পরেরদিন সকাল বেলা বাপজানকে সঙ্গে নিয়ে গেলাম ডাক্তার বাবুর চেম্বারে। ডাক্তার বাবু হালদার বাবুর পূর্ব পরিচিত বলা ভালো, বন্ধু স্থানীয়। মূলত সেই সূত্রে বাপজানদের সকলকেই উনি খুব ভালোভাবে চিনতেন। অনেকক্ষণ ধরে সেদিন আমাকে পরীক্ষা নিরীক্ষা করলেন। বুকে পিঠে একটা যন্ত্র ধরে জোরে জোরে শ্বাস নিতে বললেন। এমন যন্ত্র আমি ইতিপূর্বে কখনো দেখিনি। ডাক্তারবাবুর কথামতো জোরে শ্বাস নিতে আমার বেশ কষ্ট হচ্ছিল। রাতের সেই ব্যথাটা তখনও আমাকে বেশ কাবু করে রেখেছিল। উনি হাত দিয়ে বেশ জোরে টিপে টিপে পরীক্ষা করাতে আমার চোখে জল চলে আসে। কোনক্রমে দম ধরে নিজেকে সামলে নিলেও লাগছে কিনা ডাক্তার বাবুর জিজ্ঞাসায়, মুখে কিছু না বলে মাথা নেড়ে সম্মতি জ্ঞাপন করি।চোখে তখন রীতিমত জল ছল ছল করছে।ডাক্তারবাবু আগের দিন রাস্তায় যেতে যেতে এবং দুপুরে ও রাতে কি কি খেয়েছি তার খোঁজখবর নিলেন।এবার মুখ ভার করে বললেন, পেটে অত্যধিক গ্যাস হওয়াতে রাতে বুকের যন্ত্রণার কারণ।চিন্তার কোন কারণ নেই বলে উনি বাপজানকে আশ্বস্ত করলেন। সামান্য কিছু ওষুধ দিয়ে আরেকবার ভয়ের কোনো কারণ নেই বলে হালদার বাবুকেও জানাতে বললেন।অস্বীকার করব না রাতের সেই ভয়াল স্বপ্নটা এতক্ষণ পর্যন্ত আমার মধ্যে চেপে বসেছিল। ডাক্তারবাবুর কথাতে আমিও কিছুটা আশ্বস্ত হই। বাকি রাস্তা কিছুটা ফুরফুরে মেজাজেই বাপের সঙ্গে হাঁটতে হাঁটতে দোকান ঘরে চলে আসি।
আমার এই সুখানুভূতি বেশিক্ষণ স্থায়ী হয়নি। দোকানঘরে ফিরে আমি খুব মর্মাহত হলাম। হালদারবাবু আমাকে গ্রামে ফেরত পাঠানোর যাবতীয় ব্যবস্থা সেরে রেখেছিলেন।শুরুতেই 'আমি যাব না' বলে প্রতিবাদ করলেও কোন লাভ হল না।আমার কথা কারো কাছে গ্রাহ্য হল না। স্বপন কাকার কাছ থেকে জানতে পারলাম,এ বাড়িতে হালদার বাবুর মুখের উপর কথা বলার সাহস কারো নেই। আমরা ডাক্তারখানায় চলে গেলে উনি নাকি দাদাকে ডেকে আমার ফেরানোর ব্যবস্থা পাকা করে যান। জীবনে এক কঠিন লড়াইয়ের সম্মুখীন হলাম। বাপ, দাদা পাশে থেকেও সবাই নির্বিকার। অসহায়ভাবে আমাকে এগিয়ে দিলো এক অনিশ্চয়তার দিকে। মুখে তারা নানাভাবে সান্ত্বনা দিলেও তা যে কোনো ভাবেই আমার পক্ষে যথেষ্ঠ ছিলনা। গহরকে নিয়ে দুশ্চিন্তা যে কি অসম্ভব চাপ তৈরি করেছিল এবং পরিণামে ভিতরে ভিতরে যে কতটা আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়েছিলাম তা কেবল অন্তর্যামীই জানেন।
