বুক রিভিউ-বাসি বকুলের ঘ্রাণ
লেখিকা- মনিরা সুলতানা
প্রকৃতি-স্মৃতিচারণধর্মী জীবনের গল্প।
কথন সংখ্যা-কুড়িটি
পৃষ্ঠা সংখ্যা-৬০
মূল্য-২০০ টাকা
প্রচ্ছদ-নির্ঝর নৈঃশব্দ্য
প্রকাশনা- বুকিশ পাবলিকেশন্স
অনলাইন পরিবেশক-www.rokomari.com/bookishpublications
হটলাইন:১৬২৯৭/+৮৮ ০১৫১৯৫২১৯৭১
প্রাপ্তিস্থান- বাতিঘর
চট্টগ্রাম, ঢাকা ও সিলেট
শুরুতে কৃতজ্ঞতা জানাই ব্লগার @মা.হাসান ভাইকে। বন্ধুত্বের মেলবন্ধনে ওনার সমুদ্রসম অন্তরিকতার কারণে বাসি বকুলের সুগন্ধ পদ্মা পাড় পার হয়ে কলকাতার উপকণ্ঠে আছড়ে পড়েছে। পাশাপাশি আরেকটি কথা না বললেই নয়, শুভ কাজের প্রারম্ভে একটু ধূপধুনো প্রদীপ প্রজ্জ্বলনের প্রথা উপমহাদেশে বহুদিন ধরে প্রচলিত। তাই রিভিউ পর্বের শুরুতে টাটকা বকুল না পেয়ে বাসি বকুলের ঘ্রাণ দিয়েই অতিথি আপ্যায়নের ইচ্ছা। বকুল ফুলের যোগানদাতা হিসেবে ধন্যবাদ দেই লেখিকা মনিরা সুলতানা আপুকে। এবার নেওয়া যাক 'বাসি বকুলের ঘ্রাণ'।
আমাদের জীবন স্রোতস্বিনীর ন্যায়। চলমান প্রবাহ পথে নানা ঘাত-প্রতিঘাত প্রতিকূলতা আমাদেরকে পোহাতে হয় । চড়াই উতরাই প্রবাহ পথে কখনো দুঃখকর অনুভূতি আমাদেরকে যেমন দুঃখের অতল সাগরে নিমজ্জিত করে তেমনি সুখস্মৃতি কখনোবা ছোট্ট ডিঙিনৌকা থেকে বিশালাকার জাহাজ হয়ে দুঃখের অতল সাগরে ভেসে থাকতে সাহায্য করে। 'বাসি বকুলের ঘ্রাণ' বইতে লেখিকা আমাদেরকে পরিচয় করিয়েছেন সুখ-দুঃখের ব্যথা বেদনা ভরা জীবনের কুড়িটি উপখ্যানের সঙ্গে।
শুরুতেই উনি উড়ো চিঠি'র প্রসঙ্গ এনেছেন। উপলব্ধি করেছেন প্রাপ্ত এমনই উড়ো চিঠির শব্দের হাহাকারের মধ্যে মেলে অক্ষরের পাঁজরভাঙ্গা আর্তনাদ। পাশাপাশি আছে নাম বিভ্রাটের কারণে রোকেয়া হলের ঠিকানায় প্রাপ্ত কোন এক অজানা শোয়েবের ক্যাডেট জীবনের মধ্যরাতের নির্মমতম কান্না। তারুণ্যের উচ্ছলতার দুষ্টুমিতে লেখিকাও কম যাননি। শোয়েব যখন বুঝতে পারেন তাকে বোকা বানানো হচ্ছে তখন অবশ্য সেই পর্বের ইতি ঘটে। পরে চিঠির প্রাপক আসল মনিরার সঙ্গে লেখিকার সাক্ষাৎ হয়।যদিও গুড গার্লের মতো আসল মনিরার সঙ্গে তিনি সে প্রসঙ্গ এড়িয়ে যান।
কবিগুরুর ঋতুরঙ্গের মতোই লেখিকা নিজের জীবনের উপখ্যানকে বিভিন্ন ঋতুর আদলে রাঙায়িত করার চেষ্টা করেছেন। তাই বর্ষার আগমনী বর্ষা কথনের সঙ্গে বাদল দিনের চিঠি কখনো বা মাঘের চিঠি কখনো বা ভরা আশ্বিনের ঐক্যতান সহ বিভিন্ন রং-বাহারে নিজের মনের পেখম মেলে ধরেছেন।
বাদল দিনের একটি জায়গায় কবি প্রশ্ন করেছেন,
"সাইক্লোন সমুদ্রে ঢেউয়ের সাথে সখ্যতার অন্য নাম প্রেম। সত্যিই তো কবিতাকে ভালোবেসে কি জীবন সমুদ্রের ঢেউয়ের সাথে সখ্যতা করতে হচ্ছে না?"
