সকাল থেকে ক্যামেরার পেছনে ছুটতে ছুটতে পড়ন্ত বেলায় একটু অবসন্ন হয়ে পড়ি।যদিও এই অবসন্নতায় শরীরের তুলনায় মনের অবদান ছিল অনেকটাই বেশি। হাঁটতে হাঁটতে বারেবারে লক্ষ্য যাচ্ছিল নদীর পারে বসে থাকা কপোত-কপোতিদের দিকে।আহা! কতই না সুখি ওরা। যৌবনে একটা প্রেম ট্রেম না থাকলে জীবনটা বড্ড পানশে একপেশে, অর্থহীনও বটে। আপন মনে এসব ভাবতে ভাবতে শ্রেয়সীকে অনুসরণ করতে থাকি। বারবার অনুরণিত হচ্ছিল প্রেম নাই বা হোক, কিন্তু আজ যদি শ্রেয়সীর সঙ্গে দুদন্ড অবসর কাটানোর সু্যোগ মেলে তাহলে জীবন ধন্য হতে বাধ্য। লোভাতুর হৃদয়ে বারে বারে মনে উঁকি মারতে থাকে এমন বাসনা। আর এমন দিবাস্বপ্নকে প্রশ্রয় দিতেই চলারও একটু ছন্দপতন ঘটে।শ্রেয়সীর সঙ্গে দূরত্বটা সেকারণে এসময় বেশ কিছুটা বেড়ে যায়।
হঠাৎ দূরে দৃষ্টি চলে যায়।দেখি শ্রেয়সী রাস্তা থেকে নেমে নদীর তীর বরাবর হাঁটছে। দূর থেকে মনে হলো সামনে কিছু একটা আছে। আরো একটু এগিয়ে যেতেই স্পষ্ট হয় একটা বিশালাকার কচ্ছপ মরে পড়ে আছে। নিশ্চিত হলাম কচ্ছপটির দিকেই ও এগিয়ে যাচ্ছে। আমারও কৌতূহল বেড়ে গেল।নদী পাড়ে এতবড় কচ্ছপ পড়ে থাকতে দেখে বেশ অবাক হলাম।পরে স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জেনেছি, সমুদ্র বা নদী বন্দরে এমন ভাবে পড়ে থাকতে নাকি ওদেরকে প্রায়ই দেখা যায়। মৎস্যজীবীদের জালে জড়িয়ে যাওয়ার কারণে বা ট্রলারের পাখায় আঘাতপ্রাপ্তের কারণে কাসিমদের এমন দুর্গতি নাকি প্রায়ই ঘটে থাকে। যাইহোক শ্রেয়সী ইতিমধ্যে কাসিমের অনেকটাই কাছে পৌঁছে যায়। দুই হাতে তাক করে ধরা প্রমাণ সাইজের ক্যামেরাটি নিয়ে ওকে মহাব্যস্ত বলেই মনে হলো। মনে হল এই মুহূর্তে পৃথিবীর কোনো শক্তিই ওকে রুখতে পারবে না। আশেপাশে বেশ কিছু সারমেয়কেও দেখা যাচ্ছে পাশে বসে বা দাঁড়িয়ে আছে। কি মজাটাই না ব্যাটাদের; যেন মহাভোজের আসর বসিয়েছে। দৃশ্যটা নিঃসন্দেহে দুর্লভ ভেবে বেশ শিহরিত হলাম।অন্তত আমার মতো আনাড়ির চোখকে কিছুটা হলেও যে নাড়িয়ে দিয়েছিল। সেখানে শ্রেয়সীর মতো ফটোগ্রাফারদের তো চাঁদ হাতে পাওয়ারই কথা। ওর আগ্রহ দেখে মনে হলো প্রভাতের সূর্যোদয় না দেখতে পাওয়ার যাতনা বেচারী যেন ষোল আনাই পুষিয়ে নিতে চলেছে।
কিন্তু এই সুখানুভূতি বেশিক্ষণ স্থায়ী হলো না। হঠাৎ কানে আসে একটা অস্বাভাবিক চিৎকার। দূরে তাকিয়ে দেখি শ্রেয়সী হাউমাউ করতে করতে ছুটে আসছে। উল্লেখ্য শুরুতে কয়েক সেকেন্ডের জন্য আমিও কিছুটা হতভম্ব হয়ে যাই। ওদিকে আশপাশের কয়েকজনকে ওর দিকে ছুটে যেতে দেখে চোখ যায় পিছনে বিরাট বপুর একটি কুকুরের দিকে। দেশি কুত্তা হলেও আকারে বিদেশীদের মত। বাঘের মত রে রে করে ছুটে আসছে ওর দিকে।আর এক মুহূর্তও সময় নষ্ট না করে আমিও প্রবল বিক্রমে এগিয়ে যাই ওদিকে।হাতের ব্যাগটা উঁচিয়ে ধরতেই ব্যাটা থমকে দাঁড়ায় ঠিকই। কিন্তু রাগে গজগজ করতে থাকে। আশেপাশের কয়েকজন লোকও ততক্ষণে চলে আসেন। সবারই মুখে একটাই কথা,
-ম্যাডাম কামড় দেয়নি তো কুকুরটি আপনাকে?
