মামুচাচা আবার বলা শুরু করলো,
-সেদিন সারাদিন আর দাদির কামরা মুখো হইনি। একটা অস্বস্তি আমাকে সারাক্ষণ তাড়িয়ে বেরিয়েছে।কাছের দূরের পরিচিত-অপরিচিত, কার কাছে গেলে বা কোথায় গেলে নিজেকে এই দুর্দিনে বাঁচাতে পারবো সেটাই ছিল একমাত্র কামনা। কাজেই সেই প্রশ্ন সারাক্ষণ মাথার মধ্যে ঘুরপাক খেতে থাকে। যদিও মনের সমস্ত সম্ভাবনাগুলোকে এক এক করে বানচাল করে হতোদ্যম হয়ে বারান্দার এক কোনে নিজেকে অবরুদ্ধ করে রাখি। আর এরই মধ্যে বাইরের যে কোনো গলার স্বরে বা খুটখাট শব্দে আশঙ্কার প্রমোদ গুণী এই বুঝি কাবুল চাচা এল বলে। এরইমধ্যে সাংসারিক কাজে মায়ের ঘন ঘন বারান্দায় আসাতে বিপদের আঁচ পাই। মনে মনে প্রশ্ন জাগে,তবে কি মাও দাদির মত আমাকে জেরা করার জন্য সময় নিচ্ছে? তবে আশার যে, এখনো পর্যন্ত মায়ের আচরণে তেমন কোনো পরিবর্তন চোখে পড়েনি।বেশ কয়েকবার মা ঘুরে গেলেও কিছু না বলাতে মনে মনে কিছুটা সাহস সঞ্চয় করি। আচ্ছা মা যদি না জানে, সে ক্ষেত্রে দাদি ছাড়া আর কে কে ঘটনাটি জানে, তা জানার জন্য মনে মনে উদগ্রীব হয়ে উঠি। আমার উদ্দেশ্য ছিল মা সহ অন্যান্যদের কাছ থেকে নিজেকে লুকিয়ে রাখা। অথচ সেদিন বারান্দাতেই যেন মায়ের কাজ শেষ-ই হচ্ছিল না। একাজ সেকাজে বারবার মা বারান্দায় আসছিল।
বাধ্য হয়ে মায়ের সামনে বোকার মতো বসে না থেকে নিজেকে ব্যস্ত রাখার মরিয়া উপায় খুঁজতে থাকি। কিন্তু প্রয়োজনের সময়ে যে বুদ্ধিনাশ হয়ে যায়। সেদিন আমার ভয়ঙ্কর অবস্থা হয়েছিল। কোনো হাতামাতা না পেয়ে নিজেকে খুব অসহায় মনে হতে থাকে।আমার উদ্ভ্রান্ত আচরণে মা একবার জিজ্ঞেসও করে,
-কিরে তোর কি শরীর খারাপ লাগছে?