লেখিকা পাঠকের সঙ্গে নিজের যাপিত জীবনের পরিচয় করিয়েছেন। কয়েকটি পর্বাকারে উল্লেখ করেছেন স্মৃতিতে ভেসে থাকা সেই ছোট্ট শৈশব থেকে আজকের করোনা কাল পর্যন্ত নানান অভিজ্ঞতার কথা। যেমন আছে চাঁদরাতে দুধের সর কাঁচা হলুদ ও কমলার খোসা বাটা মেখে গোসল করা বা শৈশবে শাক কুড়াতে যাওয়ার মতো মধুর স্মৃতি সমুহ।
শব্দের বাঁধুনিতে কিম্বা কথার মায়াজাল বুনতে লেখিকার জুড়ি নেই। ইতিমধ্যে ব্লগে সাহিত্য সুধারস সৃষ্টিতে নিজেকে উচ্চমার্গে নিয়ে গেছেন। সেই মার্গ দর্শন গগনচুম্বীতে পৌঁছে গেছে বাসি বকুলের ঘ্রাণের 'কালো ভ্রমর আর মালতি' নামক কথনে। শব্দের লহরী তুলে ঝংকারের ন্যায় যা পাঠক হৃদয়ে অনুরণিত হতে পারে।
"ভ্রমর! সেতো আজম্ম বিবাগী! নিকষ নিশ্চুপ নিসর্গ নির্নিমেষ নয়নে কেবল নিজেকে দেখে নিজেকেই ভালোবাসে।"
একই গল্পে অন্য স্থানে,
"নিজেকে নিঃস্ব ভাবার নিগূঢ় নীলাভ নিষ্প্রভ মন প্রথম প্রহরে ভ্রমণের মনে হলো মালতির চোখের তারার তুমুলিত ডাক। হাসির ঝর্নায় কিছু উন্মনা আলো পদ্ম হৃদয়ে টলটলে সুখ।"
অন্য আরও একটি স্থানে,
"শব্দ মাদল আনন্দদল আন্দলিত হয় ক্ষণে ক্ষণে তুমুল ঢেউ ওঠে ঢাক বাজা বুকে।"
'কৃষ্ণ জলে গাহণে' মূলত বিষাদ পর্ব। রান্নাঘরের চুলায় অগ্নিদগ্ধ হয়ে উনার মেজ আপা কলেজ শিক্ষক বধূটি প্রাণ হারান। নিজের বিবাহ প্রসঙ্গে লেখিকা তুলে ধরেছেন সানাইয়ে বিষন্নতার করুণ সুর,
"মেঝো বোনের অঙ্গার হওয়া আত্মা আমাকে বাঁচাতে পারলো না।
ভগ্নিপতির সাথে আজ আমার বিয়ে।"
লেখিকা শৈশবে একবার হারিয়ে গেছিলেন। 'কেয়া পাতার নৌকা ভাসানো দিনগুলো'তে সে কথা উল্লেখ করেছেন। মেজোপার স্কুলের বন্ধুর বাসা খুঁজতে বের হয়েছিলেন ছোট্ট দুই পিচ্চি। বন্ধুর বাসা তো পাওয়া গেল না, উল্টে নিজেদের বাসাটাও গেল হারিয়ে। মাইকে হারানো বিজ্ঞপ্তি শুনে বুঝে যান মধ্যবর্তী সময়ে কি কান্ডই না ঘটে গেছে। লেখিকা অকপটে স্বীকার করেছেন, সেদিন নিজের পিঠ ঢাল হিসেবে কাজ করেছিল।
'গল্পে গল্পে জীবন অথবা জীবনের গল্পে' লেখিকা এক কঠিন বাস্তবতাকে তুলে ধরেছেন। তের বছরের রোমিজা, ছয়ে নাসিমা আর তিরিশ পার করা রুগ্ন মা-এই নিয়ে কালী বাড়ী সংলগ্ন ঝোপড়াতে ওদের বাস। যে বয়সে বাচ্চারা উৎসাহে ফুল কুড়ায় সেটা আজ ওদের প্রয়োজন জীবনের তাগিদে ফুল বিক্রি করা। পদ্মার ভাঙ্গন বাবা হারা পরিবারটিকে দাড় করিয়েছে কঠিন বাস্তবতার মধ্যে এনে ফেলেছে এই কালিবাড়ি চত্বরে।
ভালো লেগেছে একেবারে শেষের দিকে আবীর রঙা বিকেল গল্পটিকে। হতে পারে এটা কোনো গদ্য কবিতা।
বিশ্ববিদ্যালয়ের শেষ পর্যায়ে হঠাৎ একদিন কানে ভেসে আসে,
"সমস্ত সত্ত্বায় বেহাগের করুন সুরের অস্তিত্ব জাহির করে কোথায় চললেন?
