রাজধানীর জঙ্গলে ( শেষ-পর্ব)
আনুমানিক ত্রিশ মিনিট নৌকাবিহার করে আমরা জলাশয় থেকে উপরে উঠে আসি। উল্লেখ্য বাচ্চাদের সঙ্গে নৌকাবিহার করলেও মনের মধ্যে অহরহ নিত্য করতে থাকে কেয়ারটেকারের দেওয়া আসন্ন বৈকালিক পদভ্রমণের অ্যাডভেঞ্চারের কথা । সেই মতো আমরা উপরে উঠতেই দেখি উনিও ততক্ষনে আমাদের জন্য অপেক্ষমান। পরিখা ছাড়িয়ে একটু এগিয়ে আসতেই আশপাশে অন্য কোন টুরিস্ট পার্টিকে না দেখে মনে মনে বেশ চিন্তিত হয়ে পড়লাম। কৌতূহলী দৃষ্টিতে বিভিন্ন গাছ গাছালির মধ্য দিয়ে ইতিউতি খোঁজাখুঁজি করলেও সকালের সেই মোটর গাড়িগুলোর একটিও দৃশ্যপটে পরিলক্ষিত হলো না। অর্থাৎ আমাদের বোটিং করা কালীন সময়েই বহিরাগত সকলেই জঙ্গলের বাইরে চলে গেছেন। এরকম একটা শুনশান পরিবেশে জঙ্গলের পথে আমরা দুটো পরিবার কেয়ারটেকারকে নীরবে অনুসরণ করতে লাগলাম। জঙ্গলের এদিকে বাঘ ভাল্লুক কিম্বা হাতি সাধারণত আসেনা বলে উনি ইতিপূর্বে আমাদেরকে আশ্বস্ত করলেও দলের দুটি বাচ্চার প্রশ্নের পর প্রশ্নের জবাবে কিছুটা বিরক্ত হয়ে, মাঝে মাঝে ভাল্লুক আসার কথা বলতেই আমরা ভয়ে শিউরে উঠলাম। আমরা বড়রা ওনার কথায় উদ্বিগ্নতা প্রকাশ করতেই ভদ্রলোক মুখে একগাল হাসি এনে জানালেন, বাচ্চাদের সাথে মজা করতেই বলেছিলাম। যাইহোক কথাটা যে একেবারে মজার নয়, সে বিষয়ে মনে কিছুটা সংশয় রেখে আমরা ক্রমশ এগিয়ে চললাম।
জঙ্গলের একটা দিক উঁচু করে লোহার নেটের চাদরে মোড়া আছে। নেটের উচ্চতা ফুট পনেরো/ষোলো হবে বলে মনে হলো। পিঁপড়ের সারির মতো আমরা নেটের কোলঘেঁষে জঙ্গলের দিকে চোখ রেখে এগিয়ে চললাম। অন্তত দেড় কিলোমিটার পথ এভাবে পরিভ্রমণ করার পর আমার শ্রীমান 'আর হাঁটতে পারছি না পাপা, বলে জঙ্গলের মধ্যে বসে পড়তেই আমি বিপদের আঁচ করি। কাজেই ওর পালসরেট বুঝে আর না এগোনোর কথা ঘোষণা করতেই আমার শ্রীমতি ভয়ঙ্করও ততক্ষণ আমার পাশে দাঁড়িয়ে গেল।বাচ্চা হাঁটতে না করার বাহানায় একটু হম্বিতম্বি করলেও আমি আর উচ্চবাচ্য না করে বরং নিরব থেকে শ্রীমানকে আগলে রাখলাম। জঙ্গলের পথে নীলাঞ্জনারা ততক্ষণে কেয়ারটেকারের পিছু পিছু বেশ কিছুটা এগিয়ে গেছে। আমি আবার জোরে চিৎকার করলাম। এবার ওরা ঘুরে দাঁড়ালো। ক্রমশ এগিয়ে এলো আমাদের দিকে। এখন আমার শ্রীমানকে এতটা রাস্তায় হাঁটিয়ে কি করে রুমে নিয়ে যাবো, সে ভাবনায় আমার চিন্তার রাজ্যে আঁধার ঘনিয়ে এলো। যাইহোক উপায়ান্তর করতে, সঙ্গে আনা প্রাচীনকালের ক্যামেরা ও মধ্যযুগীয় মোবাইল ফোনটি মিসেসকে হস্তান্তর করে পুত্রকে সঙ্গ দিতে লাগলাম। কিছুটা খেলাচ্ছলে, আড্ডা দিতে দিতে যাতে সদ্য তৈরি হওয়া পায়ের ব্যথাটা ও বুঝতে না পারে-এভাবে হাঁটতে থাকি।