রাজদেওড়ার জঙ্গলে (পর্ব-৫)
হাজারীবাগের 'মনোকামনা' হোটেলে পরপর দুই রাত কাটিয়ে তৃতীয় দিন সকাল ন'টায় আমরা বেরিয়ে পড়ি ট্যুরের সবচেয়ে আকর্ষণীয় রাজদেওড়ার জঙ্গলের উদ্দেশ্যে,যার পোশাকি নাম হাজারীবাগ ওয়াইল্ডলাইফ স্যাংচুয়ারি। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে প্রকৃতির সান্নিধ্য থেকে রাজদেওড়ার জঙ্গলে নিশি যাপনের সৌভাগ্য হবে কিনা সে বিষয়ে ট্যুরের শুরুতে আমরা যথেষ্ট সংশয়ে ছিলাম।(স্থানটির মহত্ব আমাদের কাছে অন্য একটি কারণে গুরুত্বপূর্ণ যেটি মূল পোষ্টের শেষে উল্লেখ করবো বলে ইচ্ছা আছে)। যাইহোক সরকারি বিধি-নিষেধের সমস্ত পর্ব অতিক্রম করে অবশেষে সুযোগ মিলতেই শুরু হলো এক অজানা আশঙ্কার প্রহর। একইসঙ্গে অদ্ভুত এক অ্যাডভেঞ্চারের হাতছানিও মনের মধ্যে সমানে দোলায়িত হতে থাকে। যদিও পরক্ষণেই আশঙ্কাকে ঢেকে দিয়ে প্রতীক্ষিত স্বপ্ন বাস্তবে প্রতিফলিত হাওয়াই এক পরিতৃপ্তি মনো রাজ্যকে আবিষ্ট করে ফেলে। ছোটনাগপুরের এক বিস্তীর্ণ খনি অঞ্চলের মধ্যে বিবদমান জঙ্গলের একটি অংশ রাজদেওড়ার জঙ্গল। এই অংশে জঙ্গলের পরিশীলতা180 কিমির অধিক হবে। অথচ আমরা যেখানে রাত্রি বাস করবো, সেই বনবাংলোটি জঙ্গলের মূল ফটক থেকে দশকিমি অভ্যন্তরে অবস্থিত। উল্লেখ্য বন্যপ্রাণীদের বিরক্ত না করতে বা তাদের হাত থেকে টুরিস্টদের নিরাপদে রাখতে সরকারি বিধি নিষেধ অমান্য করে আরো গহীন জঙ্গলে প্রবেশ দণ্ডনীয় অপরাধ।
আগেও উল্লেখ করেছি, জঙ্গলে নিশিযাপন করার পদ্ধতিটি খুব সহজ নয়; যথেষ্ট কাঠ-খড় পুড়িয়ে তবেই অনুমতি পাওয়া সম্ভব। অনুমতি নিতে হয় শহরের মধ্যস্থলে অবস্থিত ঝাড়খন্ড বনদপ্তরের আঞ্চলিক অফিস থেকে। অনেকেই শুনলে অবাক হবেন যে আজকের ডিজিটাল যুগেও অনলাইনে এমন অনুমতি পত্র সংগ্রহের সুযোগ নেই। যে কারণে আমাদেরও শহরে হাজিরা দিয়ে তবেই অনুমতি পত্র সংগ্রহ করতে হয়েছিল। জঙ্গলে প্রবেশের আগে আমাদের যথেষ্ট হোমওয়ার্ক করতে হয়।জঙ্গলের মধ্যে কোন টেলিযোগাযোগ ব্যবস্থা বা নেটওয়ার্ক না থাকায় সভ্য সমাজের সঙ্গে যোগাযোগ কার্যত অসম্ভব। এ কারণে আমরা প্রবেশের আগে যতটা সম্ভব আপনজনদের সঙ্গে যোগাযোগ পর্ব সেরে নিয়েছিলাম। গোটা একটা দিন থাকার পরিকল্পনা থাকায় জঙ্গলে প্রবেশের আগে নিকটবর্তী ইসাক বাজার থেকে বাজার করে নিয়ে যেতে হয়েছিল। ভরসা ছিল বনবাংলোর কর্মীরাই নাকি আমাদের মত অতিথিদের রান্না পরিষেবা দিয়ে থাকে। সেই মতো হিসেব কষে আমরা আগের দিন প্রয়োজনীয় সংখ্যক ডিম চাল ডাল সবজি নিয়ে তৈরি হই। সবকিছু ঠিকঠাক চলছিল। কিন্তু বিপত্তি হলো মূল ফটকের সামনে এসে, মস্তবড় একটি তালা ঝোলানো দেখে গাড়ির স্টার্ট গেল বন্ধ হয়ে।