ফ্রম সাতক্ষীরা টু বেলগাছিয়া (পর্ব-৭/প্রথম খন্ডের তৃতীয় পর্ব)
ছোট থেকেই দাদির কাছ থেকে শুনে আসছি দাদা একজন প্রকৃত শিল্পী।কাঠ দিয়ে সুন্দর সুন্দর জিনিস তৈরি করাই দাদার প্রধান কাজ। হালদার বাবুদের অন্যান্য ব্যবসা থাকলেও প্রতিপত্তির মূলেই নাকি কাঠের ব্যবসা আর যার প্রধান কান্ডারী হলো আমার দাদা। দাদার হাতের বাহারি জিনিসের গুণেই শহরের এই দোকানের এত সুনাম। যদিও এসব কথার সত্যতা যাচাই করার বা দাদার হাতের জিনিসকে চাক্ষুষ করার সুযোগ ইতিপূর্বে আমার ঘটেনি।ধরেই নিতাম দাদার প্রসঙ্গ উঠলে দাদি গদগদ ভাবে স্বামীকে নিয়ে একটু বেশি বেশি করেই গল্প করতো। তখন না বুঝলেও পরে বুঝেছি ওটাই ছিল যেন দাদার প্রতি দাদির ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ।তার মননে সারাক্ষণ যে দাদাকে বয়ে বেড়ায় তা বোঝার মতো বয়স বা উপলব্ধি তখন কি আর আমার ছিল? কিন্তু কথা বলতে বলতে দাদির চোখ-মুখের চেহারাটা যে বদলে যেত সেটা পরিষ্কার বুঝতাম। যার সবটা আমার কানের মধ্যে না ঢুকলেও শ্রোতা হিসেবে আমিই ছিলাম সেসময় দাদির সবচেয়ে কাছের মানুষ। দাদি যেমন আমার সঙ্গে গল্প করে শান্তি পেত আমিও তেমনি কিছুটা পরিতোষ প্রাপ্তির আশায় মনে মনে দাদিকে ঘুষ দিতাম। মন দিয়ে সবটা না শুনলেও বাধ্য শ্রোতার মতো মাথা নেড়ে সম্মতি জানাতাম। লক্ষ্য ছিল যেন তেন প্রকারে শহরে কাজে পাঠাতে দাদি যেন কোন বাঁধা হয়ে না দাঁড়ায় বা পারলে আমার হয়ে কিছুটা যেন ওকালতিও করে।
হালদার বাবুদের দালানকোঠা থেকে বেশ কিছুটা দূরে একটালম্বা টিনের চালের কাঠের বাড়িতে দাদা আমাকে নিয়ে এলো। ভিতরে ঢুকতে বুঝলাম জায়গায় জায়গায় একটু অন্ধকার হলেও বড় বড় জানালা গুলোর আশেপাশে পর্যাপ্ত আলো ঘরের অন্ধকারকে অনেকটা আলোকিত করে তুলেছে। সঙ্গে একটা আঁশটে গন্ধের সঙ্গে পরিচিত হলাম। প্রথমে ঝটকা খেলেও বুঝলাম বিভিন্ন রকমের কাঠের গন্ধ মিলিতভাবে ঘরটাকেই আশপাশ থেকে কিছুটা স্বতন্ত্রতা দান করেছে। কিছুটা দম বন্ধ হওয়া গন্ধ বৈকি। ঘরের গন্ধমাদনকে সামলে নিয়ে দু'পা সামনে এগিয়ে যেতেই চোখ পড়লো বাহারি সব জিনিসের উপর। আমি বিস্ময়াভিভূত হলাম এত সুন্দর সুন্দর জিনিস মানুষ করে কি করে ভেবে। আজ সবার আগে দাদির কথাগুলো যেন চোখের সামনে ভেসে উঠলো।কাঠের তৈরি বিভিন্ন রকম জিনিস চারিদিকে ডায় করে সাজানো। এতদিনে শুনে আসা নানান কথা, কল্পনা আজ আমার চোখকে জুড়িয়ে দিল। আমি অবাক হয়ে সেগুলোকে প্রত্যক্ষ করতে লাগলাম।
