রাজ দেবনাথ জঙ্গলে (পর্ব-৩)
ক্যানারি হিলসের অপরূপ সৌন্দর্যে আমরা মোহিত হয়ে যায়। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য সেদিন যাত্রার শুরুতেই প্রথম সাইটসিনের গন্তব্যস্থল হিসেবে দূর থেকে দেখে যাকে নিতান্ত ধূসর পাহাড় বলে মনে হয়ে মনো রাজ্যে কিঞ্চিত বিরক্তি ও যথেষ্ট ম্যাড়মেড়ে মনে হয়েছিল। অথচ আঁকাবাঁকা পাহাড়ি রাস্তা দিয়ে যখন ক্রমশ উপরে উঠতে থাকি তখন মনে হলো প্রকৃতিদেবী যেন তাকে নানান অলংকারে সাজিয়ে অপরূপা সুন্দরী লাস্যময়ী রূপে গড়ে তুলেছেন। সেদিন আবহাওয়াটাও আমাদের মতো আনাড়িদের ট্র্যেকিংয়ের পক্ষে যথেষ্ট অনুকূলে ছিল। সকালে ২২/২৩ ডিগ্রি টেম্পারেচারেও অভিকর্ষের বিরুদ্ধে উপরে উঠতে আমাদের যথেষ্ট শ্বাসকষ্ট শুরু হতে লাগলো। আমরা প্রত্যেকেই যথেষ্ট সময় নিয়ে মাঝে মাঝে থেমে থেমে ক্রমশ এগিয়ে চললাম। যদিও সাময়িকভাবে পথিমধ্যে দু একটি স্থানে গো-বিষ্ঠার উপস্থিতি আমাদেরকে যথেষ্ট ভাবিত এবং সুখানুভূতিতে ছেদ ঘটিয়েছিল। যাইহোক এরমধ্যে সঙ্গে সমানে চলতে থাকল সঙ্গে নিয়ে আসা ক্যামেরার মুহুর্মুহু ফ্লাস বন্দী। বাচ্চারা অবশ্য আমাদের সঙ্গে ধীরগতিতে যেতে রাজি নয়। তারা আমাদেরকে ছেড়ে ততক্ষণে অনেক উপরে পৌঁছে গেছে। ওদের হাসির কলকাকলিই অচেনা পাহাড়ে প্রতিধ্বনিত হয়ে ওদের অবস্থান নির্দেশ করছিল। ক্রমশ একটার পর একটা ধাপ উপরে উঠতে উঠতে নাম না জানা হরেকরকমের ফুল, ছোট-বড় নানান গাছের সমারোহ এবং পাখির কলকাকলিতে এক নৈসর্গিক পরিবেশে আমাদের মনোজগতকে আনন্দ উদ্বেলিত করে তোলে।
ক্যানারি হিলসের সিঁড়িতে কোন একটি স্থানে কিছুটা শ্রান্ত হয়ে এক প্রকৃতি কন্যার সাক্ষাৎ পেয়ে স্নিগ্ধ নয়নে তার শোভা পরখ করছিলাম। হালকা বেগুনি কয়েকটি ফুলের উপস্থিতিতে প্রকৃতি কন্যা যেন নিজের অহংবোধ তুলে ধরেছিল। বাতাসের মৃদুমন্দ গতিতে ছান্দিক ভাবে দুলে দুলে সে অহংবোধ যেন ঠিকরে বেরোচ্ছিল। হঠাৎ পিছন থেকে হুস হুস শব্দের আগমনে কিঞ্চিত ঘাবড়ে গেলাম;ছেদ ঘটলো আমার কল্পনার জগতে। পিছনে তাকিয়ে দেখি পেল্লায় সাইজের একটি কৃষ্ণকায় ধেনুর পথ আগলে আমি বসে থাকায় রুষ্ট হয়ে ক্রমাগত মাথা দোলাচ্ছে। পারলে যেন এখনই শিং বাঁধিয়ে আমাকে ছুড়ে ফেলে পাহাড়ের পাদদেশে। আমি পড়িমড়ি করে সিঁড়ি থেকে একটু নিচে নেমে ওর রাস্তা করে দিলাম। আমার সম্মান প্রদর্শনে বোধহয় উনি খুব প্রসন্ন হলেন। আর হবেন নাই বা কেন, দেবতা বলে কথা! যাইহোক মহাশয়া উৎফুল্ল হয়ে ক্রমশ নিচে নামতে লাগলেন। আমি অবাক নয়নে ওনার পশ্চাৎ গমন নিরীক্ষণ করতে লাগলাম। গো-প্রজাতি যে ট্রেকিং করে সেটা আমার জানা ছিল না।