সেদিন দীর্ঘ রাস্তায় এক প্রকার নিরব থেকেই দাদার পাশে হেঁটে গেছি। শুরুতেই দাদা বিভিন্নভাবে আমাকে বোঝানোর চেষ্টা করেছিল যে এতটা মন খারাপ করার কি আছে, এটাই তো শেষ যাওয়া নয়। কদিন বাদে আবার আমাকে ফিরিয়ে নিয়ে যাবে বলে আমাকে বোঝাতে থাকে। কিন্তু দাদার সেসব কথা আমার কানে ঢুকছিল না। আমি তাৎক্ষণিক ঘটনায় বিশ্বাসী। সুদূরপ্রসারী কোনো ভাবনা আমার মাথায় আসে না বা ভাবার চেষ্টাও করি না।স্বভাবতই দাদার শত কথাতেও আমি একটাও শব্দ না করাতে একসময় বাধ্য হয়ে দাদাও মুখ বন্ধ করে। সেদিনের এই নীরবতা আমার কাছে অধিক শ্রেয় বলে মনে হয়েছিল।ইত্যবসরে গতকাল থেকে ঘটে যাওয়া একটার পর একটা ঘটনা যেন চোখের সামনে ভেসে ওঠে। আজ ডাক্তারখানায় যাওয়ার আগ মুহূর্ত পর্যন্ত যে মানুষটার উদারতা আমাকে মুগ্ধ করেছিল, মূহূর্তেই তা যেন ধুলোয় গড়াগড়ি খেতে লাগলো। ওনার করা সমস্ত কাজ আমার কাছে গুরুত্ব হারাল।কাজেই নেপথ্যের কান্ডারী হিসেবে যাবতীয় ক্ষোভ গিয়ে পড়লো হালদার বাবুর উপরে।
তবে এই না পাওয়ার যাতনার মধ্যেও কিছুটা সুখানুভূতি মনকে আন্দোলিত করে তোলে।শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত স্বপন কাকার মিষ্টি আচরণ কিছুটা হলেও আমার মনকে শান্তি দিয়েছিল।যদিও তা বেশিক্ষণ স্থায়ী হয়নি। মাত্র দেড় দিনের মধ্যেই তার ছন্দপতন ঘটে।কিন্তু সেই স্বল্প সময়ে মনের অজান্তেই আপনজনদের দূরে সরিয়ে স্বপন কাকা প্রবেশ করেছিল হৃদয়ের অনেকখানি গভীরে।জুড়ে নিয়েছিল অনেকখানি স্থানও। কত কথাই না এই অল্প সময়ে মানুষটার সঙ্গে হয়েছিল। দাদির পরে আর একজনের সঙ্গে যেন প্রাণ খুলে কথা বলতে পেরেছিলাম। চলে আসার সময় মাথায় ও পিঠে হাত বুলাতে বুলাতে কাকা বলেছিল,
-মন খারাপ করিস না মাহমুদ। কদিন বাদেই দেখবি আবার ঠিক এখানে চলে এসেছিস।
স্বপন কাকার কথাটা ওই সময় আলাদাভাবে আমার অনুভূতিতে কোন পরিবর্তন না ঘটালেও যতই বাড়ির পথে এগোতে থাকি ততই কানের মধ্যে যেন প্রতিধ্বনিত হতে থাকে। এই ভাবনার সঙ্গে সমান্তরালভাবে গহরের চিন্তাও আমার শিরদাঁড়ায় যেন কুঠারাঘাত করতে থাকে।বুঝতে পারি মনের ক্লান্তি শারীরিক ক্লান্তির উপর চেপে বসেছে।তাই মনের বিরুদ্ধে গিয়ে পা দুটোই শরীরটাকে কোনোক্রমে টানতে থাকে।শেষের দিকে পাও যেন জড়িয়ে আসতে থাকে। অবশেষে দুপুরের অনেক পরে আমরা বাড়িতে উপস্থিত হই।
