ফ্রম সাতক্ষীরা টু বেলগাছিয়া (পর্ব-৬/প্রথম খন্ড দ্বিতীয় পর্ব)
(নামে পর্ব-৫ হলেও আজ থেকে শুরু হলো দুটো খন্ডে বিভক্ত 'ফ্রম সাতক্ষীরা টু বেলগাছিয়া' উপন্যাসের প্রথম খণ্ডের প্রথম পর্ব। সেক্ষেত্রে বিগত চারটি পর্ব উপন্যাসের ভূমিকা পর্ব বা প্রাককথন হিসেবে বিবেচিত। সুধী পাঠক বৃন্দকে সঙ্গে থাকার জন্য অনুরোধ করা হচ্ছে।)
দাদা যে আমাকে কাজে নিয়ে যেতে রাজি হবে প্রথমটা যেন ভাবতেই পারিনি। মনে হয়েছিল যে আমার সঙ্গে বুঝি রসিকতা করছে। কথাটা সত্য কিনা তা দাদিকে জিজ্ঞেস করতেই মুখ বেজার করে,
-হ্যাঁ কি করবো তোকে পাঠাবো না তো। সারাদিন বাড়ি থেকে যা দুষ্টুমি করছিস তাতে পাড়ায় কান পাতা দায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। তোর অতিষ্ঠে আমি যেন আর পেরে উঠছি না।
আমি খারাপ বা আমার আচার-আচরণ খারাপের কথা সেই কবে থেকে সবার মুখ থেকে শুনে শুনে আমার কান একেবারে পোঁচে গেছিল। কাজেই দাদির এসব কথা তখন আমার মাথায় ঢুকছিলো না।তার মধ্যে শহরে কাজে যাওয়ার কথাটা শুনে তা যেন আনন্দে আমাকে ভাসিয়ে নিয়ে গেল।সাময়িকভাবে আমি দিশেহারা হয়ে যাই। আনন্দকে বহিঃপ্রকাশ করব কিভাবে তা ভেবে রীতিমত অস্থির হয়ে উঠি। শুরুতেই যে চিন্তা মাথায় ঢুকে ছিল তাহল জামাকাপড়ের চিন্তা। বাংলা প্যান্ট পড়লেও সবগুলোতেই ছিল কমবেশি ফুটোফাটা। দাদি ও মা অবসর সময়ে আমাদের ভাই বোনদের জামাপ্যান্টের ফুটোফাটা বন্ধ করতো। বলা চলে গ্রাম্য মহিলাদের বৈকালিক অবসর বিনোদনের মাধ্যমই ছিল পুরানো জামা কাপড়ে হাত সেলাইয়ের কাজ করা। সেদিন প্রস্তুতি ছাড়াই হঠাৎ করে এভাবে সুযোগ মেলাতে তাকে সদ্ব্যাবহার করতে আমি মরিয়া হয়ে ওঠি। প্যান্ট গুলো একত্রে করে খুঁজতে থাকি কোনগুলোতে একটু কম ফুটোফাটা আছে তা বার করার। উল্লেখ্য জামাকাপড়ে বেশি ছেঁড়াফাটার কথা বললে হয়তো দাদা রাজি হবে না অথবা যাওয়া পিছিয়ে যেতে পারে, এটাও মাথায় ছিল। কাজেই জুতসই দুজোড়া জামাকাপড় পছন্দ করে দাদির কাছে তুলে ধরি ছাড়পত্র পাওয়ার আশায়।
সেদিন শহরের পথে পা দিতেই মনে মনে নানান ভাবনা কল্পনালোকে তোলপাড় হতে থাকে।বলা ভালো শহর সম্পর্কে নানান জিজ্ঞাসা, নানান অনুভূতি যেন দলা পাকিয়ে আমার অন্তরে ঘুরপাক খেতে থাকে। হাঁটতে হাঁটতে দাদার অলক্ষ্যে আপন মনে মাঝে মাঝে হেসে উঠি। যদিও দাদার চোখকে ধুলো দিতে পারেনি। আড়চোখে আমার অনুভূতি বুঝতে পেরে যায়। চোখাচোখি হতেই আমি লজ্জা পেলেও দাদাও খুশি হয়। এবার সাধ্যমত চেষ্টা করতে থাকে আঙ্গুলের ইশারায় দূরে বা আরও দূরের বিভিন্ন জিনিসগুলো বোঝানোর। আমি সবকিছুতে মাথা নেড়ে মুগ্ধ চিত্তে তার কথায় সন্তোষ প্রকাশ করতে থাকি।কত ফাঁকা জমি মাঠ-ঘাট পেরিয়ে আমরা অতিক্রান্ত হতে থাকি। রাস্তার ধুলোয় আমার পা থেকে হাটু পর্যন্ত একেবারে সাদা হয়ে যায়। মাঝে মাঝে সামান্য হাওয়াতেও ধুলো উড়তে থাকে। ইতিমধ্যে কয়েকটি স্থানের ধুলোর স্তুপে লাথি মেরে বেশ মজা পেয়েছিলাম। প্রথমে দু একবার দাদা সায় দিলেও পরে আমার পায়ের দশা দেখে বারণ করে।