আমি আমতা আমতা করে উত্তর দেই,
-কই নাতো! আমি তো ঠিকই আছি।
মা আবার কাজে চলে যেতেই আমি যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচি। হঠাৎ মাথায় একটা বুদ্ধি এসে যায়। চাম-বাটুল দিয়ে পাখি মারা ছিল আমার অন্যতম প্রিয় একটি নেশা। মুহূর্তেই পুরানো ভাঙাচোরা জিনিসপত্রগুলো নিয়ে বসে পড়ি। বেশ কয়েকটি চাম গুলতি ঠিক থাকলেও কয়েকটি তার মধ্যে খুলে ফেলি। নতুন করে বাঁধার কাজে নিজেকে ব্যস্ত রাখি। চাম বাটুল দিয়ে পাখি মারার জন্য আমার বেশ সুনাম ছিল। কয়েকদিন আগের ঘটনা, বারান্দায় দুটি চড়ুই পাখি খেলা করছিল। খেলার ছলে নিজেদের মধ্যে কিচিরমিচির করছিল আপন মনে।আমি গুটি গুটি পায়ে তাদের অনেকটা কাছে চলে যাই। নিজেকে কোনক্রমে বারান্দার পাশে নারকেল গাছের আড়াল থেকে তাক করে তাদের মধ্যে একটাকে বাটুল দিয়ে ঘায়েল করেছিলাম। বাড়ির সকলে সেদিন আমার খুব তারিফ করেছিল। তবে দাদি খুব বকাবকি করেছিল। ছোট্ট পাখিগুলোকে আর কোনদিন যাতে না মারি সে বিষয়ে একপ্রকার নিশ্চয়তা আদায় করে নিয়েছিল। যদিও সাময়িক পরিত্রান পেতে তখনকার মতো দাদির কথায় সম্মতি দিলেও পরে সুযোগ পেলে ছোট-বড় যেকোনো পাখিকে লক্ষ্য করে যে বাটুল ছুড়তাম না তা নয়। তবে সাফল্য পরে আর আসেনি। আর এই ব্যর্থতার কারণেই পরের দিকে প্রচেষ্টায় ভাঁটা পড়েগেছিল। সেদিন মায়ের সামনে নিজেকে ব্যস্ত রাখতে মোক্ষম সময়ে চাম-বাটুলের নানান বাঁধনে নিজেকে নিয়োজিত রাখি। যদিও সে কাজে একেবারেই মন ছিলোনা। মায়ের পদধ্বনিতে কান খাড়া রেখে,আড় চোখে মায়ের আসা-যাওয়ার দিকেই লক্ষ্য রাখছিলাম। তবে যেভাবেই আড়াল করিনা কেন কপালে যে দুর্ভোগ আছে সে বিষয়ে এক প্রকার নিশ্চিত ছিলাম।
গহরকে জলে ডুবিয়ে মেরেছি বলে দাদি আমার উপর প্রবল বেখাপ্পা হয়। অথচ দাদি ছিল পৃথিবীতে আমার সবচেয়ে আপনজন। দাদির এই পরিবর্তনে আমি মানসিকভাবে প্রচন্ড ভেঙে পড়ি। অথচ আমি তো ওকে মারতে চাই নি, স্রেফ জলে ফেলে দিতে চেয়েছিলাম। ও যে পড়ে মারা যাবে, তা কি আর আমি জানতাম? আমার মনের এই সত্য কথাটি আমি দাদিকে বোঝাই কেমন করে? সেদিন দিন শেষে সন্ধ্যা নামতেই বাইরে ঘুটঘুটে অন্ধকারের মধ্যে কে বা কারা আসছে, এই আশঙ্কায় আমার অন্তরে যেন হাতুড়ি পিটতে থাকে। রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তা আরও গভীর হয়। একটু রাতের দিকে মায়ের ডাকে সাড়া দিয়ে রাতের খাবার খেয়ে যে যার মতো শুয়ে পড়লেও দুশ্চিন্তা কিছুতেই দূর হয়নি। গোটা বাড়ি একেবারে নিঃশব্দে নিশিযাপনে গেলেও তার মধ্যে একা আমিই কেবল নৈশপ্রহরী হিসেবে বালিশে এপাশ-ওপাশ করে গেছি।ঘুম যেন আমার চোখ থেকে শত সহস্র যোজন দূরে পালিয়ে গেছে। কিছুতেই আর ঘুম আসছিল না। বালিশে মাথা দিয়ে ভাবতে থাকি, কি দুর্বিষহ দিনটাই না আজকে কাটলো। আগামীকাল কপালে কি আছে কে জানে?
