গত শনি ও রবিবার দুদিনের ছুটি নিয়ে সপরিবারে একটু ঘুরতে গেছিলাম শহর থেকে প্রায় পাঁচ ঘণ্টা দূরে শিয়ালমারির জঙ্গলে। পাঠক বন্ধুরা হয়তো ভাববেন শিয়ালমারির জঙ্গল মানে শিয়ালে পরিপূর্ণ কিনা... না তা কিন্তু নয়। জঙ্গলটি শিয়ালের নামে নামকরণ হলেও সারাদিনে একটিও শেয়ালের দেখা পাওয়া যায় নি। এমন কি শোনা যায়নি একবারের জন্যও শৃগাল প্রজাতির বড় মেজ ছোট কারোর এক খন্ড হুক্কাহুয়োও। তবে শিয়াল না মিললেও নৈসর্গিক দৃশ্য উপভোগ করার যাবতীয় মসলা মজুদ ছিল জঙ্গলটিতে। বনবিথির আদর্শ জায়গা বলা যেতে পারে। হাজার রকমের পাখির কলকাকলিতে মুখরিত এলাকাটি যেন প্রকৃতির নয়নাভিরাম সৌন্দর্যের লীলাভূমিতে পরিণত হয়েছে।আর এই কারণেই আলাদাভাবে কোনো বন্য প্রাণীকে দেখার বাসনায় লোভাতুর হবার দরকার নেই বলে আমার মনে হয়েছিল। যাই হোক বনদপ্তরের অনুমতি আদায় করতে গিয়ে দেখি অফিসে বসা ভদ্রলোকের মুখটি খুব চেনা চেনা লাগছে। মনের মধ্যেই হাতড়াতে থাকি, কোথাও যেন দেখেছি দেখেছি... কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই উত্তরও পেয়ে যাই। তবুও কিছুটা সন্দেহ রেখে আমতা আমতা করে জিজ্ঞেস করি,
- আপনি কি রায়হান আকুঞ্জি?
চশমা পড়া স্বল্পকেশী ভদ্রলোক তখন টেবিলে বসে আপন মনে কাজ করছিলেন। আমার প্রশ্ন শুনে এমন হা করে তাকিয়ে রইলেন যেন মন হলো আকাশ থেকে পড়েছেন। খানিকক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে থেকে,
অ্যা অ্যা অ্যা... করতে করতে চশমা খুলে হাসি হাসি মুখে উত্তর দিলেন,
-হ্যাঁ আ..প..নি ঠিকই বলেছেন, আমি রায়হান আকুঞ্জি। কিন্তু.....
-আমি পিটার চৌধুরী। ৯৭ এর কলেজ ব্যাচ।
আমার কথা শুনে তিড়িং করে দুপায়ে দাঁড়িয়ে উঠে,
- ওওও....সরি সরি সরি... আমি না একদম চিনতে পারিনি।
মূহুর্তে আপনি থেকে তুই,
-তুই একদম বদলে গেছিস ভাই পিটার। তখন ছিলি রোগা পটকা।আর এখন একদম গোলগাল চেহারার। মুখের ভুগোল পর্যন্ত বদলে গেছে।কি করে চিনব ভাই বল না..
যাইহোক ওর কল্যাণে আমরা অতিসমাদরে শিয়ালমারির জঙ্গল পরিদর্শন করলাম।
ভারী অদ্ভুত ছেলে ছিল রায়হান। ভীষণ পরোপকারী যাকে বলে। তবে ওর পরোপকারের ধরনটা ছিল একটু ব্যতিক্রমী। ও সাহায্য করত কলেজে হঠাৎ জুতো ছিঁড়ে বিপদে পড়ে যাওয়া যেকারোর জুতো সেলাইয়ের মাধ্যমে। ক্রমশ একজন দুজন দিয়ে শুরু করে পরের দিকে গোটা কলেজে যেকারো জুতো ছিঁড়ে গেলে তাদের সামনে মুশকিল আসান হিসেবে সমাধান করত রায়হান। ওর এই জুতো সেলাই করার কারণে অল্প দিনের মধ্যেই ক্লাসে বেশ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। বন্ধুদের মধ্যে কেউ কেউ সামনাসামনি রসিকতা করে ওকে মুচি বলতেও কসুর করত না। সরল সাদাসিধা ছেলেটি এতোটুকু রাগ না করে একটা নিষ্পাপ হাসি দিয়ে যেচে পড়ে নেওয়া কর্তব্য পালন করে যেতো। জুতো সেলাই করাটা সমাজবদ্ধু মুচি সম্প্রদায়ের সন্তানের কাছে খুবই স্বাভাবিক কিন্তু অবাক হয়েছিলাম একজন মুসলিম পরিবারের সন্তান কি করে এমন জুতো সেলাইয়ের কাজ করতে পারে ভেবে।
