ফ্রম সাতক্ষীরা টু বেলগাছিয়া (পর্ব-৪)
মাখালগাছা গ্রামের একজন মজার মানুষ হলেন মাহমুদ মুন্সি। এক বাক্যে সবাই তাকে মামু বলেই চেনেন। সাম্প্রতিককালে মানুষটা প্রমোশন পেয়ে মামু থেকে মামুচাচা'তে পরিণত হয়েছেন। যদিও এর পিছনে একটা মজার কাহিনী আছে। আসছি সে প্রসঙ্গে পরে। এহেন মামু কখনোই কারো কাজে না করেননা। জায়গা জমি সামান্য থাকলেও মামুর চাষবাসের প্রতি তেমন মন নেই। সারাবছরই কারো না কারোর বাড়িতে কোন না কোনো কাজ করে বেড়ান। মূলত বাঁশের দর্মা, বাঁশের চৌকির পাশাপাশি দু'চালা, চারচালা বা আটচালা জাতীয় বাঁশের চাল তৈরিতে তার জুড়ি মেলা ভার। মামুর চরিত্রের একটা বৈশিষ্ট্য হলো কখনোই মুখবুজে কাজ করতে পারেন না। গল্পবাগিশ হওয়াতে তার আশপাশে গল্প করার মতো লোকজনের অভাব হয়না। তাছাড়াও পরিচিত বা অপরিচিত যেই হোন মামুর সামনে দিয়ে যাবেন অথচ কথা বলবেন না, হতেই পারেনা। অপরিচিত মানুষের সঙ্গে মামুর কথা বলার ধরনটা বেশ মধুর। দূর থেকে এরকম কোন ব্যক্তিকে দেখলে সাধারণত গলা খাঁকারি দিয়ে জিজ্ঞেস করেন,
-মৌল্লার পো কৈ যাও?
অপরিচিত ব্যক্তি এদিকে ওদিকে তাকাতে থাকলে, মামু হাসিমুখে আবার বলেন,
-আরে ফালুকফুলুক কেন করো খুঁড়ো , তোমাকেই জিজ্ঞেস করেছি।
সে বেচারা তখন বাধ্য হয় মামুর সঙ্গে দাঁড়িয়ে দু-একটি কথা বলতে।পরে চলে গেলে মামু আমোদিত হন এবং উপস্থিত সকলেই বেশ মজা পান মামুর এমন রসালাপে। উল্লেখ্য এভাবে কত ব্যস্ত মানুষের গতি যে মামু কমিয়ে দিয়েছেন তার হিসেব নেই। যদিও মামু শুধু শুকনো মুখে কথা বলেন না। কখনো কখনোবা বিড়ি দিয়ে পথচলতি লোকের প্রতি সৌজন্য বিনিময় করেন। কেউ নেন কেউবা নেন না। মামুর এই আগবাড়িয়ে কথা বলার ধরনে হোক অথবা তার মধুর ব্যবহারের কারণেই হোক মিস্ত্রী হিসেবে আশপাশের গ্রামগুলোতে মামুর সুনাম সর্বজনবিদিত। এহেন মামু যে বাড়িতে কাজে যান সাময়িকভাবে সেখানে একটা জমজমাট আড্ডাখানা বানিয়ে ছাড়েন। গ্রামবাসীদের সঙ্গে রসালাপের মাধ্যমে একটা সুন্দর সম্পর্ক গড়ে তোলেন। কোথাও কোথাও আবার গ্রামবাসীরাও কম যান না।অনেকে মামুকে মজা করে বলেন,
-মামুর মতো বাঁশ দেওয়া লোক গ্রামে আর দ্বিতীয় নেই।
মামু খুশি হন। অনেকে এ কারণে তাকে 'বাঁশমামু' বলেও ডাকেন। প্রতিউত্তরে কিছুটা গর্বের সাথে মামু বলেন,
-উত্তরাধিকারসূত্রে তেমন কিছু না পেলেও লোককে বাঁশ দেওয়ার মহৎ গুণটি পেয়েছি। সুযোগ পেলে তার সদ্ব্যবহার করি আরকি।
মামুর এমন সরল স্বীকারোক্তিতে সকলে খুশি হন।
আসরে নতুন কেউ থাকলে আত্মপক্ষ সমর্থনে মামু একটা গল্প প্রায়ই বলেন,
-একবার এক গ্রামে এরকম কাজ করতে করতে এক বয়স্ক খুড়োর সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল।একেতো গরম কাল তার উপরে সেদিন প্রচন্ড গা ঝলসানো রৌদ্রে কিছুতেই কাজ করতে পারছিলাম না। ঘাম একেবারেই ছিল না ঠিকই কিন্তু মাঝে মাঝে এমন লু বয়ছিল যে কিছুতেই কাজে মন আসছিল না। বেশ কয়েকবার গামছা ভিজিয়ে গা ঠান্ডা রাখার চেষ্টা করলেও কিছুক্ষণের মধ্যেই তা আবার যা তাই, গামছা যাচ্ছিল শুকিয়ে। কোনো কিছুতেই স্বস্তি পাচ্ছিলাম না। এই অবস্থায় আমার গল্প করার খিদে যায় প্রচন্ড বেড়ে।এদিকে ওদিকে তাকিয়ে খুঁজতে থাকি গল্প করার মতো কেউ আশপাশে আছে কিনা। নাহা সেদিন এমন কাউকে পেলাম না।আর পাবোই বা কেমনে, এমন গরমে সাধারণত সবাই গাছ তলায় পুকুর পাড়ে বা অন্য কোথাও আশ্রয় নেয়। নিরাশ হয়ে ভাবতে ভাবতে একটা বিড়ি শেষ করে আবার একটা সবে ধরিয়েছি, এমন সময় দেখি এক খুঁড়ো কাঁধে মস্তবড় এক কোদাল নিয়ে দুর্বল শরীরটাকে কোনোক্রমে টানতে টানতে মুখ নিচু করে আপন মনে হেঁটে যাচ্ছে। কাছাকাছি আসতেই একটা গলা খাঁকারি দিয়ে জিজ্ঞেস করি,
-খুড়ো কই যাও?