সাধারণত বাড়ির সকলের সকাল সকাল ঘুম থেকে ওঠার রেওয়াজ। আমিও বরাবরই ভোরবেলায় উঠে পড়তাম। কিন্তু সেদিন রাতে ঘুম না হলেও সকালে উঠতেও ইচ্ছে হচ্ছিল না।আলসেমি করেই বিছানায় শুয়ে থাকি।রাতে ঘুম না হওয়াতে বুঝতে পারি চোখদুটিতে খচখচানি শুরু হয়েছে। এই অবস্থায় আরো কিছুক্ষণ শুয়ে থাকি। তবে একটা সময় এভাবে পড়ে থাকাটা আর সম্ভব হলো না। সকালের মিষ্টি রোদ বারান্দায় উজ্জ্বলভাবে কিরণ দেওয়াতে আমার আরও একটা কৌশলের হলো অপমৃত্যু। বাড়ির সকলে যেখানে উঠে পড়েছে সেখানে আর শুয়ে থাকিই বা কেমন করে? খানিকবাদে ঘুঁটের ছায়ে দাঁত ঘষতে ঘষতে দাদির কামরার সামনে পায়চারি করি। ভাবনা ছিল দাদি হয়তো গতকালের ঘটনা ভুলে আবার আগের মত কাছে ডাকবে। ফজরের নামাজের পরে দাদি সাধারণত আরো কিছুক্ষণ শুয়ে থাকে। আমি এই সময়ের জন্য অপেক্ষা করছিলাম। কিন্তু সেদিন বাইরে ঝলমলে রোদ উঠলেও কামরা থেকে দাদির কোন সাড়াশব্দ না পেয়ে মনে মনে দাদির উপর বেশ অভিমানী হই। পাল্টা ভাবতে থাকি, ভুল তো মানুষ মাত্রই করে থাকে। একবার কাছে ডাকলে না হয় আরও একবার ক্ষমা চেয়ে নিতাম। তাই বলে একেবারে হীরের মা কিরে করে বসে থাকা! আমার সঙ্গে কথা না বলে যদি দিন যায়, তাহলে আমারও দিন আটকে থাকবে না। দাদির উপর পাল্টা অভিমান করে এবার আমিও দাঁত মাজতে মাজতে জোরে গলাখাকারি দিয়ে হাতমুখ ধুতে চলে যাই। আরো বেশ কিছুক্ষন কেটে গেল তবুও দাদির কোনো সাড়া শব্দ না পাওয়াতে এবার যেন মনে কেমন একটা অনুভূতি তৈরি হয়। যেনতেন প্রকারে দাদির সামনে পড়তে প্রবল ইচ্ছে তৈরি হয়। সঙ্গে কেমন যেন মনে মনে একটা খচখচানি শুরু হতে থাকে। এমন সময় মা বেশ জোরে জোরে আমার নাম ধরে ডাকতেই জ্বি বলে সাড়া দিয়ে কাছে চলে যাই।
-দেখ তো তোর দাদি উঠেছে কিনা....
মায়ের নির্দেশে কিছুটা আহ্লাদিত হয়ে কামরার উদ্দেশ্যে পা বাড়াই।
'দাদি দাদি' বলে ডাকতে ডাকতে কামরার দরজা ঠেলতেই বুঝি ভিতরে থেকে ছিটকিনি দেওয়া। প্রাথমিক বাঁধা যে কোন মানুষের গায়ের জোর অনেকটা বাড়িয়ে দেয়। আমিও শুরুতে বাঁধা পেতেই আরও জোরে জোরে ধাক্কা দিয়ে উচ্চঃস্বরে 'দাদি দাদি' বলে ডাকতে থাকি। কিন্তু ভেতর থেকে কোন উত্তর নাই। এদিকে আমার জোরে চিৎকার চেঁচামেচিতে বাড়িতে উপস্থিত সকলের সঙ্গে আশপাশের কিছু লোকজনও ছুটে আসে। সকলে যে যার মত জোরে জোরে ধাক্কা দিলেও ভিতর থেকে কোন সারা শব্দ নেই।