দুজনের শরীরের উপর ভর দিয়ে টলতে টলতে কোনোক্রমে দাদির খাটিয়ার উদ্দেশ্যে পা বাড়ালাম। উঠোনের এক প্রান্তে দাদিকে শায়িত করা আছে।বুঝতে পারলাম দাদির কাফনের কাজটি ইতিমধ্যে সম্পন্ন হয়ে গেছে। চারিদিকে উৎসুক্য জনতার ভিড়। তারমধ্যে পথ করে এগোতে রীতিমতো অসুবিধা হচ্ছিল। অবশেষে পাশে গিয়ে দাঁড়াতেই, কে একজন সাদা কাপড়ে আপাদমস্তক ঢাকা দাদির মুখের কাপড়টা ঈষৎ সরিয়ে দিতেই নিজেকে আর ধরে রাখতে পারলাম না। মনের মধ্যে জমে থাকা কান্নাগুলো যেন এতক্ষণে হুরমুড়িয়ে বেরিয়ে এলো। প্রবল কান্নার রোল তুলে খাটিয়া ধরে বসে পড়লাম। খানিক বাদেই ভারী গলায় একজনের ধমকানি কানে এলো। মায়াতের পাশে নাকি এমন উচ্চস্বরে মায়া কান্না কাঁদতে নেই। স্বভাবতই এমন অপ্রত্যাশিত ধমকানিতে কিছুটা হতচকিত হয়ে যাই। মুখ তুলে দেখি, শ্বেত শুভ্র দাড়িওয়ালা একজন দীর্ঘাঙ্গী লোক আমার দিকে বড় বড় চোখ করে তাকিয়ে আছেন। পরে জেনেছি উনি নাকি দাদির এক চাচাতো ভাই হন। যাইহোক উনার ধমকানিতে কান্না বন্ধ হলেও মনের মধ্যে ডুকরে বয়ে চলা কান্না গুলো যেন গলার কাছে এসে দলা পাকিয়ে যাচ্ছিল। মাঝে মাঝে দুই-একটা প্রবল জলোচ্ছাসের ন্যায় দুই ঠোঁটের বাঁধ ভেঙে বাইরে বেরিয়েও আসছিল। অথচ যার উপরে আমার তখন কোনো নিয়ন্ত্রণ ছিল না। এমন সময় উনি আরেকবার চমকাতেই মনের কান্নার ঢেউগুলো অবলীলাক্রমে মিলিয়েও গেল। সাথে সাথে বুঝতে পারি স্থানটি আমার কাছে বেশ অসহনীয় হয়ে উঠেছে। চারপাশটা একবার তাকিয়ে দেখি লোকে লোকারণ্য। কেমন যেন সকলে ফ্যাল ফ্যাল করে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। সবাইকে আমি চিনিও না জানিও না তারা দাদির কে কি হন বা কোথায় থাকেন। তবে এটুকু বুঝেছি তারা সবাই আমাদের আত্মীয় কুটুম্ব। দাদির খবর শুনে তারা যে যার মত চলে এসেছেন একবার চোখের দেখা দেখবেন বলে। পরপর চমকানিতে হৃদয়ের কান্না গুলোকে অবদমিত করে বরং উপস্থিত আত্মীয় কুটুম্বদের কিছুটা সুবিধা করে দিতেই ভিড় ঠেলে এসময় বাইরে বেরিয়ে আসি।
বলতে দ্বিধা নেই যে এত মানুষের সমাগম দেখে সেদিন বিষন্নতার মাঝেও কিছুটা হলেও খুশি হয়েছিলাম, এটা ভেবে যে আমাদের আত্মীয় কুটুম্বের সংখ্যা নেহাত কম নয়। উল্লেখ্য পরবর্তী বহুদিন পর্যন্ত লোক কুটুম্বের এমন লম্বা বহর নিয়ে আমার শিশু মনে বেশ পুলকিত বোধ করতাম। কিন্তু পরে যখন দেখেছি আশেপাশের অন্যান্য মৃত বাড়িতেও এমনই লোকসমাগম হয়, তখন অবশ্য ধারণাটি ধীরে ধীরে অস্তমিত হয়ে যায়। আত্মীয়তার সম্পর্ক না থাকলেও বিপদের দিনে একে অপরের পাশে দাঁড়ানোটাই গ্রামাঞ্চলের একটা অলিখিত রীতি ধারণাটি এ সময় থেকেই মনের মধ্যে প্রোথিত হতে থাকে।
