আর পাঁচ জনের মতো শৈশবে আমিও পাড়ার বন্ধুদের সাথে মজাদার সব খেলাধুলা করতাম। কিন্তু তারই মধ্যে একটি ঘটনা আজও আমাকে একদিকে সামাজিক অবক্ষয়তার নগ্ন দৃষ্টান্ত স্বরূপ মস্তক অবনত করে দেয়, অপরদিকে কিছু না করতে পারার যন্ত্রণা হতাশায় বিহ্বল করে এক অনিশ্চিয়তার অন্ধকার গহ্বরে ডুবিয় দেয়।
আমাদের বাড়ি থেকে সামান্য দূরে ছিল বিশালাকার একটি তেঁতুল গাছ। বিশালাকার হওয়ায় এর নিচটা ছিল সুবিস্তৃত ছায়াময়। পথচারীদের সঙ্গে আশেপাশের এলাকাবাসীরাও খরতপ্ত রৌদ্রে একদন্ড জিরিয়ে নিতে বাড়ির কাজ ফেলে চলে আসতেন তেঁতুল তলায়।কারো কারো হাতে আবার তালপাতার হাত পাখা দেখতে পেতাম। আর এর উপরে ছিল হাজার রকমের পাখির আস্তানা। তাদের কলকাকলিতে মুখরিত হয়ে থাকতো আমাদের এই তেঁতুল তলা। এমন একটি জায়গা পক্ষীকুলের সঙ্গে আমাদের মতো কচিকাঁচাদের কাছেও ছিল আদর্শ খেলার জায়গা। তখন দ্বিতীয় শ্রেণীতে পড়ি, কাজেই পড়াশোনায় বড়দের নজরদারি শুরু হয়নি।ফলে সকাল সন্ধ্যে একটু নমো নমঃ করে দু একটা পাতা উল্টিয়ে ছু মেরে ছুটে আসতাম এই তেঁতুল তলায়। মাঝে দুপুরে গোসল করা ও খাওয়া দাওয়ার পর্বটা বাদ দিলে সারাটা দিন কেটে যেতো এই গাছটার নিচে। নানারকমের খেলা ছিল আমাদের বিনোদনের মাধ্যম। একঘেয়েমি কাটাতে মাঝে মাঝে খেলার ধরন পরিবর্তন করা হতো।আর এসবে আমাদের টিমলিডার ছিল ময়না বুবু।বয়সে আমাদের চেয়ে পাঁচ/ ছয় বছরের বড় হবার কারণে আমাদের সবার উপরে দাপট ছিল বেশ।ময়না বুবুই ঠিক করতো কোনটার পরে আবার কোন খেলা শুরু হবে।খেলা মানেই অভাব অভিযোগ ধরাবাঁধা। সমস্যায় পড়লে আমরা সবাই নিজেদের অভিযোগ ময়না বুবুকে জানাতাম। সাময়িক খেলা বন্ধ রেখে ময়না বুবু সবাইকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে ঝগড়া বিবাদ মিটিয়ে দিত ।
একদিন সন্ধ্যায় মায়ের কাছে পড়তে বসেছি। এমন সময় হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে ময়না বুবুর মা সাকিলা ফুপু আমাদের বাড়িতে চলে আসে। জিজ্ঞেস করে আমি ওকে দেখেছি কিনা। উত্তরে বিকালে একসঙ্গে খেলার কথা জানাই। কিন্তু সন্ধ্যা এতোটা গড়িয়ে গেলেও মেয়ে না ফেরায় ফুপু খুব চিন্তায় পড়ে। আগের দুদুটি সন্তান হারানোর কষ্ট ফুপুর কথায় বারে বারে ফুটে ওঠে।মা ফুপুকে সান্ত্বনা দেয়, আগেভাগে এতো সব কু-ভাবনা না ভাবতে। বরং আরেকটু ধৈর্য্য ধরে অপেক্ষা করতে বলে। হয়তোবা কারোর সঙ্গে কোথাও গেছে, ঠিক চলে আসবে। বুঝতে পারি মায়ের আশ্বাসে ফুপুর দুশ্চিন্তা এতোটুকু কমেনি। উল্টে কিছুক্ষণ চুপ থেকে অনেকটা দৃঢ়তার সঙ্গে বলে ওঠে,