বেশ কয়েকদিন যেতেই লক্ষ্য করি, প্রমিলা মহলে রায়হানের জনপ্রিয়তা ঈর্ষণীয় ভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে।আর ঠিক তখনই ঘটে যায় একটা উল্লেখযোগ্য ঘটনা। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের শিক্ষক ছিলেন স্বাধীন বাবু। একদিন সিঁড়ি দিয়ে নামার পথে অসাবধানতায় স্যার পা হড়কে পড়ে যান।ভাগ্য ভালো যে উনি খুব বেশি উপর থেকে পড়েননি। কয়েকটি ধাপ উপর থেকে নিচে পড়তেই করিডোরে উপস্থিত ছেলে মেয়েরা ছুটে গিয়ে স্যারকে ধরে ফেলে। স্যারের পায়ের চপ্পলের একপাটি যায় ছিঁড়ে। মনে হয় একারণেই স্যারের পদস্খলন ঘটতে পারে। যাইহোক ছেলেমেয়েদের কাঁধে ভর দিয়ে কোনক্রমে উঠে দাঁড়িয়ে প্যান্টের ধুলো ঝাড়তে ঝাড়তে স্যার বাম হাত দিয়ে ছেঁড়া জুতোটা একটু উঁচুতে তুলে চিন্তিত হয়ে পড়লেন। ওনার কপালের ভাজ দেখে আঘাত খুব বেশি বলে মনে না হলেও জুতো ছেঁড়ার দুশ্চিন্তা আঘাতের মাত্রাকে ছাড়িয়ে গিয়েছে বলে মনে হলো। এমতাবস্থায় স্যারের দুর্ভাবনা নিরসন করতে, আমরা কয়েকজন ছুটে গেলাম রায়হানকে খোঁজ করতে। রায়হানের নাম করতেই, স্যার আপত্তি জানিয়ে, কলেজের কোনো ছেলেকে দিয়ে জুতো সারানোর কাজ করানো কোনো অবস্থাতেই সমীচিন হবে না। যদিও তখন কে শোনে কার কথা।স্যারের জন্য কিছু একটা করতেই হবে। আমরা অনেকেই উপর নিচে ছুটে গেলাম রায়হানের সন্ধানে। অনেক খোঁজাখুঁজি করে অবশেষে ব্যাটাকে পাওয়া গেল তিনতলায় অনার্সের ছোট্ট একটা ঘরে কয়েকজন বন্ধুর সঙ্গে আড্ডা মারতে। সেদিন স্পেশাল খাতির করে রায়হানকে তিন তলা থেকে গ্রাউন্ড ফ্লোরে ঘটনাস্থলে নিয়ে আসা হলো। স্যার আবারো আপত্তি করলেন। কিন্তু সেই আপত্তিও কাজে এলো না। কয়েক মিনিটের মধ্যে ও স্যারের জুতো ঠিক করে দিল।স্যার ওকে থ্যাংকস জানিয়েছিলেন।অথচ সেই থ্যাংকসের ছিটেফোঁটা আমাদেরও প্রাপ্য ছিল। ওকে খুঁজে বার করার জন্য আমাদেরও যে কম অবদান ছিল না, তা কিন্তু নয়। যাইহোক স্যার সেদিন আমাদের দিকে একবারও মুখ তুলে চাইলেন না, ধন্যবাদ দেওয়া তো দূরের কথা।
