সেদিন রাতে দাদা আমাদেরকে নিয়ে তুলেছিল বাপজানের চাচতো চাচাতো বোন জোবাইদা ফুফুর বাড়িতে। যদিও আমি আগে কখনো ওনাকে দেখিনি। এমনকি বাপ-দাদার মুখে ওনার নামও কখনো শুনিনি।আজ হঠাৎ করে ওনার পরিচয় জেনে যে কারণে বেশ অবাক হই। হয়তো এটা মানুষের একটা স্বাভাবিক ধর্ম যে স্বার্থের সংঘাতে একে অপরের থেকে দূরে সরে গেলেও বিপদে আপদে মানুষ আবার মৃত সম্পর্ককে আঁকড়ে ধরতে চায় অথবা সম্পর্ককে পুনরুজ্জীবিত করার চেষ্টা করে। সেদিন বাইরে দাঁড়িয়ে ফুফুর সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক নিয়ে ভিতরে ভিতরে আকাশকুসুম ভাবতে থাকি আর চারদিকে গাছগাছালি পরিবেষ্টিত প্রায়ান্ধকারের মধ্যে অস্পষ্টভাবে যতটা সম্ভব বড়োসড়ো বাড়িটিকে পরখ করার চেষ্টা করি।মনে প্রশ্ন জাগে, ফুফুদের বাড়ি শহরের এতটা কাছে থাকলেও কেন বাপ-দাদা ইতিপূর্বে আমাদেরকে এখানে কেন আনেনি। সেসময় আশেপাশের বিস্তীর্ণ গ্রামাঞ্চলে বাড়ি বলতে সবারই মাটির বাড়িই ছিল। পাকা বা ইটের বাড়ি তখন ছিল সাধারণ মানুষের কাছে অকল্পনীয়। ফুফুর শ্বশুরবাড়ির লোকেরা ছিল বেশ পয়সাওয়ালা নামডাকওয়ালা বংশধর। বাড়িটি যেন তাদের সেই সমৃদ্ধতার পরিচয় বহন করছিল।বড় বাড়ি মানেই কেন জানি আমার মনে হতো তারা বংশে বড়োও। অন্তত আমার চোখে এত বড় বাড়ি ইতিপূর্বে কখনো দেখেছি বলে মনে হয় না। চারধারে গোল করে উঁচু পাঁচিলে ঘেরা। পাঁচিলের উপরে পরিপাটি করে খড়ের ছাউনি দিয়ে ছাওয়া।এহেন পরিস্থিতিতে তিন হাত দূরে ফটকের সামনে দাঁড়িয়ে দাদা মাঝে মাঝে বিরতি দিয়ে 'মোবারক মোবারক' বলে ডেকেই চলেছে।আর আমরা অধীর আগ্রহে পাঁচিলের ভেতরে থেকে কারো না কারো আগমনের অপেক্ষায় প্রহর গুনতে থাকি।
বেশ কিছুক্ষণ এভাবে থাকার পরও কারোর কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে হতাশ হয়ে অবশেষে রাস্তার উপর বসে পড়ি। আসলে দীর্ঘ পথে ক্লান্ত শ্রান্ত হয়ে আর সোজা ভাবে দাঁড়ানোর মতো শক্তি তখন আমাদের শরীরে অবশিষ্ট ছিল না। এমন সময় বয়স্ক দাড়িওয়ালা এক ভদ্রলোককে পাঁচিলের দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে আসতে দেখে আমাদের মনে আশার সঞ্চার হয়। দাদা পরিচয় করিয়ে দিল উনি ফুফুর শ্বশুরমশাই হন। আমরা তৎক্ষণাৎ ওনাকে সালাম জানালেও উনি আমাদের দিকে ভ্রুক্ষেপ করলেন না। আসলে দাদাকে দেখেই ওনাকে বুকে জড়িয়ে ধরা দেখে আমরা আমাদের ক্লান্তি হতাশা সাময়িক ভুলে গেলাম।