রাজদেওড়ার জঙ্গলে (পর্ব-৪)
অনেক খোঁজাখুঁজির পরও সেদিন ঘরের মধ্যে বা করিডোরে আমরা নীলাঞ্জনার হাতের পোলার রিংটি পেতে ব্যর্থ হই। স্বভাবতই দারুণ এক বিষন্নতা আমাদেরকে গ্রাস করে। সন্ধ্যের আসরে যেখানে জমিয়ে আড্ডা মারার কথা অথচ আমরা নিজের নিজের রুমে জড় পদার্থের মধ্যে বসে থাকি। অস্বীকার করব না যে এখানে আসার আগে মনে কতই না স্বপ্ন ছিল, একজন ব্লগার হওয়াই দারুণ দারুণ সব ঘটনার সাক্ষী হয়ে ব্লগে শেয়ার করবো। এমতাবস্থায় পরে কি হবে জানিনা তবে আপাতত স্বপ্নভঙ্গ হওয়ায় বিরস বদনে বসে রইলাম।
আপন মনে ভাবতে ভাবতে হঠাৎ মাথায় এলো স্থানটির আর্থ-সামাজিক অবস্থা তুলে ধরলে নেহাৎ মন্দ হয় না। ব্লগের কয়েকজন মান্যবর ভ্রমণের অভিজ্ঞতা বা রংবেরঙের ছবির চেয়ে ভ্রমণ স্থানের আর্থ-সামাজিক কাঠামো নিয়ে আলোচনা করতে বেশি পছন্দ করেন। সুতরাং ওনাদের কথা চিন্তা করে কিছু তথ্য দেওয়ার সামান্য চেষ্টা আরকি। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে গত দুদিন ধরে সমানে যেটা চোখে পড়েছে, মূলত কৃষিপ্রধান অঞ্চলটির বিস্তীর্ণ পতিত অনুর্বর জমি রাস্তার দুপাশে খাঁ খাঁ করছে। স্থানটিতে ভৌগোলিক কারণে শীতকাল কিছুটা এগিয়ে থাকায় পথিমধ্যে বেশ কিছু স্থানে শীতের সবজি ক্ষেতের দেখা পেলাম। রাস্তার দু'পাশে সারিবদ্ধ বাড়িগুলি বেশিরভাগই ঘুমটি ধরনের। অর্থনৈতিকভাবে তাদের নিম্নবিত্তের সাক্ষ্য বহন করছে। গ্রাম ছেড়ে একটু এগিয়ে গিয়ে শহরের মধ্যেও আর্থিক বৈষম্য তেমন চোখে পড়লো না। শহরে যত্রতত্র নোংরা আবর্জনার স্তুপের স্বমহিমায় বিরাজমান থেকে নগর কর্তৃপক্ষের অপদার্থতার ছাপ স্পষ্ট। একাধিক স্থানে বাড়ির সামনে গরু-ছাগলের সহাবস্থান চোখে পড়লো। পশুপালন ওখানে অন্যতম একটি জীবিকা। শহর কিংবা গ্রামের পিচ রাস্তার উপর গরুর পাল নিয়ে যাওয়ার দৃশ্য হামেশাই চোখে পড়েছে। এহেনো গোচারণ কালে কিছু বলদের গলায় হাঁটু সমান একটি করে বাশ ঝোলানো থেকেই দুষ্টু দমনের পরিচয় পেলাম। বিষয়টি আমার কাছে বেশ অভিনব লাগলো।