- না ভাবি না।আমার মন বলছে আমার ময়নার বড় কোনো বিপদ ঘটেছে।
আমরা চুপ করে থাকি।মা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। খানিক বাদে ফুপু চলেও যায়। আমরা অসহায় ভাবে সেদিন ওনার চলে যাওয়ার সাক্ষী হই।পরে চারদিকে খোঁজাখুঁজি শুরু হয়। কিন্তু কোথায় ময়না বুবু খুঁজে পাওয়া যায়নি।
দিন তিনেক পরে সকালে পড়তে বসেছি। এমন সময় বাড়ির সামনে দিয়ে একদল লোককে ছুটে যেতে দেখে বই খাতা ফেলে আমিও ওদের পিছু নিই।বাড়ি থেকে পাঁচ ছয়শো মিটার দূরে অনেকটা নির্জন এলাকায় আমাদের প্রাথমিক বিদ্যালয় অবস্থিত।এর চারপাশে কিছু ডোবা আছে। বর্ষায় গাঁয়ের লোকেরা এখানে পাট পচাতে দেয়।তো এই পঁচা পাটের জার থেকে পাট ধুতে গিয়ে ভিতর থেকে ফুলে ঢোল হওয়া একটা লাশ বেরিয়ে আসে। খবরটি চাওড় হতেই চারদিকে থেকে লোকজন ছুটে আসে। মূহুর্তে স্থানটি লোকেলোকারণ্যে পরিণত হয়। প্রথমে আমি ঢুকতে পারছিলাম না। এদিক ওদিক ফালুক ফুলুক করে একজনের পায়ের ফাঁকে মাথা গলিয়ে ঢুকে পড়ি। দৃশ্যটি দেখেই আমি চমকে উঠি।আরে! এতো আমাদের ময়না বুবু। চোখের সামনে এই দৃশ্য দেখে প্রচন্ড কান্না পেয়ে যায়।ছুটে আসি বাড়িতে মাকে খবর দিতে। কিছুক্ষণ পর পুলিশ চলে আসে। ময়না বুবু লাশ হয়ে পুলিসের গাড়িতে চলে যায়।
দৃশ্যটি দেখে ভয়ানক অস্বস্তি ও অসুস্থ বোধ করি।এক অসহনীয় যন্ত্রণা আমাকে যেন জ্ঞানশূন্য করে দেয়। কোথায় গেলে শান্তি পাবো কিছুই বুঝে উঠতে পারিনি। উদ্ভ্রান্তের মতো ছোটাছুটি করতে থাকি। কিছু লোককে সাকিলা ফুপুর বাড়ির দিকে যেতে দেখে সঙ্গী হই। গিয়ে দেখি সেখানেও প্রচুর লোকজন। ফুপু মাটিতে আছাড় পিছাড় খাচ্ছে। উপস্থিত মহিলারা ওনাকে আগলে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করছেন। সে এক মর্মান্তিক দৃশ্য। নিজেকে সামলানো অসম্ভব। কান্নায় আমার গলা ধরে আসে। সামলাতে না পেরে অগত্যা বাইরে বেরিয়ে আসি। মনে মনে উত্তর খুঁজতে থাকি কে বা কারা মারলো বুবুকে।আর কেনই বা মারলো? পরিচিত কারোর কাছে সন্তোষজনক উত্তর পাইনি। বাড়িতে এসে মাকে জিজ্ঞেস করলে মা একটা ধমক দিয়ে,
- ছোট মানুষের সব বিষয়ে মাথা ঘামানোর দরকার নেই,বলে থামিয়ে দেয়।
কি আর করার। তবে বয়সের সীমাবদ্ধতার কারণে আপাত দমে গেলেও পরবর্তী বহুদিন এর উত্তর খুঁজে গেছি।
