উত্তুঙ্গ কাঞ্চনজঙ্ঘার শুভ্রশিখরে সূর্যদেবের রক্তিমাভ আভার বর্ণচ্ছটা প্রত্যক্ষ করার অনির্বচনীয় অনুভূতির কথা কাব্যে পড়েছি। কথাসাহিত্যে কাঞ্চনজঙ্ঘার রূপ মাধুরীকে বাস্তবে মনরাজ্যে পরিচয় করাতে কয়েক বছর আগে সপরিবারে পাড়ি জমাই দার্জিলিংয়ে। কিন্তু প্রকৃতিদেবীর খামখেয়ালি আচরণে বা বর্ষণমুখর আবহাওয়ার কারণে সেদিন আমরা লাস্যময়ী কাঞ্চনজঙ্ঘার অপরূপ সুধা আস্বাদন থেকে বঞ্চিত হই। ঝিরঝিরে বৃষ্টিতে একরাশ বিরক্তি নিয়ে হোটেলের রুমে আবদ্ধ থেকে অবশেষে পড়ন্ত বিকালে আবহাওয়ার একটু উন্নতি হতেই হাজির হই দার্জিলিং ম্যালে। সঙ্গীসাথীরা ক্যামেরা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লেও আমার দৃষ্টি ছিল দূরে সবুজে বিস্তৃত দিগন্তরেখার ওপারে। উদাসী মনে যখন মেঘের রাজ্যে ভেসে চলেছি ঠিক তখনই এক সৌম্যকান্তি যুবককে সামনে এগিয়ে এসে আচমকা নিচু হয়ে প্রণাম করতেই সম্বিৎ ফিরে পাই,
- আরে! আরে! তুমি তুমি.... ....
- স্যার আমি সৈকত।
সৈকতের নাম শুনতেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে বছর পনেরো আগেকার ঘটনা....
খুব ভালো ছেলে ছিল সৈকত। তবে অষ্টম শ্রেণীতে উঠে সম্পূর্ণ বদলে যায়। আমি ছিলাম ক্লাস টিচার। শুরু থেকেই দেখি ও প্রচন্ড অমনোযোগী।প্রায়ই দিন দেরি করে ক্লাসে আসতো। সঙ্গে চুলের কাটিং ছিল অত্যন্ত আপত্তিকর।
প্রথমদিকে বারকয়েক ভালো করে বুঝিয়েছিলাম। কিন্তু কোনো লাভ হয়নি। অবাক হতাম। একেতো দেরি করে স্কুলে আসে,তারপর ক্লাসে বসামাত্রই ঘুমিয়ে পড়তো। বুঝতে পারি রাতে ঘুমটাও নিশ্চিত হচ্ছে না ছেলেটার। একদিন টিফিন পিরিয়ডে সৈকতকে ডেকে নিয়ে বাবা বাছা বলে ওর সমস্যাটা জানতে চেষ্টা করি। গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে ওকে বন্ধুসুলভ ভাবে চেষ্টা করেছিলাম যাতে খোলা মনে সমস্যাটা আমাকে জানায়।কিন্তু না কিছুতেই আমি ওর মনের কথা জানতে পারিনি।
জীবনের সব ব্যর্থতা পরাজয় নয়। এমনো কিছু ব্যর্থতা আছে যা মানুষকে জয়ের গন্ধ শোঁকায়; গড়ে তোলে সাফল্য লাভের শক্তি সঞ্চয়ের অদম্য মনোবল।মনে মনে সেদিনই যেন এমন শক্তি সঞ্চয় করেছিলাম যে করেই হোক বাচ্চা ছেলেটার রহস্যের জট আমাকে উদ্ধার করতেই হবে।
ফাস্ট টার্ম পরীক্ষার আগে জানিয়েছিলাম অভিভাবক না আনলে পরীক্ষায় বসতে দেওয়া হবে না। সম্ভবত সেই কারণে একদিন সকালেই দেখি বাবার হাত ধরে দাঁড়িয়ে আছে ছেলেটা। কয়েকবছর আগেও ভদ্রলোককে একবার দেখেছিলাম। আজ ওনার স্বাস্থ্য এতোটাই ভেঙে গেছে যে শুরুতে চিনতেই পারছিলাম না।মানতে কষ্ট হচ্ছিল সেবার ছেলের সাফল্যে দেখা করতে আসা সুঠামদেহী দীর্ঘাঙ্গি মানুষটি মাত্র দু বছরের ব্যবধানে হতশ্রী চেহারা নিয়ে আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছেন।মুখ ভর্তি দেড় দু-সপ্তাহের কাঁচা পাকা খোঁচা খোঁচা দাঁড়ি, উসকো-খুসকো চুলের শীর্ণকায় মানুষটি ঘাড় বেঁকিয়ে অনেকটা গুলতির মতো হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। প্রশ্ন জাগে ,
- আপনি কি অসুস্থ?