এই ঘটনার পর থেকে শুধু ছেলেরা নয় মেয়েদের মধ্যেও জুতো মেরামতের আগ্রহ তৈরি হয়। মেয়েদের কাছে চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় ওর কাছে আমাদের কদর যায় যথেষ্ট কমে। আমরা জুতো ঠিক করার কথা বললে, কোনো না কোনো মেয়ে বন্ধুর দোহাই দিয়ে দেরি হবার যুক্তি দেখাত। এসময় ওর আরও একটা পরিবর্তন লক্ষ্য করি। প্রথমদিকে ব্যাটা কারোর কাছ থেকে পয়সা নিত না। কিন্তু পরের দিকে সকলে এক দু টাকা দিলে না করতো না।টাকা না হয় অন্যদের কাছ থেকে নেবে তাইবলে আমাদের কাছ থেকেও টাকা নেওয়া! ওর এমন পরিবর্তনে বেশ রাগ হলেও মুখে প্রকাশ না করে বরং অপেক্ষা করতাম কখন আমাদের সময় আসবে।কাজ শেষে এক টাকা দিয়ে বলতাম,
- আমাদের জন্য তুই কলেজে প্রচার পেয়েছিস।আর সেই আমাদেরই কিনা তুই দূর করে দিলি? মেয়েরা তোর বেশি আপন হয়ে গেল ভাই?ও জিহবা কেটে ক্ষমা চাওয়ার ভঙ্গিতে,
-না না এমন করে কেন ভাবছিস? আমি যেমন ছিলাম তেমনি আছি। আমাকে নিয়ে প্লিজ তোরা ভুল বুঝিস না।
ওর এমন সরল স্বীকারোক্তিতে বুঝতে পারি আমাদের ঔষধে কাজ হয়েছে। এবার আমাদের আসল লক্ষ্য মেয়েদের জুতো মেরামত একেবারেই বন্ধ করে দেওয়া। কিন্তু কীভাবে তা সম্ভব তা নিয়ে আমরা গভীর চিন্তায় পড়ি। অনেক ভাবনাচিন্তার পর অবশেষে উপায় বের করি। ঠিক হয় প্রত্যেকেই প্রতিদিনে নিজের নিজের বাড়ির যত ছেঁড়া ফাটা জুতো আছে কোনক্রমে পায়ে গলিয়ে কলেজে এসে ওকে মেরামত করতে দেওয়া হবে। জুতোর ভারে ও যেন মাথা তুলতে না পেরে সারাক্ষণ ডুবে থাকে। একই সঙ্গে নুতন করে কোনো মেয়ের জুতো নিতে হলে ওকে যেন পাঁচবার ভাবতে হয়। শুধু ওর উপর ছেড়ে না দিয়ে আমরা জুতো দিয়ে খালি পায়ে ওর পাশে বসে কিম্বা দাঁড়িয়ে থাকতাম। মেয়েরা কেউ উপস্থিত হলে নিজেদের খালি পায়ের দিকে ইশারা করে দেরি হবে বলে ভাগিয়ে দিতাম। রায়হানের উত্তরের জন্য অপেক্ষা করতাম না। উল্লেখ্য আমাদের জুতো সেলাই করতে করতে রায়হানের অনেক সময় চলে যেতো। এমনকি কখনোবা খালি পায়ে ক্লাসে চলে যেতাম। আহারে! বেচারা বন্ধু সত্য পালনের জন্য জুতো সেলাই করেই বাইরে কাটিয়ে দিচ্ছে। উল্টো দিকে আমরা তখন ভিতরে দিব্বি ব্যস্ত ক্লাস করতে।ওকে ওভাবে বাইরে রাখতে পেরে আমরা অলক্ষে উল্লাসে ফেটে পড়তাম।
আমাদের এই সুখের মধ্যে কাঁটা হয়ে দাঁড়ালো বর্ণালী। ও প্রায়ই এসে অভিযোগের সুরে বলতো, আমরা নাকি ইচ্ছা করেই ওকে জুতা সেলাইয়ে ব্যস্ত রাখার জন্য বাড়ি থেকে রোজরোজ ছেঁড়াফাটা জুতো নিয়ে আসছি।ভারী অন্যায় করছি ওর সঙ্গে।কথাটা সত্য হলেও আমরা মুখে দমবার পাত্র ছিলাম না। আমরাও বলতাম,
-তোরাও গাদাগাদা জুতো ওকে দিয়ে সেলাই করিয়ে নিয়েছিস। এখন সেসব করতে না পেরে আমাদের বিরুদ্ধে ওকে ক্ষেপিয়ে তোলবার জন্য যা না হবার তাই করে বলছিস।
আমরা আরও বলতাম,
