somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ফ্রম সাতক্ষীরা টু বেলগাছিয়া ( সূচনা পর্ব -২)

২২ শে এপ্রিল, ২০২০ রাত ৯:২৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



ফ্রম সাতক্ষীরা টু বেলগাছিয়া (পর্ব-৩)

দোয়া প্রার্থনা:- অত্যন্ত কষ্টের সঙ্গে জানাচ্ছি যে জনপ্রিয় ব্লগার আরোগ্য অতিসম্প্রতি মারাত্মক শারীরিক অসুস্থতায় ভুগছে। যদিও দীর্ঘদিন ধরে ও রক্তাল্পতায় ভুগছিল। অতি সম্প্রতি তার সঙ্গে জ্বর, শুকনো কাশি ও সময়ে সময়ে কাশিতে রক্ত পড়া যোগ হওয়াতে শারীরিক অবস্থার চূড়ান্ত অবনতি ঘটে।এদিকে করোনার কারণে চিকিৎসা পরিষেবা পাওয়াও রীতিমতো চ্যালেঞ্জের সেখানে এমন শারীরিক অবস্থা নিঃসন্দেহে অকুল সাগরে পড়ার সামিল। এমতাবস্থায় কোনোরকমে একটু চিকিৎসার সুযোগ পাওয়ায় ডাক্তারি পরীক্ষা-নিরীক্ষায় টিবির সম্ভাবনা আছে বলে ডাক্তারবাবুর অনুমান। উল্লেখ্য যাবতীয় চিকিৎসা আপাতত বাসা থেকেই হচ্ছে।
তার সঙ্গে আমার মেইল যোগাযোগ থাকলেও এর বেশি কিছু জানা সম্ভব হয়নি। গতকাল দুবার মেল করলেও আজ এখনো পর্যন্ত কোন উত্তর পাইনি।
ব্লগার আরোগ্যের দ্রুত আরোগ্যলাভ কামনা করতে সকলের কাছে প্রার্থনা করার অনুরোধ রইলো।