সেদিন উপস্থিত বহু লোকের মুখে ঘুরে ফিরে আসছিল দাদার প্রসঙ্গ। কয়েকজন বারেবারে জানতে চাইছিল বাপ-দাদা সম্পর্কে। আমি কারো কোন প্রশ্নের উত্তর দিতে পারিনি কারণ বাপ দাদা এসে পৌঁছেছে কিনা কিংবা কখন আসবে বিষয়টি ছিল আমার কাছে সম্পূর্ণ অজ্ঞাত। অস্বীকার করব না যে তাদের মত আমিও মনে মনে উত্তর খুঁজতে থাকি, বাপ দাদাকে দাদির মৃত্যুর খবর জানাতে গেলোই বা কে? বরং এমন অপ্রত্যাশিত দুর্ঘটনার মধ্যে কেউ সেখানে পৌঁছে গেছে কিনা সে প্রশ্ন আমাকে রীতিমতো ভাবিয়ে তোলে। এমনই ভাবনা নিয়ে ভিড় ঠেলে বাড়ির ভিতরে প্রবেশ করতেই দেখি একদল মহিলার ভীড়। সকলের পাশ কাটিয়ে উঁকি মারতে দেখি, মা নিস্তেজ হয়ে পড়ে আছেন। পরে বুঝেছি ঘটনাটাকে মূর্ছা যাওয়া বলে। কয়েকজন মায়ের মাথায় ক্রমাগত পানি দিচ্ছেন এবং বাতাস করছেন। চোখের সামনে ঘটনাটি দেখে আমি বিষন্নতায় কাট হয়ে যাই। বড় দুই বুবুকেও দেখলাম মলিন মুখে মায়ের পাশে বসে আছে। হঠাৎ আমাকে দেখে এমনই একজন, বাপ দাদা ফিরেছেন কিনা জানতে চাইলো। আমি মাথা নেড়ে না সূচক উত্তর দিয়ে পাল্টা জিজ্ঞেস করি, কে গেছে তাদের খবর দিতে। তখনই জানতে পারি আমার বাপের মেজ ভাই মানে ইসমাইল চাচা সেই সকালেই বেরিয়ে গেছেন শহরে বাপ-দাদাকে খবর দিতে। উত্তরটা পেয়ে মনে-মনে কিছুটা আশ্বস্ত হলাম যাক একটা বিরাট দুশ্চিন্তার তাহলে অবসান হলো।
আসরের নামাজের পর দাদির জানাজা সম্পন্ন হয়। বাড়ি থেকে একটু দূরে পারিবারিক কবরস্থানে দাদিকে সমাধিস্থ করা হয়। কবরস্থ করার পর হঠাৎ কোনো এক সময় আমি সামনে পড়ে যেতেই হঠাৎ দাদা হাউমাউ করে কেঁদে উঠে আমাকে জড়িয়ে ধরে।দাদার এমন অপ্রত্যাশিত আচরনে আমি কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়ি। নিজের বুক চাপাতে চাপাতে বিলাপ করতে থাকে,
-কেন আমাকে একবার খুলে বললে না আনোয়ারা যে মাহমুদকে বাঁচাও! মাহমুদকে বাঁচাও।
এত লোকের মধ্যে দাদার এমন আকস্মিক বিলাপে আমার অন্তরাত্মা কেঁপে ওঠে। পাশাপাশি নতুন করে আশঙ্কার কালোমেঘ আমার হৃদয়কে ঘনীভূত করে তোলে। আমি বোকার মতো দাঁড়িয়ে থাকলেও দাদা আমাকে জড়িয়ে নিজে নিজেকে সমানে প্রশ্ন করতে থাকে,
-কি এমন বিপদ দাদুভাই তোর মধ্যে দেখেছিল যা আমাকে খুলে বলতে পারেনি।
বিলাপের ছলে হলেও দাদার এমন বুকফাটা আর্তনাদে আমি অশনিসংকেত টের পাই। উপস্থিত কয়েকজন দাদাকে শান্ত হতে পরামর্শ দিয়ে ধরাধরি করে কামরায় নিয়ে যায়। আমিও এত লোকজনের ভিড়ে ঘটনা কি ঘটে না ঘটে আশঙ্কা করে সেদিনকার মত দাদার সামনেও না যেতে মনস্থির করি।