হঠাৎ পথের পাশে একটি সাপের খোলস দেখে গা গুলিয়ে উঠলো। সকালে অফিস কক্ষ সহ আমাদের রুমের আশপাশে কার্বলিক অ্যাসিডের ঝাঁঝালো গন্ধ থেকে বুঝেছিলাম এলাকার শ্বাপদ সম্ভাবনা থাকতে পারে। এক্ষণে কেয়ারটেকারকে জিজ্ঞেস করতেই উত্তরে ধরা পড়লো বিভিন্ন জাতের বিষধর সাপের উজ্জ্বল উপস্থিতির কথা। যদিও গোটা পদভ্রমণ কালে বিশালাকার কিছু বন্য কেন্নো ও কিছু মৃত পশুর দেহাবশেষ ছাড়া তেমন কিছুই দৃষ্টিগোচর হল না। পাঠকদের জ্ঞাতার্থে জানিয়ে রাখি। চলমান বন্য কেন্নোগুলো এতটাই গতিশীল ছিল যে বিভিন্ন ভাবে দেওয়া পোজগুলি হেজি হওয়ায় ব্লগে শেয়ার করা গেল না।
পদভ্রমণ শেষ করে সেদিন সন্ধ্যাবেলায় ঘুটঘুটে অন্ধকারের মধ্যে নিজেদের অতিথি নিবাসে না গিয়ে আমরা দুটি পরিবার সরাসরি অফিসকক্ষের ডাইনিং রুমের সোলার আলোতে সন্ধ্যাকালীন আড্ডায় মেতে উঠি। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য নেটওয়ার্ক পরিকাঠামো না থাকায় নিকটজনদের সঙ্গে ফোনালাপ বন্ধ হলেও ছবি তোলার জন্যও ফোনের চার্জ দরকার। মূলত এই উদ্দেশ্যে ফোন গুলোকে অফিস কক্ষের সোলার প্লাগ পয়েন্টে চার্জে বসানোও আমাদের অন্যতম একটি উদ্দেশ্য ছিল। পাশাপাশি অনেকদিন পর আমাদের মতো অতিথিদের আপ্যায়নের সুযোগ পেয়ে বনকর্মীরা খুব উৎফুল্ল হয়েছিল।ওদের চোখ-মুখের ভাষাতে আমরা তার বহিঃপ্রকাশ লক্ষ্য করেছিলাম। সেদিন উপস্থিত বনকর্মীদের আন্তরিক ব্যবহারে আমরা সাময়িক ভাবে ভুলে যাই যে আমরা জঙ্গলে রাত কাটাতে এসেছি। সন্ধ্যার আসরে দু-দুবার জম্পেশ করে চা ও মুড়ি মাখিয়ে পরিবেশন করার মধ্য দিয়ে সেদিন ওরা নিজেদের সুহৃদের পরিচয় তুলে ধরেছিল।
যাইহোক এরকম সন্ধ্যাকালীন আড্ডায় সময় কাটানোর উত্তম মাধ্যম হলো আমাদের কাছে, গানের লড়াই। দলের খুদে সদস্যরা ভীষণ উপভোগ করে সান্ধ্যকালীন এমন আড্ডায় মেতে উঠতে। কথায় ও আড্ডায় কখন যে রাত ন'টা বেজে গেছিল সেদিকে আমাদের কোনো ভ্রুক্ষেপ ছিল না। হঠাৎ ওনাদের একজনের খাবারের কথা স্মরণ করাতে উপলব্ধি করি যে মধ্যপ্রদেশে বেশ চিন চিন করছে। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি ততক্ষণে রাত নটা বেজে গেছে। তড়িঘড়ি করে খাবার পর্বটি সমাধা করে আনুমানিক রাত সাড়ে নটা নাগাদ কেয়ারটেকারের বড় একটা টর্চের সৌজন্যে আমরা পা বাড়াই নিশি যাপনের জন্য নিজেদের অতিথি নিবাসের উদ্দেশ্যে। তার আগে উনি টর্চটা চতুর্দিকে মেরে দেখে নিলেন। বেশ কয়েকবার এদিক-ওদিক ঘুরিয়ে দেখে নেওয়ার পর এবার আমাদেরকে পা বাড়ানোর অনুমতি দিলেন। কিছুটা অগ্রসর হতেই কেয়ারটেকারের হাতের টর্চের আলো আঁধারের মধ্য দিয়ে এক ঝাঁক আলোর বিচ্ছুরণে আমরা সকলেই থমকে দাঁড়ালাম। নিস্তব্ধ নিশুতি রাত্রে ছোট-বড় বিভিন্ন আকারের গাছের ঘন অন্ধকারের ছাতা যেন আমাদের মাথার উপর মেলে ধরেছে।তারই মধ্যে উনি এবার সরাসরি ঐদিকে চর্ট তাক করতেই পাথরের মূর্তির মতো চোখগুলো যেন স্থির হয়ে থাকলো। অন্যদের কেমন হয়েছিল জানি না, কিন্তু জঙ্গলে এমন বিচ্ছুরিত আলো পরোখ করে নিজের সমস্ত শরীর যেন বরফ-শীতল ঠান্ডা হয়ে গেল। কাল বিলম্ব না করে পুত্রকে দু'হাঁটুর মধ্যে আগলে ধরলাম। বাকীদেরকেও দেখলাম সবাই গুটিসুটি মেরে একটা জায়গায় চলে এসেছে।কেয়ারটেকার হাতের টর্চ জ্বালিয়ে রেখে মুখে সমানে আমাদেরকে ভয় না পেতে আশ্বস্ত করে গেলেন। কয়েক মুহুর্ত পরে প্রাণীগুলি উল্টোপথে যাত্রা করায়, দেখলাম ওগুলো জংলি গরু ছিল। প্রাণীগুলো গরু ছিল নিশ্চিত হওয়াতে মনে মনে বেশ স্বস্তি পেলাম। সাথে ওদের ফিরে যাওয়া দেখে মনে সম্বিতও ফিরে পেলাম। আমি ডুয়ার্সের জঙ্গলে বাইসান দেখেছি কিন্তু এগুলো একেবারেই সে রূপ নয়। নেহাত গরু বলেই মনে হলো, অথচ চেহারার চাকচিক্যে এমন দোদুল্যমান চতুষ্পদীকে ইতিপূর্বে কখনোই যে দেখিনি-একথা অস্বীকার করব না। যাইহোক আমরা আরও কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে টর্চের আলোয় ওদের প্রত্যাগমন প্রত্যক্ষ করতে লাগলাম। একেএকে সবগুলি অদৃশ্য হতেই আমরা আবার লক্ষ্যে পা বাড়াই। রুমে ঢুকে মনে মনে ভাবতে থাকি,এমন বন্য প্রকৃতিতে সামান্য গরু দেখে মনের মধ্যে যে ধুকপুকানি শুরু হয়েছিল তা অমন বিশেষ পরিবেশে না পরলে অনুভূত হওয়া সম্ভব নয়।
