মামু চাচা আবার বলতে লাগলো,
-দাদির মৃত্যুর খবর পেয়ে দাদা সেই যে চলে এসেছিল তারপর আর শহরমুখো হয়নি। পূর্বেই উল্লেখিত যে দাদির মৃত্যু দাদাকে সম্পূর্ণ বদলে দিয়েছিল। মানুষটার হাঁটা-চলা ভাবভঙ্গি সবকিছুই যেন স্থবির হয়ে গিয়েছিল।সারাক্ষণ কামরার মধ্যে কেবল শুয়ে বসে কাটাতো। তিনবেলা খাবার দিলে খেতো।না দিলেও মুখে একবারও খাবারের কথা আনতো না। মা কয়েকবার দাদাকে এভাবে সময় না কাটিয়ে বরং শহরে কাজে যাওয়ার পরামর্শ দিয়েছিল। যদিও দাদা মুখে কিছু না বলে বা না শোনার ভান করে মুখ নিচু করে থাকতো। মা পুনরাই বললে, কখনো বা মুখ তুলে মায়ের দিকে করুণভাবে তাকিয়ে থাকতো। সেই তাকানোর মধ্যে আমি দেখতে পেতাম এক অসহায়ত্বের ছবি যা চোখেমুখের অভিব্যক্তিতে যেন পরিস্ফূট ছিল। আমার মন চাইতো মা যেন দাদাকে এরকমভাবে আর কিছু না বলে। দাদার নির্লিপ্ততার কারণেই হোক অথবা আমার অন্তরের কথা জানতে পেরেই হোক পরের দিকে মা আর দাদাকে কাজে যাওয়া নিয়ে কিছুই বলতো না।ফলে কিছুটা নিশ্চিন্তে বসে শুয়েই দাদার এসময় দিন কাটছিল। এমনই একদিন সকালে খুব ব্যস্ততার সঙ্গে ওনাকে বেরিয়ে যেতে দেখে খুব অবাক হই। যদিও যাবেই বা কোথায় ভেবে প্রথমে বিষয়টিকে পাত্তা দেইনি। ভেবেছিলাম আশেপাশে কোথাও গেলেও অল্প সময় পরে ঠিক চলে আসবে। কিন্তু সেদিনের আমার সেই প্রতীক্ষার কিছুতেই যেনো আর শেষ হতে চাইছিল না। একেতো একটা অপরাধ প্রবণতা সারাক্ষণ তাড়া করে বেড়াতো। তার পরে সেদিনের বেপাত্তায় ভিতরে ভিতরে যে কতটা দুশ্চিন্তিত হয়ে পড়েছিলাম তা কেবল অন্তর্যামীই জানেন।
সেদিন দাদার দীর্ঘ অনুপস্থিতিতে প্রচন্ড অস্থির হয়ে পড়েছিলাম। আমার মত মাও খুব উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছিল। একটা সময় আর চুপ করে বসে থাকতে না পেরে মা দুপুরের পরে বড় ভাই বোনদের এখানে-ওখানে খোঁজ করতে পাঠিয়ে দেয়।কিন্তু এক এক করে সবাই ফিরে এলেও কোনো সন্ধান না পাওয়াতে দুশ্চিন্তার করাল ভাঁজ আমাদের গোটা পরিবারকে গ্রাস করে। অগত্যা বাড়ির বড়দের খবর দেওয়ার জন্য সবে কথাবার্তা চলছিল এমন সময় সন্ধ্যার একটু আগে দাদা বাড়ি ফিরলে আমাদের যাবতীয় সংশয়, দুশ্চিন্তার নিরসন হয়। আমরা উৎকন্ঠিত হয়ে নানান প্রশ্নে দাদাকে জর্জরিত করলেও প্রতিউত্তরে দাদা নিরুত্তর থাকে। পরেরদিন একইভাবে সকালবেলা আবার বের হলে আমি মায়ের নির্দেশমতো দাদাকে অনুসরণ করতে থাকি। অনেকটা পথ হেঁটে গিয়ে দেখি দাদা একটা বাড়িতে সবে বাঁশের কাজে হাত দিয়েছে। সামনে পড়ে যেতেই ধরা খেয়ে গেলাম। অকপটে স্বীকার করি,
-তোমাকে খুঁজতেই আমি বার হয়েছি।
স্বভাবতই দাদা খুব খুশি হয়েছিল সেদিন আমার এমন পিছু নেওয়াতে বা এমন অকপটে স্বীকারোক্তিতে। শিশুর মতো এক গাল হেসে,
-এসেছিস যখন আমাকে সাহায্য করনা দাদুভাই?