একই সঙ্গে উচ্চস্বরে কান্নার আওয়াজ আমাদের আসন্ন অ্যাডভেঞ্চারের কল্পনার দোলানিতে ছেদ ঘটালো। আমার শ্রীমান উচ্চস্বরে কেঁদে কেঁদে বলতে লাগলো,
-আমি জঙ্গলে ঢুকবো না পাপা, আমি জঙ্গলে ঢুকবো না।
ওর মনোজগতের হঠাৎ পরিবর্তনে আমরা বিচলিত হয়ে পড়ি। বিভিন্ন ভাবে ওকে বোঝানোর চেষ্টা করলেও একই কথা বারবার বলতে থাকে। গেটের পাশেই প্রহরীর কোয়ার্টার । সামান্য ডাকাডাকিতে, কিছুক্ষণের মধ্যেই এক লম্বা চাবি নিয়ে সে গেট খুলে দিল। বাবাই তখনও সমানে কেঁদে চলেছে।ইতিমধ্যে পিছনে দুটি গাড়ি চলে আসাতে আমাদের গাড়ি ওদেরকে রাস্তা ক্লিয়ার করে দিল। আমার সহকর্মীরাও ওকে বিভিন্ন ভাবে বোঝাতে লাগলো। কিন্তু কোনভাবেই ওকে আশ্বস্ত করতে না পেরে এবার প্রকৃতির ডাকে সাড়া দেওয়ার কথা উল্লেখ করে ওকে গাড়ি থেকে নামতে বলি। বাধ্য ছেলের মত নেমে এলো আমার ডাকে। উপায়ন্তর না পেয়ে চালক গাড়িটিকে মূল ফটকের বাইরে এক পাশে দাঁড় করিয়ে রাখল। আমরা পিতা-পুত্র জঙ্গলের রাস্তা ধরে বেশ কিছুটা এগিয়ে গেলাম। চারিদিকে বিশুদ্ধ বাতাস সঙ্গে সবুজে সবুজারণ্য, মাঝে মাঝে বিভিন্ন রকম পাখির কুজন আশপাশের পরিবেশকে অসম্ভব মায়াবী করে তুললো। হাতের কাছেই একটি বনফুলের উপর একটি প্রজাপতিকে দেখে ওর দৃষ্টি আকর্ষণ করতেই,ও আগ্রহভরা দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলো। কিছুক্ষণ বাদে এক পা দুপা করে প্রজাপতির দিকে এগিয়ে গিয়ে ধরার চেষ্টা করতেই, প্রজাপতি দিল লম্বা ছুট। এক্ষেত্রে ব্যর্থ হলেও তাৎক্ষণিকভাবে হেসে ফেললো। এবার আমি ওর ভয় পাওয়ার কারণ জিজ্ঞাসা করতেই,
-মূল ফটকে ছবি দেওয়া, জঙ্গলের বসবাসরত বিভিন্ন প্রাণীর ছবি মূলত বাঘ ও সাপের ছবি দেখেই আমার ভয় করছে পাপা।
আমি সস্নেহে ওকে আবার দুবাহুতে জড়িয়ে ধরলাম। পিঠ চাপড়িয়ে আশ্বস্ত করলাম,
-তোমার কোন ভয় নেই বাবা। আমরা যেখানে থাকবো জায়গাটি একেবারেই নিরাপদ।
ও খুব জোরে ঘাড় কাত করে বলে উঠলো,
- আ্যা! ঠিক তো? কোন ভয় নেই তো?