পর্ব-২

রুনার ছুটে যাওয়া দেখে মেজো ও সেজো বোন দৌড়ে ছুটে যায় পাঁচিলের সদর দরজার কাছে। দুজন প্রায় একইসঙ্গে জিজ্ঞাসা করে,
-আব্বু কি হয়েছে তোমার? রুনা কি করেছে?
রাকিব মিয়া মেয়েদের কথার উত্তর তো দিলেন না উল্টে আরও রেগে গিয়ে গজরাতে গজরাতে চোখ মুখ বিকৃতি করে পাল্টা জিজ্ঞেস করেন,
-কী হ-য়ে-ছে আ-মা-র? এক প্রকার দাঁত মুখ চেপে বার কয়েক রিপিট করেন কথাটা। দুই বোন হঠাৎ থতমত খেয়ে ভয় পেয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে। উল্লেখ্য উনি যখন স্বাভাবিকভাবে কথা বলেন তখন ওনার কথার মধ্যে কোন জড়তা থাকে না। কিন্তু রেগে গেলে মুখ দিয়ে সহজে কথা বার হয় না। আর তখনই কথা না বলতে পারার হতাশায় শরীর ভাষাতে ভয়ঙ্কর ক্ষোভ উগড়ে দেন। সেই মুহূর্তে যারা সামনে পড়ে তাদের উপর বিষোদগার করতে থাকেন। যেন পারলে এক্ষুনি ছিঁড়েই খাবেন। ইতিমধ্যে ভারী শরীরটাকে টানতে টানতে অনেকটা দূর্মুস করতে করতে সাহিদা বিবি ঘটনাস্থলে উপস্থিত হন। খুব শান্ত ভাবে জিজ্ঞাসা করলেন,
- হ্যাগো! কি হয়েছে তোমার? বাড়ির মধ্যে না ঢুকে বাইরে দাঁড়িয়ে এভাবে কথা বলছো কেন?
এবার যেন আগুনে ঘৃতাহুতি পড়ল। এতক্ষন দরজা থেকে বেশ খানিকটা দূরেই ছিলেন রাকিব মিয়া। এক-পা দু-পা কিছুটা এগিয়ে যাচ্ছিলেন
মোড়ল সাহেব কিছু একটা বলতে। কিন্তু ঝপাং করে পাশে থাকা সাইকেলটি সশব্দে মাটিতে পড়ে যাওয়াতেই বিপত্তি আরও বেড়ে গেল। বোধহয় সাইকেলের স্ট্যান্ডটি ভালো করে দেওয়া ছিল না অথবা জায়গাটি নরম মাটির কারণে স্ট্যান্ডটি বসে গিয়ে সাইকেলটি পড়ে থাকতে পারে। যাইহোক প্রিয় সাইকেলটি পড়ে যাওয়াতে এবার রাগের মাত্রা যেন সপ্তমে চড়ে গেল। ছুটে গিয়ে সাইকেলটি তুলে কোনোক্রমে দাঁড় করিয়ে চলে এলেন সাহিদা বিবির এক্কেবারে সামনে। উচ্চতায় রাকিব মিয়া সাহিদা বিবির তুলনায় বেশ কিছুটা খাটো। কিন্তু এক্ষুণে স্ত্রীর সামনে দাঁড়িয়ে খাটো মানুষটি লাফিয়ে লাফিয়ে উষ্মা প্রকাশ করতে লাগলেন।কিন্তু কি বলতে চাইছেন সেটা পরিপূর্ণ না হওয়াতে কারো কাছে বিষয়টি স্পষ্ট হলো না।রেখা ও রুবি একে অপরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করতে লাগলো।ইশারাতে একে অপরকে জিজ্ঞাসা করল আব্বুর কথাটা বুঝতে পেরেছে কিনা।কিন্তু দুজনেই মাথা নাড়িয়ে তাদের দুর্বোধ্যতার জানান দিল। সাহিদা বিবির যেন এবার ধৈর্যের বাঁধ ভেঙ্গে গেল। তিনিও পাল্টা গলা খাকিয়ে চড়া সুরে বলতে লাগলেন,
-অসভ্য লোক কোথাকার। যত লম্ফঝম্প সব বাড়িতে, বউয়ের কাছে। এমন মরদ যে বাইরে কারো কাছে লাফালাফি করতে পারেনা।এই লোককে পাড়ার লোক মোড়ল মানে কেমন করে, আমার মাথায় ঢোকে না। সারাজীবন আমার হাড়মাশ জ্বালিয়ে খাচ্ছে।অথচ বাইরে এক্কেবারে যেনো অবতার।
স্ত্রীর পাল্টা আক্রমণে রাকিব মিয়া একটু থতমত খেয়ে গেলেন। উনি মুখ খুললেও পাঁচিলের বাইরে বাড়ির বউ যে এভাবে মুখ খুলতে পারে তা ভাবতে পারেননি। তাই কিছুটা দেখে অবাক হলেন। প্রাথমিক জড়তা কাটিয়ে উনিও এবার পাল্টা আক্রমণ শুরু করলেন,
-অসভ্য আমি না তুমি? মেয়ে-জামাই থাকবে কোথায় সে কথা ভেবে ভেবে আমি দিশেহারা। কোথায় তাড়াতাড়ি বাড়ি এলুম একটা সমাধান সূত্র বার করব বলে। আর উনি রাজরানী হয়ে ভিতরে বসে আছে। বারে বারে একটার পর আরেকটা মেয়ে পাঠাচ্ছে। আবার বাইরে এসে চিৎকার চেঁচামেচি করা। মোড়ল বাড়ির মানসম্মান সব ধুলোয় মিশিয়ে দিয়ে যেন মহোৎসব করছে।
মেয়েদের দিকে মুখ করে সাহিদা বিবি তৎক্ষণাৎ বিচারপ্রার্থীর ন্যায় অভিযোগ করেন,
-দেখলি দেখলি লোকটার মুখের ভাষা দেখলি? আমাকে কিনা বলে রাজরানী? কি রাজরানীর শ্রী গো! আর আমি যদি রাজরানী হই তাহলে তুমি তো রাজামশাই।
আক্রমণের ঝাঁজ বজায় রেখে মুহূর্তে স্বামীর দিকে মুখ ফিরে আবার বলতে লাগলেন,
- আর মহোৎসব করছি আমি না তুমি?বাইরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে যা করছ তাতে পাড়ার লোক ঠিকই বুঝতে পারছে কে প্রকৃতই মহোৎসব করছে।
সাহিদা বিবি যেন কিছুতেই থামতে চাননা। নাক মুখ বেঁকিয়ে তীব্র ক্ষোভের সঙ্গে বলতে লাগলেন,
--কিছু লোককে মাঝে মাঝে চাল ডাল দিয়ে তাদের মাথায় খবরদারি ফলানো।‌ তোমার মোল্লাকির আমি কিচ্ছু বুঝিনা? এবার মোল্লাকি সব বন্ধ করে দেব।