পাশাপাশি সহকারী জীবিকা হিসেবে হোটেল ও তার পার্শবর্তী অঞ্চলটিই আমার যুক্তিতে বিষয় নির্বাচনের আদর্শ স্থান বলে বিবেচিত হল। সকালে হোটেলের ঠান্ডা আচরণের কথা ইতিমধ্যে উল্লেখ করেছি। সে সময় মনে কৌতূহল তৈরি হয়েছিল এক প্রকার অতিথি শূন্য লাক্সারি হোটেলটির ব্যয়-নির্বাহ হয় কিভাবে সে কথা ভেবে। প্রথম দিন বিকালে ফিরে হোটেলটির সামনে সারিবদ্ধ ছোট-বড় বিভিন্ন আকারের গাড়ি ও বিভিন্ন বয়সের নারী পুরুষের সমাগম দেখে আমাদের মত ফ্যামিলিম্যানদের পক্ষে নিশিযাপন করা কতটা নিরাপদ সেকথা ভেবে রীতিমত শংকিত হয়ে পড়ি। গ্রাউন্ডফ্লোর থেকে দোতলার করিডোর পর্যন্ত সর্বত্র যেন বাতাসে মদের গন্ধ ম ম করতে লাগলো,যা কখনো কখনো ছোট-বড় বিভিন্ন ঢেউয়ের আকারে নাসারন্ধের দেওয়ালে ক্রমাগত ধাক্কা দিতে লাগলো। আমার শ্রীমান তো জিজ্ঞেস করেই বসলো,
-পাপা কি একটা বাজে গন্ধ তোমার নাকে আসছে?
সে সময় আমায় একটু হালকা ঠান্ডা লেগে ছিল। কাজেই নাকটা ঈষৎ টেনে নিয়ে হ্যাঁ না করতে করতে উত্তর দিলাম,
-আসলে ঠান্ডায় আমার একটা নাকটা এক প্রকার বন্ধ হয়েই আছে। যে কারণে ততটা গন্ধ পাচ্ছি না তবে উগ্র পারফিউমের সঙ্গে কি একটা নোংরা বস্তুর মিশ্রিত গন্ধ বাতাসে ভরে গেছে,বলে কোনোক্রমে বুঝিয়ে ওকে ঘরের ভিতরে নিয়ে আসি।
সেদিন হাজারীবাগ নবায়ন উদ্যান থেকে ফিরে শুরুতেই হোটেলে বৈকালিক জনসমাগম দেখে একটু অবাক হয়েছিলাম কিন্তু সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠে যখন আবিষ্কার করি যে পার্শ্ববর্তী বন্ধ রুমগুলো থেকে আলোকরশ্মি উঁকি দিচ্ছে তখন হোটেলের আয়ের উৎস রহস্য সম্পর্কে এক প্রকার নিশ্চিত হই। আমার সহকর্মী রঘুদায়ের একটু ধূমপানের বাতিক আছে। এক সময় উনি দরজায় টোকা দিতেই সঙ্গ দিতে বেরিয়ে এলাম। করিডোরে দাঁড়িয়ে গল্প করতে করতে পার্শ্ববর্তী দুটি রুম থেকে দু'জন নারী পুরুষকে সপ্রতিভ ভাবে পাশ কাটিয়ে সিঁড়ি দিয়ে নিচে নেমে যাওয়ার মধ্য দিয়ে আমাদের ধারণা বদ্ধমূল হলো। যদিও সন্ধ্যের সঙ্গে সঙ্গে গোটা হোটেল থেকে এই কৃত্রিম ভিড় অদৃশ্য হয়ে যায়। কর্মচারীরা যে কারণে আমাদের মধ্যে পরিবার নয়, দু-এক ঘন্টার অতিথিদের আপ্যায়ন করতেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। যাইহোক সন্ধ্যায় জনশূন্য হোটেলটিতে আমরা অনেকটা নিরাপদ অনুভব করি।