পাশাপাশি আরও একটি বিষয় মনের মধ্যে উঁকি দিল। এতদিন গ্রামে মাটির বাড়িতে থেকে এসেছি।আজ প্রথম কাঠের বাড়িতে থাকবার সুযোগ সামনে আসায় বেশ শিহরিত হতে লাগলাম। এমন সময় দাদার ডাকে আমার ভাবনায় ছেদ পড়লো।
-কিরে দাদা শুধু হাঁ করে তাকিয়ে থাকবি? খাবি দাবি না? ওসব দেখার অফুরন্ত সময় পাবি। চল এখন হাত-মুখ ধুয়ে আসি।
উল্লেখ্য দাদির ন্যাওটা ছিলাম বলে আর ভাই বোনদের নাম ধরে ডাকলেও দাদা আমাকে দাদা বলেই ডাকত।
দাদার ডাকে আমি সম্বিত ফিরে পেলাম।সত্যিই তখন বেশ খিদে পেয়েছিল। কিন্তু চোখের সামনে এত এত নতুন জিনিস দেখার আনন্দ সাময়িক সে সব কিছুকে ভুলিয়ে দিল।
- হ্যাঁ যাই বলে, চোখ তুলে তাকাতেই দেখি দূরে বাপজান দাঁড়িয়ে আছে। হাসিহাসিমুখে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। চোখাচোখি হতেই আমি সলজ্জে চোখ নামিয়ে অন্যদিকে ঘুরে দাঁড়াই। প্রায় দু সপ্তাহ পরে বাপের সঙ্গে দেখা হলো।বাপজান এমনিতে কম কথা বলে। আর তাছাড়া আমি বাড়িতে দুষ্টুমি করায় বাপ বাড়িতে এলে সচরাচর সামনে না এসে একটু পালিয়ে পালিয়েই থাকতাম। আজ সামনাসামনি দেখা হওয়াতে আমিও ঠিক কি বলবো ভেবে উঠতে পারিনি।আড়চোখে দেখলাম বাপের পাশে আর একজন কালো মতো লোক দাঁড়িয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। দাদা পরিচয় করিয়ে দিলো ও হল নজরুল চাচা। আর কাছে দাঁড়ানো ফর্সা লোকটির দিকে ইশারা করে দেখালো,
- ও তোমার স্বপন কাকা।
বাপের সামনে এভাবে আরেকজনকে চাচা বা কাকা বলে পরিচয় করানোয় কেমন যেন অস্বস্তি হচ্ছিল। অস্বস্তির অবশ্য কারণও ছিল। ছোট থেকেই বাপকে সামনাসামনি বাপ বলে ডাকি নি। এখন ডাকতে কেমন যেন সংকোচ বোধ করি। সেখানে অপর কাউকে এমন নামে ডাকতে হবে ভেবেই এমন লজ্জার অনুভূতি তৈরি হয়েছিল।
কিছুটা অপ্রাসঙ্গিকভাবে দাদাকে জিজ্ঞেস করি,
- আচ্ছা দাদা,এটাই কি আমাদের থাকার ঘর?
দাদা উত্তর না দিয়ে পাল্টা আমাকেই জিজ্ঞাসা করে,
-কেন দাদা ঘরটা কি তোমার পছন্দ হচ্ছে না?
- না দাদা। অপছন্দের নয় বরং ঘরটা আমার খুব ভালো লেগেছে কিনা তাই জিজ্ঞেস করলাম।
আমার কথা শুনে সকলেই হো হো করে হেসে উঠলো।
স্বপন কাকা বলে উঠলো,
-দোকান ঘরে থাকতে আবার কারো ভালো লাগে নাকি?