সাহিদা বিবি রাগের মাথায় ঠিকই বলেছেন। রাকিব মিয়া বাইরের লোকের প্রতি সাধারণত রাগ দেখান না। তবে সব সময় যে এ নীতি মেনে চলতে পারেন তেমনটি নয়। মাঝে মাঝে একে অপরের উপরে একটু ধমকাধমকি দেন ঠিকই। তবে ওনার এই ধমকাধমকিকে কেউ বিশেষ পাত্তা দেন না।পাড়া-পড়শীরা প্রত্যেকেই জানেন মোড়ল সাহেবের কাছ থেকে ধমক খেলে পরে প্রাপ্তিযোগ ঘটবে।মনের দিক থেকে অত্যন্ত কোমল স্বভাবের মানুষটি কাউকে ধমক দিয়ে বেশিক্ষণ নিজেকে ধরে রাখতে পারেন না। নিজের কোমল চরিত্রের জন্যই হোক বা উদ্দিষ্ট ব্যক্তিকে হাতে রাখার জন্যই হোক কিছুটা তোষামোদ করতে পরে তাকে কাছে ডেকে নেন।এমনিতে সারাবছর হিন্দু- মুসলিম নির্বিশেষে বহুলোককে নিজের জমিতে কাজ দেন, তারপরও অনেক ক্ষেত্রে বাড়ি থেকে চাল ডাল নিয়ে কিম্বা জমিতে কাজ পাইয়ে দিয়ে যতটা সম্ভব তাদের পাশে থাকার চেষ্টা করেন।আর এক্ষেত্রে তাদেরকে হাতে রাখার জন্য ঘরে স্ত্রীকে খুশি রাখাটা যে জরুরি-মোড়ল সাহেব এটা ভালোই বোঝেন। সাহিদা বিবির প্রত্যক্ষ সহযোগিতা ছাড়া ঘর থেকে এক কনা চাল ডাল বের করা যে সম্ভব নয়।তাই যখনই স্ত্রীর উপরে বিশেষ গুণ প্রদর্শন করেন, ওনার পাল্টা আক্রমণে এক প্রকার ঢোক গিলতে বাধ্য হন।