প্রবল দুশ্চিন্তায় উৎসুক্য দৃষ্টিতে আমরা একে অপরের দিকে মুখ চাওয়াচাওয়ি করতে লাগলাম। আমাদের অপেক্ষার প্রহর শেষ হলো বটে তবুও ভিতরের কোন সাড়াশব্দ না পাওয়াতে এক সময় আমাদের ধৈর্যের বাঁধও ভেঙে যায়। বেশ কয়েকজন মিলে এবার সজোরে দরজায় ধাক্কা দিতেই বাঁশের দরজা গেল খুলে। কিন্তু ভিতরে ঢুকেই দেখি সর্বনাশ! বাঁশের আঁড়াতে পড়েনো শাড়ি পেঁচিয়ে দাদি ঝুলে আছে। নিজের চোখকে যেন বিশ্বাস হচ্ছিল না, যে আমি ঠিক দেখছি তো! ক্রমশ আমার চোখ ঝাপসা হয়ে গেল। সবকিছু অন্ধকার দেখতে লাগলাম। মাথাটাও যেন স্মৃতি শূন্য হয়ে গেল। কিন্তু পরক্ষণেই কিছু সময়ের জন্য আবার সম্বিত ফিরে পেলাম। সকলে মিলে ধরাধরি করে দাদিকে উপর থেকে নামানো হলো। পাড়ায় যারা বাকি ছিল তারাও ছুটে এলো আমাদের চিৎকারে। উপস্থিত অনেকেই দাদির গায়ে হাত দিয়ে দেখল। নাহা! একদম ঠাণ্ডা হয় গেছে। শরীর অনেকটা কাঠ হয়ে গেছে। মুহূর্তে আমার পৃথিবী ভেঙে চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে গেল। সমবেত চিৎকারে মেনে নিতে বাধ্য হলাম যে দাদি আর নেই। ঘটনার আকস্মিকতায় কান দুটোতে যেন প্রবল বিস্ফোরণ হওয়ার উপক্রম হলো। আমি হতোদ্যম হয়ে মেঝেতে বসে পড়লাম। এরপরের ঘটনা আমার আর মনে নাই।
পরে যখন চোখ মেলে দেখলাম একদল মহিলা আমাকে ঘিরে বসে আছে। কেউ বাতাস করছে, কেউ বা মাথায় জল দিচ্ছে। চারিদিকে লোকে লোকারণ্য। পাশাপাশি চাপা, মৃদু এবং উচ্চঃস্বরে কান্নার রোল বাতাসে মুহুর্মুহু আছড়ে পড়ছে। যে শব্দ আমার কানকে আরও ভারাক্রান্ত করে তুললো।উচ্চঃস্বরে কান্নার শব্দটি চিনতে পারলাম, যে এটি আমারই মায়ের। আমি তেরেফুরে উঠে হাঁটু মুড়ে মাথা নিচু করে বসে রইলাম।পাশের চাচার বাড়ি থেকে কোরআন শরীফ তেলাওয়াতের আওয়াজ কানে ভেসে এলো। বুঝলাম বেশ কয়েকজন মিলে কোরআন তেলাওয়াত করছে।এত বিষন্নতার মধ্যেও শব্দটি খুব আশাপ্রদ হয়ে হৃদয়ের অন্তঃস্থলে ঢুকে গেল। আমার এভাবে বসে থাকায়, উপস্থিত একজন মহিলা বলেই উঠলো,
-মাহমুদ বাবা! শেষবারের মতো দাদির মুখটা একবার দেখে এসো।
তাদের বিভিন্ন জনের বিভিন্ন কথা আমার কানে আসছিলো কিন্তু কোনো কিছুই যেন আমার কানের মধ্যে ঢুকছিল না। শুধুমাত্র শেষবারের মতো দাদির মুখ দেখার সুযোগটা গ্রহণীয় হলো। দুজন আমাকে দুদিকে হাত ধরে রাখলো। তাদের দেখানো পথেই টলতে টলতে আমি কোনোক্রমে এগিয়ে চললাম.....
পর্ব-৭
পর্ব-৯
সর্বশেষ এডিট : ১৬ ই জানুয়ারি, ২০২১ সকাল ১১:১৩