আমি বুঝলাম না কেন স্বপন কাকা এ কথা বলছে।
এমনসময় দাদা ডাকতেই পিছুপিছু চললাম হাতমুখ ধুতে। ভেবেছিলাম আশপাশে কোন পুকুর টুকুরে বোধহয় যেতে হবে।বড় উঠোনের এক্কেবারে শেষে গিয়ে আমরা থমকে দাঁড়ালাম। সামনে বেশ কিছুটা উঁচু গোল করে বাঁধানো কি একটা যেন আছে। উঁকি দিয়ে দেখলাম নীচে কালো জল। দাদা বেশি ঝুঁকতে বারণ করলো। জানালো এর নাম কুয়া। নিচে পড়ে গেলে উঠে আসাটা খুব সহজ নয়। সেদিন প্রথম কুয়োর সঙ্গে পরিচিত হলাম।দাদা দড়ি দিয়ে বাঁধা একটা বালতি করে জল তুলে দিল। দুজনে একসঙ্গে হাতমুখ ধুয়ে ঘরে ফিরতেই দেখি স্বপন কাকা আমাদের জন্য ভাত বেড়ে বসে আছে।
সেদিন দাদা ফিরবে বলে স্বপন কাকা আগে থেকেই ডিমের ঝোল রান্না করে রেখেছিল।তখন আজকের মত এতো ব্যাপকহারে পোল্ট্রি মাংসের বা ডিমের প্রচলন হয়নি। মাঝে মাঝে যে ডিম রান্না হতো তা একান্তই দেশি হাঁস-মুরগির। কাজেই খাওয়া হতো ডেড়-দুমাস বাদে বাদে। তবে হাঁসের ডিম খেতে বেশি পছন্দ করতাম। কারণ তা আকারে অনেকটা বড় হয়। ভিতরে লাল রঙের কুসুমটি ছিল আমার খুবই পছন্দের। যদিও আজ খেতে বসে ডিমের আকার দেখে বুঝলাম যে এটি মুরগির ডিম, হাঁসের নয়। আমার মা বরাবরই খুব ভালো রান্না করে। বাড়ির সকলেই মায়ের রান্নার খুব প্রশংসা করে। কিন্তু সেদিন খেতে বসে বুঝলাম ভারী চমৎকার রান্না হয়েছে। মুখ ফসকে বলেও ফেলি মায়ের চেয়েও ভালো হয়েছে। আমার কথা শুনে দাদা খুব জোরে হেসে ওঠে। বাড়ি গিয়ে মাকে সব বলে দেবে বলাতে, আমি বেশ অস্বস্তিতে পড়ি। বাপের দিকে তাকিয়ে দেখি একটু দূরে দাঁড়িয়ে আমার দিকে মিটমিট করে চেয়ে হাসছে। বুঝতে পারি যে এখানে এসে মায়ের নামে বেফাঁস কথা বলাটা ঠিক হয়নি। ইতিমধ্যে নানান গল্পগুজবে অনেকটা ভাত খেয়ে ফেলায় আমার অসহায় অবস্থা আরও বেড়ে যায়। খাওয়া শেষে আর কিছুতেই যেন সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারছিলাম না। মনে হলো কে যেন কোমরটাকে শক্ত করে বেঁধে রেখেছে। চোখ যেতেই বুঝতে পারি, প্যান্টের দড়ি কোমরে পুঁতে বসেছে। সকলেই প্যান্টের দড়িটি খুলে ফেলার পরামর্শ দিল। বেশ কিছু সময় আঙ্গুল গুজিয়ে চেষ্টা করে অবশেষে দড়িটা খুলতে সমর্থ হই। তারপরও অনেকক্ষণ বসে থাকি মেঝেতে। আরো অনেকক্ষণ পরে ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হই। এই অল্প সময়ের মধ্যে একটা বিষয় চোখে পড়েছে। স্বপন কাকা দাদার ন্যাওটা হলেও নজরুল চাচার সঙ্গে বাপের সম্পর্কটা খুবই ভালো। বাপ আর চাচা আমাদের আসার আগেই খাওয়া-দাওয়া সেরে নিয়েছিল। স্বপন কাকাই শুধু দাদার সঙ্গে খাবে বলে অপেক্ষা করছিল।