বাড়ি ফিরতেই প্রত্যাশামতো অস্বাভাবিকতা আমার চোখে ধরা পড়ে।সবাই এসে কথা বলছে ঠিকই কিন্তু তার মধ্যেও কেমন যেন একটা অস্বস্তিকর পরিবেশ, একটা থমথমে ভাব। বুঝতেই পারি মাত্র এক রাতের ব্যবধানে পরিবেশটি আমূল বদলে গেছে। দাদিই প্রথম খবরটি দিল, গতকাল কাবুল চাচার ছোট ছেলে গহর পুকুরে ডুবে মারা গেছে। কথাটা শোনা মাত্রই দাদা আঁতকে উঠলো। কোন পুকুরে, কখন পাওয়া গেছে, সঙ্গে আর কেউ ছিল কিনা,উদগ্রীব ভাবে এক নিঃশ্বাসেই প্রশ্নগুলো করে ফেলে।তবে দাদি অনেকটা নির্লিপ্তভাবে সেসব প্রশ্নের উত্তর দিলেও বারেবারে আমার দিকে তাকাতে থাকে।সে সময় দাদীর চোখে মুখের সঙ্গে গলার স্বরটাও কেমন যেনো অচেনা লাগছিল।জীবনে এই প্রথম দাদিকে আমার কোন অপরিচিত সন্দেহভাজন ব্যক্তি বলে মনে হল।প্রচন্ড অস্বস্তি হচ্ছিল এভাবে পাশে বসে থেকে।সুযোগ খুঁজছিলাম কি করে এখান থেকে বের হওয়া যায়।হঠাৎ পেচ্ছাপ পেয়েছে বলে এক ছুটে ওখান থেকে বেরিয়ে সোজা মায়ের কাছে চলে যায়।মা তখন রান্নাঘরে ব্যস্ত ছিল।আশপাশে দুই এক জন ভাই বোন ছিল।সকলের সঙ্গে টুকটাক কথা বলে গোসল সেরে বারান্দায় শুয়ে পড়ি।অনেক পরে মায়ের রান্না শেষ হয়।খেতে বসলাম ঠিকই কিন্তু খাবার কোন টান ছিল না কিম্বা খাবার কিছুতেই যেনো গলার ওপাশে সরছিল না।খাওয়া শেষে আবার বারান্দায় গিয়ে শুয়ে পড়ি। সেদিন সারাদিনে আর দাদির কামড়া মুখো হইনি।পরপর দুদিন এভাবেই কাটে। আমাকে কেউ কিছু জিজ্ঞাসা না করায়, মনে মনে কিছুটা স্বস্তি পেয়েছিলাম, এটা ভেবে যে এই যাত্রার মতো হয়তোবা বেঁচে গেছি।গহরের পুকুরে ডোবানোর দায়টি অন্তত আমার গা থেকে নেমে গেছে।
মনে মনে যা ভাবি না কেন ভিতরে ভিতরে একটা অস্বস্তি থেকেই গেছিল।আগেও বলেছি শুরুতে দাদির চাহনিটা আমার ভালো লাগেনি। যে কারণে ফেরা থেকেই আমি দাদিকে এড়িয়ে চলছিলাম। দাদা একবার ডেকেছিল আমাকে গহরের কবর জিয়ারত করবে বলে। কিন্তু ক্লান্তির দোহাই তুলে আমি যেতে রাজি হইনি। দাদা অবশ্য স্বীকার করেছিল মাত্র দুদিনেই দীর্ঘ রাস্তা অতিক্রান্তের ফলে আমার অবসন্নের কথা। যে কারণে আর চাপ না দিয়ে নিজেই চলে যায় গহরের কবর জিয়ারত করতে।এই পর্বে দাদা দুদিন বাড়িতে ছিল।দ্বিতীয় দিন রাতের বেলা দাদির কামরা থেকে বেশ জোরে জোরে দুজনেরই কথা শুনতে পাই।এমন উচ্চঃস্বরে কথা ইতিপূর্বে কখনো শুনিনি।