- আজ্ঞে আগে ছিলাম। কিন্তু এখন অনেকটাই সুস্থ হয়ে উঠেছি।
অবাক হই! দাঁড়াতে পারছেন না,ছেলেকে আগলে কোনক্রমে দাঁড়িয়ে আছেন, সেই মানুষ বলে কিনা অনেকটাই সুস্থ।
যাইহোক ভদ্রলোককে পাশের একটি ঘরে নিয়ে বসাই। মুখোমুখি বসে বলতে লাগলেন,
- সৈকত গত সপ্তাহে বলেছিল বাবা, তোমাকে আমার ক্লাস টিচার ডেকেছেন একবার বিদ্যালয়ে যেতে হবে। কিন্তু পরে আবার ও বেঁকে বসে।বললে,স্যারকে বলে ম্যানেজ করে নেব।
গলাটা খাঁকারি দিয়ে ,
-একে তো জঘন্য করে চুল কাটা। আপনারা মাস্টারমহাশয়রা শুধু নন, আমি বাবা হয়েও প্রথমে মানতে পারছিলাম না।তার উপর প্রতিদিন ক্লাসে বসে ঘুমিয়ে পড়া, পড়া বলতে না পারা- আপনারা সবকিছুই একপ্রকার মেনে নিয়ে ওকে ক্লাসে অনুমতি দিয়ে যাচ্ছেন। চেষ্টা করছেন যাতে ওকে আবার পড়াশোনার মধ্যে ফেরানো যায়।বাড়ি ফিরে এই নিয়ে আমাদের বাবা ছেলের মধ্যে কতো কথা হতো। শাস্তির প্রসঙ্গ উঠলে বলতো যে খুবই সামান্য একটু আধটু ভোগ করলেও সেটা বলার মধ্যে ছিল না।
বুঝতে পারি বেশি বেশি করে শিক্ষকদের স্নেহশীলতা বাবার কাছে তুলে ধরেছে। তবে তার মধ্যেও অবাক হলাম বাবার অসুস্থতার কথা একবারের জন্যেও মুখে আনলো না কেন ভেবে। অথচ দিনের পর দিন নির্বিকার ভাবে শাস্তি মাথায় পেতে নিয়েছে। কোনো ভাবেই কিছু করতে না পেরে কথার চাবুকেও বিদ্ধ করার চেষ্টা করে গেছি। আসলে তখন উদ্দেশ্য ছিল যেন তেন প্রকারে অভিভাবক হাজির করানো।এমতাবস্থায় বাবার মুখে আমাদের ভালো আচরণের কথা শুনে খুশি হলেও অন্তরে এবার রীতিমতো আশঙ্কা তৈরি হয় আমাদের অসদাচরণের কথা বাবাকে বলেনি তো? অথবা বললেও ভদ্রলোক ইচ্ছে করেই সেগুলো গোপন করছেন না তো?
কিছুক্ষণ বিরতি নিয়ে এবার প্রসঙ্গ পরিবর্তন করতে জিজ্ঞেস করি,
- আপনার অসুস্থতাটা ঠিক কী?
বড় একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে,
- ট্রলারে দুর্ঘটনা থেকে।
- ট্রলার দুর্ঘটনা! কীভাবে ঘটলো?