ভ্রমণকাহিনীর নামে একটি গুগলি কাহিনী তৈরি করে মনে মনে কিছুটা আত্মতৃপ্ত অনুভব করে বালিশে সবে হালকা মাথা গুঁজে দিয়েছি এমন সময় বাইরে দরজায় খটখট শব্দ পেলাম। দরজা খুলতেই,
- মামা তোমাদের সবাইকে আমার মা রঘু আঙ্কেলের ঘরে চা খেতে ডাকছে, এক নিঃশ্বাসে কথাটি বলে নীলাঞ্জনার পুত্র নীলাঞ্চ অদৃশ্য হয়ে গেল।
পরিস্থিতির গুরুত্ব উপলব্ধি করে আমার শ্রীমান এতক্ষণ বদ্ধ ঘরে নিজেকে আটকে রেখে সংযমের পরিচয় দিলেও নীলাঞ্চর ডাকে সারাদিনই তড়াৎ করে উঠে পড়লো। অল্প সময়ের মধ্যে নিজেদেরকে তৈরি করে আমরা রঘুদার রুমের উদ্দেশ্যে পা বাড়ালাম। চায়ের পেয়ালায় চুমুক দিতে দিতে আমরা যে যার হাতের ফোনে সারাদিনের ফটোগুলি উল্টেপাল্টে দেখতে লাগলাম। উদ্দেশ্যে ছিল নীলাঞ্জনার হাতের পোলায় সর্বশেষ কখন সোনার রিংটি দেখা গেছে সেটি খুঁজে বার করার। রঘুদাই প্রথম বিষয়টি তুলে ধরল যে ক্যানারি হিলসের সব ছবিতে এবং হাজারীবাগ নবায়ন উদ্যানের প্রথম দিকের ছবিগুলিতে পোলায় হলুদ দাগ থাকলেও শেষ দিকের ছবিগুলিতে হলুদ দাগ অনুপস্থিত। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে সেদিন দুপুরবেলা যখন আমরা উদ্যান ছেড়ে চলে আসি সেদিন এক পশলা বৃষ্টি আমাদের ভ্রমণে যথেষ্ট বাঁধা দিয়েছিল। হালকা বৃষ্টি তার উপরে প্যাচপ্যাচে কাঁদা হওয়ার আশঙ্কায় সেদিন নবায়ন উদ্যানে সময় কাটানোটা আমাদের কাছে যৌক্তিক বলে মনে হয়নি। এক্ষণে উদ্যানের শেষ ফটোগুলিতে নীলাঞ্জনার হাতের পোলায় হলুদ রিং না থাকায় এক প্রকার নিশ্চিত হই যে রিংটি তাহলে উদ্যানের কোথাও পড়ে গিয়ে থাকবে। দুটো সম্ভাবনা তৈরি হলো। এক-রিংটি গাড়িতে পড়তে পারে। দুই-পার্কেও পড়তে পারে। এমতাবস্থায় পরের দিনের কর্মসূচিতে শহরের উপকণ্ঠে অবস্থিত ঝাড়খণ্ড ট্যুরিজম ডেভলপমেন্টের অফিস থেকে হাজারীবাগ ন্যাশনাল পার্কে নিশিযাপনের অনুমতি আদায় করতে যাওয়ার সঙ্গে নতুন করে পার্কে রিং খোঁজা অন্তর্ভুক্ত হলো।