শ্রেয়সী তখন কথা বলার মতো অবস্থায় ছিল না। চোখ বন্ধ করে গাল হা করে জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছিলো।কারো কোনো কথা ওর কানে ঢুকছে বলে মনে হলো না। হাঁপাতে হাঁপাতে হঠাৎ ঝপাং করে নীচে বালিতে হুমড়ি খেয়ে গেল পড়ে । কাছেই জলের বোতল ছিল। এগিয়ে ধরলাম ওর দিকে। কিন্তু নাহা! কোন সাড়া দিল না; চোখ বন্ধ করে রইলো। উপস্থিত কয়েকজন চোখে জলের ঝাপটা দিতে পরামর্শ দিতেই আর ওর অপেক্ষায় না থেকে বোতলটা খুলে সেটাই করে ফেলি। তিন-চার বার জলের ঝাপটা দিতেই এবার চোখ তুলে চেয়ে থাকে আমার দিকে।
-কি হচ্ছে তোর? ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবো? জিজ্ঞেস করতেই হাত ইশারা করে ওসবের দরকার নেই বলে জানিয়ে দেয়। উপস্থিত কেউ কেউ ওর কাছে জানতে চাইলো চিকিৎসার ব্যবস্থা করবে কিনা...
ও আগাগোড়াই শুভাকাঙ্ক্ষীদের এসব প্রশ্নের উত্তরে নীরব থেকে গেলো।
একসময় অত্যুৎসাহী জনতার প্রশ্নবাণ বন্ধ হয়। তবে তখনো তারা নীরব দর্শকের মতো সামনে দাঁড়িয়ে থাকলেন।
খানিক বাদে চোখে মুখে যন্ত্রণাক্লিষ্ট শ্রেয়সী অতিকষ্টে মুখে একঝলক শুকনো হাসি নিয়ে তাদেরকে ধন্যবাদ জানিয়ে বললো,
- আপনাদের সকলের কাছে আমি চিরঋণী। আপনারা যেভাবে আমার সাহায্যার্থে এগিয়ে এসেছেন তাতে আমার কৃতজ্ঞতা জানানোর ভাষা নেই। কিন্তু শুরুতে আমি কথাবলার মতো অবস্থায় ছিলাম না। প্রচন্ড শ্বাসকষ্ট হচ্ছিল। দম নিতে পারছিলাম না। আপাতত অনেকটাই কাটিয়ে উঠেছি। সঠিক সময়ে আপনারা না এলে হয়তো বড় ধরনের বিপদ হতে পারতো। কুকুরটি আজ আমাকে খুবলে খেয়েই ফেলত। বিষয়টা ভেবে এখনো আমার গা শিউরে উঠছে। অসংখ্য ধন্যবাদ দাদা আপনাদেরকে,বলে জোড়হাতে আরও একবার প্রণাম করতেই উপস্থিত লোকজন একে একে প্রস্থান করতে থাকে।
আমি এতক্ষণ একটু দূরেই দাঁড়িয়ে ছিলাম। লোকজন চলে যেতেই এবার ইশারায় কাছে ডাকে আমাকে।পাশে গিয়ে দাঁড়াতেই দুহাতে শক্ত করে আমার ডানবাহু ধরে ওঠার চেষ্টা করে।আমি সাধ্য মতো শালীনতা বজায় রেখে ওকে দাঁড়াতে সাহায্য করি। ওকে ধরে তুলতেই আমার হাতে যথেষ্ট বালি লেগে যায়। এতক্ষণ বালির উপর বসে থাকায় সারাগায়ে বালি মেখে একশেষ অবস্থা মেয়েটির। উল্লেখ্য ওর ক্যামেরাটা আগেই যথাস্থানে গুছিয়ে রেখেছিলাম।ভয় পেয়ে ক্যামেরা ফেলে ছুটেছিল। জানিনা বালির উপর ওভাবে পড়ে থাকা ক্যামেরাটি কতটা ভালো আছে। যাইহোক এক্ষণে সারা গায়ে বালির কথা উল্লেখ করতেই ঝেড়ে দিতে বললো। আমি যতটা সম্ভব ওর শরীর স্পর্শ না করে বালি ঝাড়তে চেষ্টা করি। বিষয়টি ওর দৃষ্টি এড়ায় নি। অপ্রস্তুত করে জিজ্ঞেস করে,
-আমাকে তোর ভালো লাগেনা রে বকুল?