ভদ্রলোক বলতে লাগলেন,
-পেশায় আমি একজন মৎস্যজীবি। পুরীতে থাকতাম। ওখানে কাজ ছিল ট্রলারে করে সমুদ্রে মাছ ধরা।মাস ছয়েক আগের ঘটনা। আমরা একটু আগেভাগেই মোহনায় চলে আসি। সেদিন আমরা অনেকটা ভোরবেলায় সব কাজ শেষ করে মোহনার একটু ভিতরে ট্রলারটি নোঙর করতে এগিয়ে যাই।সারেংয়ের নির্দেশ মতো হাতে গ্রাফিন নিয়ে ট্রলারের সাইডে দাঁড়িয়ে ছিলাম। লক্ষ্য ছিল পছন্দমতো একটা জায়গায় ট্রলারটিকে নোঙর করা। আশপাশে তখন অন্যান্য মাছভর্তি ট্রলার গুলো মোহনার দিকে ছুটে আসছিল। সেদিন উল্টো দিক থেকে আসা এরকমই একজনের সঙ্গে কথা বলতে বলতে বেখেয়ালি হয়ে যাই। পাশের আরেকটি ট্রলার সজোরে ধাক্কা মারে আমাদের খালি ট্রলারটিকে। আমার হাতে গ্রাফিন ছিল ফলে টাল সামলাতে না পেরে তার উল্টোদিকে জলে গিয়ে পড়ি। সঙ্গে সঙ্গে একটা বড় ঢেউ আমাকে সম্পূর্ণ ডুবিয়ে দেয়।এর পরের ঘটনা আর আমার মনে নেই।
যখন জ্ঞান আসে, বুঝতে পারি আমি হসপিটালে আছি। গোটা শরীরটাই যেন ব্যান্ডেজ করা, সঙ্গে অসম্ভব ব্যথা। হাত পা মাথা কোনো কিছুই নাড়াতে পারছিলাম না। চারদিকে নানা রকমের পাইপ জোড়া। কোনোটাতে অক্সিজেন কোনটাতে বা স্যালাইন, আরও কতো রকমের পাইপ সব মিলিয়ে এক ভয়ঙ্কর অবস্থা। এমনকি বেশ কয়েকদিন কথা বলার শক্তি পর্যন্ত ছিল না।ক্রমশ বুঝতে পারি শরীরের একাধিক জায়গা ভেঙে গেছে। ডান হাতের কব্জি সহ ডানপায়ের হাঁটুর নিচে অংশটাও ভেঙে গেছে। সঙ্গে মেরুদণ্ডের হাড়েও চিড় ধরেছে। এসবের সঙ্গে সারা গায়ে ছিল অজস্র ক্ষতবিক্ষত।খবর পেয়ে সৌদামিনী চলে আসে।মহাজন খারাপ মানুষ ছিলেন না। আমার যাবতীয় চিকিৎসার পাশাপাশি ওর মায়ের থাকা খাওয়ার ব্যবস্থাও করে দেন। কিন্তু কয়েকসপ্তাহ যেতেই উনি বেঁকে বসেন। জানিয়ে দেন যে ওনাকে যেহেতু দীর্ঘমেয়াদি চিকিৎসার খরচ বহন করতে হচ্ছে তাই ওর মায়ের দায়িত্ব নিতে পারবেন না। খবরটা শুনে আবার দুশ্চিন্তায় পড়ি। অথচ সে সময়ে সৌদামিনী ছাড়া আমার এক মুহূর্ত চলছিল না। হসপিটালে চিকিৎসার সুযোগটুকু পেলেও আমার খাওয়া পড়া মাখা স্নান করানো বাথরুমে নিয়ে যাওয়া সবই কাজ ওই সামলাচ্ছিল। এমতাবস্থায় কোনো উপায় না থাকায় আমাকে ফেলে রেখে সৌদামিনী বাড়ি ফিরে আসে।সপ্তাহখানেক পরে দেখি আবারো ও হসপিটালে চলে এসেছে। মুখে চওড়া হাসি। সৈকত নাকি কাজ করে মাকে টাকা পাঠানোর ব্যবস্থা করেছে। না এখবরে আমি খুশি হতে পারিনি। সৈকতকে নিয়ে কত স্বপ্ন ছিল। আমার উদ্বিগ্নতা দেখে সৌদামিনী জানায়, মা'কে সৈকত কথা দিয়েছে,শত অসুবিধার মধ্যেও লেখাপড়া ঠিক চালিয়ে যাবে।
- কি কাজ করতো সৈকত? প্রশ্ন করতেই,
ভদ্রলোক কম্পিত গলায় বলতে লাগলেন,
