somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

হরিপদ পাল এবং একজন অমলকান্তি

০৩ রা জুলাই, ২০১৪ রাত ৯:৩৫
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



...........সবাই মেঘ বালক হতে পারে না। তার আগেই সন্ধ্যের গাঢ় অন্ধকার গোধূলীকে জাপটে ধরে শূষে নেয় ।।

হরিপদ পাল ।
ক্লাস ফোর পড়ুয়া বেঁটে, কদাকার, বারোমাসি সর্দিতে নাক ভিজে থাকা সেই ছেলেটি । অংক স্যারের ক্লাসে হোমওয়ার্ক না করে আনার অপরাধে যে রোজ মার খেতো , মারের সময় একদৃষ্টিতে মাটিতে তাকিয়ে থাকতো । ক্লাস শেষে যখন জিজ্ঞেস করতাম-‘ কিরে খুব লাগছে না ?’ । সে একগাল হাসিতে ভেঙ্গে পড়ে বলতো-‘ দূর, স্যার আস্তে কইরা মারছে’ ।

হরিপদ আমার স্কুলে যাতায়াতের সাথি ।
গুলতি দিয়ে পাখি শিকার, কাগজ কেটে ঘুড়ি বানানো, ছিপ দিয়ে মাছ ধরার কৌশল শেখানোর শিক্ষক ।

ওর বাবা চিনিকলে কাজ করতো । যে মুভিং ট্রে-টাতে আখ ফেলা হত তার শেষমাথায় অনেকগুলো রোটেটিং ব্লেড লাগানো থাকতো । লম্বা লম্বা আখগুলো সে ব্লেডের মুখে পড়তেই নিমিষে টুকরো হয়ে যেতো । ওর বাবা একটা লম্বা কাস্তে হাতে সেগুলো দেখভাল করতেন ।
আমরা প্রায়ই চিনিকলের ভেতরে গিয়ে আখভর্তি ট্রাকের লরিতে শুয়ে আখ খেতাম । শুয়ে শুয়ে নীলচে শুভ্র আকাশে পাখির ওড়াওড়ি দেখতাম । আকাশের বিশাল সাদা ক্যানভাসে শিশুমনের কল্পনা দিয়ে আঁকিবুকি চালাতাম ।


একদিন স্কুল থেকে ফেরার পথে শুনি হরিপদের বাবার হাত কেটে গেছে । রোটেটিং মেশিনের রাক্ষুসে দাঁতগুলো আখ আর হাতে’র তফাত বোঝেনি । বেচারা হরিপদের নাকের জলের সাথে সেদিন চোখের জল মিশে গিয়েছিলো ।


আমরা প্রাইমারী ছেড়ে হাইস্কুলে উঠলাম, হরিপদের বাবা বিছানা ছেড়ে উঠতে পারলেন না কোনদিন । স্কুল থেকে হরিপদ পালের নাম কাটা গেলো, আসলে হরিপদ’ই কাটিয়ে নিল । জীবন তাকে স্কুলের ক্ষুদ্র গন্ডীর বাইরে প্রকৃতির মত বিশাল শিক্ষালয়ে শিক্ষা নেবার সুযোগ করে দিল ।

তারপর..... অনেকদিন কেটে গেলো । মাঝে একবার বাড়িতে গিয়ে শুনি সে এখন হরিপদ কেরানি । স্কুলে নানা ফুট ফরমায়েশ খাটে । দেখা হলেই একগাল হাসি হেসে বলতো- ‘বেশ আছি’ ।

হরিপদ কেরানির সঙ্গে আমার রোজ দেখা হয়। বাসে, পথে, ঘাটে, ফাঁকা রাস্তায়, নিশুত রাতে, মাঝে মাঝেই। হরিপদ এসে বসে আমার পাশে।