অন্যদিকে,কথাতেও সাহিদা বিবি দমে যাবার পাত্রী নন। স্বামীকে প্রতিআক্রমণে বলেন, শিয়াল রাজা বলে কটাক্ষ করেন এবং রাজত্ব ফলাবেন বাইরে গিয়ে বলে আঙ্গুল উঁচিয়ে সাবধান করেন। ঘরের মধ্যে ওসব উনি বরদাস্ত করবেন না।
চোখের সামনে আব্বু-আম্মুর এমন ঝগড়া দেখে রেখা ও রুবি কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে যায়। তারা ঠিক বুঝে উঠতে পারেনা উদ্ভূত পরিস্থিতিতে তাদের ঠিক করণীয় কি? এদিকে জোরে জোরে চিৎকার চেঁচামেচিতে আশপাশের বেশ কয়েকজন ছুটে আসেন। যতই আপদ-বিপদে পাশে দাঁড়াক,মোড়ল বাড়ির এমন দুর্লভ ঝগড়া দেখার সুযোগ তারা হাতছাড়া করবেনই বা কেন। দরজার বাইরে তখন দু-চার জন মুখ চাওয়াচাওয়ি করে দাঁড়িয়ে গেছেন। দুই বোন বুঝতে পারলো ক্রমশ বাইরের লোক জমতে শুরু করেছে। এবার তারা একসঙ্গে দুদিক থেকে মায়ের দুইহাত ধরে টানতে লাগলো।সাহিদা বিবি হাত ঝাঁকিয়ে ছাড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হলেন। মেয়েরা আরো জোরে টানতে থাকায় রণেভঙ্গ দিয়ে অনিচ্ছা সহকারে ভিতরে ঢুকে গেলেন। বাড়ির উঠোনে ঢুকতেই কান্নায় ভেঙে পড়লেন। বিলাপ করে বলতে লাগলেন,এমন বনেদি পরিবারের বউ হয়েও প্রকাশ্যে রাস্তায় লোকের সামনে যেভাবে অপমান সহ্য করতে হলো তাতে তিনি মর্মাহত।এ মুখ তিনি কি করে দেখাবেন তা ভেবে তিনি এক প্রকার দিশেহারা।
রেখা বোঝাতে থাকে,
-আব্বু রেগে গেলেই তো এভাবে কথা বলেন। এ আর নতুন কি? তুমি এতটা দুশ্চিন্তা কেন করছো?
সাহিদা বিবিও পাল্টা প্রশ্ন ছুড়ে দেন,
-আচ্ছা তোরা তো বড় হয়েছিস, আমার অপরাধটা কোথায় বল দেখি? যে মানুষটা একদিন বাড়িতে নেই, নতুন কুটুম্বের বাড়িতে গেছে মেয়ে- জামাই ফিরুনি আনার নেমন্তন্ন দিতে। আমরা বাড়িসুদ্ধু সবাই অপেক্ষায় আছি,কোথায় এসে নানা রকম গল্পগুজব করবে, তা না করে ঘরের বউকে বাইরে ডেকে বেইজ্জত করা।


চোখের সামনে মেজো ও সেজো মেয়ে তাদের মাকে টানতে টানতে ঘরের ভিতরে নিয়ে যাওয়ায় সাময়িকভাবে রাকিব মিয়া বিহ্বল হয়ে পড়েন। মেয়েরা তাহলে মাকেই বেশি ভালোবাসে? দুই মেয়ের একজনও তো কই আমাকে ঘরে ঢোকার কথা বললো না। অথচ রত্না থাকলে ঠিক এমনটি হতে দিত না। রত্না যে ঠিক এক্কেবারে মায়ের মতই বোঝে তাকে। এসব ভাবতে ভাবতে রাকিব মিয়া ভুলে গেলেন আসলে তিনি ঠিক কি বলতে চেয়েছিলেন। কিছুক্ষণ মাথা চুলকিয়ে অবশেষে স্মরণ করতে পারলেন। হ্যাঁ তাকে তো চৌকি খুঁজতে যেতে হবে। বিফল মনোরথে সাইকেলটা কোনোক্রমে চালু করে প্যাডেল পা রেখে তড়াৎ করে লাফিয়ে সিটে বসে পড়লেন।

মাকে ধরে নিয়ে বাড়ির ভিতরে নিয়ে গেলেও তাদের আব্বু আসছে না দেখে দুই বোন বেশ অবাক হল। আব্বু কি তাহলে রাগ করে অন্য কোথাও চলে গেছে? আব্বু-আম্মু তো আগেও ঝগড়া করেছে, তখন তো আব্বু এমন রাগ করেননি।এদিকে রাকিব মিয়ার ঘরে না ফেরার সময়টি ক্রমশ দীর্ঘ হতেই মেয়েদের সঙ্গে সাহিদা বিবিও চিন্তিত হয়ে পড়লেন। মনের মধ্যে কুডাক ডাকতে লাগলো। তাহলে রত্নার বাড়িতে কি তেমন কিছু খারাপ ঘটনা ঘটেছে?রেগে না গেলে কখনো তো অমন হাম্মা বলে ডাকে না। নিশ্চয়ই তেমন কোনো সমস্যা হয়েছে।আর সে জন্যই হয়তো লোকটার মাথাটা বিগড়েছে।এসব ভাবতে ভাবতে সাহিদা বিবি এক ধরনের আত্মগ্লানি অনুভব করতে লাগলেন। ওই ভাবে কথা বলা যে উচিত হয়নি তা ভেবে মনে মনে দংশিত হতে লাগলেন। এদিকে সময় ক্রমেই অতিক্রান্ত হয়ে দুপুর গড়িয়ে গেল তবুও রাকিব মিয়ার দেখা নেই। এবার মা-মেয়েরা সকলেই খুব উদ্বিগ্ন হয়ে পড়লেন। রেখার চোখে ধরা পড়লো যে আম্মু বারেবারে সদর দরজার দিকে তাকাচ্ছে। সে বলেই ফেললো,
-আম্মু আব্বুর সঙ্গে তোমার ওভারে কথা বলা ঠিক হয়নি।
মেজোবুর কথার রেশ ধরে রুবিও একই কথা বলল,
-হ্যাঁ আম্মু মেজবু ঠিকই বলেছে।
সাহিদা বিবির রাগ ততক্ষনে এক্কেবারে গলে জল। অনেকটা মেয়েদের সুরে সুর মিলিয়ে স্বীকার করলেন,
-হ্যাঁ তোরা ঠিকই বলেছিস। আমার ওভাবে কথা বলা ঠিক হয়নি। আসলে সামনে যেতেই মানুষটা এমন রুদ্রমূর্তি ধারণ করলো যে আমি মাথাটা আর ঠিক রাখতে পারিনি।