আমি এক কথায় রাজি হয়ে যাই। সেদিন থেকেই নেমে পড়ি দাদার সঙ্গে বাঁশের কাজ করতে। একটু বেলা বাড়লে বাড়িওয়ালা দাদি পরম যত্নে দাদার জন্য কাঁচা লঙ্কা ও পেঁয়াজ দিয়ে পান্তাভাত সাজিয়ে আনে। আরেকটি থালা চেয়ে নিয়ে কিছুটা ভাত দাদা আমাকে খেতে দেয়।কি অসাধারণ লেগেছিলো কাজের বাড়িতে সেদিন দাদার সঙ্গে বসে পান্তাভাত খেতে। কাজ করলে যে অন্যের বাড়িতেও খাবার পাওয়া যায় এটা আমার কাছে ছিল সম্পূর্ণ অজ্ঞাত।মনে মনে সংকল্প নেই, এমন সুযোগ কিছুতেই হাতছাড়া করা যাবে না। উল্লেখ্য সেদিন দুপুরবেলাতেও দাদার খাবারে আমি ভাগ বসায়। সেদিন বেলাকরে বাড়ি ফিরলে মা অবাক হয়। মাকে খুলে বলি সব কথা। মায়ের পরামর্শ মতো পরেরদিন থেকে পুরো মাত্রায় দাদার সঙ্গে কাজে নেমে পড়ি।বলে রাখা ভালো যে দাদার কাছে কাজ শেখার চেয়ে কাজের বাড়িতে সকালের পান্তাভাত ও দুপুরের গরমভাত যে আমাকে কাজের প্রতি অধিক আকৃষ্ট করে তুলেছিল তা অস্বীকার করি কেমনে।
এদিকে দাদা গ্রামে কাজ করছে- এ খবর খুব দ্রুতই চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। ফলে অল্পদিনের মধ্যেই আশেপাশের বিভিন্ন জায়গা থেকে টুকটাক বাঁশের কাজ আসতে থাকে। অবশ্য বেশি দূর হলে দাদা সঙ্গে সঙ্গে না করে দিত। দাদার সঙ্গে থাকতে পেরে এতদিন পরে আমারও যেনো একটা হিল্লে হল। নতুন কাজের সূত্রে দাদার সঙ্গে আমার সখ্যতা ক্রমশ বাড়তে থাকে। দাদার পিছনে আঠার মত লেগে থাকতাম এক কাজের বাড়ি থেকে আরেক কাজের বাড়ি পর্যন্ত। দাদার পিছনে এভাবে ঘুরে বেড়ানোয় মায়ের দিক থেকেও কোনো সমস্যা ছিল না। মায়ের কাছে কাজের চেয়ে দাদাকে চোখে চোখে রাখাটাই অধিক গুরুত্বের ছিল। যাইহোক দাদার পিছনে লেগে থাকায় কিছুদিন যেতেই কাজটির প্রতি আমার বেশ আকর্ষণ তৈরি হয়। দাদাকে বলিও সে কথা।খুব খুশি হয়েছিল সেদিন দাদা আমার সরল মনের এমন ভালোলাগা প্রতিক্রিয়া পেয়ে। পরের দিকে কাজ করতে গিয়ে বুঝেছি দাদাকে সবাই খুব খাতির করতো। আমিও যেন দাদার সেই সম্মানের কিছুটা ভাগীদার হয়ে উঠলাম। দাদার সুবাদে আমাকেও লোকে বেশ খাতির করতে থাকে। আমি বিষয়টি বেশ উপভোগ করতাম। প্রায়ই কাজের ফাঁকে ফাঁকে বিভিন্ন খুটিনাটি বিষয় নিয়ে দাদার সঙ্গে আমার আলোচনা হতো। প্রচন্ড স্মৃতিকাতর হয়ে যেতো দাদা শহরের প্রসঙ্গ উঠলে। কত বড় বড় মানুষের সঙ্গে শহরে দাদার পরিচয় ছিল।উঠে আসতো হিন্দু-মুসলিম সম্প্রীতির কথা।হালদার বাবুর বাড়িতে দুর্গাপূজার সময় কতই না তারা মজা করত। উৎসব অনুষ্ঠান উপলক্ষে হৈ-হুল্লোড় আমোদ-প্রমোদের কথা শুনে আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকতাম। কতরকমের মজাদার খাবার দাবারের কথাও দাদা উল্লেখ করতো।শহরে না গেলে নাকি মানবজীবন অসম্পূর্ণ থাকতো।
তবে এত আনন্দ,এত উপভোগের মধ্যেও একটা বিষন্নতার করুন সুর দাদার কথায় ও চোখে মুখে ধরা পড়তো। মুহুর্তের মধ্যেই কেমন যেন গুটিয়ে যেত। ঘনঘন দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলতো,
