রাজদেওড়ার জঙ্গলে ( পর্ব-৬)
কেয়ারটেকার আমাদেরকে নিয়ে চললো রুমের উদ্দেশ্যে।যেতে যেতে রাস্তায় বামদিকে একটি সুসজ্জিত বাংলো দেখে প্রশ্ন করতেই,
-ওটা ভিআইপিদের জন্য সংরক্ষিত স্যার।
ঠিকই তো ভিআইপি রুম বলে কথা! চারিদিকে উচু করে কাঁটাতারের বেড়া দেওয়া। মাঝে বাচ্চাদের জন্য ছোটখাটো একটা পার্কও বিদ্যমান।গেটের সামনে সুসজ্জিত গাছগুলো সুন্দর করে ছাঁটা। ঠিকই তো! এমন একটি বাংলো তো শুধু ভিআইপিদের বিচরণের পক্ষেই উপযুক্ত। বাংলোটি দেখতে দেখতে পা ফেলেছি আর হাঁটছি। এমন সময় আরও কিছুটা এগিয়ে যেতেই আরও একটি শ্যাওলা ধরা, জায়গায় জায়গায় পলেস্তারা খসা ছোটখাটো একটা বাড়ী চোখে পড়লো।উল্লেখ্য সকালে যাওয়ার সময় আমাদের গাড়িটি এই বাড়িটির পাশ দিয়েই গেছিল। তখন একবারও কল্পনায় আসেনি যে এই বাড়িটিই আজ আমাদের নৈশ ঠিকানা হবে। আমরা কেয়ারটেকারকে অনুসরণ করে সোজা উঠলাম সেই বাড়িতে। করিডরের দাঁড়াতেই একটা ভ্যাপসা গন্ধ নাকে এলো। চারিদিকে ঝুল আর মাকড়সাদের জাল বিস্তার করা দেখে বুঝলাম বহুদিনে এবাড়িতে কোন অতিথি সমাগম ঘটেনি। কেয়ারটেকার হাত দিয়ে কয়েকটি জাল কেটে এগিয়ে যেতেই পড়িমড়ি করে মাকড়সাদল ছুটে পালাতে লাগলো। এবার সঙ্গে আনা চাবিগুচ্ছ দিয়ে বেশ কয়েকবার চেষ্টা করে অবশেষে ঘরটি খুলতে পারল।পাশাপাশি দুটো রুম। একটিতে কমোড আছে অন্যটিতে পাদানি। পায়ের সমস্যা থাকায় নীলাঞ্জনাকে কমোড যুক্ত রুমটি ছেড়ে দিয়ে আমরা গেলাম অন্যটিতে।
সেদিন রুমে ঢুকে ইলেকট্রিক পয়েন্ট দেখে খুব খুশি হয়েছিলাম। জঙ্গলের মধ্যে রাত কাটাবো অথচ ইলেকট্রিক পয়েন্ট! বিষয়টি একেবারেই অপ্রত্যাশিত ছিল। আমার শ্রীমানও আমার মতই আনন্দিত ইলেকট্রিক পয়েন্টের উপস্থিতি দেখে। আনন্দের আতিশয্যে সে তো প্রকাশ করেই ফেললো,
- পাপা ইলেকট্রিক আছে যখন তাহলে টিভি হবে না কেন?
কেয়ারটেকার রুম দেখিয়ে আমাদের আরও কিছু দরকার হয় কিনা সে অপেক্ষায় তখনও পাশে দাঁড়িয়েছিল। মেঘের প্রশ্ন শুনে তার দেওয়া উত্তরে মুহূর্তে আবির্ভূত আমাদের সমস্ত আশা যেন শব্দের বেগ মাটিতে আছড়ে পড়লো। শ্রীমানের দিকে মুখ করে,
-না বাবা। ওগুলো ইলেকট্রিকের পয়েন্ট নয়।
এমন উত্তরে স্বভাবতই অবাক না হয়ে পারলাম না। এবার আমি জিজ্ঞাসা করি,
-তাহলে ঘরে এগুলো পয়েন্ট কিসের দাদা?
আমার দিকে ফিরে,
-বাবু ওটা জেনারেটরের লাইন। গোটা বাংলোতে জেনারেটরের ব্যবস্থা আছে, ওগুলো তারই পয়েন্ট। আসলে..