ওদের কথা তখনো শেষ হয়নি এমন সময় বাইরে একটু দূর থেকে পরিচিত সাইকেল বেলের ঝনঝনানি শব্দ শুনতেই ওদের মুখে হাসি ফুটলো। বুঝল আব্বু তাহলে চলে এসেছেন। মেয়েদের সঙ্গে মায়ের মুখেও চওড়া হাসি খেলে গেল। রেখা সবার আগে ছুটে গেল সদর দরজা খুলে দিতে। হাসিমুখে জিজ্ঞাসা করে,
-আব্বু তুমি এতক্ষণ কোথায় ছিলে?
-একটু দরকারে গিয়েছিলাম রে মা। মাথায় সারাক্ষণই তোদের চিন্তা থাকে, কিভাবে তোদের একটু ভালো খাওয়াতে-পড়াতে, একটু সুখী করতে পারবো সে কথা ভেবেই তো সারাদিন ছুটে বেড়াই।
এমন সময় সাহিদা বিবিও সামনে চলে আসেন। খুব শান্তভাবে জিজ্ঞেস করেন,
-হ্যাঁগো হারুনের বাপ সেই যে চলে গেলে তারপর থেকে এতক্ষণ কোথায় ছিলে?
-খুব সমস্যায় পড়েছি হারুনের মা।

কে বলবে স্বামী-স্ত্রী একটু আগে কি ঝগড়াই না করেছেন। দুজন দুজনকে কথায় আহত করার আপ্রাণ চেষ্টা করে গেছেন। অথচ কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে তাদের মধ্যে এত মধুর সম্পর্ক, এত বোঝাবুঝি; কথাতে মনে হল একে অপরের পরিপূরক যেন হৃদয়ের অভিন্ন আত্মা। মানুষের জীবনের সঙ্গে মনেরও অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক বিদ্যমান। চিন্তাশক্তির প্রবাহ সব সময় এক খাতে প্রবাহিত হয় না। অচেনা অজানা সে পথে চড়াই-উৎরাই থাকবেই। দুর্বিনীত মনও কখনও ভয়াল ভয়ংকর কালবৈশাখীর মতই আকার ধারণ করে। যখন প্রবাহিত হয় তখন তার সংহার মূর্তির কাছে প্রতিপক্ষ নিতান্তই তুচ্ছতাচ্ছিল্যে পরিণত হয়। যারা তার সংহার রূপে উতলা হয়ে পড়ে তাদেরকে ভাসিয়ে নিয়ে যায় কোনো এক ধ্বংসস্তূপে, দাঁড় করায় জীবন যুদ্ধের এক ভয়ঙ্কর জলবিভাজিকার মধ্যে। কিন্তু শত বাধাতেও যারা অবিচল থাকে, উত্তীর্ণ হয় এক কঠিন ধৈর্যশীলতার পরীক্ষায় দুর্যোগ শেষে তাদের জন্য আসে সুন্দর মেঘমুক্ত আকাশ। তার বর্ণিল আলোকচ্ছটায় নিজেদের জীবনকে করে তোলে উজ্জীবিত।