অন্ধকারে আমি দূর থেকে দাঁড়িয়ে দেখছিলাম,ভাই-বোন সবাই গিয়ে ভিড় করেছে দাদির কামরার সামনে।আমি অবশ্য আর ওমুখো হইনি। তবে কান খাঁড়া করে রেখেছিলাম ওদের মধ্যে ঝগড়ার কারণ কি তা বুঝতে।রাতে মাকে জিজ্ঞেস করেও তেমন কোনো সদুত্তর পাইনি। মনে মনে বেশ মজা পেয়েছিলাম, যাক তাহলে নিশ্চিন্ত হওয়া গেল। দাদা-দাদি নিজেরা ঝগড়া করছে যখন তাহলে এ যাত্রায় বেঁচে গেছি।
তৃতীয়দিন সকালে দাদা চলে যেতেই দাদি ইশারা করে ডাকে আমাকে। দাদির মুখটা তখনও থমথমে।বুঝতে পারে গত রাতের ঝগড়ার রেশটা তখনও চোখ মুখে রয়ে গেছে। যাইহোক দাদির এমন ডাকে আচমকা বুকের মধ্যে গুরু গুরু করে ওঠে। মুহূর্তে একটা অশনিসংকেত টের পাই। সঙ্গে সঙ্গে দুশ্চিন্তার কালো মেঘ আমার চিন্তার জগতকে আচ্ছন্ন করে ফেলে। মনে মনে প্রশ্ন করতে থাকি, কি এমন কথা থাকতে পারে যে তার জন্য দাদি আমাকে এমন চুপিসারে ডেকে নিয়ে এসেছে।উল্লেখ্য গত রাতে ঝগড়ার ঘটনাটি আমার মাথা থেকে সম্পূর্ণ অদৃশ্য হয়ে গিয়ে বরং নিজের কৃতকর্মের চাপেই কিছুটা চোরের মত দাদির পিছু পিছু কামরায় প্রবেশ করি। আমি ঢুকতেই একবার উঁকি দিয়ে বাইরেটা দেখে নিয়ে, দাদি কামড়ার দরজাটা বন্ধ করে দেয়। ভিতরে ঢুকে তখনও ভালো করে বসিনি।হঠাৎ প্রথম কথা ধেয়ে এলো আমার দিকে,
-গহরকে পুকুরে ডুবিয়েছিস কেন?
দাদি যে এমন করে সরাসরি আমাকে প্রশ্ন করতে পারে তা আমার কল্পনায়ও ছিলনা।উল্লেখ্য গত তিনদিন ধরে তৈরি হওয়া আমার মনের যাবতীয় প্রতিরোধ শক্তি দাদির এক প্রশ্নেই মুহূর্তে ফুৎকারে উড়ে যায়। আমি ঠিক ভেবে পেলাম না ঠিক কি উত্তর দেব বা ছুটে পালিয়ে যাবো কিনা।মাথা নিচু করে চুপচাপ বসে রইলাম। দাদি আবার খোঁচা দিয়ে জিজ্ঞাসা করে,
-কিরে চুপ করে আছিস কেন? আমার কথার উত্তর দে।
বুঝতে পারি, নাহা! দাদি আমাকে ছাড়বেনা।একবার গলা খাকারি দিয়ে গলাটা পরিষ্কার করার চেষ্টা করলেও কোনো শব্দই যেনো বের হচ্ছিল না।একটা অসহনীয় অবস্থা আমাকে রীতিমত অবরুদ্ধ করে ফেলে। নিজের উপর তখন আর কোন নিয়ন্ত্রণ ছিল না।শরীরের তাপমাত্রা হঠাৎ বেড়ে যায়।বাইরে ঘামে গলা-মুখ ভিজতে থাকে অথচ গলার ভিতর শুকিয়ে কাঠ হয়ে যায়।উপায়ন্তর না পেয়ে,ডান পায়ের বুড়ো আঙ্গুল দিয়ে ক্রমাগত মাটির নিচে ঘষতে থাকি।একবার মনে হচ্ছিল, 'না বলে দিই ছুট।কিন্তু পরক্ষনেই মনে হলো ছুটে পালাবোই বা কোথায়।পাশাপাশি পেট থেকে গলা পর্যন্ত বিকল্প প্রতিরোধগুলো যেন আন্দোলিত হতে থাকে।