ওর মুখে এমন আদুরে কথায় আমি অপ্রস্তুত হয়ে যাই। নিজেকে সংযত রেখে বলি,
- এক কথায় এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়া যাবে না রে। তাছাড়া এখন সেই পরিবেশও নেই।আগে সুস্থ হও।পরে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করা যাবে।
শ্রেয়সীর যন্ত্রণাক্লিষ্ট মুখচ্ছবি দেখে বুঝতে পারি সমস্যা গুরুতর। স্বভাবতই গভীর দুশ্চিন্তা আমাকে গ্রাস করে। হঠাৎ করে পাওয়া এমন শুকনো বিপদে চিন্তা শক্তি হারিয়ে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়ি। দুর্ভাবনায় গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে যায়।তাই ওর মুখে এমন আপাত প্রেমের কথায় যতটা পুলকিত হওয়ার কথা ছিল ততটা আমার হৃদয়কে তোলপাড় করেনি। ইতিপূর্বে লক্ষ্য করেছিলাম বেশ কিছুটা দূরে পার্কের মধ্যে গাছের নীচে বেদি করা আছে। অনেকেই পার্কের মধ্যে বসে গল্প করছেন। ওখানে বসার কথা বলতেই এককথায় রাজি হয়ে গেল। ওকে সাহায্য করতে কোনোক্রমে ধরলাম ঠিকই। কিন্তু পায়ের স্টেপিংয়ে ভয়ানক সমস্যায় গোটা শরীরের ভর এসে পড়ে আমার উপর। শুরুতে বারদুয়েক টালমাটাল অবস্থা তৈরি হয়। আমি নিজেই নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে পড়ে যাচ্ছিলাম। কোনক্রমে নিজেকে সামলে ওকে নিয়ে এগিয়ে চলি। লক্ষ্য করি যন্ত্রণায় ওর চোখ মুখ বুজে বুজে আসছে। অস্ফুটে কিছু একটা বলতে চাইছে। কি বলতে চাইছিস জিজ্ঞেস করতেই ইশারায় কুচকিতে টান ধরার কথা বলে। তৎক্ষণাৎ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে পায়ের নির্দিষ্ট স্থানটি ম্যাসাজ করতে লাগলাম। যন্ত্রণার মধ্যেও আয়েশে চোখ বন্ধ করে থাকলো। বেশ কিছুক্ষণ ম্যাসাজ করার পর মনে হল একটু স্বস্তি পেয়েছে। পাটাকে একটু টানটান করে বললো,
- একটু ধর দেখি হাঁটতে পারি কিনা...