-স্বাধীনতা বুঝি আমরা আর এজীবনে দেখে যেতে পারব না দাদুভাই।
দাদার এই হঠাৎ গম্ভীর হয়ে যাওয়া বা এসব স্বাধীনতার মানে আমি ঠিক বুঝতে পারতাম না। তবে ওনার হঠাৎ চুপসে যাওয়া দেখে আমিও মুখ কাচুমাচু করে বসে থাকতাম। আশঙ্কা করতাম এই বুঝিনা আবার দাদির প্রসঙ্গ তোলে। কিছুটা স্বগতোক্তি করে বলতে থাকে,
কত লোক দেশের জন্য লড়াই করছে। কত রক্ত ঝরছে দেশের জন্য। আমি অবুঝের মতো প্রশ্ন করতাম, দেশ থাকতে আবার দেশের জন্য কারা লড়াই করছে দাদা? কেন দেশটা আমাদের নয় দাদা? দাদা বিজ্ঞের মতো মাথা নাড়িয়ে বলতো,
-দেশটা আমাদের হলেও আমাদের নেই। আমাদের মাথার উপরে ইংরেজরা বসে আছে।
দাদার উত্তর আমার ভালো লাগতো না। আমি ছোট ঠিকই তাই বলে অন্ধ নই। পরিষ্কার মাথার উপরে ফাঁকা আকাশ দেখতে পাচ্ছি। অথচ দাদা বলে দিলে মাথার উপর ইংরেজরা আছে। দাদাকে বললে সেকথা, কেমন উদাসিন হয়ে,
-সে তুই বুঝবিনা দাদুভাই। আরেকটু বড় হলে বুঝবি মাথার উপরে আকাশ না কারা আছে। তবে মাথার উপরে যেই থাকুন দাদার সঙ্গে আমার এই সখ্যতার মধ্যে কবে যে দাদা দাদির শোক কাটিয়ে উঠেছে তা আমরা কেউই খেয়ালই করতে পারেনি।
একদিন কাজ শেষে বাড়ি ফিরে দেখি মায়ের মুখটা বেশ ভার। বুঝছে পারি নিশ্চয়ই কোনো অঘটন ঘটেছে।মাকে জিজ্ঞেস করতেই,
-আসমার মাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।
আমি অবুঝের মতো আবারো জিজ্ঞেস করি,
-কেন মা চাচিমা কোথায় গেছেন?
কিছুটা ধমকের সুরে,
-কোথায় গেছে জানলে কি আর পাড়া শুদ্ধু সবাই এত চিন্তা করে?
তিন ভাইবোনের মধ্যে বয়সে মেজ আসমার নামেই কাবুল চাচা স্ত্রীকে ডাকতেন। স্বভাবতই পাড়ার সকলেই চাচিমাকে আসমার মা বলেই জানে। গহরের মৃত্যু পর পুত্রশোকে শোকাতুর চাচিমা দিনরাত ছেলের কথা ভেবে খাওয়া-দাওয়া ছেড়ে ছিলেন। কারো কোনো কথাতেই উনি স্বাভাবিক হচ্ছিলেন না।কেবল পাগলের মত আচরণ করতেন। কাবুল চাচাও যথাসাধ্য চেষ্টা করেছিলেন স্ত্রীকে বুঝিয়ে-সুজিয়ে স্বাভাবিক করতে কিন্তু পারেননি। দিনের বেলা তো বটেই রাতের বেলাতেও কুপির আগুন নিয়ে চাচি দর্মার বেড়া বা খড়ের চালের মধ্যে ছেলেকে খুঁজে বেড়াতেন। একবার খড়ের চালের বেশ কিছুটা পুড়েও গেছিল। চাচা সঙ্গে সঙ্গে দেখতে পেয়ে চিৎকার করাতে সবাই মিলে পানি দিয়ে আগুনটি নিভিয়ে দেয়। তারপর থেকে চাচিকে ঘরের খুঁটির সঙ্গে বেঁধে রাখতো। দুপুর বেলা গোসল করার সময় একটু ছাড় পেত। ছোট দুই ভাই বোন জহর ও আসমা মাকে দেখভাল করতো। চাচা সামনে না থাকলে দুই ভাই বোন মায়ের বাঁধন খুলে দিতো। কাবুল চাচা ফেরার আগেই আবার বাঁধন পড়িয়ে দিতো। সম্ভবত ছেলেমেয়েদের এই খোলা বাঁধনের মধ্যেই অসাবধানতাবশত চাচি কোথাও চলে গিয়ে থাকবে। যাইহোক তাৎক্ষণিকভাবে খবরটি শুনে প্রচন্ড ভেঙে পড়ি।মনে মনে আশঙ্কা করি, পরিবারটার কপালে আরও কি দুর্ভোগ আছে কে জানে....
পর্ব-৯
পর্ব-১১