সেদিন প্রভাতে বেশ কিছুটা ইতস্তত পদব্রজের পর অতিথি নিবাসের পার্শ্ববর্তী কুণ্ডীর পাশে বসলাম। কুন্ডীর প্রসঙ্গে পরে আসছি। দূর থেকে বয়ে আসা হালকা জলরাশি ছোট্ট কুণ্ডীর উপর দিয়ে অবিশ্রান্তভাবে মৃদুমন্দ গতিতে ঝর্ণার ন্যায় প্রবাহিত হয়ে চলেছে। গতকালই জেনেছিলাম ঝর্ণার উৎপত্তি নাকি জঙ্গলের অনেক গভীর থেকে। প্রকৃতি দেবীর অপার মহিমায় সমস্ত বন্যপ্রাণীকুলের জল পানের এমন ব্যবস্থা ভাবলে সত্যিই অবাক হতে হয়। এমনকি শুখা মরসুমেও নাকি এই ঝর্ণায় জলের অভাব হয় না। যে জল এসে পতিত হয় অতিথি নিবাসের পাশে ছোট্ট কুন্ডীতে। অথচ ছোটনাগপুর রেঞ্জের এই অঞ্চলগুলোতে গ্রীষ্মকালে জলশূন্য থাকারই কথা। গতকাল দুপুরে অচেনা অদেখা ছোট্ট কুন্ডীটি দেখে আলাদাভাবে তেমন আকর্ষণ না হলেও এক্ষণে রক্তিমদেবের হালকা কিরণে অবিশ্রান্ত গতিতে বয়ে চলা কুন্ডীটির মোহময়তা এক অনির্বচনীয় অনুভূতি সৃষ্টি করল। অস্বীকার করব না যে জঙ্গলে এসেছিলাম বন্যপ্রাণীদের প্রত্যক্ষ করতে। কিন্তু প্রকৃতিকে যে এভাবে হৃদয়ঙ্গম করার অনুভূতি তৈরি হবে তা কল্পনায়ও আসেনি।
কুন্ডী শব্দটির প্রতি পাঠককুলের আগ্রহ জন্মাতে পারে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে ঘাটশিলা যাপনকালে শ্রদ্ধেয় কথা সাহিত্যিক বিভূতি ভূষণ বন্দোপাধ্যায় হ্রদের মতো অতটা বড় নয় কিন্তু তুলনায় ছোটোও নয় এমন জলাশয়কে স্থানীয়দের কথ্য ভাষা অনুযায়ী কুন্ডী বলে পরিচয় করিয়েছেন। অঞ্চলটি যেহেতু একই ভৌগোলিক সীমার মধ্যে অবস্থিত কাজেই শ্রদ্ধেয় কথাসাহিত্যিকের সূত্র ধরে জলাশয়টিকে কুন্ডী বলে উল্লেখ করেছি।কুন্ডীর পাশে কতক্ষণ এভাবে বসে ছিলাম ঠিক খেয়াল ছিল না, এমন সময় দেখি বাবাই মায়ের সঙ্গে আমার পাশে চলে এসেছে। সকালের ব্রেকফাস্ট তৈরি হয়ে গেছে। সকলে আমার জন্য অপেক্ষা করছে। এক্ষণে আমার প্রকৃতিপাঠে ইতি ঘটলো। চা-জলখাবারের পর্ব সাঙ্গ করে এবার আমরা সকলে দল বেঁধে আরেকটু জঙ্গলের মধ্যে হাঁটাহাঁটি করতে লাগলাম।
গতকাল শুনেছিলাম অতিথি নিবাস থেকে বেশ কিছুটা দূরে একটু উঁচু টিলার উপর থেকে নাকি সামান্য নেট সংযোগ পাওয়া যায়। জঙ্গলের মধ্যে টেলিযোগাযোগ! শুনে অবাক হলাম। আগ্রহবশত উদ্দিষ্ট স্থানের উদ্দেশ্যে হাঁটা শুরু করলাম। চারিদিকে শাল-পিয়ালের জঙ্গল, মধ্য দিয়ে শুকনো পাতায় মচমচ শব্দে হাঁটতে হাঁটতে আমরা ক্রমশ এগিয়ে চলি। কিছুটা এগিয়ে যেতেই পিছন থেকে তেমন কোন শব্দ না পেয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখি দলের বেশির ভাগ সদস্য অনেকটাই পিছনে পড়ে গেছে। কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে পড়তেই ওনারা পাল্টা হাত ইশারা করে ডাকতেই বুঝলাম যে প্রকৃতি প্রেমীদের আগ্রহ হারিয়ে গেছে।।