেদিন আমি ঘূণাক্ষরেও বুঝতে পারিনি। যাইহোক একথা-সেকথা বলতে বলতে কিছুক্ষণের মধ্যে উনি জল খেতে চাইলেন। আমি জল দিতে গেলাম উনার পাশে। অমনি বেরিয়ে পড়লো ওনার আসল চেহারা। যেন এই সুযোগটির জন্যই উনি অপেক্ষায় ছিলেন।

কিছু বুঝে ওঠার আগেই আমাকে আষ্টেপৃষ্ঠে দুবাহুর মধ্যে জড়িয়ে ধরেন।আমি আমার শরীরের সাধ্যমত শক্তি প্রয়োগ করি। চিৎকার করতে যাওয়ায়, জোরে গলা টিপে ধরলে উপর্যুপরি কাশিতে আমার প্রবল শ্বাসকষ্ট শুরু হয়।বুঝতে পারি সহজে ওর হাত থেকে রেহাই মিলবে না বরং কৌশলের আশ্রয় নিতে হবে। কাজেই চিৎকার করার রাস্তা ছেড়ে পরবর্তী ঘটনার জন্য আমি মাথা ঠান্ডা রাখতে চেষ্টা করি। মনের মধ্যে অহরহ বিভিন্ন কৌশল ডানা মেলতে থাকে। কিন্তু তবুও শেষ পর্যন্ত কোন রাস্তা খুঁজে না পেয়ে একসময় অসহায় ভাবে ওর কাছে আত্মসমর্পণ করি। কার্যত প্রায় সারারাত জানোয়ারটার লালসার শিকার হয়ে কখন যে নিস্তেজ হয়ে পড়েছিলাম তারও আর খেয়াল ছিলনা। ভোররাতে চোখ খুলে দেখি দরজা হাট করে খোলা। অবিন্যস্ত জামাকাপড় সামলিয়ে সেদিন সকালে হোটেল থেকে সোজা হোস্টেলে গিয়ে জিনিসপত্র নিয়ে বাড়ি ফিরে আসি।

ইতি-
এক হতভাগিনি

দ্বিতীয় চিঠিটির লেখাটি বেশ উজ্জ্বল। উভয় ক্ষেত্রে চিঠিদুটির কোন তারিখ উল্লেখ করা নেই। বুঝলাম একটু আগে ঘরে বসেই চিঠিটা লিখেছে।

প্রিয় বন্ধু,

সে সময় আমার হঠাৎ গৃহে প্রত্যাবর্তনে তোমার মত বাবা-মাও খুব অবাক হয়েছিলেন। যদিও আমি কাউকে বিষয়টি পরিষ্কার করে জানানোর প্রয়োজন অনুভব করিনি। যতটা সম্ভব স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করে গেছি। একেবারে শুরুতে মনে ভাবনা ছিল অন্তত স্থানীয় থানায় গিয়ে অভিযোগ করি। কিন্তু পরক্ষণেই আইনি জটিলতায় পড়ে যদি বাবা-মা চাপ নিতে না পারেন, উল্টে বিপরীত ফল হওয়ার আশঙ্কায় সে রাস্তা ত্যাগ করি। এভাবেই পারিপার্শ্বিকতার চাপে পড়ে অবশেষে নিজের সব অদম্য জেদকে জলাঞ্জলি দিতে বাধ্য হই।

আমার এভাবে গুটিয়ে যাওয়া দেখে বাবা-মা অন্য ভাবনা ভাবতে থাকেন।যে বয়সে বিয়ে-শাদী করে সংসার ধর্ম পালন করার কথা অথচ তা না করায় বিষন্নতা আমাকে গ্রাস করছে বলে বাবা-মায়ের ধারণা হয়। তাদের আচরণে আমি সে কথা বুঝতে পারি। অথচ আমি নিজের অসহায়ত্বের কথা কাউকে প্রকাশ করতে পারিনি। নিজের মানসিক অবস্থার সঙ্গে অহরহ সংগ্রাম করতে থাকি।কোন অবস্থায় যেন বার্ধক্যের শেষ প্রান্তে দাঁড়ানো দুজন মানুষের সামনে ধরা না পড়ি। নিজেকে প্রবোধ দেই,আমাদের সমাজে এরকম হাজারো শেফালী আছে যারা প্রতিনিয়ত কোন না কোন ভাবে যৌন লাঞ্ছনার শিকার হয়ে পারিপার্শ্বিকতার চাপে নিজেদেরকে গুটিয়ে রাখতে বাধ্য হয়েছে।