-এসব দুষ্টু দুষ্টু কথার নামে মিছিমিছি প্রেম ভালোবাসার কথা বলে ছেলেটার মাথাটা নষ্ট করে দিস না...ও একা আমাদের সঙ্গে পেরে উঠতে না পেরে মুখ ঝামটা দিয়ে চলে যেতো।
বর্ণালীর এই রায়হান প্রীতি দেখে আমরা পিছনে হাসাহাসি করতাম।যাক তাহলে জুতো সেলাই করেও একজনের মন গলেছে।বর্ণালী নির্ঘাত রায়হান মুচির প্রেমে পড়েছে।
ঘটনার দুসপ্তাহ অতিক্রান্ত হতে পারেনি হঠাৎ রায়হান নিরুদ্দেশ। দেখতে দেখতে বেশ কয়েকদিন অতিক্রান্ত হলেও রায়হানের কোন খোঁজখবর নেই। আমরা বন্ধুরা সবাই খুব চিন্তায় পড়লাম। হোস্টেলে ওর রুমমেটও কোনো খবর দিতে পারল না।আশায় ছিলাম যে বর্ণালী হয়তো ওর কোন সন্ধান দিতে পারবে। কিন্তু নাহা। দুদিন পরে বর্ণালী এলে ওকে জিজ্ঞেস করতেই, সেই একই রেজাল্ট জানিনা।ওর চোখে মুখে দুশ্চিন্তার করাল মেঘ আমাদের দৃষ্টি এড়ালো না। আমরা কিছুটা দুঃখ দুঃখ মুখে লোকদেখানো দুশ্চিন্তা দেখিয়ে বর্ণালীকে কাছে টানার চেষ্টা করি।ও অত্যন্ত আবেগপ্রবণ হয়ে বলে,
-জানিস রায়হান যে কতোটা ভালো ছেলে তা ঠিক মুখে বলে বোঝানো যাবে না। ও এতোটাই উঁচু দরের যে.....বলে চুপ করে থাকে। খানিকক্ষণ বাদে, আমরা যদি সিকিভাগও ওর মতো মহানুভবতার অধিকারী হতাম তাহলে নিজেদেরকে ধন্য বলে মনে করতাম।
বর্ণালীর কথায় আমরা অবাক না হয়ে উল্টে ধরে নেই প্রেমের গদগদে আঠা একে অপরের হৃদয়কে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলেছে।আর তাই রায়হানের অনুপস্থিতে বিরহ যন্ত্রণায় কাতর বর্ণালী। যাই হোক নিরুদ্দেশ ছেলেটার জন্য আমরা আরও একবার দুঃখ প্রকাশ করে সেদিনের মত ওকে বিদায় দেই।
রায়হানের অনুপস্থিতি খুব বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। আরো কয়েকদিন পরে বর্ণালীই উপযাজক হয়ে এসে আমাদেরকে খবর দেয় যে তার একদিন আগে নাকি রায়হানের সাথে ওর দেখা হয়েছে।ও হোস্টেল এসেছিল কিছু বইপত্রের সঙ্গে কিছু টাকা পয়সা নিতে। পরবর্তীতে আরও কিছুদিন কলেজে আসতে পারবে না বলে জানিয়েছে।
মুখ কাচুমাচু করে বর্ণালী আরও বলে,
- জানিস পিটার ওর খুব বিপদ।
আমি জিজ্ঞেস করি,
-বিপদটাই কি প্লিজ খুলে বলনা..
বর্ণালীর কথায়,
-জানিস ওর না দাদু মারা গেছে।
আমি বললাম,
-দাদু মারা গেছে জানবো কেমনে?আর তাছাড়া মারা গেছে যখন তখন কিই বা আর করা যাবে? গম্ভীর হয়ে বলি,
- আমাদের সবাইকে একদিন না একদিন চলে যেতেই হবে। কাজেই মেনে নেওয়া ছাড়া কোন উপায় নেই।ওর দাদুর মাগফিরাত কামনা করছি।
সঙ্গে সঙ্গে বর্ণালী জানালো,
- আরে সে আবার মুসলিম না।
আমার আগ্রহ এবার শতগুণ বেড়ে যায়। প্রশ্ন করি,
-রায়হানের দাদু মুসলিম নন! তবে কি হিন্দু?