আমি আবার হাত ধরতেই ধীরে ধীরে সাবধানে পা ফেলে এগোতে লাগলো। কচ্ছপের গতি নিয়ে আমরা হাঁটতে থাকি। অবশেষে কোন একসময় আমরা পার্কের ভেতরে পৌঁছে যাই।ভারী শরীরের ভরটি জায়গায় জায়গায় আমার উপর সম্পূর্ণ ছেড়ে দিয়েছিল। বাস্তবে বুঝতে পারি ওর মতো ডেভেলপ ফিগারের নারীকে এভাবে হাটিয়ে নিয়ে যাওয়া কতটা কষ্টের, কতটা শ্রম সাপেক্ষ ব্যাপার। সম্ভবত আমার অসুবিধায় তখনো উপস্থিত দু-এক জন ওর অন্য হাতটি ধরবে কিনা জানতে চাইলে ও বিনয়ের সঙ্গে তা প্রত্যাখ্যান করে। অগত্যা কোনোক্রমে ধরে গাছের বেদীতে বসিয়ে দিতেই ও পা লম্বা করে সঙ্গে সঙ্গে টানটান হয়ে শুয়ে পড়ে।ওর এমন আচরণে আমার চিন্তা আরও বেড়ে যায়। দুর্ভাবনার কালোমেঘ আমার অন্তরের মধ্যে কালবৈশাখীর ঝড় তোলে। বুঝতে পারি বড় ধরনের কিছু একটা নিশ্চয়ই ওর হয়েছে। নইলে ওর মত লৌহ-কাঠিন্যের মেয়ে আজ এতটা ভেঙে কেন পড়বে?,একটু আরাম পায় কিনা ভেবে জিজ্ঞেস করি,
- সোয়েটারগুলো দেবো?ওর উপর মাথাটা রাখবি? বেশ আরাম পাবি।
ও আগ্রহ দেখালো না।উল্টে পাশে বসার ইঙ্গিত করলে ওর গায়ে গা ঠেকিয়ে বসে পড়ি। উল্লেখ্য গায়ে গা লাগাতেই মনের সাহস যায় অনেকটাই বেড়ে। চক্ষুলজ্জার মাথা খেয়ে জিজ্ঞেস করি,
আমার কোলে মাথা রাখবি?
এবার ও একটা মিষ্টি হাসি দিয়ে তৎক্ষণাৎ মাথা নেড়ে সম্মতি দেয়। যেন এমনটির জন্যেই ও এতক্ষণ অপেক্ষা করছিল।ওর এই সম্মতি মূহুর্তে আমার অন্তরের কালবৈশাখীর ভয়াল অন্ধকার দূর করে। আনন্দের রৌদ্রোজ্জ্বল দীপ্ততা আমাকে আত্মহারা করে তোলে। ফল্গুধারার মতো যে আনন্দ মনের সঙ্গে গোটা শরীরেও প্রবাহিত হয়।মনে মনে ভাবি এতটা সাহসী আমি হলাম কেমনে।পরম মমতায় সেদিন শ্রেয়সীর মাথাটাকে কোলে তুলে ভিতরে ভিতরে কুকুরটিকে ধন্যবাদ দিতে থাকি। ভাগ্যিস কুকুরটি ওভাবে ওকে তাড়া করেছিল।নইলে এ যাত্রায় ওকে পাওয়ার স্বপ্ন আমার অধরাই থেকে যেতো।
নদীর দিকে মুখ করে আমি আমার বাম উরুতে ওর মাথাটা ধরলেও ও আরো উপরে উঠে ডান উরু পর্যন্ত এগিয়ে আসে। ততক্ষণে ওর উন্নত ডান স্তনটি চেপে বসে আমার বাম উরুর উপরে। মূহুর্তে শরীরের ভেতর বিদ্যুৎ তরঙ্গের ন্যায় প্রবাহিত হয়।নারী শরীরের চুম্বকত্ব এই প্রথম অনুভব করি। উফ! সে এক অনির্বচনীয় অনুভূতি! এক অসম্ভব ভালোলাগার আবেশে শরীর মন জুড়ে যায়। এবার ঘটলো ঠিক উল্টো ঘটনা।আমার একটি হাত ধরে ও মাথায় বিলি কাটতে বলে। কিন্তু আমার যে তখন পাথরের মূর্তির মত অবস্থা। কিন্তু কেমনে বলি ওকে সে কথা। ও চাইছিল আমি ওর সঙ্গে প্রাণ খুলে গল্প করি। কিন্তু ততক্ষনে আমার গলা শুকিয়ে যে কাঠ। বুঝতে পারি শরীরের তাপমাত্রা কয়েকগুণ বেড়ে গেছে। এদিকে ও সমানে চাপ দিতে থাকে, ওর সঙ্গে যেন কিছু গল্প করি। কিন্তু আমার পক্ষে তা কিছুতেই সম্ভব হচ্ছিল না।ওর পীড়াপীড়ীতে আর সহ্য করতে না পেরে বলেই ফেলি সে কথা,