এদিকে আমার সঙ্গী সাথীদের কোন সাড়াশব্দ আর না আসায় বেশ চিন্তিত হয়ে পড়লাম। নিজের অবস্থান উপলব্ধি করে বুঝলাম যে দলের মধ্যে আমি সবচেয়ে পিছিয়ে পড়েছি। এবার দ্রুত পা চালালাম। অবশেষে সোয়া এক ঘন্টায় আমি পাহাড়ের শিখরদেশে উঠতে সমর্থ হলাম। যদিও দলের বাকি সদস্যরা সকলেই ইতিপূর্বে উপরে পৌঁছে গেছে। জলের খোঁজ করে দেখলাম সঙ্গে আনা কারো বোতলেই সামান্য পরিমাণেও জল অবশিষ্ট নেই। কি আর করার! অগত্যা সকলের মাঝে বসে পড়লাম। তবে বসার স্থানটি নিঃসন্দেহে সুন্দর। দিগন্তবিস্তৃত সবুজ আর সবুজ। দূরে সাপের মতো আঁকাবাঁকা শহুরে রাস্তা। আর আমরা বসে আছি পাহাড়ের চূড়ায় মেঘের দেশে। নিজেকে সাময়িক মিথলজির দেবকুল বলে ভাবতে লাগলাম। সকলের মধ্যে হাসির রোল উঠে গেল।উপস্থিত সকলে আমার স্ত্রীকে পার্বতীর খেতাব দিল। কাজেই আমি হলাম দেবাদিদেব মহাদেব। কিছুক্ষণ পরেই আমাদের মর্তে নামার পালা। তবে সুখানুভূতি বেশিক্ষণ স্থায়ী হলো না। আশপাশের চোখ বুলিয়ে দেখলাম পলিউশন ক্যানারি হিলসের দেবভূমিতেও আছড়ে পড়েছে। বেশ কিছু দেওয়াল লিখনে, প্রেমের নিদর্শন স্বরূপ নব্য কপোত-কপোতিরা নিজেদের উপস্থিতির জানান দিয়ে গেছে। আরো একঘন্টা পরে আমরা এবার পদদেশে নামতে তৈরি হলাম।
হিলটপে বসার মঞ্চ নিয়ে অদ্ভুত একটি অনুভূতি হয়েছিল। পাঠকদের জ্ঞাতার্থে জানিয়ে রাখি, হিল টপের মঞ্চটাকে দূর থেকে মন্দিরের চূড়া বলেই মনে হয়েছিল। ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতায় দেখেছি ভারতবর্ষের বেশিরভাগ পাহাড়ের চূড়ায় কমবেশি মন্দিরের উপস্থিতি থাকায় ক্যানারি হিলসের চূড়াটিকেও আর পাঁচটা সাধারণ মন্দির বলেই আমার মনে হয়েছিল।মন্দির হলে সেখানে কিছু ফরমালিটিজ মেইনটেইন করতে হয়। ব্যক্তিগতভাবে সেগুলোতে আমার আপত্তি থাকায় আমি সাধারণত এসব ক্ষেত্র এড়িয়ে চলি। কিন্তু উপরে ওঠার পর ধারণা পাল্টে যায়। এক্ষণে মন্দিরের পরিবর্তে শুধুমাত্র একটি বেদি মঞ্চ দেখে প্রসন্ন হলাম। মন্দিরের পরিবর্তে শুধুমাত্র বসার মঞ্চের উপস্থিতির কারণ খুঁজতে লাগলাম। জানিনা হাজারীবাগের নৈসর্গিক পরিবেশে অবসর যাপনকালে কবিগুরু এই পাহাড়ের শিখর দেশে পদচারণা করেছিলেন বলেই হিল টপে কোন নির্দিষ্ট দেব মন্দির প্রতিষ্ঠিত না হয়ে অসাম্প্রদায়িক বেদী মঞ্চ তৈরি হয়েছে। বিষয়টি নিয়ে পরে হোটেলে এসে জিজ্ঞাসা করলেও যদিও কোনো সদুত্তর পাইনি।