নাহা এ যাত্রায় আমার আর নেটওয়ার্কের সন্ধানে জঙ্গল সাফারি করার আর সম্ভব হলো না। কিছুটা বিষন্ন বদনে পশ্চাদমুখী হতে বাধ্য হলাম। বেশ কিছুক্ষণ হাঁটার পর অতিথি নিবাসের সামনে গতকাল আমাদের ছেড়ে চলে যাওয়া সুমো গাড়িটিকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে হৃদয়ে যেন ভায়োলিনের করুন সুরে বিষন্নতায় ভরে গেল।গত কয়েক দিনের সফর শেষ করে এবার আমাদের সত্যিকারের ঘরে ফেরার বাদ্যি বাজলো। আমরা আর সময় ব্যয় না করে তৈরি হতে লাগলাম। আনুমানিক সকাল সাড়ে দশটা নাগাদ রাজদেওড়ার জঙ্গলকে বিদায় জানিয়ে আমরা রওয়ানা দিলাম আমাদের শেষ আকর্ষণীয় স্থান রাঁচির হুড্রু ফলসের উদ্দেশ্য। উল্লেখ্য সেদিন রাত নয়টার রাঁচি স্টেশন থেকে আমাদের ফেরার ট্রেন।মাঝে দশ/এগারো ঘণ্টার বেশ কিছুটা সময় আমাদের হুড্রু ফলসে কাটাতে হবে।
জঙ্গল থেকে বেরিয়ে নেট সংযোগ পেতেই গুগল সার্চ করে জানলাম হুড্রু ফলসের দূরত্ব 110 কিমি। চারলেনের হাজারীবাগ-রাঁচি হাইরোডে গাড়ি ছুটতে থাকলো দুর্বার গতিতে। জায়গায় জায়গায় নির্মীয়মানের কারণে নো এন্ট্রি করে দুই লেন হওয়াতেও গাড়ির গতির বিশেষ হেরফের অনুভব করলাম না। মাঝে একবার পাম্প থেকে তেল ভরা ছাড়া গাড়ি ছুটতে থাকে ঝড়ের গতিতে। দুপুর সাড়ে বারোটায় কোন একটি স্থানে হঠাৎ গাড়িটি বেগ কমাতে দেখি একটা পাঞ্জাবি ধাবার সামনে আমরা চলে এসেছি। অবশ্য চালককে আগে থেকে তেমনই নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। কমবেশি ফ্রেশ হয়ে বসতেই কিছুক্ষণের মধ্যেই দেখি টেবিলে আমাদের পছন্দ মতো নিরামিষ খাবার চলে এসেছে।পরম তৃপ্তিতে মধ্যপ্রদেশ শান্ত করে আবার আমরা গাড়িতে চাপলাম। এবার মিনিট চল্লিশের মধ্যেই আমরা পৌঁছে যায় আমাদের ট্যুরের অন্তিম আকর্ষণীয় স্পট হুড্রু ফলসের সামনে।
ফলসের সামনে গিয়ে বাস্তবে যেন আমি মুখের কথা হারিয়ে ফেললাম। এমন নয়নাভিরাম সৌন্দর্যে এক অনুপম আনন্দে যেন আত্মহারা হয়ে যাই। কি অসম্ভব ক্ষিপ্রতায় সুবর্ণরেখার জলরাশি ছোট-বড় বিভিন্ন আকারের বোল্ডারের গা ঘেঁষে নিম্নদেশে আঁছড়ে পড়ছে।