পূর্ব পরিকল্পনা মতো পরের দিন সকালে প্রাতরাশ করে আমরা গন্তব্যস্থলের উদ্দেশ্যে রওনা দিই। কিন্তু শেষ মুহূর্তে আমি পড়ি বেশ একটা বিরম্বনায়। এদিকে ততক্ষণে দলের সকল সদস্যবৃন্দ রাস্তায় গিয়ে অপেক্ষারত। রুম লক করতে গিয়ে বারেবারে চেষ্টা করেও ব্যর্থ হই। নিচ থেকে গিন্নির ক্রমাগত ফোন আসতে থাকে। এই যাই সেই যাই বললেও নিজেকে সম্পূর্ণ করতে ব্যর্থ হই। যথেষ্ট চাপে পড়ে রীতিমত ঘামতে থাকি। পকেটের ফোনটি ক্রমাগত রিং হতে লাগলো। আমি ফোন রিসিভের কোন যৌক্তিকতা খুঁজে না পেয়ে চেষ্টার অব্যাহত রাখলাম। একসময় গোটা লকটি দু টুকরো হয়ে খন্ডাংশ আমার হাতের মুঠোয় চলে এলো। আশপাশে চোখ বুলিয়ে দেখে নিলাম কোন সিসিটিভি আছে কিনা। নাহা! কোন সিসিটিভি না থাকায় কিছুটা স্বস্তি পেলাম। এবার লকটি পূর্বাবস্থায় কোনোক্রমে সেট করে নিচে নেমে আসি। ফোনে না পেয়ে অবশেষে সামনে পেতেই গিন্নি অগ্ন্যুৎপাত শুরু করলো। এই একটি ক্ষেত্রেই নিন্দুকেরা যাই ভাবুক আমি নিজেকে সক্রেটিস ভাবি। ওনার স্ত্রীও অগ্নুৎপাত করে ওনাকে টলাতে না পারলে মাথায় বালতি করে জল ঢেলে দিতেন। দার্শনিকের অবশ্য সরল স্বীকারোক্তি, জানি মেঘ গর্জনের পর বর্ষা হয়। যাইহোক শ্রীমতি ভয়ঙ্করের অগ্নি বর্ষণ একসময় বন্ধ হলে আমরা সকলে গাড়িতে চেপে বসি। গোটা রাস্তা মাথার মধ্যে ঘুরপাক খেতে থাকে ভাঙ্গা লকের কারণে ঘরটি উন্মুক্ত অবস্থায় রাখার জন্য।
নিজের অস্থিরতার কথা গোপন করে দলের শিশু ও মহিলা সদস্যদের সঙ্গে নিয়ে প্রবেশ করি উদ্যানের ভিতরে, উদ্দেশ্য নীলাঞ্জনার পোলার রিংটি পাওয়ার একটা ক্ষীন প্রচেষ্টা করা। দলের অন্য দুই পুরুষ সদস্য পূর্বেই উল্লেখিত রাজদেওড়ার জঙ্গলে বা হাজারীবাগ ন্যাশনাল পার্কে নিশিযাপনে সরকারি অনুমতি লাভের উদ্দ্যেশ্যে শহরে অবস্থিত ঝাড়খণ্ড ট্যুরিজম ডেভলপমেন্টের অফিসের উদ্দেশ্যে রওনা দেয়।
পার্কে দর্শন কাল সকাল দশটা দেওয়া থাকলেও স্টাফদের এসে মূল ফটো খুলতে আরও মিনিট দশেক লেগে যায়। মোটামুটি দশটা পনেরো কুড়ির মধ্যে আমরা পার্কে প্রবেশ করি। কোন প্ল্যান না করে আমরা যে যার মত বিচ্ছিন্নভাবে পায়ের দিকে চোখ রেখে রিংটি খুঁজতে থাকি। দলের কনিষ্ঠ সদস্যরাও বড়দের মতো একেকটা লাইন ধরে খুঁজতে থাকে।