পরবর্তী কিছুটা রাস্তা ভালোভাবে গেলেও ধুলোর স্তুপ দেখে ভিতরে ভিতরে লাথি মারার বাসনা উঁকি মারতে থাকে। সুযোগ বুঝে দু-একটিতে লাথি মারতেই দাদা এবার মৃদু ধমক দেয়। ধমক খেয়ে বুঝি ততক্ষনে যা হওয়ার হয়ে গেছে আমার কোমর পর্যন্ত ধুলোয় ধূসরিত। ভদ্রলোকের বাড়িতে ঢুকতে গেলে একটু সভ্য ভদ্র হয়ে ঢোকা দরকার। কাজেই দাদার কথাকে মান্যতা দিতেই বাকি রাস্তায় ধুলোখেলা থেকে বিরত থাকি। ধুলোখেলা বন্ধ করা মাত্রই বুঝি অন্য একটি যন্ত্রনা পেটের মধ্যে চিঁচিঁ করতে থাকে। বুঝতে পারি পায়ের গতি হঠাৎ বেশ কমে গেছে। সকালে বাড়ি থেকে পেট ভরে পান্তা খেয়ে বের হলেও পথিমধ্যে বেশ খিদে অনুভূত হয়। ইতিমধ্যে আমরা বহু রাস্তা অতিক্রম করেছি। যাইহোক খিদে পেয়েছে কিনা দাদা সে কথা জিজ্ঞেস করলেও হ্যাঁ বলাটা নিরাপদ হবে না ভেবে,
- না আমার তেমন খিদে পায়নি।
খিদের কথা মুখে স্বীকার না করলেও দাদা বোধহয় বুঝতে পেরেছিল আমার মনের কথা। খানিকবাদে পথিমধ্যে একটা ঘুমটি মতো দোকান থেকে দাদা কিছু মুড়ি ও বাদাম নিয়ে এলো। বাকি রাস্তা আমরা ওগুলো খেতে খেতেই এগোতে থাকি। কি অপূর্ব লেগেছিল সেদিন খিদে পেটে মুড়ি-বাদাম খেতে, তা বলে বোঝানো যাবে না। এভাবে হাঁটতে হাঁটতে একটা সময় আমরা ধুলোবালির রাস্তা ফেলে মূল শহরে প্রবেশ করি। কালো কালো রাস্তার সঙ্গে বড় বড় দালান দেখে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকি। রাস্তা বলতে আমরা গ্রামে সারাবছর ধুলোবালি ও বর্ষার সময় কাদা রাস্তা দেখে অভ্যস্ত। এক্ষণে শহরের কালো দেখে দাদাকে জিজ্ঞাসা করলে জানিয়েছিল,
-শহরের রাস্তা নাকি এমনই হয় যা পিচ দিয়ে তৈরি। আমার চোখে-মুখে বিস্ময় দেখে দাদা আরও বলেছিল,
-শহরে আরো কত কি দেখার আছে। এখানে পিচ রাস্তা, বিভিন্ন মোটরগাড়ির সঙ্গে মার্টিন বান লাইনে ট্রেনও অন্যতম দর্শনীয় বিষয়।
মোটরগাড়ির কথা আমি আগেই শুনেছিলাম। সেদিন দাদার কাছে প্রথম ট্রেন গাড়ির কথাও শুনি। ট্রেন-মোটরগাড়ি এসবের কথা শুনে আমার কল্পনায় বিস্ময়ের ঘোর লেগে যায়। কারা চড়ে, কিভাবে চড়ে, কোথায় যায়, এভাবে নানান প্রশ্ন করতে থাকি। ট্রেন খুব বড় বলাতে আমি দুই হাত উঁচু করে ইশারা করে জিজ্ঞেস করি ট্রেন আকাশের সমান উঁচু কিনা। প্রথমে দাদা হাসলেও অবশেষে বোঝাতে ব্যর্থ হয়ে বলে ফেলে, একদিন সুযোগ মতো আমাকে মার্টিন বান লাইনে ট্রেন দেখাতে নিয়ে যাবে। সেই পরীক্ষিত দিন কবে হবে সেই মুহূর্তে জানতে চাওয়াতে দাদার ধৈর্যের বাঁধ যেন ভেঙে যায়। এবার মাঁড়ি চেপে চেপে বেশ ধমকের স্বরে জবাব দেয় এত বকবক না করার জন্য। আমি সাময়িকভাবে গুটিয়ে গেলেও একটা প্রশ্ন মাথার মধ্যে ঘুরপাক খেতে থাকে। একটা বড় বাড়ির দিকে আঙ্গুল তুলে ভয়ে ভয়ে ফের জিজ্ঞাসা করি,
-এগুলো কি রাজবাড়ি? দাদীর কাছে রাজবাড়ির অনেক গল্প শুনেছি কিনা।
দাদা অবশ্য এক্ষেত্রে আমাকে ধমক না দিয়ে স্বাভাবিকভাবেই উত্তর দেয়,
-শহরের পয়সাওয়ালা লোকেরা এই সব বাড়িতে থাকে।
-তুমি আর বাপ মিলে তো অনেক পয়সা রোজগার করো, তাহলে এমন একটি বাড়ি তৈরি করতে পারো না কেন?