বর্ণালী জানায়,
- তুই ঠিক বলেছিস। উনি একজন হিন্দু ধর্মাবলম্বী।নাম মহাদেব মুচি।
আমি আর নিজেকে সামলাতে পারিনি। তৎক্ষণাৎ প্রশ্ন করি,
-তবে কি ও ধর্মান্তরিত মুসলিম? সবকিছু কেমন যেনো ঘোলাটে মনে হয়। তুই ওদের সম্পর্কটা আমাকে খুলে বলনা প্লিজ।
বর্ণালী জানায়,
-খুব ছোটবেলায় রায়হান ওর নানুর সঙ্গে গ্রামের হাঁটে যাওয়ার বায়না করত। ছোট্ট শিশুর বায়না ফেলতে পারত না ওর নানু। হাত ধরে গুটি গুটি পায়ে নানু রায়হানকে নিয়ে যেতো বাড়ি থেকে প্রায় পৌনে এক কিমি দূরে গ্রামের হাটে। এইভাবে সপ্তাহে দুদিন নানুর সঙ্গে হাটে ঘুরতে যাওয়া রায়হানের একটা অভ্যাসে পরিণত হয়। কিন্তু একটা বাচ্চা এতোটা হাঁটার ফলে ক্লান্ত হয়ে পড়তো।ফলে হাটে পৌঁছে ক্লান্ত রায়হান ঘুমিয়ে যেতো।আর এই ঘুমন্ত নাতিকে নিয়ে নানু প্রতি হাটবারেই মহাদেব মুচির চটে শুইয়ে দিত। নানুর হাটবাজার করার মধ্যেই রায়হানের ঘুম সম্পন্ন হতো।ঘুম থেকে উঠে রায়হান লক্ষ্য করত কীভাবে মহাদেব মুচি জুতো সেলাই করে।ক্রমশ মহাদেব মুচি হয়ে হয়ে উঠে ওর অত্যন্ত প্রিয় মহাদেব নানা।চটে বসে বসে রায়হান সেই ছোট্ট বেলায় পরম যত্নে শিখে নেয় জুতো সেলাইয়ের নানান কলাকৌশল। চটে ঘুমিয়ে যাওয়ার ফলে, হাটুরেদের দেওয়া জুতো থেকে ধুলোবালি লেগে যেতো রায়হানের গায়ে। হাটবাজার শেষ করে নানু নিতে এলে মহাদেব নানা ও ওর নানু দুজনে মিলে ওর গা থেকে ধুলোবালি ঝেড়ে দিত।
যে ধুলোবালিছাই শৈশবে রায়হানের গায়ে মনে লেগে গেছে তা থেকে ছেলেটা পরে আর নিজেকে আলাদা করতে পারেনি।তাই বড় হলেও খুঁজে পায়নি এমন জুতো সেলাইয়ের মধ্যে সামান্যতম নোংরা।ওর নিজের নানু মারা গেছে সেই কবেই। কিন্তু তবুও নানুর ভালোবাসা আদর স্নেহ সে এতো দিন ধরে পেয়ে আসছে মহাদেব নানার সৌজন্যে ।ও জানিয়েছিল, মহাদেব নানার দুটি ছেলে থাকলেও কেউ বয়স্ক মানুষ দুজনকে খেতে পড়তে দেয়না। উচ্চ মাধ্যমিকে পড়াকালীন সময় থেকেই তাই ও টিউশনির পাশাপাশি দু একটা যা জুতো পেয়েছিল মেরামত করে গ্রামে মহাদেব নানাকে দিয়ে আসতো।পরে কলেজে ভর্তি হয়ে নুতন জায়গায় টিউশনি না পেয়ে আমাদের মধ্যে কয়েকজনের জুতো মেরামত করে যা সামান্য পয়সা পেতো তা দিয়ে আসতো বয়স্ক মানুষটিকে। কিন্তু কিছু দিন আগে বাড়ি গিয়ে জানতে পারে ওর সেই মহাদেব নানা মারা গেছে। নানার মৃত্যুতে ছেলেটা অত্যন্ত ভেঙে পড়ে।কদিন গ্রামে থেকে একটু সামলে নিয়ে তাই হোস্টেলে ফিরে আসে। নানার শেষকৃত্য সহ ঘাটের কাজ সম্পন্ন করা পর্যন্ত আরও কিছু টাকার দরকার। সামান্য কিছু টাকা নাকি ও এখানে রেখে গেছিল। সেদিন মূলত ওটাই নিতে আসে।আর এসব কারণেই আগামী বেশকিছু দিন কলেজে আসতে পারবে না বলে আমাকে জানিয়েছে।
এতক্ষণ ধরে একটা ঘোরের মধ্যে ছিলাম। বর্ণালীর কথা শেষ হতেই যেন সম্বিত ফিরে পেলাম।সমবয়সী ছেলেটাকে নিয়ে এতো দিন কত হাসাহাসি ঠাট্টা তামাশা করেছি। কিন্তু এখন শ্রদ্ধায় মাথা অবনত হয়ে গেল। সঙ্গে নীরবে গড়িয়ে পড়লো অশ্রু।
আজ শিয়ালমারির বিট অফিসে দাঁড়িয়ে বর্ণালীর কথা জিজ্ঞেস করতেই শিশুসুলভ হাসি প্রতিধ্বনিত হলো রায়হানের চোখে মুখে।
- সে অনেক কথা।
জুতো সেলাই এখনো করে কিনা জানতে চাইলে,
-মহাদেব নানা মারা যাবার পর বর্ণালীকে কথা দিতে হয় আর কখনো জুতো মেরামত করবো না বলে।পরে বিয়ের পিঁড়িতে বসে আরো একবার স্মরণ করিয়ে দেয় সে কথা। কাজেই তখন থেকেই আমি স্ত্রী সত্য পালন করে চলেছি।
সর্বশেষ এডিট : ০৮ ই জানুয়ারি, ২০২৩ দুপুর ২:১৩