মিনিট পনেরো তখন হয়নি হঠাৎ দূর থেকে একসঙ্গে তিনটি বাচ্চার চিৎকারে তাকিয়ে দেখি, হাতে রিংটি উঁচু করে যুদ্ধ বিজয়ের হাসি হাসছে নীলাঞ্জনার পুত্র নীলাঞ্চ। মায়ের রিংটি খুঁজে পেতেই স্বভাবতই সে বিজয় উল্লাসে ফেঁটে পড়লো। আমরা গিয়ে তার পিঠ চাপড়িয়ে বাহবা দিতে লাগলাম। উল্লেখ্য এই স্থানেই বাচ্চাদের সঙ্গে গতকাল নীলাঞ্জনাও দোলনায় বসে দোল খেয়েছিল। দোল খেতে গিয়ে কোনভাবেই ধাক্কা লেগে পোলাটা বিচ্ছিন্ন হয়ে নিচে পড়তে পারে। রিংটি ফিরে পেতেই আমাদের উচ্ছাস তখনও কাটেনি। উল্লেখ্য সেদিন সন্ধ্যাবেলার টিফিন খরচটি নীলাঞ্জনার নিকট থেকে আদায় করতে পেরে আমরা রীতিমতো উচ্ছ্বসিত। এমন সময় দলের অন্যতম সদস্যা সুজাতা বৌদির (রঘুদার স্ত্রী) একটি ফোনে আমাদের যাবতীয় আনন্দের ছন্দ কেটে যায়। ফোনে কথা বলতে বলতে একটু দূরে গিয়ে বারকয়েক অ্যাঁ অ্যাঁ করে শব্দ করাতে বুঝতে পারলাম যে নিশ্চয়ই বড় কোন ধরনের একটা অঘটন ঘটেছে। । আমরা সকলেই উৎকন্ঠিত দৃষ্টিতে বৌদির দিকে তাকিয়ে রইলাম। এক সময় কথা বলা বন্ধ হলো। পায়ের দিকে তাকিয়ে কয়েক কদম হেঁটে বৌদি আমাদের পাশে চলে এসে অস্ফুটে বলল,
-আজ সকাল এগারোটায় শাশুড়ি মায়ের দেহান্তর ঘটেছে।
আমরা উপস্থিত সকলেই কার্যত বাকরুদ্ধ হয়ে গেলাম।আগে থেকে জানতাম উনি একটু অসুস্থ তাই বলে চিরদিনের জন্য চলে যাবেন এটি ছিল কল্পনাতীত। যাই হোক তাৎক্ষণিক করণীয় কি সেটা ঠিক বুঝে উঠতে পারলাম না। কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই ঘোর কেটে গেল। সকলে মিলে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললাম যে হোটেলে ফিরতে হবে। যেমন ভাবনা তেমনি কাজ।পার্ক থেকে বের হতেই একটি অটো পেয়ে গেলাম। অটোতে বসে হোটেলের পথে ফিরতে ফিরতে অটো ড্রাইভারকে দিয়ে একটি সুমো গাড়ি রিজার্ভ করা হয়। হিসাব মতো আড়াই ঘন্টা হাতে সময় আছে, একশো কুড়ি কিলোমিটার দূরে রাঁচি স্টেশন থেকে বিকাল 3:15 মিনিটের ট্রেনটি ধরলে হয়তো রঘুদা সপরিবারে মায়ের অন্তেষ্টিতে যোগ দিতে পারবে। আমরা সকলে হাত লাগিয়ে ওদের জিনিসপত্র গুছিয়ে দিয়ে গাড়িতে তুলে দেই।যদিও চিন্তায় ছিলাম মায়ের শেষ মুখ দেখতে পাবে কিনা...