-আসলে মানে কি? থামলে কেন?
-বড় সাহেব বা উপরমহল থেকে যখন লোকজন আসে তখন অবশ্য গোটা বাংলো আলোকিত হয়। তবে চাইলে আপনারাও পেতে পারেন...
আমরাও পেতে পারি শুনে এক নির্মল আনন্দে মনটা ভরে গেল। সঙ্গে সঙ্গে প্রশ্ন করি,
- কিন্তু কেমনে পাব?
- প্রতি ঘন্টায় ১৫০ টাকা হিসেবে আমরাই জেনারেটরের ব্যবস্থা করি দাদা। তবে এই বন বাংলোর কোন রুমেই পৃথক করে জেনারেটরের ব্যবস্থা নেই। এক জন নিলে সবাই তার সুফল পাবে।ও আবার জিজ্ঞাসা করল,
-বাবু আপনাদের জেনারেটর লাগবে?
-না না ও সবের দরকার নেই। পারলে রাতে একটি ক্যান্ডেলের ব্যবস্থা করলেই চলবে।
-হ্যাঁ বাবু ক্যান্ডেল আমরা অফিস থেকে দিয়ে থাকি। তবে জেনারেটরের ব্যবস্থা হঠাৎ করে দেওয়া সম্ভব নয়। আগে থেকে জানালে আমরা ইসাক বাজার থেকে ডিজেল এনে রাখি।
আমি ওর সরল স্বীকারোক্তিতে একটু বোকা বোকা হাসি দিয়ে নমস্কার জানাতেই ও পাল্টা নমস্কার জানিয়ে বিদায় নিল।
তবে যাওয়ার আগে আরও একবার সাবধান করে গেল। যদিও গভীর জঙ্গল শুরু হয়েছে আরো অনেক দূর থেকে। এই স্থানটি তুলনায় অপেক্ষাকৃত ন্যাড়া। দিনের বেলায় সাধারণত বন্যজন্তুদের এদিকে আসার সম্ভাবনা একেবারেই নেই। তবুও একাকী দূরে কোথাও না যাওয়ার পরামর্শ দিল। সেদিন আমরা পৌঁছানোর পর আরও দশ/বারোটা বিভিন্ন আকারের গাড়ি জঙ্গল পরিদর্শনে আসে। শহুরে ঝাঁ-চকচকে পুরুষ-মহিলাদের দাপাদাপিতে স্থানটিকে দুপুরবেলা রীতিমতো একটি পিকনিক স্পট বলেই মনে হলো। তবে যারা এলো তাদের কাউকে এখানে ওভেন জ্বালিয়ে রান্না করতে দেখলাম না। সম্ভবত বাইরে থেকে খাবার দাবার নিয়েই সকলে এখানে ঘুরতে আসে। পুরুষ মহিলা মিলিয়ে চার/পাঁচ জনের একটি দলকে দেখলাম আমাদের রুমের দিকে এগিয়ে আসতে। আমি হিন্দিতে একেবারেই সড়গড় নই। বিপদ আসন্ন বুঝে রুমের করিডর থেকে ভিতরে পা ফেলতেই হিন্দিতে ঝাকে ঝাকে কিছু মিসাইল ছুটে এলো। অভদ্র হতে পারলাম না, বাধ্য হয়ে আবার ওদের দিকে মুখ করে দাঁড়ালাম। প্রশ্নকর্তা ভদ্রলোককে পরিষ্কার বাংলায় বললাম,
-আপনি কি জানতে চাইছেন আমি কিছুই বুঝতে পারছি না।
ওনাদের ধারণায় বাঙ্গালীদের থাকার জায়গা সম্ভবত একটিই। যে কারণে উনি আমার মুখের বাংলা শুনে জানতে চাইলেন আমরা কলকাতা থেকে এসেছি কিনা। আমি মাথা নাড়িয়ে সম্মতি প্রকাশ করতেই আমার শ্রীমান ততক্ষণে পাশে এসে দাঁড়ালো। ও সামনের দুটি পা নাড়াতে নাড়াতে হিন্দিতে পাল্টা জিজ্ঞাসা করল,
-আপনারা কোথা থেকে এসেছেন?