সেদিন আমার মুখে প্রশস্তি শুনে স্বপন কাকা খুব উৎফুল্ল হয়েছিল। কারণ রান্নাটা স্বপন কাকাই করেছিল। পরে একদিন বাড়ি থেকে মুরগি এনে খাওয়াবে বলে প্রায় সঙ্গে সঙ্গে ঘোষণা করেছিল। পরে হবে বা দেরিতে হবে-এমন কোনো কিছুকেই আমি সহ্য করতে পারিনা। স্বভাবতই এমন আশ্বাসবাণীতে আমার স্বপ্নের পারদ চড়চড় করে উপরে উঠে যায়। সরল মনে বলেও ফেলি,
-স্বপন কাকা পারলে তুমি আগামিকালই ব্যবস্থা করো না।
কাকা উত্তরে জানিয়েছিল,
-কিন্তু আমি বাড়িতে না গিয়ে আনবো কেমন করে মাহমুদ?
স্বপন কাকার বাড়িও আমাদের মত শহর থেকে অনেকটাই দূরে। ওর সমস্যাটা বোঝার মত সক্ষমতা তখন আমার তৈরি হয়নি। কিন্তু না পাওয়ার যাতনা যে আমাকে বিদ্ধ করে, তাকে অস্বীকার করি কেমন করে। এক্ষুনি তা না পারার অক্ষমতায় মুহূর্তে আমার স্বপ্ন ভেঙ্গে যায়। আমি হতোদ্যম হয়ে পড়ি।
খাওয়া দাওয়ার পরে দোকানের মাঝ বরাবর বেশ কিছুটা জায়গা ফাঁকা করে বিছানা পেতে আমরা যে যার মতো একটু বিশ্রামে যাই। একটু পরেই আবার বিকেলের কাজ শুরু হবে, চলবে সন্ধ্যা পর্যন্ত। স্বপন কাকার কাছ থেকে জানতে পারি, আজ একটু দেরি হলেও অন্য দিনগুলোতে সকলে নাকি আরো আগে বিশ্রামে যায়। যাই হোক দোকানের শেষ প্রান্তে একটি বিছানা ফেলে বাপ ও নজরুল চাচা একসঙ্গে শুয়ে পড়ে। আর আমরা ঠিক আরেক প্রান্তে শুয়ে পড়ি। শোয়ার সঙ্গে সঙ্গে দাদার নাক ডাকা শুরু হয়। বুঝতে পারি দাদা ঘুমের দেশের গহীনে ঢুকে গেছে। শুয়ে শুয়ে স্বপন কাকার সঙ্গে গল্প করতে আমার খুব ভাল লাগছিল। সেদিন থেকেই স্বপন কাকা আমার খুব বন্ধু হয়ে গেল। কাজের ফাঁকে আমরা দুজনে প্রায়ই নানা রকম খেলাও খেলতাম। স্বপন কাকা জানিয়েছিল গোটা শহরে এই দোকানের খুব সুনাম।প্রচুর পয়সাওয়ালা লোকজন আসেন এই দোকানে কাঠের নানারকম জিনিসপত্র ক্রয় করতে। বিয়ের সময় নাকি এখানে বেশ চাপ থাকে। নাওয়া-খাওয়ার সময় পর্যন্ত পাওয়া যায় না।। আর যার হাতের গুণে এই দোকানের এত সুনাম তিনি হচ্ছেন আমার দাদা। কথাটা শুনে আমার সত্যিই গর্বে বুক ভরে গেল। আনন্দে আমার চোখ ঝাপসা হয়ে এলো। মনে হল যেন স্বপন কাকার মুখে দাদির কথারই প্রতিধ্বনিত হচ্ছে। দাদার প্রতি শ্রদ্ধা অত্যধিক বেড়ে গেল। মনে মনে সংকল্প করলাম জীবনে যেন দাদার মতো বড় শিল্পী হতে পারি।