এক অকৃত্রিম হাসি আমাদের চোখেমুখে চলে এলো। মোলাকাত পর্ব শেষ হলে, একে অপরকে ছেড়ে দিতেই এবার ওনার দৃষ্টি গেল আমাদের দিকে। আমরা ততক্ষণে দাঁড়িয়ে গেছি, এভাবে আমাদের বাইরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে উনি খুব দুঃখ প্রকাশ করতে থাকেন।ভালো লেগেছিলো ওনার এমন সরল স্বীকারোক্তিতে। দাদার সঙ্গে ওনার কথোপকথনে বুঝতে পারি ফুফুর স্বামী স্থানীয় কোর্টের সরকারি পেশকার। সারাদিন উনি কাজে ব্যস্ত থাকেন। সেই সক্কালে চলে যান, আসেন সন্ধ্যে করে।আজ একটু আগেই নাকি বাড়ি ফিরেছেন। আরও কয়েকজন ছেলে থাকলেও তারা সবাই যে যার মতো ব্যস্ত আছেন। উনিও সচরাচর এ সময় বাড়িতে থাকেন না। একটু দূরে মসজিদে সময় কাটান। আজ একটা বিশেষ কাজে মাগরিবের নামাজ পড়িয়ে একটু আগেই ফিরেছেন। ঘরের মধ্যে যেকাজে ব্যস্ত ছিলেন। ওনার ঘরটি সদর দরজা থেকে অনেকটা দূরে হওয়ায় শুনতে পাননি।বাড়ির মহিলারা ডেকে দিতেই উনি বাইরে এসেছেন।ভালো লেগেছিল ওনার এমন সরল স্বীকারোক্তিতে। কিন্তু সে ভালোলাগা ছিল ক্ষণস্থায়ী।দাদা অবশ্য এই সামান্য দেরিকে ধর্তব্যৈর মধ্যে না এনে অন্যান্য নানান প্রসঙ্গ উত্থাপন করে পরিস্থিতিকে স্বাভাবিক করতে আপ্রাণ চেষ্টা করে। খানিক বাদেই বিশেষ দরকার আছে বলে হাত ইশারা করে আসছি বলে ভদ্রলোক সেই যে চলে গেলেন তো গেলেনই...।
অবাক হয়েছিলাম ফুফুর প্রতি, অন্তত একবারের জন্যও উনি আমাদের সামনে না আসায় আমার ছোট্ট হৃদয়ে এ বাড়ির ফুফু নামক সম্পর্কের মানুষটির প্রতি খুব রাগান্বিত হয়েছিলাম। যাইহোক দীর্ঘক্ষন বাড়ির ভিতর থেকে কাউকে না আসতে দেখে ওনার প্রত্যাগমনের দৃশ্যটি বড় বেশি করে চোখের সামনে যেন ভাসতে থাকে। শেষের দিকে মনে হল এতজনকে বাইরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে হয়তো ভদ্রলোক বড় ভয় পেয়েছেন; একপ্রকার পালিয়ে যেন নিজেকে রক্ষা করলেন।
দীর্ঘক্ষন এভাবে অপেক্ষায় থেকে একসময় বিরক্তি চূড়ান্ত মাত্রায় পৌঁছে যায়। মনে মনে দাদার এখানে আসার সিদ্ধান্তের জন্য খুব রুষ্ট হতে থাকি। বিরক্তি লাগছিল নিজেদের উপরেও; যারা আমাদের আগমনকে ভালোভাবে নেয়নি অথচ তাদের কাছেই আমরা আশ্রয়প্রার্থী। ঘুরেফিরে প্রশ্নটা মাথায় মধ্যে বাজতে থাকে। আমাদেরকে এভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলেও ভদ্রলোকের একবারের জন্যও আমাদের আগমনের কারণটি জানতে চাননি।উপস্থিতিকে নিজেদের মধ্যে কথাবার্তা বলে বুঝেছিলাম কম সময়ের মধ্যে তুলনায় এই স্থানটি ছিল অনেকটাই নিরাপদ। কাজেই রাতটুকু থাকার ব্যবস্থা হলে হোলো। আগামীকাল সকালে বিকল্প কিছু ভাবা যাবে বলে দাদা আশ্বাস দেওয়ায় রাতটুকু কোনক্রমে কাটিয়ে দেওয়ার জন্য নিজের মনকে প্রবোধ দেই। অস্বীকার করবো না, সেসময়ে পরিস্থিতি আমাদেরকে যথেষ্ট বাস্তবমুখী করে তুলেছিল। আগামীকাল সকালে বিকল্প কিছু ভাবনার কথা বললেও আপাতত রাতটুকু কোনক্রমে পার করতেই মনস্থির করি।