-আচ্ছা শ্রেয়সী! আমারও তো তোর সঙ্গে গল্প করতে ইচ্ছা করছে। কিন্তু এক্ষণে আমি তোর সঙ্গে গল্প করবো কেমনে? কেন বুঝতে পারছিস না যে আমি কাঠের পুতুল নই;একজন রক্ত মাংসের মানুষ। তোর স্পর্শে আমি নিজেকে স্বাভাবিক রাখতে পারছি না।
আমার কথায় ওর মধ্যে সামান্যতম পরিবর্তন দেখলাম না। উল্টে মনে হল আমার অসহায়ত্ব যেন ওকে আরও আনন্দিত করে তুলেছে। দুষ্টু একটা হাসি দিয়ে নাকটা টিপে দিয়ে,
- ও বুঝেছি,বলে আবার পাশ ফিরে রাস্তার দিকে মুখ করে শুয়ে পড়ে। এবার অন্য স্তনটি আমার ঊরুতে স্পর্শ করে। আমার যে তখন কি অবস্থা তা কেবল উপরওয়ালাই জানেন। নিজের সঙ্গে নিজেই লড়াই করেছি। সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে নিজেকে সংযত রেখে একহাত দিয়ে মাথায় বিলি কাটি অন্য হাত ওর পিঠে বোলাতে থাকি। পিঠে হাত বুলিয়ে বুঝতে পারি ও অত্যন্ত আঁটোসাঁটো ব্রা পড়ে আছে।স্ট্রিপ দুটো যেন পিঠে পুঁতে বসে আছে। বিলি কাটতে কাটতে কিছুটা না জানার ছলে জিজ্ঞেস করি,
- আচ্ছা কুকুরটি তোকে তাড়া করলো কেন রে?
ভেবেছিলাম এতক্ষণে ও অনেকটাই স্বাভাবিক হয়ে গেছে। কিন্তু আমার ধারণা ভুল ছিল। হঠাৎ গম্ভীর হয়ে গেলো। একটু দম নিয়ে বলল,
-ওদের মধ্যে দুই-তিনটি কুকুর কচ্ছপটিকে ধরে টানাহেঁচড়া করছিল। আর এই কুকুরটি একটু দূরে শুয়ে ছিল। প্রথমদিকে সব ঠিকঠাক ছিল।ওরা ওদের মত কাজ করছিল আর আমিও বিভিন্ন অ্যাঙ্গেল থেকে ছবি তুলছিলাম। কিন্তু হঠাৎ করে এই কুকুরটি রেরে করে আসে আমার দিকে। আমি ভয়ে হাতের ক্যামেরা ফেলে পালিয়ে আসি।তার পরের ঘটনা তো তোরা দেখেছিস।
আমি পাল্টা বলি,
- ও হয়তো ভেবেছে তুই ওদের খাবারে বাধা দিচ্ছিস।
মুখে কিঞ্চিৎ শুকনো হাসি এনে জানালো,
-বলতে পারবোনা। আমি কুকুর বিশেষজ্ঞ নই।
বুঝতে পারি প্রসঙ্গটা তুলতেই ও হঠাৎ বদলে গেছে। পরিবেশটি থমথমে হয়ে গেল।আর সেটা হলো আমারই নির্বুদ্ধিতার জন্য।কেন যে ওকে কুকুরের প্রসঙ্গে জিজ্ঞেস করতে গেলাম। এখন অপেক্ষায় রইলাম কত তাড়াতাড়ি ও আবার স্বাভাবিক হয় সে কথা ভেবে।
কথা বলার সময় ঘোমটা টানা এক মহিলাকে বার কয়েক সামনে ঘুরঘুর করতে দেখে বেশ অস্বস্তিতে পড়ি। ভদ্রমহিলা হাল্কা ঘোমটা টেনে আমাদের দিকে তাকাতে তাকাতে চলে গেলেন। ওনার অমন রহস্যময়ী চাহনি আমাকে সন্দিগ্ধ করে তোলে। আবার একটা নতুন চিন্তায় পড়লাম। নতুন করে আবার কোন ঝামেলায় পড়তে চললাম না তো? মনে মনে বললাম,
-কিরে বাবা! এতো লোক বসে আছে সেখানে না গিয়ে আমরা একদিন একটু বসার সুযোগ পেলাম আর সেই দিকেই ধাওয়া? কি জানি কি অভিসন্ধি।নাকি কোনো অশ্লীলতার দায়ে আবার নতুন করে কোনো ঝামেলায় পড়ি।
এসময়ে শ্রেয়সী বেশ কিছুক্ষণ চুপচাপ ছিলো।বকবক করছিলাম মূলত আমিই। কিন্তু হঠাৎ আমার নীরবতা ওকে কৌতুহলী করে তোলে। শুয়ে শুয়েই জিজ্ঞেস করে,
-কিরে এমন চুপসে গেলি কেন?