আমি আবারও ওর পিঠে হাত দিয়ে আশ্বস্ত করি,
- না।তোমার কোন ভয় নেই বাবা। তুমি চোখ বুজিয়ে গাড়িতে উঠ, দেখো সবাই আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে। ওর হাত ধরে আমরা আবার গাড়ির দিকে এগিয়ে চললাম। আমাদের ফিরে আসতে দেখে, সবাই একসঙ্গে হেসে ওঠাতে ও লজ্জা পেয়ে গেলো। যাইহোক মেঘের বাঁধা কাটিয়ে উঠে আবার আমরা গাড়িতে উঠলাম। মূল ফটক অতিক্রম করে সাপের মতো আঁকাবাঁকা জায়গায় জায়গায় মোরাম বিছানো পাহাড়-জঙ্গলের রাস্তা ধরে গাড়িটি ক্রমশ এগিয়ে চললো।
বাবাইকে সাধ্যমত আশ্বাস দিয়ে গাড়িতে তুললেও অস্বীকার করব না যে একটা আশঙ্কা ইতিপূর্বে আমার মনোজগতে তৈরি হয়েছিল যেটা ইতিমধ্যে বেশ প্রকট আকার ধারণ করেছে। বাহ্যিক পরিবেশ যথেষ্ট আরামদায়ক হলেও আমার শিরায় প্রবাহিত ঠান্ডা স্রোত অদ্ভুত শীতলতায় আমার সর্বাঙ্গ কাঁপিয়ে তুলেছে। এমতাবস্থায় জঙ্গলে থাকার সিদ্ধান্তটি কতটা সুবিবেচনাপ্রসূত সে প্রশ্ন নিজের অন্তরেই নিরন্তর খুঁজতে থাকি। আমাদের গাড়ির চালক স্থানীয় হওয়ায় ও সাধ্যমত আমাদেরকে আশ্বস্ত করতে থাকে। ওর আপ্তবাক্যে আমাদের বিশেষ ভাবান্তর ঘটেছে এ কথা বলবো না। পাহাড়ি ঝর্ণার চড়াই-উৎরাই রাস্তা ধরে গাড়ি ক্রমশ এগিয়ে চলল। পথিমধ্যে কয়েকটি স্থানে রাস্তার অবস্থা অত্যন্ত ভয়াবহ। বুঝতে পারলাম দুদিকে পাহাড়ি খাল মাঝে বোল্ডার দেওয়া উঁচু-নিচু বোল্ডারের মধ্যে নুড়ি পাথরের তৈরি রাস্তার উপর যাওয়া রীতিমতো পাল্কি সদৃশ্য বলে মনে হলো। সমান রাস্তায় আমরা আবার দুপাশে গাছগাছালিতে চোখ রেখে চললাম। যদিও মাঝে মাঝে কিছু পাখি ও বাঁদরের নানান অঙ্গভঙ্গি ও কিচিরমিচির ছাড়া তেমন কিছুই চোখে পড়লো না।
হঠাৎ একটি স্থানে বেশ ঠান্ডা অনুভূত হলো। চালক এবার উচ্চস্বরে কথা না বলতে আমাদেরকে অনুরোধ করলো।আগেই উল্লেখ করেছি চারিদিকে শান্ত প্রকৃতির শাল-পিয়ালের জঙ্গলের অপার সৌন্দর্য উপভোগ করার মতো মন না থাকায় একপ্রকার নিষ্প্রভ ভাবে উপস্থিত সকল সদস্যের সঙ্গে নিশ্চুপ থাকলাম। এমন সময় আবার একটা পাহাড়ি ঝর্না চোখে পড়তেই চালক বলে উঠলো,
-এই স্থানগুলিতে হাতির পাল জল পান করতে আসে।