তাই এই মধ্যবর্তী সময়ে, নিজেদের ভালোলাগা-মন্দলাগাকে পাত্তা না দিয়ে বরং ততক্ষণে ওনাদের কারো না কারোর আগমনের জন্য বাইরে তীর্থের কাকের মতো অপেক্ষা করতে থাকি। একসময় সত্যিই আমাদের সে প্রতিক্ষার অবসান ঘটে। এবার হাতে কেরোসিনের কুপি হাতে ভদ্রলোক আবার আসেন আমাদের সামনে। পাশেই সৌম্যকান্তির আরেকজন যুবক ওনার সঙ্গে চলে আসেন। বুঝতে পারলেও পরিচয় পর্ব থেকে নিশ্চিত হই উনিই ফুফুর স্বামী। উনি সৌজন্য সূচক কিছু কথা বললেও আমাদেরকে বাড়ির ভিতরে নিয়ে যাওয়ার প্রসঙ্গে একবারো গেলেন না। দাদার সঙ্গে টুকটাক কথাবার্তা বলে কিছুক্ষণ পর উনিও চলে গেলেন বাড়ির ভিতরে। বুঝতে পারি আমাদের এমন আগমনে ওনারা বেশ বিরক্ত এবং বিব্রতও। নিঃশব্দে এভাবেই সময় অতিক্রান্ত হতে থাকে পরবর্তী সময়গুলো। উপায়ান্তর না পেয়ে অন্ধকারের মধ্যেই আমরা একেঅপরের দিকে মুখ চাওয়াচাওয়ি করতে থাকি। চিন্তার গভীরতা একটু ফ্যাকাসে হতেই একটা মুহুর্মুহু ডাক কানে আসতে থাকে। উল্লেখ্য শব্দটির সঙ্গে আমি ইতিপূর্বেই পরিচিত; শিয়ালের হুক্কাহুয়া। বলতে অত্যুক্তি নেই যে শিয়ালের ডাককে এখন আর আমি ভয় পাই না। উল্টে হৃদয়ে একপ্রকার আশা জাগানিয়ার সঞ্চার হয়। এই ডাক তো মঙ্গলসূচক। কাজেই দুর্ভাবনা নয়; নিশ্চয়ই একটা সুরাহা আসন্ন। মনে মনে সেই কল্পনায় বুঁদ হয়ে থাকি।
জীবন স্রোতস্বিনীর ন্যায়। জীবন নদে চলার পথে আমরা নানান বাধা-বিপত্তি, নানান অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করি। সেদিন নিজের অভিজ্ঞতা থেকেই বুঝেছি অসহায়ত্বই বোধ হয় কাউকে অন্ধকার বা কুসংস্কারের অতল গহবরে নিক্ষেপ করে। যাইহোক এভাবে একপ্রকার নিরুপায় হয়ে আমরা জোবাইদা ফুফুর বাড়ির লোকের আগমনের অপেক্ষায় থাকি। কতক্ষণ এভাবে ছিলাম ঠিক খেয়াল ছিল না কিন্তু ততক্ষণে ঝিমুনি আমাদেরকে গ্রাস করেছে।আমরা তখন অর্ধ শোয়া অবস্থায় রীতিমতো তন্দ্রাচ্ছন্ন। এমন সময় একসঙ্গে বাবা ছেলে একটা কেরোসিনের কুপি নিয়ে বেরিয়ে এলেন। চূড়ান্ত হতাশার মধ্যেও আবার স্বপ্ন দেখি, যাক এবার তাহলে নিশ্চয়ই একটা সুরাহা হবে। দু'জনেই একসঙ্গে আমাদেরকে ওনাদেরকে অনুসরণ করতে ইশারা করলেন। অন্ধকার পথে বাবা ছেলে আমাদেরকে পথ দেখিয়ে চললেন। জানিনা এভাবে আমাদেরকে ওনারা কোথায় নিয়ে তুলবেন।আসার সময় জামাইয়ের হাতে একটা পোঁটলা লক্ষ্য করি। অনেক্ষন হাঁটার পর আমরা সকলে একটা বাড়ির সামনে এসে দাঁড়ালাম।এটা ছিল গ্রামেরই মসজিদ। এই মসজিদেই ফুফুর শ্বশুর মশাই নামাজ পড়ান। মসজিদে থাকতে হবে শুনেই দাদাকে একটু চিন্তিত হতে দেখলাম। যদিও সেটা সাময়িক। কারণটা অবশ্য আমাদের সবারই জানা। সেদিন থেকে আমাদের সঙ্গে স্বপন কাকারও ঠিকানা হয়ে উঠেছিল গ্রাম্য এই আটচালা মসজিদটি।