সারাদিন দোকানঘর আর সন্ধ্যার পর মাঝখানের ফাঁকা জায়গা পরিস্কার করে সেটা হয়ে ওঠে চারজন মানুষের বসবাসের স্থান। তিনটি ভিন্ন পরিবারের মানুষ একই স্থানে দিনের পর দিন একে অপরের সাথী। ভাগ করে নিচ্ছে অন্যের খাবার দাবারের সঙ্গে সুখ-দুঃখও। এখন এই চার জনের সঙ্গে নতুন করে যোগ হলাম আমি। শুরুতেই পাঁচমিশালী কাঠের যে দুর্গন্ধ নাকের পর্দাকে কম্পিত করে গুরু মস্তিষ্কের অন্তঃস্থলে প্রবেশ করে অন্তরকে কুঠারাঘাত করেছিল। কিন্তু কয়েক ঘন্টার ব্যবধানে পরিবেশেটা যেন আমূল বদলে গেল।নিজেকে তৈরি করে ফেললাম স্থানটিতে থাকবার উপযোগী হিসেবে। বুঝতে পারলাম জায়গাটি সত্যিই যেন কতদিনের চেনা। মাথার উপর নির্মল বাতাস আর একে অপরের সঙ্গে খুনসুটি- এটাই যেন এইবাড়ির সদস্যদের সঙ্গে আমারও রোজনামচা হতে চলেছে। আগেই বলেছি, জানলাগুলো বেশ বড় প্রশস্ত; পর্যাপ্ত আলো-বাতাস সারাক্ষণ ঘরে আসা-যাওয়া করে। দিনের আলো নিভতেই নতুন একরকম আলো ঘরকে আলোকিত করে তুললো। এমন উজ্জ্বল আলো আমি আগে কখনো দেখিনি। তার তীব্র আলো যেন ঠিকরে ঠিকরে বেরোচ্ছিল। দাদা জানালো, একে বিজলিবাতি বলে। গ্রামের বাড়িতে কেরোসিনের কুপি দেখে অভ্যস্ত। তার স্থানে আজ এই বিজলিবাতি হঠাৎ আমার ভালোলাগার অনুভূতিকে আবেশে ভরিয়ে তুললো। আমি মুগ্ধ হয়ে পরিবেশটিকে উপভোগ করতে লাগলাম। আরও একটু রাত হলে স্বপন কাকা রাতের খাবার ব্যবস্থা করে ফেললো। স্বপন কাকা জানালো,খুব গরম পড়লে নাকি রাতেও পৃথকভাবে রান্না করতে হয়, অন্যথায় দুপুরের খাবার গরম করে দুবেলা খাওয়ার চল।
রাতে খাওয়ার পর আমরা যে যার জায়গায় শুয়ে পড়ি। দুপুরে ঘুমাইনি শুনে দাদা আমাকে পাশে নিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দেয়। আমার অন্য পাশে ছিল স্বপন কাকা। তবে এবার আর দুপুরে মত অতটা দূরে না শুয়ে একটু দূরেই বিছানা পেতে শুয়ে পড়ে বাপ ও নজরুল চাচা। আমরা যখন শুয়ে পড়ি তখনও বাইরে পথচলতি মানুষের কথাবার্তার শব্দ শুনতে পাই। পরে কখন ঘুমিয়ে যাই তা আমার খেয়াল ছিলনা। হঠাৎ মাঝরাতে ঘুম ভেঙ্গে যায়। চোখ মেলে দেখি শিওরে ও পায়ের দিকে সকলে গোল হয়ে উৎসুক দৃষ্টিতে চেয়ে আছে।