ওরা চলে যেতেই আমরা খুব বিষণ্ণ হয়ে পড়ি। তিনটি পরিবারের তিনটি ছানা ছিল একটি চলে যেতেই বাকি দুটি খুব একাকিত্বের মধ্যে পড়ে। বয়সে একটু বড় হওয়ায় রঘুদার পুত্র গুঞ্জন বাকি দুটোকে আগলে রেখেছিল। কাজেই গুঞ্জনের সদ্য অনুপস্থিতিতে দুটো কচি কাঁচার বিষন্নতা ছিল চোখে পড়ার মতো। আমরা সাধ্যমতো ওদের নিঃসঙ্গতা দূর করার চেষ্টা করলাম। সেদিন সন্ধ্যাবেলায় হোটেলের উল্টোদিকে রেস্টুরেন্টে বসেই সময়টা কাটিয়ে দেই। রঘুদাকে ইতিমধ্যে বেশ কয়েকবার চেষ্টা করেও ফোনে না পেয়ে আরো বিমর্ষ হয়ে পড়ি। চলন্ত ট্রেনে নেটওয়ার্ক সমস্যা থাকায় টেলিযোগাযোগ সবসময় সম্ভব নয় বলে নিজেদেরকে সান্ত্বনা দিতে থাকি। রাত সাড়ে আটটা নাগাদ হঠাৎ ফোন আসাতে সর্বশেষ খবর পাওয়ার আশায় কিছুটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলি। কিন্তু নাহা! আমাদের সমস্ত জল্পনা-কল্পনা উল্টে দিয়ে জানালো যে ওরা এখন বাঁকুড়া স্টেশনে নেমে একটা মারুতি গাড়ি করে গ্রামের উদ্দেশ্যে রওনা দিচ্ছে। হিসাব অনুযায়ী বাড়ি পৌঁছাতে নাকি আরও এক ঘন্টা লাগবে। পরের খবরটি আমাদের আরো বিষন্নতায় ভরিয়ে দিল।বিকাল পাঁচটার সময় বড় দুই ভাই ও বাবার উপস্থিতিতে মায়ের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া সম্পন্ন হয়ে গেছে। স্টেশন থেকে গ্রামের বাড়িতে ফেরার গাড়িতে ওর সঙ্গে ওর ছোট দাদাও ছিলেন যিনিও ওর মতোই মায়ের অন্তেষ্টিতে যোগ দেওয়ার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। খবরটি পেয়ে মনের বিহ্বলতা আরো বেড়ে গেল। মনে হল শুধু রঘুদা একা নয় আমরাও যেন মায়ের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় যোগ দেয়ার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়েছি। ইতিমধ্যেই কোনোক্রমে রাতের খাবার খাওয়া হয়ে গেছিল। চূড়ান্ত অস্বস্তির মধ্যে কোনক্রমে দলের বাকি সদস্যদের সঙ্গে নিয়ে রেস্টুরেন্ট থেকে বার হয়ে রাস্তা অতিক্রম করে হোটেলে চলে আসি। রুমের সামনে এসেই মনে পড়লো দিনের শুরুতে যে লকটি হাতলসহ ভেঙে যাওয়ায় কোনক্রমে গুঁজে চলে গেছিলাম। সারাদিনে ব্যস্ততার কারণে তার কথা বেমালুম ভুলে গেছিলাম। লোকটির যথারীতি একি অবস্থায় আছে। এক্ষণে ভাঙা লকটি হাতে নিয়ে রিসিপশনে কমপ্লেন করি এবং এরকম অরক্ষিত অবস্থায় যদি কিছু মিসিং হয় তার ইঙ্গিত করতেই রিসেপশন থেকে তিন/চারজন কর্মচারী শশব্যস্ত হয়ে ছুটে এলো। প্রত্যেকেরই লক্ষ্য ছিল লকটিকে মেরামত করা। অবশেষে ব্যর্থ হয়ে রন ভঙ্গ দিয়ে শুরু করে দুঃখ প্রকাশের আদিখ্যেতা। যদিও মনে মনে আমি ওদের এরকম আচরণে বেশ স্বস্তি বোধ করি। যাই হোক রুমে ঢুকে পরের দিনের জন্য প্রস্তুতি নেই। কারণ আমাদের পরের দিনে যে রাজদেওড়ার জঙ্গলে নিশিযাপন করতে হবে।
তখনো আমরা একসঙ্গে:-
উপরের ছবিগুলো ইতিপূর্বে পরিচয় করানোই নতুন করে আর ক্যাপশন দেওয়ার প্রয়োজন বোধ করছি না।
রাজদেওড়ার জঙ্গলে আমাদের স্বাগতম জানাতে তৈরি:-
রাজদেওড়ার জঙ্গলে (পর্ব-২)
সর্বশেষ এডিট : ০৫ ই মে, ২০২০ সকাল ৮:৩৬