উত্তর এলো ধানবাদ থেকে। আমি বোকার দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলাম উভয়ের কথোপকথনের মাঝে। এমন সময় আমার শ্রীমান সবার সামনে হাঁড়ি ভেঙে দিল,
-পাপা হিন্দি জানে না।
আগন্তুকরা সকলেই শুনে হো হো করে হাসতে লাগলো। আমিও তাদের সঙ্গে হাসিতে যোগ দিলাম। ওরা আমার শ্রীমানের কাছে জানতে চাইলো,
-তুমি হিন্দি শিখলে কোথা থেকে?
-টিভিতে কার্টুন দেখে এবং আমার স্কুলের হিন্দি ক্লাস থেকে।
ওদের বাকি প্রশ্নের উত্তর সবই আমার শ্রীমান জানিয়ে দিল। কিভাবে এখানে রুম পাওয়া যায় বা রাতে থাকতে গেলে কোথা থেকে অনুমতি সংগ্রহ করতে হয় কিংবা কি কি সাবধানতা অবলম্বন করা জরুরী। জীবনের প্রথম দোভাষীর ভূমিকা পালন করে ও তখন রীতিমতো উচ্ছ্বসিত। চলে যাবার সময় ওরা সকলেই ক্ষুদে দোভাষীর সঙ্গে কর্মদন করল। নমস্কার প্রতি নমস্কারের পর্ব শেষ হতেই আমরা আবার রুমের মধ্যে প্রবেশ করি। পূর্বেই বলেছি অতিথি সমাগম তেমন না ঘটায় ঘরটি অত্যন্ত ধুলোময় ছিল। আমার গিন্নি মগে করে জল নিয়ে যতটা সম্ভব ঘরটিকে বসবাস উপযোগী করার আপ্রাণ চেষ্টায় ব্যস্ত। এমতাবস্থায় আমি সহযোগিতা না করে বাইরে ভদ্রলোকদের সঙ্গে কথা বলে অহেতুক সময় নষ্ট করাতে ঘরে ঢুকেই সম্মুখীন হতে হল এক পশলা অগ্নি বর্ষণের। বোবার কোন শত্রু নাই। কাজেই মাথার উপর দিয়ে মিসাইলগুলো ছুটতে লাগলো। পড়িমড়ি করে লাগেজ থেকে জামা কাপড় ঝোলানোর জন্য সঙ্গে আনা প্লাস্টিকের দড়িটা টাঙিয়ে দিতেই ওনার মানভঞ্জন হলো। ওদিকে কিচেন রুম থেকে মধ্যাহ্নভোজের খাবার তৈরির খবর আসতেই আমরাও হাতমুখ ধুয়ে বেরিয়ে পড়লাম অফিস কক্ষের দিকে। মধ্যাহ্নভোজের পর অফিস কক্ষের সঙ্গে লাগোয়া বড় ঝিলে বোটিং করে বাচ্চাদেরকে মনোরঞ্জনের চেষ্টা করি।যদিও মনের মধ্যে কেয়ারটেকারের কথাটি অনুরণিত হতে থাকে,আপনার যদি বেশি দেরি না করেন তাহলে বিকালে জঙ্গল পরিদর্শন নিয়ে যাব.....
জলাধার থেকে উপচে পড়া জল:-
দলছুট হরিণ শাবক:-
এখানেই স্পাইডারটি দেখা মেলে:-
বনবাসীর সঙ্গে পরিচয় করানো:-
স্নিগ্ধ জলাশয়টি:-
শিকারের অপেক্ষায়:-
পাহাড়ি খেজুর গাছ:-
জঙ্গলের মধ্যে যে পথে আমরা হেঁটে ছিলাম:-
ছবিটি আগেও দেখিয়েছি। পরিখার উপর দিয়ে অফিসকক্ষে যাওয়ার পথ:-
সবাই স্বপ্ন দেখে:-
পরবর্তী পর্বের জন্য( ফলসের নামটি আজ গোপন রইল):-
রাজদেওড়ার জঙ্গলে (পর্ব-৪)
সর্বশেষ এডিট : ০৫ ই মে, ২০২০ সকাল ৮:২৪