এই কথা শুনে পিছন ফিরে যখন ওকে দেখি!
অসহ্য সুখ শব্দটার মর্ম অনুভব করি শিরায় শিরায়।
আমি পাল্টা প্রশ্ন করলাম,
বিষন্ন হৃদয়ের তরুণ কি এই প্রথম দেখলেন?
হাসিতে আলোর ঝরনা ছড়িয়ে বলল,
জানোতো পৃথিবীর সমস্ত বিষন্নতার বিরুদ্ধে আমার যুদ্ধ ঘোষণা করা আছে।
বইমেলা তক পায়েপায়ে সপ্তসুরের বীণা বাজলো আনন্দ উচ্ছলতায়। মাঝরাস্তায় থেমে তাকে জানালাম,
-তোমাকে চাই!
ঠিক সেই মুহূর্তটা পৃথিবীতে ইতিহাস হয়ে থাকল আমার হৃদয়ে, ক্ষনিকের নিস্তব্ধতা শেষে ওর হাসির কালবৈশাখী, ফাল্গুনের মিষ্টি রোদকে লন্ডভন্ড করে ফেললো।
কিছুই বলল না,
পাশের স্টল থেকে আনিসুল হক এর 'গাধা' বইটা কিনে তাতে লিখল গাধা আবির। আমার কাছে একটাই মাত্র সফল ভালোবাসার গল্প আছে। আর ভালোবাসার গল্প একটার বেশি থাকা ঠিক না।"
মধুরেণ সমাপয়েৎ না হলেও গল্পকথন এখানেই শেষ হলে আমার কাছে ভালো লাগতো। কিন্তু একদম শেষে লেখিকা 'সরলতার কাব্যে' ওনার শৈশবের নৌকা যোগে গ্রামের বিয়েতে যাওয়ার সরলতার আত্মমগ্নতার কাহিনী পরিবেশন করেছেন। শেষ গল্প হিসেবে যেটা ভালো লাগেনি। গল্পটাকে উনি যদি মাঝে ঢোকাতেন সেক্ষেত্রে বোধ হয় বেশি ভালো হতো।
পাঠক হিসেবে বরং পরামর্শ গল্পগুলোকে যদি উনি জীবনের সরলরেখা ধরে ক্রমানুসারে দিতেন তাহলে আমার মনে হয় আরো ভালো হতো। গল্পের মধ্যে কখনও ওনার বিশ্ববিদ্যালয়ের হলের জীবন আবার কখনো শৈশব, কখনো বেড়ে ওঠা প্রভৃতি পর্বগুলো বড় বেশি মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে।
প্রচ্ছদ অত্যন্ত সুন্দর হয়েছে।পাতার কোয়ালিটি, হরফের মান অত্যন্ত ভালো। যদিও বাঁধাই কোয়ালিটি আশাপ্রদ নয়। আমি যে বইটি পেয়েছি সেই বইয়ের বাঁধায় বলে কিছু নেই। বাঁধায় সুতো ছিঁড়ে একাকার হয়ে আছে।
বইটির মূল্যটাও একটু বেশি বলে মনে হল। পাতা সংখ্যা অনুযায়ী ১৬০ টাকার মধ্যে থাকলে ভালো হত।
সবশেষে আবারো বলব, বাসি বকুলের ঘ্রাণ দারুন সুগন্ধির। আপনারা যারা এখনো সংগ্রহ করেননি অনতিবিলম্বে বইটি সংগ্রহ করে বকুলের অপার সুগন্ধ আস্বাদন করুন।
বিশেষ দ্রষ্টব্য:-রিভিউটি গতকালই দিয়েছিলাম। বিশেষ কারণবশত তুলে নিতে বাধ্য হই। খুবই দুঃখিত আমি। গতকাল পোস্টে যারা মন্তব্য বা লাইক করেছিলেন তাদের কাছে ক্ষমাপ্রার্থী। আপনাদেরকে আজ আরও একবার পোস্টে আসার জন্য অনুরোধ রইলো।