আমার এই বিষণ্ণের দিনগুলোতে তোমাকে পাশে পাওয়ার স্বপ্নে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতে থাকি।আসলে নিজের যন্ত্রণার কথা কাউকে শেয়ার করতে না পারায় মনের মধ্যে মাঝে মাঝে ভয়ঙ্কর অস্থিরতা তৈরি হয়েছিল। কখনো মনে হয়েছিল অব্যক্ত কথাগুলি মাঝেমাঝে পেটের মধ্যে যেন গুমরে গুমরে উঠছে। আর এ কারণেই দরকার ছিল তোমার মত কোন বিশ্বস্ত সুহৃদের। যদিও আমার অব্যক্ত যাতনা একসময় অবদমিত হয়। ক্রমশ একাকীত্বই আমার সাথী হয়ে ওঠে। আমার সমস্ত চাওয়া-পাওয়া গুলো নিঃসঙ্গতা নামক একটা বিন্দুতে এসে মিলিত হয়। এরই মধ্যে একদিন বাবা চলে গেলেন অমৃতলোকে।নিজের শিক্ষা-দীক্ষা বিবেক বুদ্ধি নিয়ে যখন নিজেই নিজেকে উপহাস করতে থাকি। এমনই এক প্রভাতে অনির্বাণ মুনিয়াকে নিয়ে হাজির হয়। বাবা-মা হারানো অভাগিনী মেয়েটি বয়সে খুবই ছোট্ট ঠিকই কিন্তু উপরওয়ালা ওর হৃদয়কে আকাশ সমান মায়ায় ভরিয়ে দিয়েছেন। ওই এখন আমাদেরকে নতুন করে বাঁচার স্বপ্নে বিভোর করে তুলেছে।যে কারণে আমি এখন অনির্বাণকে নিয়ে স্বপ্ন দেখি এক নতুন প্রভাতের....


ইতি-
শেফালী

মরীচিকা (পর্ব-৩২)






সর্বশেষ এডিট : ১৮ ই সেপ্টেম্বর, ২০২০ দুপুর ২:২৫
৩৩টি মন্তব্য ৩৩টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

অন্যায় অত্যাচার ও অনিয়মের দেশ, শেখ হাসিনার বাংলাদেশ

লিখেছেন রাজীব নুর, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৪:৪০



'অন্যায় অত্যাচার ও অনিয়মের দেশ, শেখ হাসিনার বাংলাদেশ'।
হাহাকার ভরা কথাটা আমার নয়, একজন পথচারীর। পথচারীর দুই হাত ভরতি বাজার। কিন্ত সে ফুটপাত দিয়ে হাটতে পারছে না। মানুষের... ...বাকিটুকু পড়ুন

মুক্তিযোদ্ধাদের বিবিধ গ্রুপে বিভক্ত করার বেকুবী প্রয়াস ( মুমিন, কমিন, জমিন )

লিখেছেন সোনাগাজী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৫:৩০



যাঁরা মুক্তিযদ্ধ করেননি, মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে লেখা তাঁদের পক্ষে মোটামুটি অসম্ভব কাজ। ১৯৭১ সালের মার্চে, কৃষকের যেই ছেলেটি কলেজ, ইউনিভার্সিতে পড়ছিলো, কিংবা চাষ নিয়ে ব্যস্ত ছিলো, সেই ছেলেটি... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। সাংঘাতিক উস্কানি মুলক আচরন

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:০৪



কি সাঙ্ঘাতিক উস্কানিমুলক আচরন আমাদের রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রীর । নাহ আমি তার এই আচরনে ক্ষুব্ধ । ...বাকিটুকু পড়ুন

একটি ছবি ব্লগ ও ছবির মতো সুন্দর চট্টগ্রাম।

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ৮:৩৮


এটি উন্নত বিশ্বের কোন দেশ বা কোন বিদেশী মেয়ের ছবি নয় - ছবিতে চট্টগ্রামের কাপ্তাই সংলগ্ন রাঙামাটির পাহাড়ি প্রকৃতির একটি ছবি।

ব্লগার চাঁদগাজী আমাকে মাঝে মাঝে বলেন চট্টগ্রাম ও... ...বাকিটুকু পড়ুন

দ্য অরিজিনস অফ পলিটিক্যাল জোকস

লিখেছেন শেরজা তপন, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ১১:১৯


রাজনৈতিক আলোচনা - এমন কিছু যা অনেকেই আন্তরিকভাবে ঘৃণা করেন বা এবং কিছু মানুষ এই ব্যাপারে একেবারেই উদাসীন। ধর্ম, যৌন, পড়াশুনা, যুদ্ধ, রোগ বালাই, বাজার দর থেকে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×