এদিকে পরপর দুদিন দুটো মৃত্যুর ঘটনা গ্রামবাসীদের মুখে মুখে ঘুরে ফিরে আসতে থাকে। গহরের মৃত্যু দু'দিনের বাসি হলেও দাদির সদ্য মৃতুর ঘটনা সবাইকে একপ্রকার শঙ্কিত করে তোলে। সিরিয়াল মৃত্যু শুরু হল কিনা ঘুরেফিরে সে প্রশ্নও উঠতে থাকে। এমন আশঙ্কার থমথমে পরিবেশে গোটা গ্রামবাসী প্রহর গুনতে থাকে। এমতাবস্থায় ভালো গুনিন দিয়ে গ্রাম ঘেড়া যায় কিনা কিম্বা সকলে মিলে দোয়াখানি দেয়া যায় কিনা এসব কথা লোকমুখে প্রচার হতে থাকে। সকলে প্রায়ই বলাবলি করে গ্রামে নাকি জীন-ভূতের ভর করেছে। যখন তখন যে কারো ঘাড়ে আসতে পারে জ্বীনের আছর। এমতাবস্থায় সমগ্র গ্রামবাসীরা ভয়ে সিঁটিয়ে থাকে। তবে এরই মধ্যে একদল আবার আকার ইঙ্গিতে দাদির মৃত্যুর জন্য দাদাকেই দায়ী করে। দিনের-পর-দিন দাদার শহরে পড়ে থাকাটাই দাদির মৃত্যুর প্রধান কারণ বলে কানাঘুষো কথা প্রচার হতে থাকে। দাদাও যেন কয়েক জনের চোখ-মুখের ভাষা বুঝে যায়। তাই তাদের অনুচ্চারিত অব্যক্ত হত্যার দায় নিজের কাঁধে নিয়ে বিলাপ করতে করতে হঠাৎ হঠাৎ বলতে থাকে,
-হ্যাঁ আমিই মেরেছি আনোয়ারাকে। আমিই মেরেছি। আমিই আনোয়ারার মৃত্যুর জন্য দায়ী। ঘটনার কয়েকদিন পর সকাল বেলার দাদার কামরায় যেতেই আমাকে দেখে আবার শিশুর মতো আচরণ করতে থাকে। আর্দ্র গলায় নিজের বুক চাপড়াতে চাপড়াতে বলতে থাকে,
-হ্যাঁ দাদুভাই আমিই মেরেছি তোর দাদিকে। আমিই মেরেছি। আমিই তার মৃত্যুর জন্য দায়ী। কতবার বলেছিল শহরের কাজ ছেড়ে দাও ছেড়ে দাও। বয়স হয়েছে। এবার পাকাপাকিভাবে বাড়ি চলে এসো। কিন্তু আমি তার কোন কথাই শুনিনি কখনও। আমি পাল্টা ওকে বোঝাতাম, সুরত চলে খেটে খাই, দুটো পয়সা পাই। এখনো ছেলেদের কাছে হাত পাততে হয় না। কিন্তু তাতে ও কোনদিন খুশি হয়েছিল বলে মনে হয়নি।
কিছুক্ষণ থেমে থেকে দাদা আবার বলতে লাগলো,
-শেষবার এসে ধরলো আবার নুতন বায়না। তোকে শহরে বাপের কাছে রেখে এসে আমাকে গ্রামে ফেরার জন্য পীড়াপীড়ি করেছিল। সেটাও আমি রাখতে পারিনি। বলেছিল তুই নাকি খুব বিপদের মধ্যে আছিস। ছোট্ট বাচ্চা ছেলের আবার বিপদ কিসের শুনে আমি খুব করে হেসেছিলাম। উড়িয়ে দিয়েছিলাম অদ্ভুতুড়ে যুক্তি বলে। সেদিন রাতে এই নিয়ে কতই না মান অভিমান করেছিল। তবে বুঝেছিলাম ও খুব রেগেছিল। শেষমেষ আমাকে রাজি করাতে না পেরে, বলেছিলে তোকে কাজে না নিয়ে গেলে নাকি আমার মরা মুখ দেখবে। আচ্ছা এমন টুকটাক ঝগড়া-ঝাটি কোন সংসারেই না হয়না। তাই বলে মুখে যা বলল সেটাই করতে হবে? বলেই দাদা আবার শিশুর মত বিলাপ করতে থাকে,
-আনোয়ারা আমাকে ফাঁকি দিয়ে চলে যাবে আমি কল্পনাও করতে পারিনি দাদুভাই...