এবার দাদা হো হো করে হেসে উঠলো। চোখে গোল্লা পাকিয়ে দুহাত প্রসারিত করে,
-এরকম একটা বাড়ি করতে অনেক অনেক অনেক টাকার দরকার।
হাঁটতে হাঁটতে আমরা এক সময় একটি বড় বাড়ির সামনে চলে আসি। দাদা হাসি হাসি মুখে জানায়,
-এটাই আমাদের মনিব সুব্রত হালদারের বাড়ি।
দাদির কাছে রাজপ্রাসাদের গল্প শুনেছি।বাড়িটিকে দেখে মনে হলো এমন-ই একটি রাজপ্রাসাদের সামনে দাঁড়িয়ে আছি। রাজাদেরও তো অনেক পয়সা থাকে। অথচ দাদা কেন এমন বাড়িওয়ালাকে রাজা বলতে চাইছে না, মনে মনে নিরন্তর উত্তর খুঁজতে থাকি। দাদা বাবু বাবু বলে বারকয়েক ডাকতেই লম্বা ফর্সা ছিপছিপে চেহারার এক ভদ্রলোক বাইরে বেরিয়ে এলেন।
-আরে রুস্তম যে! কখন ফিরলে?
-এইতো বাবু এইমাত্র। এখনো দোকানে ঢুকিনি। আপনার সঙ্গে দেখা করতেই দাঁড়ালুম।
- বেশ ভালো। বেশ! তা সঙ্গের বাচ্চাটা কে?
- আজ্ঞে আমার নাতি,ফজরের মেজো ছেলে।
ভদ্রলোক এগিয়ে এসে আমার হাত ধরে নাম কি ও কোন ক্লাসে পড়ি জানতে চাইলেন। আমি নাম বলে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইলুম। কথা বলতে বলতে ভেতর থেকে একজন ভদ্রমহিলাও বের হলেন। কোনো মানুষের এত সুন্দর রূপ হতে পারে আমি আগে কখনো দেখিনি। দাদা পরিচয় করিয়ে দিল,
-ইনি তোমার নতুন দাদি।
নতুন দাদি মিষ্টি করে হেসে কাছে টেনে আমাকে আদর করতে লাগলেন।
এবার ভদ্রলোক আমাকে শহরের স্কুলে ভর্তি করে দেওয়ার প্রস্তাব দিতেই আমি ভো করে কেঁদে ফেলি। এক সময় আমিও স্কুলে যেতাম। কিন্তু সমস্যা বাঁধলো ওই হারান মাস্টারকে নিয়ে।পরপর দুদিন শাস্তি পেয়ে রাগ গিয়ে পড়ে মাস্টারের উপরে। ব্যাটাকে কামড়ে দিয়ে মাংস ছিঁড়ে উপযুক্ত শাস্তি দিয়ে স্কুল থেকে পালিয়ে এসেছিলাম। তারপরে আর কখনো ওমুখো হইনি।এক্ষুনি আবার সেই স্কুলের প্রসঙ্গ উঠতেই আমার মনের মধ্যে প্রচণ্ড ভয় চলে আসে। দাদা আমাকে সান্ত্বনা দিতে থাকে,
-কাঁদিস না বোকা কোথাকার। তোকে আর স্কুলে যেতে হবে না।
আমার মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে ওনার দিকে তাকিয়ে দাদা আরও বলল,
-আমি বাবুকে পরে বুঝিয়ে বলব খন তোর স্কুল ভীতির কথাটি।
ভদ্রলোক কি যেন ভাবলেন। মুখের চেহারাটা সঙ্গে সঙ্গে বদলে গেল। এবার দাদাকে সরাসরি জিজ্ঞাসা করলেন,
-রুস্তম তুমি তাহলে নাতিকে কাজ শেখাবে বলে নিয়ে এলে?
দাদা মুখে কিছু না বললেও হাসিমুখে কেবলই নিরব থেকে যেন ওনার প্রশ্নের সম্মতি জানালো। উনি আর কিছু না বলে ভিতরে ঢুকে গেলেন। নতুন দাদি আমার দিকে মিষ্টি করে হেসে,
-মাহমুদ দীর্ঘ রাস্তায় অনেক পরিশ্রম হয়েছে। এখন স্নান করে বিশ্রাম নাও। পরে কথা হবে, বলে স্বামীর পিছু পিছু ভিতরে ঢুকে গেলেন।আমরাও প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই পাশের দোকান ঘরের দিকে পা বাড়ালাম।
ফ্রম সাতক্ষীরা টু বেলগাছিয়া (পর্ব-৪)
সর্বশেষ এডিট : ১৬ ই জানুয়ারি, ২০২১ দুপুর ১২:০৩