হারুনের বাপের মুখ থেকে খুব সমস্যার কথা শুনে স্বভাবতই সাহিদা বিবি উতলা হয়ে পড়েন। তিনি উদ্বিগ্ন দৃষ্টিতে স্বামীর মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে ঘরের দিকে পা বাড়ান। কিন্তু ভিতরে ভিতরে অজানা আশঙ্কায় তোলপাড় হতে থাকে কথাটি শোনার জন্য। রাকিব মিয়া সাইকেলটি রেখে চোখে মুখে জল দিয়ে বারান্দায় আসতেই ততক্ষণে মেয়েরা মাদুর পেতে অপেক্ষা করতে থাকে তাদের আব্বুর বসার জন্য। সাহিদা বিবি গামছাটা এগিয়ে দিলে হাত মুখ মুছতে মুছতে রাকিব মিয়া বলতে লাগলেন,
-বুঝলে হারুনের মা, গতরাতেই আমি প্রথম কাঠের চৌকিতে ঘুমিয়েছি।
-কাঠের চৌকি? সে আবার কেমন?
-ভীষণ সুন্দর গো দেখতে। আমাদের বাড়িতে যেগুলো আছে এগুলো যেমন বাঁশের তৈরি সেখানে রত্নার বাড়িতে যেগুলো দেখলাম সেগুলো সব কাঠের তৈরি এবং খুব সুদৃশ্য। রাতে খাওয়ার পরে বেয়াইন সাহেবা আমাকে শোয়ার ব্যবস্থা করতে বললে রত্না আমাকে ওই চৌকিতে নিয়ে যায়। কি সুন্দর আরাম গো তোমাকে ঠিক বলে বোঝাতে পারবো না। কত এপাশ-ওপাশ করলাম কিন্তু কোন ক্যাচ ক্যাচ শব্দ নেই। কিন্তু সমস্যায় পড়লাম অন্য জায়গায়।
-এটা তো খুব আনন্দের;এর মধ্যে আবার সমস্যা কেন?
-সমস্যা হল তোমার মেয়েকে নিয়ে।
-রত্নাকে নিয়ে? কেন রত্না আবার কি করলো?
-ও আমায় বললে কি না আব্বু তোমার জামাই কিন্তু সারাজীবন কাঠের চৌকিতে ঘুমিয়ে মানুষ। ওরা আসার আগেই যেন আমি এমন একটা চৌকির ব্যবস্থা করি। মেয়ের হুকুম বুঝলে?
-তা তুমি কি বললে?
-আমি আর কি বলব?মেয়ে বাবার কাছে আবদার করেছে। এখন বাবাকে তা রক্ষা করতে হবে।
-জানে আব্বুর কানে যখন পৌঁছে গেছে আব্বু নিশ্চয়ই একটা ব্যবস্থা করবে, বলে সাহিদা বিবি খুশী খুশী ভাবে আবারো বলতে থাকেন, তা তুমি কি ব্যবস্থার কথা ভেবেছ?
-দেখো দুদিন বাদেই ওরা আসছে। এত কম সময়ে কি করেই বা নতুন চৌকি বানাবো।আর কোথায় পাবো কাঠ, মিস্ত্রি এবং আরও কত কি। তাছাড়া এ সম্পর্কে তো আমার কোন ধারনা নেই। তাই গিয়েছিলাম গোয়ালবাড়ির ভূদেবর কাছে।
-কে ভূদেব?ও কি করবে?
-আরে ঐ তো রত্নার বিয়ের ত্রিপোল-সামিয়ানা ভাড়া দিয়েছিল।
-ট্রিপল-সামিয়ানা এখানে আসছে কেন?
-আসলে গিয়েছিলাম ও তো বিভিন্ন জিনিস ভাড়া দেয়। তাই ভাবলাম ওর কাছে গেলে এরকম জিনিস কয়েকদিনে ভাড়া পাওয়া যাবে কিনা সেই আশাতে। কিন্তু গিয়ে লাভ হল না।
-ও নেই বলল?
-না একেবারে নেই তা নয়।বিয়েতে যে জলচৌকিটা নিয়ে দিয়েছিল, সেটা দেখিয়েই বললো যদি লাগে ওটা যেন নিয়ে আসি। কোন ভাড়া লাগবেনা।
-জলচৌকি সে আবার কি?
-ওগুলো চৌকির মতই তবে আকারে অনেকটাই ছোট। একজন লোক কোনোক্রমে গুটিসুটি মেরে শুতে পারে। কোন অবস্থায় পা লম্বা করতে পারবে না। তুমি বোধহয় দেখনি বিয়ের দিন বর সাজানোর জায়গাটি। ওটা ছিল জলচৌকি উপর করা।
-না আমার ঠিক মনে পড়ছে না।
-ওই জন্য ঠিক বুঝতে পারছ না।
-তাহলে এখন উপায়, বলে সাহিদা বিবি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে স্বামীর দিকে কৌতুহলী দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকেন।
বেশ কিছুক্ষণ সকলে নিশ্চুপ থাকার পর রাকিব মিয়া নীরবতা ভঙ্গ করেন। সামান্য ঘাড় দুলিয়ে অত্যন্ত শান্তভাবে বলেন,
-একটা পথ আছে। তবে কাজ হবে কিনা ঠিক বলতে পারছিনা।