সন্তানশোক ফুপুকে বারেবারে পেতে হয়েছে। ফুপুদের আসল বাড়ি বাংলাদেশের কালিগঞ্জে। একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সময় নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে ওপারের বহু পরিবার আমাদের আশেপাশের গ্রামগুলোতে চলে আসে।আর এই পরিবার গুলোর বেশিরভাগ পুরুষ সদস্য ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা। মায়ের মুখে শুনেছি ফুপুর স্বামী অর্থাৎ জামাই, স্ত্রী পুত্র কন্যাকে আমাদের গ্রামে রেখে যুদ্ধ করতে গেছিলেন। তখন ময়না বুবু ছিল দুধের শিশু।অন্যান্য পরিবারগুলো যুদ্ধের পর পর দেশে ফিরে গেলেও ফুপু স্বামীর পথপানে চেয়ে এখানেই থেকে যায়। আশায় ছিলেন একদিন ওনার স্বামী ওনাদের ঠিকই নিতে আসবেন। কিন্তু হায়! দীর্ঘদিন গেলেও উনি না ফেরায় গ্রামের সবাই ধরে নিয়েছিলেন উনি হয়তো আর বেঁচে নেই; মুক্তিযুদ্ধে প্রাণ হারিয়েছেন। মায়ের কাছে শুনেছি পড়শিরা নিজেদের মধ্যে বলাবলি করলেও পাছে ফুপু কষ্ট পান তাই এপ্রসঙ্গ কেউ ফুপুর সামনে তোলেননি।
যদিও এই গ্রামের সবাই যে ফুপুদের প্রতি সদয় ছিলেন তা নয়।তিন ছেলের মধ্যে বড় ছিল হারান ভাই। খুব কম কথা বলতো। স্বভাব চরিত্রেও ভীষণ ভালো। মায়ের বাধ্য সন্তান যাকে বলে। ফুপুর মুখে শুনেছি,হারান ভাই নাকি বলতো ওদের আব্বা যদি না আসে তাহলে এখানেই জমি জমা কিনে স্থায়ী ভাবে বসবাস করবে। স্থানীয় একজন মহাজনের কাছে বিড়ি বাঁধার কাজ করতো হারান ভাই। সারাদিন কাজ আর কারখানাতেই কাটিয়ে দিত। ফুপুর মেজো ছেলে ছিল পোলিও রোগে আক্রান্ত। আমার সেই ছোট্ট শৈশবে মনে হতো এই ছেলেকে ফুপু বেশি স্নেহ করতেন।মাকে প্রায় বলতেন,
- ভাবি আমি মরেও শান্তি পাবো না। আমার নকিবের উপায় কি হবে ভেবে আমি রাতে ঘুমাতে পারি না।
একদিন রাতে পাড়ায় একটি চেঁচামেচি কানে আসে। মায়ের সঙ্গে গিয়ে দেখি নকিব ভাই খুব অসুস্থ।ফুপু প্রচন্ড কান্না করতে থাকেন। পাড়ার লোকেরা একজন ডাক্তার ডেকে আনেন। কিন্তু তিনি এসে বলেন,শরীরে প্রাণ নেই।নকিব ভাইয়ের মৃত্যুতে ফুপু খুব ভেঙে পড়ে। প্রতিবেশীদের বাড়িতে মুড়ি ভাজার কাজ করতেন ফুপু। কিন্তু পরবর্তী বহুদিন ফুপুকে আর কাজে যেতে দেখিনি।।