পাহাড় থেকে নেমে আমাদের পরবর্তী গন্তব্যস্থল ছিল হাজারীবাগ ঝিল এবং তৎসন্নিহিত হাজারীবাগ নবায়ন উদ্যান। রাস্তাটি দু-আড়াই কিমির অধিক নয় বলে চালকের নিকট থেকে আগেই জেনেছিলাম। পথিমধ্যে তিন/চারটি ইংরেজি মাধ্যম স্কুলের উপস্থিতি চোখে পড়লো। রাস্তাটিও বেশ প্রশস্ত এবং ডেকোরেটেড।এখানেই প্রথম ট্রাফিক পুলিশকে যানবাহন নিয়ন্ত্রণ করতে দেখলাম। একটু দূরে পরপর সারিবদ্ধ ভাবে বেশ কয়েকটি বহুতল মাথা উঁচু করে যেন সম্মিলিতভাবে শহরের অভিজাত এলাকার সাক্ষ্য বহন করছিল। আরও কিছুক্ষণ পরে আমরা একসময় বহু প্রতীক্ষিত হাজারীবাগ ঝিলে পৌঁছে যায়। ঝিলের পাশেই রাস্তার উল্টো দিকে নবায়ন উদ্যানটি অবস্থিত।
পাশাপাশি অবস্থিত হলেও উভয়ের মধ্যে বিস্তর প্রভেদ বিদ্যমান। উদ্যানটি যতটাই কৃত্তিম, সাজানো-গোছানো, ঝিলটি ঠিক ততটাই প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর বলে অনুভূত হলো। প্রসস্থ ঝিলটি কোন একসময় সম্ভবত একটি বড় জলাশয় ছিল। পরে নগর কর্তৃপক্ষ সৌন্দর্যায়ন করে শহরের অন্যতম দর্শনীয় স্থানে পরিণত করেছেন। কংক্রিটের চাদর দিয়ে গোটা ঝিলের চারদিকে বাঁধানো। ক্লান্ত পথিকের অথবা প্রকৃতিপ্রেমীদের কাছে আরো উপভোগ্য করে গড়ে তুলতে স্থানে স্থানে বৃক্ষরোপণ করা আছে। আছে বসার সুন্দর বেদির ব্যবস্থাও। এহেন ঝিলের মৃদুমন্দ বাতাসে বৃক্ষতলে বসলে নিদ্রাদেবী নিঃসন্দেহে সাড়া দিতে বাধ্য। আমরাও বেশ কিছুক্ষণ বেদিতে বসে রইলাম। যতদূর দৃষ্টি যায় ঝিলের নীল জলরাশির উপর বিস্তৃত শাপলার উপস্থিতি যে তাকে আরো আকর্ষণীয় করে তুলেছে সে কথা বলাবাহুল্য। ঝিলের পাশে পিচের রাস্তা দিয়ে হেঁটে একটু এগিয়ে যেতেই হতোদ্যম হলাম।সদ্য নিরঞ্জন প্রতিমার কাঠামো ও বাসি পূজার উপকরণ ঝিলের হৃদয়ে শহরবাসীর কুঠারাঘাত বলে মনে হল। এতক্ষণে তৈরি হওয়া শহরবাসী সম্পর্কে উচ্চ ধারণা মুহূর্তে বিলীন হয়ে গেল। আর ঝিলের পিছনে সময় না দিয়ে কুড়ি টাকা করে জনপ্রতি টিকিট কেটে উল্টো দিকের উদ্যানে ঢুকে গেলাম।