মাঝে মাঝে সেগুলো দুমড়েমুচড়ে গেলেও কিছুতেই একটিকে নির্দিষ্ট করতে পারছিলাম না। ফলে সম্ভব হচ্ছিল না দাদির প্রশ্নের কোন উত্তর দিতে।কতগুলো যুক্তি খাড়া করলেও মুখের এপারে আসছিল না, ওপারেই মিলিয়ে যাচ্ছিল। কেবল সাপুড়ে মন্ত্র পড়ার মতো ঠোঁট দুটোকে আন্দোলিত করে গেছি। ইছামতি নদীর তীরে দাঁড়িয়ে দেখেছি, সব ঢেউ পরিপূর্ণতা পায় না। অগণিত ঢেউ তীরে আসার আগেই মিলিয়ে যায়।আমার প্রতিরোধগুলোও তেমনি সেদিন জিহ্বায় ডগায় আসতে পারছিল না। তার আগে মুখগহবরের মধ্যে বা গলার ভেতরে মিলিয়ে মিলিয়ে যাচ্ছিল।তবে কথা যাই হোক, দাদি এতটা নিশ্চিত কিভাবে হলো তা ভেবে ভিতরে ভিতরে তোলপাড় হতে থাকে। যাইহোক সমস্ত দায় মেনে নিয়ে এই প্রশ্নটা করার ইচ্ছে জাগলেও সেটাও জিহ্বার আসার আগেই শুকিয়ে গেছিল।
আমার নিরুত্তর দেখে দাদি যা বোঝার বুঝে গেছে।এবার আমার আরও কাছে এসে বলতে লাগলো,
-তোর জন্মের সময় তুই ছিলি সাত মেসে,একটা মাংসপিণ্ড টাইপের।হাত পা বুক মাথা তখনও ভালো করে তৈরি হয়নি।বুকের কাছে খুব ধুকপুক ধুকপুক করতো।কেউ ভরসা দিতে পারিনি যে তুই বাঁচবি। ওদিকে তোর মাও ছিল মরণাপন্ন অবস্থায় মধ্যে। টানা কয়েকদিন জ্ঞান ছিল না।কিছু খেতেও পারত না।তোর বাপ রাতদিন পড়েছিল তোর মায়ের পিছনে।যম-মানুষের লড়াই করে অবশেষে তোর মাও সুস্থ হয়। তোকে প্রথম দিন থেকেই নিজের কাঁধে দায়িত্ব নিলেও আশা করিনি যে তুই শেষ পর্যন্ত তুই ফিরবি।যাইহোক উপরওয়ালার রহমতে তুইও ক্রমশ স্বাভাবিক হতে লাগলি।কিন্তু সুস্থ হয়ে তোর মায়ের আরেকটি রূপ দেখে আমি খুব মর্মাহত হয়েছিলাম।তোর মা তোর দিকে ফিরেও তাকাতো না।মুখে বলতো যে ছেলে আমাকে মারতে মারতে পৃথিবীতে এসেছে সে হয়তো কোনদিনো আমাকে মেরেই ফেলবে।আমি কত করে বোঝাতাম, বৌমা ছোট্ট বাচ্চাকে নিয়ে ওরকম বলতে নেই।মনে প্রশ্রয় দিও না এসব চিন্তাভাবনার।ওরা হলো ফেরেশতা।ও রকম ভাবলে উপরওয়ালার রহমত থেকেও বঞ্চিত হবে।সংসারে বালা-মুসিবত কিছুতেই দূর হবে না।কিন্তু কে শোনে কার কথা। কোনদিন পারিনি বোঝাতে।তোকে সামনে দেখলে কেমন যেন হিংস্র হয়ে উঠত।বাধ্য হয়ে আমিই তোকে সারাক্ষণ আগলে রাখতাম।তোর বাপজান তো সারাবছর বাড়ি থাকতো না। আর মায়ের স্নেহ ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত হওয়ায় স্বভাবতই তোর প্রতি একটু দুর্বল হয়ে পড়েছিলাম। আর এ কারণেই নিজের হাতেই তোকে গড়তে থাকি।