কিছুটা থমকে,
- আমারে জিজ্ঞেস করলে?
-হ্যাঁ! তুমি ছাড়া এখানে আর কেই বা আছে?
- হু বাড়ি ফিরছি কাজ শেষে।
- এই বয়সেও কাজ! তা কি কাজ করো তুমি?
এবার মাজাটা(ঘাড়) সোজা করে গলাটা কিছুটা চড়িয়ে,
-খানা(গ্রামের জল সরবরাহের জন্য অপেক্ষাকৃত সরু নালা) কাটার কাজ করি গো খানা কাটা।
কথাটা শুনে কিঞ্চিত সন্দেহ হওয়াতে,
-সে তুমি যাই বলো খুঁড়ো, তোমাকে দেখে কিন্তু মনে হচ্ছে না যে তুমি ভালো খানা কাটতে পারো।
এবারে ভয়ঙ্কর রেগে গিয়ে লোকটা কাঁধ থেকে কোদালটা মাটিতে নামিয়ে ডান হাত দিয়ে বুক চাপড়াতে চাপড়াতে বলতে থাকে,
- অ্যা... তুমি কি-না আ-মা-র কাজ নিয়ে সন্দেহ করো? আমার চৌদ্দ পুরুষ খানা কেটেছে। আমি নিজে খানাতেই এই বয়স পার করেছি। একপ্রকার আমার খানায় জন্ম? সেখানে তুমি কিনা আমার কাজ নিয়ে সন্দেহ করো?
-আসলে খুঁড়ো তোমার নামটা না জানার জন্য ঠিক চিনতে পারছিনা।
-আমার নাম দেনা সর্দার।
- ও আচ্ছা। এবার বুঝতে পেরেছি তুমিই সেই দেনা সর্দার,এলাকায় সবাই এক বাক্যে 'খানায় জন্ম' বলেই যাকে চেনে?
আমার শেষ কথাতে দেনা খুঁড়ো খুব খুশি হলো। কয়েকবার মাথা দুলিয়ে সম্মতি জানিয়ে কোদাল তুলে হাসতে হাসতে সামনে পা বাড়ালো।
উপস্থিত সকলেই হোহো করে হাসতে থাকে দেনা খুঁড়ো সম্পর্কে মামুর গল্প শুনে। কয়েকজন তো আবার মামুর কাছে বায়না ধরে দেনা খুঁড়োকে একবার চোখের দেখা দেখার জন্যও।
এহেন হাসিখুশী মানুষটার মনেও সাম্প্রতিককালে একেবারেই শান্তি নেই। পরিচিত কয়েকজনকে আকার-ইঙ্গিতে বলেছেন সে কথা। আগেই বলেছি মামুর প্রকৃত নাম মাহমুদ মুন্সি। মামু ঠিক মনে করতে পারেন না সর্বপ্রথমে কে নামটিকে সংক্ষেপে মামু বলা চালু করেছিল। সেই কবে থেকে নিজ গ্রাম তো বটেই আশেপাশের গ্রামের লোকদের কাছেও মামু নাম শুনতে শুনতে যেন নিজের আসল নামটি ভুলতে বসেছেন। এতদিন বয়স কম থাকাই বিষয়টা খারাপ তো লাগতোই না বরং মজাই পেতেন।কিন্তু সাম্প্রতিক কালে তা একপ্রকার দুর্ভাবনার পরিণত হয়েছে। বয়জ্যেষ্ঠরা যদিওবা তাকে মাহমুদ মুন্সী না বলে মামু বলে ডাকেন তাই বলে ছোটখাটো ছেলেছোকরাদের মুখে এমন ডাক কিছুতেই যেন মানতে পারছেন না। মামুর এই গুমড়ে যাওয়াতে ছোকরার দল আরো বেশি উৎসাহিত হয়ে তাদের বাপ-দাদাদের মতো মামুকে মামু বলেই ডাকতে থাকে। আর এটা নিয়েই মামুর যত মাথাব্যথা। মামু আর আগের মত হাসি ঠাট্টা করেন না। জোর করেই যেন নিজেকে বদলানোর চেষ্টা করছেন।