মসজিদটি আদতে জোবাইদা ফুপুদের দলুজ বাড়ি।বাড়ি থেকে অনেকটা দূরে লোকালয় থেকে একেবারেই বিচ্ছিন্ন ছিল দলুজ বাড়িটা। মূলত মেহমানদের থাকবার উদ্দেশ্যে নির্মিত হয়েছিল। পরের দিকে আশপাশের বাড়িগুলো থেকে আগত মুসল্লিদের জামাতে নামাজ পড়ার জন্য দলুজটিকে আবার মসজিদ হিসেবেও ব্যবহৃত হয়। তখন থেকেই দলুজের পরিবর্তে মসজিদ রূপেই এলাকায় পরিচিতি লাভ করে। ফুফুর শ্বশুরমশাই মসজিদে নামাজ পড়ান। মসজিদে থাকতে হবে শুনে দাদা শুরুতেই আমাদের নিয়ে একটা গোপন মিটিং করে।স্বপন কাকার পরিচয় সম্পূর্ণ গোপন করতে আমাদের সকলকে নির্দেশ দেওয়া হয়। শুধু তাই নয়, আপাতত এখানে অবস্থান কালে স্বপন কাকাকে স্বপন নামের পরিবর্তে সৌকত নাম ধরে ডাকতে পরামর্শ দেওয়া হয়।কাকা বিনাবাক্যে দাদার পরামর্শ গ্রহণ করে। সেদিন রাতে সবাই মিলে হাত লাগিয়ে ফুফুর জামাইয়ের আনা চালডাল ফুঁটিয়ে কোনক্রমে দুমুঠো ভাত গলাধঃকরণ করে অবশেষে গভীর রাতে আমরা বিছানায় যাওয়ার ছাড়পত্র পাই। উল্লেখ্য তখন সদর দরজার সামনে অন্ধকারে বসে বসে ঘুমাচ্ছিছিলাম কিন্তু এখন শুয়ে পড়ে কিছুতেই চোখে খুম আসছিল না। চোখের পাতা কিছুতেই যেন এক হচ্ছিল না। নিঃশব্দ পুরীতে আমি বাদে সকলেই গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন বুঝে নিজের উপর চাপ ভীষণই বেড়ে যায়। নুরুল চাচার নাক ডাকা রাতের নিঃসঙ্গতাকে আরো প্রকট করে আমার বুকে দুন্দুভি বাজাচ্ছিল।বাইরেও সমানে ঝিঁঝিঁপোকার নানান শব্দ রাতের নিঃসঙ্গতাকে আরো প্রকট করে তুলেছিল। দলুজের একপ্রান্তে বিরামহীন ভাবে তখন আলোক দান করছিল কেরোসিনের শিখা। মাঝে মাঝে দ্রুত গতির পবন দেব তার উপস্থিতিকে প্রশ্নের সম্মুখীনে দাঁড় করাচ্ছিল। কোনক্রমে পবনদেবের বাঁধা কাটিয়ে আবার সে উন্নত শিখরে অবস্থান করে আপনার স্বাভাবিক ছন্দে ফিরতে মরিয়া ছিল আর ঠিক তখনই বাইরে প্রবল চিৎকারে তেড়ে-ফুঁড়ে সোজা ভাবে বসি।। এমন গগনভেদী চিৎকার চেঁচামেচিতে এভাবে শুয়ে থাকা অসম্ভব মনে হলো। কিছুক্ষণ কান খাঁড়া করে থাকতেই মনে হলো যেন হাজার শব্দের কোলাহল বা কোন এক উন্মত্ত জনতা যেন আমাদের দিকেই ধেয়ে আসছে...
সর্বশেষ এডিট : ২০ শে মার্চ, ২০২১ বিকাল ৫:০৫