আমরা অপার কৌতূহলে স্থানটির দিকে তাকিয়ে রইলাম। নাহ! হাতি তো দূরের কথা একজোড়া পায়ের ছাপও পর্যন্ত চোখে পড়লো না। স্থানে স্থানে গাড়িটি অত্যন্ত ধীর গতিতে চলতে লাগলো। কখনো কখনো মনে হলো যেন আমরা চরকিতে দুলছি। এরই মাঝে কিছু পরিচিত পাখির ডাক কানে এলেও অপরিচিত কিছুটা ভারী শব্দ আমাদের মনের আতঙ্কের পরিবেশকে যেন কষাঘাত করতে লাগলো। মূল ফটকে দূরত্বটি দশকিমি লেখা থাকলেও বাস্তবে তথ্যটি সঠিক কিনা রীতিমতো সন্দেহ হতে লাগলো। রাস্তা যেন কিছুতেই শেষ হচ্ছিল না। মাঝে মাঝে কিছু নিম্ন স্থানে জলরাশিকে ইশারা করে ড্রাইভার জানালো,
-হাতির পাল সাধারণত ঝর্নার নিম্ন প্রবাহের স্থানগুলোতে জল খেতে আসে।
ওর বলার সঙ্গে সঙ্গে আমরা নয়ন ভরে স্থান গুলোর দিকে দেখতে থাকি।ও নিজেও নাকি একবার আমাদের মতো এরকম একটি দলের জঙ্গল সাফারির সময় হাতির দলের একেবারে সামনা সামনি পড়ে গিয়েছিল। সেদিন স্টার্ট বন্ধ করে চোখ বুঁজে বারেবারে ঈশ্বরের নামে জপ করে। খানিকবাদে চোখ খুলে দেখে হাতিগুলো একটু দূরে সরে গেছে। যদিও পরে কখনো এরকম ঘটনার প্রত্যক্ষ করতে হয়নি। যাইহোক মানসপটে ভীতির আবহ নিয়ে অবশেষে সকাল সোয়া দশটা নাগাদ আমরা গন্তব্যস্থলে পৌঁছে যায়।
জঙ্গলের মধ্যে পৌঁছে আমাদের আতঙ্ক অনেকটা দূর হয়।আশপাশের চার-পাঁচটি অতিথি নিবাস সহ একটি অফিসকক্ষ ও একটি ভিআইপি অতিথি নিবাস দেখে জঙ্গলটিকে আর জঙ্গল বলেই মনে হলো না।ইতিমধ্যে পৌঁছে যাওয়া আরও কিছু গাড়ি ও টুরিস্ট দেখে স্থানটিকে ছোটখাটো একটি পিকনিক স্পট বলেই মনে হলো। তাদের পাশ কাটিয়ে চালক আমাদেরকে অফিস কক্ষের সামনে নামিয়ে দিলো। অফিস কক্ষটি চারদিকে পরিখা পরিবেষ্টিত। আমরা সঙ্গের লটবহরকে নিয়ে পরিখা পার হয়ে অফিস কক্ষে প্রবেশ করি। আমাদেরকে বসিয়ে রেখে কেয়ারটেকার স্নান সেরে নিলেন। পরে আমাদের পরিচয় পত্র যাচাই করে চললেন সোজা রুমের উদ্দেশ্যে।
জঙ্গলে ঢোকার মূল ফটক:-
পরিখার উপর দিয়ে অফিস কক্ষে যাওয়ার রাস্তা:-
জঙ্গলের রাস্তা:-
ক্লান্ত পথিকবর:-
ঝর্ণার জলে সৃষ্ট জলাশয়ে বৈকালিক নৌকাবিহার:-
মানচিত্রে রাজদেওড়া জঙ্গল:-
তখন বিকেল বেলা হঠাৎ হাতির ডাক শুনতে পাই জঙ্গলের এই দিক থেকে।
রাজদেওড়ার জঙ্গলে (পর্ব-৩)