আমি ভদ্রমহিলার দিকে ইশারা করে বলি,
- এক ভদ্রমহিলা আমাদের লক্ষ্য করছেন। বারকয়েক সামনে দিয়ে গেলেন তাকাতে তাকাতে। ব্যাপারটা আমার ঠিক ভালো লাগছে না...
-হ্যাঁ আমাদের ফলো করছেন? বলে ও তেড়ে-ফুঁড়ে উঠে বসে।
ও উঠে বসতেই আবার দেখি ভদ্রমহিলা আমাদের দিকেই আসছেন। এবার ঘোমটা অনেকটা কমিয়ে হাসি হাসি মুখে আমাদের সামনে চলে এলেন। বুঝতেই পারছি কিছু একটা বলতে চান। একদম সামনে এলে আমি জিজ্ঞেস করি,
-কিছু বলবেন?
- এ মনা তুই রণ না?
কি আশ্চর্য! এমন করে মনা বলে ডাক তো একমাত্র আমার বড় বুবুই ডাকে আমাকে। পাঠকদের উদ্দেশ্যে বলি, হ্যাঁ আমার ডাকনাম রণ। ভায়ের নাম জয়। জমজ দুই ভাই জন্মেছিলাম কয়েক মিনিটের ব্যবধানে। স্বাভাবিকের চেয়ে দুই ভাইয়ের ওজন অনেকটাই কম ছিল। একপ্রকার মরণাপন্ন অবস্থা থেকে দুই ভাই বেঁচে গিয়েছিলাম। তাই বাবা-মা আমাদেরকে আদর করে রণজয় নাম দেন। দুভাইয়ের চেহারায় মিল ছিল অদ্ভুত রকমের। ছোট থেকেই আত্মীয়-স্বজন থেকে শুরু করে পাড়াপড়শি বন্ধুমহলে সকলেই গুলিয়ে ফেলতেন আমাদেরকে। আমাকে জয় ভাবতেন বা জয়কে রণ মনে করতেন। শুধুমাত্র মা বাবা ও বড় বুবুই আমাদের সঠিকভাবে চিনতে পারতেন। একই ক্লাসে পড়তাম; স্কুলে স্যারেরা আগে থেকেই নাম জিজ্ঞেস করে পড়া ধরতেন।জয় একটু দুষ্টুমি করতে চাইতো। মাঝেমাঝে বলতো স্যারদেরকে ঘোল খাইয়ে নিজেদের পরিচয় একটু ঘুরিয়ে বলি। কিন্তু আমি রাজি হতাম না। দুই ভাইয়ের একই রকম দেখতে হওয়ায় বাস্তব জীবনে আমাদেরকে বেশ কয়েকবার খুবই সমস্যার মধ্যে পড়তে হয়েছিল। জয়ের গার্লফ্রেন্ড ছিল।সেকি বিব্রতকর অবস্থায় পড়তে হয়েছিল একদিন আমাকে।সে কথা না হয় বলবো আরেকদিন। যাইহোক এতদূরে ঘুরতে এসে নিজের পরিচয় এভাবে সঠিকভাবে উল্লেখ করায় ওনার পরিচয় নিয়ে আমিও বিস্ময়াভিভূত হয়ে পড়ি। তাই মনে পাহাড়সম জিজ্ঞাসা নিয়ে আমতা আমতা করে বলি,
- হ্যাঁ আপনি ঠিকই ধরেছেন আমি রণ। কিন্তু আপনাকে তো চিনলাম না?