তার এই হঠাৎ বদলে যাওয়াতে বয়স্করা খুব চিন্তিত। আগ্রহ নিয়ে খোঁজখবর করতেই জানতে পারেন মামুর দুঃখের কথা। ক্ষোভের গুরুত্ব উপলব্ধি করে তারাও মামুর প্রতি সহানুভূতিশীল হয়ে পড়েন। সমস্যার সমাধানে নিজেরা উদ্যোগী হয়ে পরিচিত যুব গোষ্ঠীকে বয়স্ক মানুষটাকে এখন থেকে আর নাম না ধরে ডাকার পরামর্শ দেন। প্রথমে তা মানতে না চাইলেও অবশেষে বয়স্কদের ধমকাধমকিতে গ্রামের তরুণ প্রজন্ম বাধ্য হয় মামুর নুতন নামকরণ মেনে নিতে। এখন আর কম বয়সীরা কেউ তাকে শুধু মামু বলে ডাকে না, সকলে মামুচাচা বলেই ডাকে। যুবকরা অবশ্য নতুন নামকরণে খুশি। খুশি মামুচাচাও তাদের কাছ থেকে সম্মান আদায় করতে পেরে।
ডাকাবুকো মানুষটি সারা জীবন একা একা কাজ করে এসেছেন। কিন্তু এখন বয়সের ভারে কিছুটা নতজানু। কাজে সহযোগিতা করার জন্য মধ্যম পুত্র শাকিলকে সঙ্গে নেন। তবে শুধু সহযোগিতা তা নয়, উদ্দেশ্য শাকিলকে ঘষে মেজে নিজের পূর্বপুরুষের পেশাতেও রপ্ত করাবেন। তিন ছেলের মধ্যে বাউন্ডুলে প্রকৃতির বড় ও ছোট জনকে দিয়ে যে কিছু হবে না তা তিনি পরিচিত মহলে ব্যক্ত করেন। আপাত সুখী মানুষটিকে এই একটা জায়গাতে কেমন যেন চিন্তিত এবং হতাশাগ্রস্থ বলে মনে হয়। শাকিল অত্যন্ত ধৈর্যশীল এবং শৃঙ্খলা পরায়ন বাবার কথায় কখনো আমান্য করে না। সে গ্রামে বা পাশের গ্রামে যেখানেই কাজ আসুক জিনিসপত্র নিয়ে আব্বার আগে পৌঁছে যায়।আগে গিয়ে স্থানটিকে ঝাড়ু দিয়ে কাজের উপযোগী করে। কিছুক্ষণের মধ্যে মামুচাচাও পৌঁছে যান। পিতা-পুত্র মন দিয়ে কাজে লেগে যায়। সাধারণত সকালের নাস্তা পান্তা খাওয়ার আগে একপ্রস্থ কাজ হয়ে যায়। সাময়িক বিশ্রাম নিয়ে আবার কাজ শুরু হয়, চলে দুপুর পর্যন্ত। দুপুরে স্নান খাওয়ার পর আবার সাময়িক বিশ্রাম নিয়ে আর এক প্রস্থ কাজ হয়ে থাকে যা চলে বিকাল পর্যন্ত। আর তার পরেই ছুটি। তবে বিকেলে কাজ শেষে বাবা-ছেলে একসঙ্গে বাড়ি ফেরেন। পাড়ারই কোন এক বাড়িতে এক সকালে সবে মামুচাচা ছেলেকে নিয়ে কাজ শুরু করেছেন। এমন সময় মোড়ল সাহেবকে দেখে চওড়া হাসি দিয়ে উঠে দাঁড়ান। আদাব বিনিময়ের সঙ্গে সঙ্গে, সক্কালবেলা এমন মানুষের দর্শন পাওয়া যে বিরাট সৌভাগ্যের তা উচ্চারণ করে মহান উপরওয়ালাকে বারে বারে ধন্যবাদ দিতে থাকেন মামুচাচা।
ফ্রম সাতক্ষীরা টু বেলগাছিয়া (পর্ব-২)
সর্বশেষ এডিট : ১৬ ই জানুয়ারি, ২০২১ দুপুর ১২:০৪