জঙ্গলে সাপের উপদ্রবের কথা আগেই বলেছি। সেই আশঙ্কায় সেদিন রাতে ঘরে না ঢুকে দরজার মুখে দাঁড়িয়ে টর্চের আলোতে ঘরের প্রতিটি স্থান ভালো করে পর্যবেক্ষণ করে এক প্রকার নিশ্চিত হয়ে তবেই ঘরে প্রবেশ করি। রাতে আলোর ব্যবস্থা বলতে রিসেপশন থেকে আমাদেরকে দেওয়া একটি মাত্র মোমবাতি।তারই আলোয় সঙ্গে নেওয়া খবরের কাগজ গুলোর মধ্যে কয়েকটি মন্ড পাকিয়ে ঘরের যতটা সম্ভব ফাঁক ফোকর গুলো বন্ধ করতে চেষ্টা করি। অস্বীকার করব না যে পরিবারের সামনে বাচ্চার কথা ভেবে এভাবে লক্ষিন্দারের বাসর ঘরের মতো নিশ্ছিদ্র করি ঠিকই কিন্তু ওই মুহূর্তে পৃথিবীর ভীতুতম মানুষটি যে আমি, সে কথা নির্দ্বিধায় বলা যেতে পারে।বাইরে হালকা শীতের আমেজ অনুভূত হলেও এভাবে দরজা জানালা বন্ধ করায় ঘরের তাপমাত্রা দ্রুত বৃদ্ধি পেতে থাকে। জানালাগুলো ভীষণ শক্তপোক্ত লোহার তৈরি। যে কোন প্রাণীর আক্রমণ থেকে একেবারে নিরাপদ বলে মনে হলো। যাইহোক এরকম দম বন্ধ পরিস্থিতিতেও মোমবাতি জ্বালিয়ে রেখে, মশারিটা কোনক্রমে গুঁজে দিয়ে আমরা এক সময় চলে যাই স্বপ্নের জগতে। মাঝরাতে নিদ্রাদেবী হঠাৎ বিরূপ হলেন। চোখ মেলে দেখি মোমবাতির আলো ততক্ষণে অদৃশ্য হয়ে গেছে। ঘন অন্ধকারে গলার নিচে হাত দিয়ে বুঝতে পারি যে ঘেমে অনেকটা ভিজে গেছি। পাশে নিদ্রামগ্ন বাবার এর গলায় হাত দিতেই দেখি পরিহিত পোশাক অর্ধভেজা। একটু দূরে মেঝেতে চর্ট ফেলতেই দেখি মোমবাতি একেবারে মেঝেতে মিশে গেছে। অগত্যা চর্টের আলোয় বাবাই এর পোষাক বদল করে একটু জল পান করে আবার শুয়ে পড়ি। ভোর বেলা যখন ঘুম ভাঙলো হাজারো পাখির কলকাকলিতে জায়গাটিকে এক অপার্থিব সৌন্দর্যে ভরিয়ে তুলল।
হাজার কলকাকলির মধুরিমায় দুজনকে ঘরে রেখে সঙ্গের মোবাইলটা নিয়ে বের হলাম প্রাতঃকালীন পদ ভ্রমণে। কিছুটা এগিয়ে গিয়ে আশপাশের উঁচু উঁচু গাছগুলির কোথা থেকে সুরেলা কণ্ঠগুলির উৎপত্তি তা ঠাহর করতে পারলাম না। ইতিউতি উঁকি মারতেই স্নিগ্ধ প্রভাতে হঠাৎ ছন্দপতন হলো। চোখে পড়লো একদল বিভিন্ন আকারের বাঁদরকুল সকালে গাছে চড়তে ব্যস্ত। যেন বাবা-মা তাদেরকে হাতে করে দোল খাওয়া শেখাচ্ছে। পাশাপাশি আরও মনে হলো তিন জেনারেশনের পরিবার নিয়ে তারা মহানন্দে প্রাতঃকাল উপভোগে মেতেছে। গাছের এক ডাল থেকে আরেক ডালে অনবরত দোল খেয়ে চলেছে। একটি মা আবার তারই মধ্যে পরম যত্নে সন্তানকে স্তন দিতে ব্যস্ত। তবে এই জঙ্গলের বাঁদর যথেষ্ট ভদ্র। সেদিন ওদের আচরণের মধ্যে কোন বাদরামির নমুনা চোখে পড়েনি।
এবার কিছু ছবি দেখা যাক পরবর্তী গন্তব্যস্থল হুড্রু ফলসের....
গভীর মনোযোগে মেঘ:-
আবার হুড্রু ফলস:-
বিশেষ দ্রষ্টব্য:-আগামী পর্বে সিরিজটি শেষ হবে।
রাজনগরের জঙ্গলে (পর্ব-৫)
সর্বশেষ এডিট : ০৫ ই মে, ২০২০ সকাল ৮:১৮