-উমা! আমাকে চিনতে পারছিস না? আমি তোর রমিসা বুবু।
রামিসা বুবুর পরিচয়ে আমি যেন চাঁদ হাতে পাই। বুবু আবারো বলতে লাগলো,
-অন্যদিনের মত আজও সকালে মাছ সুখাচ্ছিলাম। হঠাৎ দেখলাম তুই মেয়েটির সঙ্গে নিয়ে ফটো তুলছিস। প্রথমে দেখে ভেবেছিলাম হয়তো অন্য কেউ হবে। মানুষের মত মানুষ হতেই পারে। বেশ কয়েকবার আড়চোখে দেখে মিল পেতেই সন্দেহ বেড়ে যায়। সকালে মাছ শুকানোর পর একটু বাজারে যেতে হয়। কিন্তু আজ আর বাজারে যেতে মন সায় দেয়নি।তাই কোনোক্রমে ঐসব কাজ সামলিয়ে খুঁজতে বেরিয়ে পড়ি তোদের সন্ধানে। তোরা যে পথে গেছিস সেই পথ বরাবর এগিয়ে আসি। আমার মন বলছিল যে করেই হোক তোদের খুঁজে বের করবোই। পার্কে এসে খুঁজতেই তোদের পেয়ে গেলাম। কিন্তু তোরা অন্তরঙ্গভাবে বসে থাকায় সামনে যেতে লজ্জা পাচ্ছিলাম। একটুখানি জানার জন্য মুখিয়ে ছিলাম যে তুই সত্যিই রণ কিনা। সেই সেদিনের ছোট্ট বাচ্চার সঙ্গে আজও মুখটা একদম একই রয়ে গেছে। একনাগাড়ে কথাগুলো বলেই বুবু আমার গায়ে মাথায় হাত বোলাতে থাকে। লক্ষ্য করি বুবুর মুখে যেন খই ফুটছে।তোরা দুইভাই আমার কি নেওটাই না ছিলি রে মনা।কি ভালোই না লাগতো ছোটবেলায় তোদেরকে।এ আল্লাহ! এ জীবনে যে আবার তোদের দেখা পাবো ভাবতে পারিনি।
আমি হাসিহাসি মুখে বুবুর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকি। লক্ষ্য করলাম বুবু কথা বলার মাঝে বারবার শ্রেয়সীর দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসছে। এবার ওকে জিজ্ঞেস করে,
- কি নাম ভাই তোমার?
-শ্রেয়সী গুপ্তা।
বুবু অতি সারল্যে আবার ওকে জিজ্ঞেস করে,
- আমার ভাইকে বিয়ে করবে তো?
শ্রেয়সী লজ্জায় মুখ নীচু করে হাসতে থাকে। আমিও খুব অস্বস্তিতে পড়ে যাই। এদিকে বুবুকে দেখে আমার মনে তখনো হাজার প্রশ্ন।
- আচ্ছা বুবু তোমার তো সেই ছোট্ট বেলার মুজাহিদের সঙ্গে বিয়ে হয়েছিল। কিন্তু এখন তুমি এখানে এলে কেমনে?
আমার কথা শেষ না হতেই,
- সে হাজারো কথা রে মনা,বলে একটা লম্বা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। আমরা সকলেই সাময়িক চুপ করে থাকি। বুবু আবারো বলতে লাগলো,
- আমার জীবনের কথা একদিনে বলে শেষ হবে না মনা।
সম্ভবত আমরা তখন ক্লাস ওয়ানে পড়ি তখন বুবুর বিয়ে হয়ে যায়।রমিসা বুবু ছিল আমার বড় বুবুর বান্ধবী। সারাক্ষণ আমাদের বাড়িতেই পড়ে থাকত। আমরা জমজ দুই ভাই ছিলাম বড়বুবুর খুব নেওটা।