ফুপুর ছোট ছেলে ছিল কুতুব ভাই।হারান ভাই যতোটা শান্ত, ভালো ছেলে ছিল ঠিক ততোটাই উৎশৃংখল রগচটা স্বভাবের ছিল কুতুব ভাই।চুরিদারিও করতো বলে শুনেছি। একসময় গ্রামে পরপর কয়েকটি গরু হারিয়ে যায়।গ্রাম্য শালিসী সভা বসে। কুতুব ভাইকে সন্দেহ করে অপরাধ স্বীকার করার জন্য চাপ দেয়। কিন্তু কুতুব ভাই স্বীকার না করায় সকলে মিলে সাব্যস্ত করে যতোক্ষণ স্বীকার না করবে ততক্ষণ ওকে বাঁশকল দিয়ে পিঁপড়ের চাকে বেঁধে রাখবে। সেদিন ফুপু আপ্রাণ চেষ্টা করেও মোড়লদের মন গলাতে পারেননি। পরেরদিন দুপুর রোদে পূর্ব ঘোষণা মতো কুতুব ভাইকে শাস্তি দেওয়া হয়।আর তার ঠিক পরের দিন একজন গ্রামবাসী প্রাতঃকাজ করতে গিয়ে দেখতে পায় একটি আমগাছে কুতুব ভাই ঝুলছে।প্রথমে সকলে এটাকে আত্মহত্যা বলে মনে করলেও পরে ফাঁস হয় গ্রামের এক মোড়লের মেয়ের সঙ্গে কুতুব ভাইয়ের ভালোবাসার সম্পর্ক ছিল।যে সম্পর্ক নিয়ে মোড়লের বাড়িতে প্রবল অশান্তি ছিল। লোকলজ্জার ভয়ে মেয়েকে বিয়ের ব্যবস্থা করতেই তখন সে বাবার কীর্তি ফাঁস করে বিয়ে করবে না বলে জেদ ধরে। কিন্তু ততোদিনে তো একটা প্রাণ চলে গেল। নিজের সন্তান হলেও কুতুব ভাইকে ফুপুকে অভিসম্পাত করতে দেখেছি।প্রায়ই নানা লোক ওর নামে অভিযোগ করত।আর ফুপু ওকে বকাবকি করতেন। তাই কুবুব ভাইকে হারিয়ে ফুপুকে খুব একটা কষ্ট পেতে দেখিনি। কিংবা পেলেও বাইরে প্রকাশ করেননি।
কিন্তু এবার ময়না বুবুর এমন চলে যাওয়া ফুপু কিছুতেই মানতে পারেননি। আশেপাশের লোকজন দুবেলা পরিবারটিকে খাবার দিলেও ফুপু কিছুই খেতেন না। আমার মন পড়ে থাকতো ফুপুদের বাড়িতে। এসময় তেঁতুল গাছ আর আমাকে টানতো না। নজর রাখতাম ফুপু কিছু খেয়েছেন কিনা। কিন্তু নাহ।বেশ কিছুদিন হলো ফুপু কোনো খাবার মুখে তোলেননি।পুলিশী ঝামেলার পর গ্রামের একটি কবরস্থানে ময়না বুবুকে সমাধিস্থ করা হয়। এসময় দিন যেন কিছুতেই কাটতে চাইতো না। ফুপু একদম বদলে গেছেন। আমি বড়দের মতো পাশে দাঁড়িয়ে দেখতাম মানুষটা পাগলের মত আচরণ করছেন। ফুপুর এমন অস্বাভাবিকতা আমার হৃদয়কে শোকে মুহ্যমান করে তোলে। আমি মুখ ফুটে বলতে পারিনি সেকথা কাউকে। মনে মনে ভাবতাম ময়না বুবু অপর কেউ নয়, আমারই যেন আরেক বড় বুবু। হঠাৎ একদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে শুনি ফুপুদের বাড়িটা হাট করে খোলা। বড়দের মুখ থেকে শুনেছি তাহলে হারান ভাইকে নিয়ে ফুপু ইছামতীতে নেমেছেন।ময়না বুবুকে হারিয়ে ফুপু বিলাপ করতে করতে প্রায়ই বলতেন,
- আর নিজেকে বাঁচিয়ে রেখে লাভ নেই। এবার নিজেকে কুমিরের খাবার করবো।
তাই আজও যখন খবরে দেখি ইছামতীতে কুমির দেখা গেছে। আমার শঙ্কা বহুগুণ বেড়ে যায়।
কেন জানি আজ কথাটি বারবার মনে পড়ছে, বহুদিন আগে এক কবি লিখেছিলেন,
"আকাশে বসত মরা ঈশ্বর
নালিশ জানাবে বলো ওরা কাকে?
সর্বশেষ এডিট : ০৬ ই জুন, ২০২৩ রাত ১০:৫৫