সারাদিনের ঘাম লেপ্টে থাকে কেরানি হরিপদর জামায়। ময়লা, চ্যাটচ্যাটে জামা কাঁধ থেকে ব্যাগটা নামিয়ে খুব করে গাল পাড়ে কর্পোরেট কোম্পানির বেনিয়া বাবুদের। বয়েসটাও গড়িয়েছে হরিপদর। বয়সের আগেই মাথার চুলে পাক ধরেছে । একমুখ বলিরেখা। হরিপদ হাই তোলে। তারপর সেই তো একই গল্প। দিনের শেষে পড়ে পাওয়া চোদ্দ আনা, এই আর এক হরির দোকানে ফরমায়েসি দুটো চা। হরিপদর মুখে একগাল হাসি। কর্পুরের মতো ভ্যানিস কেরানি ক্লান্তি। হরিপদ এই সময়টায় একটু বেঁচে ওঠে। নিজের মত, স্বাধীন।


###

আমাদের একেবারে ছোট্টবেলার আরেক বন্ধু ছিল। নাম অমলকান্তি। অমলকান্তি খুব ছোটবেলা থেকেই কবিতা লিখত। যা নাকি জাম আর জামরুলের পাতায় একটুখানি হাসির মতোন লেগে থাকে। রোজ দেরি করে ক্লাসে আসত, পড়া পারত না, শব্দরূপ জিজ্ঞেস করলে এমন অবাক হয়ে জানলার দিকে তাকিয়ে থাকত, যা দেখে ভারি কষ্ট হত আমার।

আমরা মোটামুটি এখন সবাই প্রায় প্রতিষ্ঠিত। এক অমলকান্তি ছাড়া। সে এখন অন্ধকার একটা ছাপাখানায় কাজ করে।না অমলকান্তির কবি হয়ে ওঠা হয়নি। হওয়া সম্ভবও ছিল না। অমল বারো ক্লাস পেরানোর আগেই বাবা সংসারের দায়িত্ব দিয়ে মুক্তি নিলেন। ছোট ছোট দুই বোন, বারোমাসি অসুখে ভোগা মা, তার সঙ্গে মানসিক বিকারগ্রস্থ এক দাদা। সব মিলিয়ে এক অস্বাভাবিক সংসারের জোয়ার এসে পড়ল অমলের ওপর।

অমল মাস মাইনের চাকরি খুঁজতে খুঁজতে হিসেব নিকেশের খাতা লেখার কাজে যোগ দিল এক পোশাকের দোকানে ।চাকরি পাওয়ার পাঁচদিনের মাথায় চাকরি গেল। হিসেবের খাতায় অমল লিখেছিল, ‘’কখন বয়স গড়ায় কে জানে। বিকেল চুঁইয়ে সন্ধে নামে জীবনের নিয়মে।‘’


পত্রপাঠ অমলের বিদায় ঘোষণা করেছিলেন দোকানের মালিক। তারপর এগলি, ওগলি পেরিয়ে শেষমেশ অন্ধকার ছাপাখানা। ওর শ্রমিক হাতের দিয়ে ছেপে বেরোয় অনেক কবিতা, প্রবন্ধ, দিনবদলের স্বপ্ন, সেসব গন্ধ ওই ছাপাখানার মধ্যে থেকেই যতটা পারে অমল শুষে নেয়। কিন্তু অমলের কবিতা অন্ধকার ছাপাখানা কাড়তে পারেনি। হাজারো দারিদ্র কাড়তে পারেনি। অমল আজও কবিতা লেখে। এই অস্থির সময়ের কবিতা।


ছাপাখানার অন্ধকার জগতের কবিতা। বাস্তবকে নগ্ন করে কাব্যিক ছলনায়। বয়স গড়িয়েছে অমলেরও। হরিপদর মতো ওরও আর বিয়ে করে ওঠা হয়নি। সমাজ সংসারের দায়িত্ব সামলাতে সামলাতেই সময় কাবার। অমলকান্তি এখনও পেয়ারাতলার গলিতেই থাকে। লোহার গরাদে দেওয়া একতলা ঘর পথের ধারেই। নোনা ধরা দেওয়ালেতে মাঝে মাঝে ধ্বসে গেছে বালি, মাঝে মাঝে স্যাঁতাপড়া দাগ। ওর সঙ্গে আর একটা জীব থাকে একভাড়াতেই। সেটা টিকিটিকি। পাঁচশ টাকার ভাড়া এখন বেড়ে হয়েছে হাজার টাকা ।