সেই সূত্রে রমিসা বুবুও ছিল আমাদের অত্যন্ত প্রিয়। তারপরে হঠাৎ একদিন শুনি বুবুর বিয়ে। আমাদের নেমন্তন্ন করেছিলেন বুবুর আব্বা। কি আনন্দ হয়েছিল সেদিন বুবুর বিয়ে শুনে। কিন্তু আমার আব্বা আমাদেরকে বিয়েতে যেতে দেননি। খুব রাগ হয়েছিল সেদিন আব্বার উপরে। শুনেছিলাম হবু দুলাভাইয়ের বাড়ি নাকি বাংলাদেশের কালীগঞ্জে। উনি ছিলেন একজন মুজাহিদ। সেদিনের সেই ছোট্ট শৈশবে আমার ধারণা জন্মেছিল মুজাহিদও এক রকমের চাকরি। আর এই চাকরিতে নাকি পয়সাকড়ি প্রচুর। সাথে দেশ-বিদেশ ঘোরার ব্যাপক সুবিধা। চাকরি সূত্রে প্রচুর পয়সাকড়ি ছিল দুলাভাইয়ের। খুব ধুমধাম করে বুবুর বিয়ে হয়েছিল। বিয়ের যাবতীয় খরচা পাতি নাকি দুলাভাই-ই বহন করেছিলেন। সকলেই বলাবলি করতেন, এমন জামাই ভাগ্য নাকি গ্রামের দ্বিতীয় কারো ছিল না। গ্রাম শুদ্ধু লোক বুবুর বিয়েতে কব্জি ডুবিয়ে খেয়েছিলেন, শুধুমাত্র আমরা বাদে। আসছি সে প্রসঙ্গে পরে। খুব সুনাম হয়েছিল দুলাভাইয়ের। এমন একজন মুজাহিদের সঙ্গে মেয়ে বিয়ে দেওয়ায় রমিসা বুবুর আব্বা ছিলেন খুবই গর্বিত। প্রচুর গয়নাগাটিও দিয়েছিলেন বুবুকে। যেন রূপকথার বিয়ে। বহুদিন গ্রামবাসীদের মুখে লেগে ছিল রূপকথার সেই বিয়ের কথা। গ্রামের মধ্যে একমাত্র আমার আব্বাই ছিলেন এই বিয়ের ঘোর বিরোধী। অচেনা অজানা মুজাহিদের হাতে মেয়ে তুলে দেওয়া ঠিক হচ্ছে না বলায় বুবুর আব্বা লোকমান চাচা আমার আব্বাকে দুকথা শুনিয়েছিলেন। আরো বলেছিলেন, আমার আব্বা ঈর্ষাবশত এই বিয়ের বিরোধিতা করছেন। মা আব্বাকে বুঝিয়েছিলেন, নিজের মেয়ে তো নয়, যার মেয়ে ভাবনা তার উপর ছেড়ে দিতে। কিম্বা এসব নিয়ে অহেতুক ঝামেলা না করতে। কিন্তু আব্বা মায়ের কোনো কথায় শোনেন নি। উনার যুক্তিতে উনি রমিসা বুবুকে বড় বুবুর মতোই নিজের সন্তানের মতোই দেখতেন। ফলে বিয়ে আটকাতে না পেরে উনি খুব হতাশ হয়ে পড়েছিলেন। মেয়েটাকে আগুনের সামনে ফেলে দিচ্ছেন বলে প্রায়ই হা হুতাশ করতেন। এই হতাশা থেকেই রাগে আমাদেরকে নির্দেশ দেন, ও বাড়ির কারোর সঙ্গে কথাবার্তা পর্যন্ত না বলতে। উল্লেখ্য আব্বাকে অমান্য করা আমাদের কারো পক্ষে সম্ভব ছিল না।ফলে তখন থেকেই বুবুদের বাড়ির সঙ্গে আমাদের একটা অলিখিত যুদ্ধ শুরু হয়। কথাবার্তাও যায় সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে। আজ এত বছর পর চোখের সামনে সেই বুবুকে দেখে যেন বিশ্বাসই হচ্ছিল না আমার সেই খিলখিলিয়ে হাসির ছোট্ট রমিসা বুবু। ঘোমটার মধ্যে থেকে ফর্সা সুমুখশ্রী টিকালো নাক তার ভরা যৌবনের লাস্যময়ীতা তুলে ধরেছিল ঠিকই কিন্তু পরিহিত বেশভূষা বুবুর হতদরিদ্রের পরিচয় বহন করছিল।
কথা বলতে বলতে কতক্ষণ যে চলে গেছে তার খেয়াল ছিল না।শ্রেয়সী একটু তাড়া দিতেই পশ্চিম দিগন্তে তাকিয়ে দেখি রক্তিমদেব ততক্ষণে অনেকটাই দিগন্তরেখার দিকে ঢলে পড়েছে। বুবুর সঙ্গে কথা শেষ হলো না। অতৃপ্ত মন নিয়ে উঠতে হলো। তবে আসার সময় বুবুকে কথা দিতে হল দু-একদিনের মধ্যে আবার যাব।
সর্বশেষ এডিট : ০৩ রা জুন, ২০২২ দুপুর ২:৩৯