আর তার-ই গুরুগম্ভীর শব্দ যেন ছন্দময় ভাবে কোন এক শিল্পীর নিরবচ্ছিন্ন সুরের মূর্ছনা সৃষ্টি করেছে। স্থানীয় নিরাপত্তারক্ষীদের নির্দেশে এখানে দাঁড়িয়ে বেশিক্ষণ প্রকৃতি নিরীক্ষণ সম্ভব হলো না। গাড়ি পার্কিং ও নির্দিষ্ট প্রবেশমূল্য দিয়ে আমরা ঝাড়খন্ড রাজ্য সরকারের তৈরি সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামতে শুরু করি। শুরুতেই দেখি বড় বড় করে সিঁড়ির সংখ্যা সাড়ে সাতশ উল্লেখ করা আছে। নিচে নামার রাস্তাটা একটু আঁকাবাঁকা প্রকৃতির। স্বভাবতই নিচে নামতে কারো কোনো সমস্যা না হওয়ারই কথা। যেমন সমস্যা আমাদেরও হয়নি। কিন্তু পাশ দিয়ে যারা উপরে উঠছেন তাদের ঘর্মাক্ত ও শ্বাসকষ্টের সমস্যা দেখে আমরাও বেশ চিন্তিত হয়ে পড়ি। না জানি আমাদের কপালেই বা কি দুঃখ লেখা আছে। আকারে অনেকটা বড় পাতিলেবুর শরবতের দোকান দেখলাম। একজনকে জিজ্ঞেস করাতে বলল দেহাতি লেবু। দশটাকা গ্লাস প্রতি হিসেবে বড়ো করে লেখাটাও চোখে পড়লো। মূলত যারা ফলস দর্শন করে উপরে উঠছে তারাই জায়গায় জায়গায় ব্রেক করে শরবত খেয়ে কিছুটা বিশ্রাম নিচ্ছে। আমারও ইচ্ছে হলো একগ্লাস দেহাতি লেবুর শরবত খাই। ইচ্ছা প্রকাশ করায় সকলে রাজি হয়ে গেল। ঠান্ডা জলের সুমিষ্ট শরবত খেয়ে ভিতরটা একেবারে শীতল হয়ে গেল। আমরা দ্রুত নিচের দিকে পা বাড়ালাম। কোন এক সময় আমরা ফলসের নিচে নামতে সমর্থ হই।
সিঁড়ির শেষ প্রান্তে একটি পরিচিত উগ্র গন্ধে গা গুলিয়ে উঠলো। গন্ধটির উৎস খুঁজতে আশপাশে তাকিয়ে দেখি পাশাপাশি তিনটি ঘুমটি ঘর অবস্থিত। তাদের মধ্যে একটির সামনে পাঁচ/সাতজন প্রান্তিক লোকের কেমন সন্দেহভাজন চাহনি। আরও একটু চোখ উঁচু করতেই দেখি ভিতরে ইঁটের উপর বসে এক মহিলা হাঁড়িয়া বিক্রি করছে। দ্বিতীয়বার আর ওদিকে না দেখে একটু টেনে পা চালালাম। এবার আমরা একেবারে ফলসের প্রান্ত দেশে চলে আসি। আগে যাকে উপর থেকে দেখছিলাম এখন বাস্তবে ফলসের সেই গর্ভাস্থানে পৌঁছে মনের সাময়িক বিষন্নতা কেটে গেল। উপর থেকে সুতীব্র গতিতে জলরাশি আঁছড়ে পড়ছে নিচে। তা থেকে সৃষ্ট অসংখ্য জলবিন্দু মেঘের ন্যায় ভেসে বেড়াচ্ছে চতুর্দিকের বাতাসে। স্থানটির তাপমাত্রাও যে কারণে উপর থেকে দুই-এক ডিগ্রি কম বলে মনে হলো। পাশাপাশি উচ্চ গতিতে জলরাশি আঁছড়ে পড়ায় সৃষ্ট হওয়া ফেনিল জলরাশি বহুদূর পর্যন্ত প্রভাবিত জলভাগকে রুপোলি পর্দায় যেন মুড়ে রেখেছে। ছোট-বড় উপস্থিত সকলেই যেন বয়সের ব্যবধান ভুলে এক অনুপম সৌন্দর্য উপভোগে মেতে উঠেছে। এমন স্থানের ফটো না তুলে থাকি কি করে? পাশাপাশি এমন জনাকীর্ণ স্থানে আমার মধ্যযুগীয় ক্যামেরাটি সাধারণত: বার করি না। কিন্তু লোভ সংবরণ করতে না পেরে ফটাফট কিছু ফ্ল্যাশের ঝলকানিতে মেতে উঠলাম। একসময় নিজেই লজ্জা পেয়ে ক্যামেরাটি বাক্সবন্দি করে হাতের স্মার্টফোন নিয়ে বাকি কাজ সমাধা করি। এভাবেই কয়েকঘন্টার যে কিভাবে কেটে গেল তার আর খেয়াল ছিল না। সম্বিৎ ফেরে যখন ততক্ষনে দেখি ঘড়ির কাঁটা সাড়ে চারটার কাছাকাছি পৌঁছে গেছে।