তবু আজও অমল বা হরিপদ লড়াই করছে, লড়াই করছে তাদের ভেঙ্গে যাওয়া স্বপ্নকে জোড়া লাগানোর জন্য ।।



পুনশ্চ : মনের ভেতর পুষে রাখা কিছু যান্ত্রিক বিষন্নতাকে 'অমলকান্তি' আর 'হরিপদ' এর ভূমিকায় তুলে ধরার প্রচেষ্ঠা । নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর বিখ্যাত কবিতা 'অমলকান্তি'র অমলকান্তি আর রবীঠাকুরের 'বাঁশি' কবিতার 'হরিপদ কেরানী'কে আশ্রয় করে এ লেখা । লেখকদ্বয়ের কাছে কৃতজ্ঞতা স্বীকার করছি ।।
সর্বশেষ এডিট : ০৪ ঠা জুলাই, ২০১৪ রাত ৯:০১
১০টি মন্তব্য ১০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

স্মৃতিপুড়া ঘরে

লিখেছেন আলমগীর সরকার লিটন, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:৩০



বাড়ির সামনে লম্বা বাঁধ
তবু চোখের কান্না থামেনি
বালিশ ভেজা নীরব রাত;
ওরা বুঝতেই পারেনি-
মা গো তোমার কথা, মনে পরেছে
এই কাঠফাটা বৈশাখে।

দাবদাহে পুড়ে যাচ্ছে
মা গো এই সময়ের ঘরে
তালপাতার পাখাটাও আজ ভিন্নসুর
খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে... ...বাকিটুকু পড়ুন

গরমান্ত দুপুরের আলাপ

লিখেছেন কালো যাদুকর, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:৫৯




মাঝে মাঝে মনে হয় ব্লগে কেন আসি? সোজা উত্তর- আড্ডা দেয়ার জন্য। এই যে ২০/২৫ জন ব্লগারদের নাম দেখা যাচ্ছে, অথচ একজন আরেক জনের সাথে সরাসরি কথা... ...বাকিটুকু পড়ুন

রাজীব নূর কোথায়?

লিখেছেন অধীতি, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৩:২৪

আমি ব্লগে আসার পর প্রথম যাদের মন্তব্য পাই এবং যাদেরকে ব্লগে নিয়মিত দেখি তাদের মধ্যে রাজীব নূর অন্যতম। ব্যস্ততার মধ্যে ব্লগে কম আসা হয় তাই খোঁজ-খবর জানিনা। হঠাৎ দু'একদিন ধরে... ...বাকিটুকু পড়ুন

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বৃষ্টির জন্য নামাজ পড়তে চায়।

লিখেছেন নূর আলম হিরণ, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৩৮



ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু শিক্ষার্থী গত বুধবার বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে বৃষ্টি নামানোর জন্য ইসতিসকার নামাজ পড়বে তার অনুমতি নিতে গিয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এটির অনুমতি দেয়নি, যার জন্য তারা সোশ্যাল... ...বাকিটুকু পড়ুন

=তুমি সুলতান সুলেমান-আমি হুররাম=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:৩৬



©কাজী ফাতেমা ছবি

মন প্রাসাদের রাজা তুমি, রাণী তোমার আমি
সোনার প্রাসাদ নাই বা গড়লে, প্রেমের প্রাসাদ দামী।

হও সুলেমান তুমি আমার , হুররাম আমি হবো
মন হেরেমে সংগোপনে, তুমি আমি রবো।

ছোট্ট প্রাসাদ দেবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×