বিশেষ দ্রষ্টব্য:- পোস্টটি আরোগ্যকে উৎসর্গ করা হলো।


ফ্রম সাতক্ষীরা টু বেলগাছিয়া (পর্ব-১)

সর্বশেষ এডিট : ১৬ ই জানুয়ারি, ২০২১ দুপুর ১২:০৬
২৮টি মন্তব্য ২৮টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

কুড়ি শব্দের গল্প

লিখেছেন করুণাধারা, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:১৭



জলে ভাসা পদ্ম আমি
কোরা বাংলায় ঘোষণা দিলাম, "বিদায় সামু" !
কিন্তু সামু সিগারেটের নেশার মতো, ছাড়া যায় না! আমি কি সত্যি যাবো? নো... নেভার!

সানমুন
চিলেকোঠার জানালায় পূর্ণিমার চাঁদ। ঘুমন্ত... ...বাকিটুকু পড়ুন

ধর্ম ও বিজ্ঞান

লিখেছেন এমএলজি, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ ভোর ৪:২৪

করোনার (COVID) শুরুর দিকে আমি দেশবাসীর কাছে উদাত্ত আহবান জানিয়ে একটা পোস্ট দিয়েছিলাম, যা শেয়ার হয়েছিল প্রায় ৩ হাজারবার। জীবন বাঁচাতে মরিয়া পাঠকবৃন্দ আশা করেছিলেন এ পোস্ট শেয়ারে কেউ একজন... ...বাকিটুকু পড়ুন

তালগোল

লিখেছেন বাকপ্রবাস, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৩৫


তু‌মি যাও চ‌লে
আ‌মি যাই গ‌লে
চ‌লে যায় ঋতু, শীত গ্রীষ্ম বর্ষা
রাত ফু‌রা‌লেই দি‌নের আ‌লোয় ফর্সা
ঘু‌রেঘু‌রে ফি‌রে‌তো আ‌সে, আ‌সে‌তো ফি‌রে
তু‌মি চ‌লে যাও, তু‌মি চ‌লে যাও, আমা‌কে ঘি‌রে
জড়ায়ে মোহ বাতা‌সে ম‌দির ঘ্রাণ,... ...বাকিটুকু পড়ুন

মা

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৩


মায়াবী রাতের চাঁদনী আলো
কিছুই যে আর লাগে না ভালো,
হারিয়ে গেছে মনের আলো
আধার ঘেরা এই মনটা কালো,
মা যেদিন তুই চলে গেলি , আমায় রেখে ওই অন্য পারে।

অন্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

কপি করা পোস্ট নিজের নামে চালিয়েও অস্বীকার করলো ব্লগার গেছে দাদা।

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ২:১৮



একটা পোস্ট সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেশ আগে থেকেই ঘুরে বেড়াচ্ছে। পোস্টটিতে মদ্য পান নিয়ে কবি মির্জা গালিব, কবি আল্লামা ইকবাল, কবি আহমদ ফারাজ, কবি ওয়াসি এবং কবি... ...বাকিটুকু পড়ুন

×