আর সময় দেওয়া সমীচীন হবে না ভেবে তাড়াতাড়ি সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে পড়ি।কারণ রাঁচি স্টেশনে আমাদেরকে সাড়ে ছটা থেকে সাতটা নাগাদ পৌঁছানোর পরিকল্পনা ছিল। মাঝে উপরে উঠতে প্রতিকূলতার সঙ্গে সাড়ে সাতশ সিঁড়ি পেরোতে হবে।উপরে উঠতে গিয়ে তিনটি স্থানে আমরা আর দশ মিনিট করে বিশ্রাম নিয়ে প্রায় এক ঘণ্টার মধ্যে আমরা উপরে উঠে আসি।পথিমধ্যে আরো একবার দেহাতি লেবুর শরবত খেয়ে শেষবারের মতো আরও একবার অপার তৃপ্তি অনুভব করি।
উপরে উঠে ফলসের জলরাশি যে স্থান থেকে নিচে পড়ছে সেই স্থানের উদ্দেশে পা বাড়ালাম। এই স্থানটি দেখার প্রতি আমার তেমন আগ্রহ ছিল না। সকলের চাপাচাপিতে একসময় মত বদলাতে বাধ্য হই।ছোট-বড় বোল্ডারের উপরে অতি সন্তর্পনে পা ফেলে কোনোক্রমে শরীরের ভারসাম্য বজায় রেখে এগোতে থাকি।শুরুতে একটু অসুবিধা হলেও পরের দিকে অবশ্য কিছুটা স্বাভাবিকত্ব ফিরে পাই। কিন্তু লক্ষ্যে পৌঁছে আমরা অবাক হই।ভালোলাগার এক আশ্চর্য মুহূর্তের সাক্ষী থাকতে পেরে আমরা নিজেরা নিজেদেরকে ধন্যবাদ দিতে থাকি। সুবর্ণরেখার জল তিন দিক থেকে তিনটি ভাগে ভাগ হয়ে ক্ষিপ্র গতিতে ধাবমান হয়ে ত্রিবেণী সঙ্গমে মিলিত হয়েছে। আর যে স্থানটিতে আছড়ে পড়ছে সেই স্থানটিকে তো আমরা একটু আগে প্রত্যক্ষ করেই এলাম। তখন আমরা আর এক প্রস্থ ফটোশুটে ব্যস্ত, এমন সময় একটা হুলুস্থুল শুনি, কিছু লোক আমাদেরকে ইশারা করে ওখান থেকে দ্রুত চলে যেতে বলছে। পাহাড়ে হড়কা বানের আগমন ঘটতে পারে শুনে অন্যান্য পর্যটকদের মতই আমরাও পড়িমড়ি করে ছুট লাগালাম।বাচ্চা সঙ্গে থাকায় ঠিকমতো স্টেপিং করতে না পারায় দু দুবার পড়ে যেতে যেতে অল্পের জন্য রক্ষা পেলাম। অবশেষে নিরাপদ দূরত্বে পৌঁছে হাঁপাতে হাঁপাতে পিছন ফিরে দেখি স্থানীয় লোকগুলি সকলে মিলে হাসিতে মেতে উঠেছে। এদিকে আমাদের বরাদ্দ সময় ততক্ষনে এক ঘণ্টা পার হয়ে গেছে। আর কালবিলম্ব না করে সঙ্গে সঙ্গে গাড়িতে চেপে বসলাম। সাড়ে সাতটার মধ্যে আমরা রাঁচি স্টেশনে পৌঁছে যাই।
হুডু ফলসের কিছু ছবি:-
আপার ফলসের কয়েকটি মুহূর্ত:-
ক্লান্ত পথিকবর:-
রাজদেওড়ার জঙ্গলে (পর্ব-৬)
সর্বশেষ এডিট : ০৫ ই মে, ২০২০ সকাল ৮:১৪