-কলকাতা শহরে প্রচুর ছোটখাটো হোটেল রেস্টুরেন্ট আছে যেখানে সন্ধ্যার পর বড়লোকের ছেলেরা তাদের মেয়ে বন্ধুদের নিয়ে ফুর্তি করতে আসে। এরা নানা রকম খাবার-দাবারের সঙ্গে প্রচুর পরিমাণে মদ খায়। পরিমাণে বেশি হলে অনেকেই বমি করে নোংরা করে ফেলে। এই বমি পরিষ্কার করতে হোটেলের ওয়েটাররা রাজি হতে চায় না।আর এখানেই কাজের সুযোগ পায় সৈকত। অন্য হোটেলে বা রেস্টুরেন্টে হলে ওয়েটাররা আবার এই টিপসে ভাগ বসাতো। কিন্তু সৈকত আমার ভাগ্নার সঙ্গে থাকায় টিপসের সবটাই নিজে রাখতে পারতো। প্রায়ই দিন রাতে ঘুমানোর সুযোগ পেত না। কোনক্রমে রাতটুকু ওখানে পার করে ভোরবেলায় বাড়ি ফিরে আবার দুই ভাইবোনের জন্যে রান্না করতে হতো। এরপরে বোনকে স্কুলে পাঠিয়ে তবেই নিজে স্কুলে যেতে পারতো।যেদিন ঠিকমতো গুছিয়ে উঠতে পারতো না সেদিন আর ওর স্কুলে যাওয়া হতো না। তবে বোনের ব্যাপারে ছিল প্রচন্ড সিরিয়াস। বোনের পড়াশোনার প্রতি তীক্ষ্ণ দৃষ্টি ছিল দাদার।দুই ভাইবোনের বয়সের ব্যবধান মাত্র দুই বছর।অথচ দায়িত্বশীলতা বা কর্তব্য পালনে ও যেন বাবা হিসাবে আমাকেও হার মানিয়েছিল।
কথা বলতে বলতে সৈকতের বাবার গলাটা ধরে এলো।
কিছু সময়ের মধ্যে উনি নিজেকে সামলে নিয়ে আবার বলতে লাগলেন,
-বমি পরিষ্কার করতে হয় সেটা না হয় কোনো কাজ ছোট নয় এই যুক্তিতে মেনে নিলাম। তাই বলে কাস্টমারদের কাছে বিশেষ ম্যাথর হিসেবে চেনানোর জন্য কানের উপর থেকে মাথার দুদিকে চুল সম্পূর্ণ কামিয়ে দিয়ে ব্রহ্মতালুর উপর অংশে সজারুর কাটার মতো বিশেষ করে চুল কাটতে বাধ্য করা - এটাকে বাবা হিসাবে কীভাবে মেনে নিই বলুন দেখি। প্রথমবার ওরাই কেটে দিয়ে জানিয়ে দেয় ভবিষ্যতে এভাবে চুল না কাটলে চাকরি থাকবে না।
এতক্ষন ধরে আমি যেন এক ঘোরের মধ্যে ছিলাম। এক অভাবী অসহায় বাবার অসীম ধৈর্যশীল বিচক্ষণ সন্তানের মর্মন্তুদ কাহিনী শুনে চোখ দিয়ে নীরবে গড়িয়ে পড়লো অশ্রু। মনে মনে বললাম দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে লড়াই কখনো চোখে দেখিনি মাঝে মাঝে গল্প বা উপকথায় পড়েছি। কিন্তু আজ জীবন যুদ্ধে হার না মানা এক কিশোর নাবিকের বিচক্ষণতার, তার অসীম ধৈর্যশীলতা, পারিবারিক মূল্যবোধের যে কাহিনী শুনলাম তা রুপালি পর্দার কাহিনীকেও হার মানাবে।
পরের দিকে আলাদা করে আর খোঁজ রাখা সম্ভব হয়নি। তারপর দীর্ঘদিন পর আজ এই দার্জিলিংয়ে অপ্রত্যাশিত সাক্ষাৎ লাভ।
পকেট থেকে একটা কার্ড বের করে বললো,
- স্যার আগামীকাল আপনাকে এখানে স্বাগত।
লেখা আছে 'দামিনী ক্যাফেটেরিয়া'।
- তোমার মায়ের নাম সৌদামিনী না? প্রশ্ন করতেই,
- হ্যাঁ স্যার সৌদামিনী ছিল ঠিকই। কিন্তু বাবা মাকে দামিনী নামেই ডাকতো।
সমাপ্ত
সর্বশেষ এডিট : ১৭ ই সেপ্টেম্বর, ২০২৩ সকাল ১১:১৯