নিজের ছেলে মেয়ে মানুষ করতে গিয়ে আমি এতটা সতর্ক ছিলাম না যতটা তোর প্রতি হয়েছিলাম।খেলতে গিয়ে পাড়ার ছেলে-মেয়েদের সঙ্গে তোর প্রায়ই ঝগড়া হতো।তোকে ইচ্ছে করেই সবাই খুব রাগানোর চেষ্টা করত।দেখামাত্র আমি সামনে ঢাল হয়ে দাঁড়াতাম। তুইও বদ কম ছিলিস না।কামড়ানো রোগ তোর বহুদিনের।যখন-তখন যাকে-তাকে কামড়ে দিতিস।পাড়ার অনেকে এ নিয়ে তোর মায়ের কাছে অভিযোগ করলেও আমার কাছে সুবিধা করতে পারত না।যদিও তোর মা এই নিয়ে আমাকে কথা শোনাতে কম করতো না।আদর দিয়ে বাঁদর করছি, বলে রাতদিন প্রায়ই অভিযোগ করত।আমি অবশ্য সে সব অভিযোগকে কোনদিনই পাত্তা দেইনি।হেসে উড়িয়ে দিতাম।জানতাম বড় হয়ে জ্ঞান-বুদ্ধি হলে তুই সত্যিকারের মানুষের মত মানুষ হবি।নিজের পাঁচ ছেলেমেয়েকে নিয়ে কখনো আমি এতটা ভাবতাম না।কিন্তু আশপাশে মানুষগুলোর তোর প্রতি এমন আচরণ দেখে আমি সারাক্ষণ খুব চিন্তায় থাকতাম।রাতে ঘুমও ভালো হতো না তোর চিন্তায়।সেই তুই কিনা শেষ পর্যন্ত এতবড় একটা অঘটন ঘটিয়ে আমার যাবতীয় আশা-আকাংখা-স্বপ্ন-সব শেষ করে দিলি? এখন তোকে আমি বাঁচবো কেমন করে?কিছুটা আগাম অনুমান করে গত রাতে তোর দাদাকে বলেছিলাম তোকে সঙ্গে নিতে। কিন্তু সমস্যা আছে জানিয়ে কিছুতেই রাজি হলো না।
কথাগুলো একটানা বলে একটি দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে দাদি চুপচাপ বসে রইলো।
আমিও এতক্ষণ অন্য জগতে ছিলাম। দাদি যেনো চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল।নিজের অপরাধবোধের আগুনে নিজেই দগ্ধ হতে থাকি। ধিক্কার জানাতে থাকি নিজে নিজেকেই।সঙ্গে ঘন ঘন দীর্ঘশ্বাসই এসময় আমাদের উপস্থিতির সাক্ষ্য বহন করছিল।আমি মাথা নিচু করে থাকলেও বুঝতে পারছিলাম যে দাদি শুকনো মলিন মুখে আমার দিকে তাকিয়ে আছে এবং কি অসম্ভব চাপ নিয়ে। সত্যিই তো আমারই বা কি হবে?বুঝতেই পারি কাবুল চাচারা তো তাহলে আমাকে ছাড়বেনা। নানান হাবিজাবি ভাবনা মাথার মধ্যে ঢুকে পড়ে। ভাবতে থাকি এমতাবস্তায় আজি কোথাও পালিয়ে যাব কিনা... খানিক বাদে আমি মুখে কিছু না বলে ঐ স্থান ছেড়ে চলে আসি।
এতক্ষণ রাকিব মিয়াও যেন অন্য জগতে ছিলেন।মামু চাচা থামতেই বলে উঠলেন,
- তারপর..
ফ্রম সাতক্ষীরা টু বেলগাছিয়া (পর্ব-৬/প্রথম খন্ডের দ্বিতীয় পর্ব)
পর্ব-৮
সর্বশেষ এডিট : ১৬ ই জানুয়ারি, ২০২১ সকাল ১১:২৭