উদ্যানে ঢুকেই একসঙ্গে একাধিক রাইডের সমাহারে আনন্দের আতিশয্যে বাচ্চাদের মধ্যে হুটোপুটি শুরু হলো।কে কোন রাইড দিয়ে যাত্রা শুরু করবে তা নিজেরাই স্থির করতে না পেরে তিন জন তিন দিকে ছুট লাগালো। আমরাও তৎক্ষণাৎ তিনটি দলে ভাগ হয়ে ওদেরকে অনুসরণ করতে লাগলাম। ফ্রি রাইড গুলো ছেড়ে দিয়ে বাচ্চারা একসময় পেইড রাইড চড়ার বায়না ধরলো। আমরা ওদের দাবি মেটাতে মনস্থির করলাম। সকাল থেকে প্রচুর হাটাহাটি পরিশ্রম হয়েছে। কাজেই নিজেদের মধ্যপ্রদেশে একটু চিনচিন ভাব অনুভূত হওয়ায় মায়েদেরকে ওখানে বসিয়ে দিয়ে আমরা চললাম একটু দূরে অবস্থিত স্টলে স্ন্যাকসের সন্ধানে। হালকা স্ন্যাক্স খেয়ে আমরা একটু রিলাক্স মুডে বসে রইলাম। ওদিকে কচিকাঁচারা মনের শান্তিতে সমস্ত রকম রাইড চড়া সম্পন্ন করে অবশেষে একসময় আমাদের কাছে ধরা দিল। আমরা আর কাল বিলম্ব না করে সঙ্গে সঙ্গে মধ্যাহ্নভোজের উদ্দেশ্যে অতিথি রেস্টুরেন্টের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিলাম।
সেদিন অতিথি রেস্টুরেন্টে ফিরে এসে আমরা বেশ বিপত্তির মধ্যে পড়ি। সকালে মধ্যাহ্নভোজের কথা বলে যাওয়ায় আমরা কিছুটা নিশ্চিন্ত ছিলাম। কিন্তু এসে শুনলাম তাদের রাইস শেষ। তলা কুড়ানো রাইস গুলো একত্রিত করে কোনোক্রমে তিন প্লেট হলো। অথচ আমরা মোট নয় জন। তবে ওদের অবশিষ্ট সব্জি যথেষ্ট থাকায় কোনোক্রমে নয় জনে ভাগ করে উদরপূর্তি করা হয়।সেদিন বিকালে আমরা আর কোথাও বার না হয়ে যে যার রুমে বিশ্রাম নেই। সন্ধ্যা বেলায় আবার আমরা আড্ডা দিতে সহকর্মী রঘুদার রুমে মিলিত হই। হঠাৎ আরেক সহকর্মী নীলাঞ্জনা লক্ষ্য করে যে তার ডান হাতের পোলার মাঝখানের জায়গাটা ফাঁকা।ঐ স্থানে বাঁধানে সোনার রিংটি অদৃশ্য। অথচ পোলাটি চৌদ্দ সালে দেশান্তরী হওয়া স্বর্গীয় বাবার দেওয়া শেষ উপহার। স্বভাবতই নীলাঞ্জনার চোখেমুখে দারুণ বিষন্নতা। আমরা তার মানসিকভাবে বিষণ্নতা কাটাতে আপ্রাণ চেষ্টা করি। বিভিন্ন ভাবে ওকে বোঝাতে থাকি। বিনিময়ে ওর মুখের শুকনো হাসি যে নিদারুণ কষ্টের তা আর বুঝতে বাকি রইলো না। পরে আমরা সকলে দলবেঁধে ওর রুমে গিয়ে তন্নতন্ন করে জিনিসটি খুঁজে খুঁজতে থাকি।
১-হাজারীবাগ ঝিল-
২- ঝিলের অন্য একটি দৃশ্য-
৩-
৪- ক্যানারি হিলসটপ
৫-পরপর কয়েকটি পাহাড়ি ফুল
মোবাইল ফোন থেকে তোলা কয়েকটি ছবি।
রাজদেওড়ার জঙ্গলে (পর্ব-১)
সর্বশেষ এডিট : ০৫ ই মে, ২০২০ সকাল ৮:৪০