আমি নাকি ঘুমের মধ্যে জোরে চিৎকার করে উঠেছি। প্রবল এক অস্বস্তি সেসময় আমাকে আরষ্ঠ করে ফেলে। সকলের কথা স্পষ্ট বুঝলেও আমি কথা বলার মত শক্তি হারিয়ে ফেলি। এই অসহায়ত্ব আমার অস্বস্তিকে আরো বাড়িয়ে তোলে। সারা গায়ে কেমন যেন ব্যথা ব্যথা অনুভব করি।তারমধ্যে ডানদিকের পাঁজরের নিচের ব্যথাটা মারাত্মক আকার ধারণ করে। সকলের মুখে একটাই প্রশ্ন কি হয়েছে? অথচ শত চেষ্টাতেও মুখ দিয়ে একটা শব্দ বের করতে পারছিলাম না। অগত্যা ডান হাত দিয়ে কোনোক্রমে ইশারা করে বুকের যন্ত্রণাকে নির্দেশ করি। তবে মুখ দিয়ে শব্দ বার হবেই বা কেমন করে? ঘুমের মধ্যে গহর এসে দাঁত মুখ চেপে যেভাবে আমাকে সজোরে মাথা দিয়ে ঢুঁসো মারলো সেকথা অন্যকে শেয়ার করি কেমনে। যদিও আমার মুখ দিয়ে কথা বার করার জন্য সকলে তখন মরিয়া হয়ে উঠেছে।এক অজানা আতঙ্ক আমাকে তখন রীতিমত গ্রাস করে ফেলেছে। শব্দ বলতে কেবল অনুচ্চারিত ফুঁপিয়ে কান্না ছাড়া আর কিছুই মুখ দিয়ে বের হচ্ছিল না।
মাঝরাতে এমন চিৎকার-চেঁচামেচিতে বাবুদেরও ঘুম ভেঙে গেল। হালদার বাবুর সঙ্গে অচেনা আরও কয়েকটি মুখ সামনে এসে দাঁড়ালো। সকলের কথা কানে আসছিল, ঘুমের মধ্যে ভয়ঙ্কর কোনো স্বপ্ন দেখেছি বলেই নাকি এমন চিৎকার করে উঠেছি,আর সেই আতঙ্কেই নাকি মুখ দিয়ে শব্দ বার করতে পাচ্ছিনা। আমি দুপাশে চোখ ঘুরিয়ে লোকগুলোকে একবার দেখে নিলাম। না যাকে খুঁজছি সে মুখটা এখানে নেই। মনে মনে নতুন দাদিকে খুঁজতে থাকি। বলতে বলতে দূরে দাদির গলার স্বর শুনতে পাই। ক্রমশ সে স্বর কাছেই চলে আসে। নতুন দাদির উপস্থিতিতে মনের মধ্যে আশার আলো চিকচিক করে ওঠে। ভিতর ভিতর একটা বাড়তি শক্তিও অর্জন করি। দাদি শান্তভাবে আদর করে কি হয়েছে জানতে চাইলেও মুখ দিয়ে কিছু বলতে পারিনি। তবে কথা বলতে না পারলেও আমার ফোঁপানো বন্ধ হয়।দাদি পাশে দাঁড়ানো স্বামীর উদ্দেশ্যে ডাক্তার দেখানোর কথা বললে হালদার বাবু মুখে কিছু না বললেও মাথা নেড়ে সম্মতি জানান। খানিক বাদে পরিচিত ডাক্তারবাবুকে দেখানোর জন্য উনি বাপকে নির্দেশও দেন। সেইমত পরদিন সকালে বাপজানের সঙ্গে পরিচিত ডাক্তারের উদ্দেশ্যে রওনা দিই।
ফ্রম সাতক্ষীরা টু বেলগাছিয়া পর্ব-৫
সর্বশেষ এডিট : ১৬ ই জানুয়ারি, ২০২১ সকাল ১১:৫৮