সরকারী মেডিকেলে ভর্তি হওয়ার পর মোহভঙ্গ হতে বেশি সময় লাগেনি। যত দিন যাচ্ছে হতাশার সাথে সাথে ক্ষোভের পরিমানও উত্তরোত্তর বাড়ছে বই কমছে না।
মেডিকেলের থার্ডইয়ারে বেসিক সাবজেক্ট পড়তে পড়তে-ই অবস্থা কাহিল হয়ে যায়, তার মাঝে থাকে ওয়ার্ড নামক যন্ত্রণা। সাথে ক্লিনিক্যাল সাবজেক্টের লেকচার হয় বোনাস, যার জন্যে সাত সকালের (আক্ষরিক অর্থেই) ঘুম কুরবানি করতে হয় নিয়মিত। তবু মন্দের ভালো যে ক্লিনিক্যালের স্যাররা আমাদের দুঃখ কিছুটা হলেও বোঝার চেষ্টা করেন বলে কিছুটা বেঁচে যাই, সারাবছর লেকচারগুলো পড়তে হয় না।
কিন্তু এবার আমাদের উপর মেডিসিনওয়ালারা গেছে ক্ষেপে। আমাদের দোষ আমরা কেন স্যারের লুইচ্চামির প্রতিবাদ করতে গেলাম? স্যাররা লুইচ্চামি করবে, বউ ঘরে রেখে মেয়ের বয়সী ছাত্রীর সাথে ফস্টিনস্টি করবে, মোবাইলে ইঙ্গিতপূর্ণ ম্যাসেজ দেবে, সবই আমাদের সহাস্যবদনে সহ্য করতে হবে। তারপরও তাদের তেল মারতে হবে, পা চাটতে হবে। কিছু বলতে গেলেই খড়্গ নেমে আসবে ঘাড়ের উপর, হুংকার শুনতে হবে ‘ কেমনে পাশ কর দেখে নেব….।’ সেই হুংকারই শুনতে হলো জুনিয়র টিচারের লুইচ্চামির বিচার বিভাগীয় প্রধানের কাছে চাওয়ায়। শুধু হুংকার দিয়ে থেমে থাকলেও না হয় হত… কিন্তু তা তো না, যাদের উপর মূল ক্ষোভ তাদের অর্ধেকের বেশি তো ফেল করলই, বাদ যাচ্ছে না কোন ছাত্রই।
এবার তাঁদের শখ হয়েছে ইয়ার ফাইনাল নেয়ার। আসলে পরীক্ষা নেয়ার নামে আমাদের উপর তাঁদের কর্তৃত্বটা আরো জোরদার করে বুঝানোর, আমাদেরকে তাঁদের কাছে নতজানু হতে বাধ্য করার। আমাদের মেডিকেলের ১৭ বছরের ইতিহাসে ইয়ার ফাইনাল হওয়ার রেকর্ড আছে একবার, তাও শুধু রিটেন। তাই এবারও ফেজ কোঅর্ডিনেটরের ইচ্ছা ছিল না পরীক্ষার ঝামেলা করার, তারপর আবার প্রফের মাঝখানে। ফেজ কোঅর্ডিনেটরের কাছে পাত্তা না পেয়ে আমাদের সেই প্রিয় শিক্ষকরা তাই হাজির হলেন প্রিন্সিপালের দরবারে, আর তার মারফতই জারি হলো সমন। নোটিশ এল রিটেন পরীক্ষার, আমরাও আসামী হাজির হয়ে দিতে গেলাম পরীক্ষা। থার্ড ইয়ার, যাদের বলা হয় ক্লিনিক্যাল সাবজেক্টের নার্সারির শিশু, তাদের পরীক্ষার গার্ড দেয়ার জন্যে হাজির হলেন পুরো মেডিসিন ডিপার্টমেন্ট, মহামান্য প্রিন্সিপ্যাল ও তার শিষ্য (ভাইস প্রিন্সিপ্যাল)। টুঁ শব্দ করেছ তো মরেছ, ঘাড় ঘুরিয়েছ তো দিলাম তোমার জায়গা বদল করে এমনই সব রোলারের তলে পিষ্ট হতে হতে পরীক্ষা দেয়ার মাঝেই এল আর এক বজ্রাঘাত, ‘ভাইভা হবে’। ও, এর শানে নুযুল তো একটু বলা উচিত ছিল, আমাদের সেই মহামান্য শিক্ষক, যার লুইচ্চামির প্রতিবাদ করতে যেয়ে আজ এই দশা তিনি তাঁর কোন এক প্রিয় ছাত্রকে পেয়ে বলে দিয়েছেন, ‘তোমাদের ভাইভা নেয়ার ব্যবস্থা করব আমি, দেখে নেব তোমরা কিভাবে পাশ কর’। সেই পুরনো হুংকার…. কারন, আমরা তো জিম্মি স্যারদের করুণার কাছে, তাঁদের দয়ার উপর নির্ভর করছে আমাদের ভবিষ্যৎ, আমাদের ডাক্তার হওয়া না হওয়া…. তাই তো আমরা আভূমি প্রণতি জানাবো তাঁদের, কখনো টুঁ শব্দও করতে পারবনা…… এভাবেই চলবে আমাদের জীবন, কারন আমরা সব হতভাগা মেডিকেল স্টুডেন্ট, আমরা জিম্মি সবার কাছে, আমরা কলুর বলদ, আমাদের আগমন এই পৃথিবীতে শুধু পাচনের বাড়ি খেয়ে জীবনের ঘানি টেনে যাওয়ার জন্যে……………………..