আমি শুকনো মুখে ঘনঘন দীর্ঘশ্বাস ফেলি আর আমার ছোট হাত গুলো দিয়ে দাদার মাথায় পিঠে হাত বুলিয়ে শান্ত হতে অনুরোধ করি। এমন সময় নিজেকে কিছুটা সংযত করে দাদা এবার আমার কাছে জানতে চাইলো,
-আচ্ছা দাদুভাই তোর দাদি তোর কি বিপদ অনুমান করেছিল, তুই কি কিছু বলতে পারবি?
দাদার এমন প্রশ্ন আমার ব্রহ্মাস্ত্রে যেন বজ্রাঘাত করে।মুহূর্ত যেন আমার শ্বাস-প্রশ্বাস বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়। কোনোক্রমে ঢোক গিলে শ্বাসযন্ত্রকে সচল রাখি। তবে এটুকু বুঝতে পারি আসন্ন বিপদ সম্পর্কে দাদি দাদাকে নিশ্চয়ই কিছু জানায়নি। নইলে দাদা এভাবে আমাকে প্রশ্ন করত না। এমতাবস্থায় নিজেকে শান্ত রেখে কিছুই জানিনা বলে দাদাকে প্রতি উত্তর দিই বটে, তবে মনে মনে ভাবতে থাকি জানিনা এভাবে আর কতদিন নিজেকে নিজের সঙ্গে লুকোচুরি খেলে আড়াল রাখতে পারব।
ঘটনার পরে আরো বেশ কিছুদিন কেটে গেছে গোটা গ্রাম মোটামুটি শান্ত। নতুন করে কোনো মৃত্যুর খবর গ্রামের কোথাও নেই। এ সময় অনেকেই বলতে লাগলো দাদার নাকি মাথা খারাপ হয়ে গেছে। বলার যদিও কারণও ছিল। দাদা প্রায়ই বাড়ির সামনে পুকুর পাড়ে গিয়ে কখনো হাসতো, কখনো আনমনে পাশে খেজুর গাছের তলায় বসে উদাস মনে দূর আকাশের দিকে চেয়ে থাকত। মাঝে মাঝে ছুটে যেত দাদির কবরের পাশে। আমরা ভাই-বোন সারাক্ষণ দাদাকে চোখে চোখে রাখতাম। বেশকিছুদিন এভাবে চলার পর দাদা আস্তে আস্তে স্বাভাবিক হতে থাকে।
এমন সময় রাকিব মিয়া বলে ওঠেন,
-হ্যাঁ আমরাও তো এ সময় তোমার দাদাকে পাগলা দাদু বলেই জানতাম।
কথার মান্যতা দিয়ে মামু চাচা আবারো বলতে লাগলো,
-আরো কিছুদিন পরে দাদা গ্রামেই টুকটাক বাঁশের কাজ শুরু করে। পাগলা লোকটা কত সুন্দর না বাঁশের চৌকি তৈরি করত ,না দেখলে বিশ্বাস করা যাবে না। তবে দাদির প্রসঙ্গ উঠলে দাদার মুখায়ব মুহূর্তে বদলে যেত। প্রচন্ড ভয়ে ছিলাম দাদাও না শেষ পর্যন্ত দাদির পথ ধরে।
এমন সময় রাকিব মিয়া উঠতে যাচ্ছিলেন,
সঙ্গে সঙ্গে মামুচাচা বলে উঠলো,
-মিয়াসাহেব গল্প যে এখনও শেষ হয়নি....
পর্ব-৮
পর্ব-১০
সর্বশেষ এডিট : ১৬ ই জানুয়ারি, ২০২১ সকাল ১১:১১