এর আগে "চিন্তার ইতিহাসে: ধর্ম কী" শিরোনামে একটা পোষ্ট দিয়েছিলাম। অনেকে দাবি করে "ধর্ম ব্যাক্তিগত বিষয়"। এ'ব্যাপারে আমার মন্তব্য কী - অনেকে জানতে চেয়েছেন। বিষয়টার গুরুত্ত্ব বিবেচনা করে এটাকে আলাদা পোষ্টে দিলাম।
ধর্মের পারলৌকিক প্রকল্প:
ধর্মের প্রজেক্ট হলো, একটা পারলৌকিক জগতের আকাঙ্খা তৈরি করা। বাস্তব দুনিয়ার যত অবিচার, বে-ইনসাফি, অমানবিকতা আছে যার বিচার দুনিয়াতে হয় না, মানুষের দুঃখ কষ্টের কোন হাল হয় না - এই পরিস্হিতিতে এই দুনিয়ায় নয় অন্য এমন এক জগতের ধারণা তৈরি করা যেখানে একজন বিচারক আছেন, বাস্তব দুনিয়ার সব অবিচার, বে-ইনসাফি, অমানবিকতার যিনি বিচার করবেন এবং বেহস্ত - দোজখের মাধ্যমে শাস্তি অথবা সুখের ইনাম ব্যবস্হা করবেন - এই হলো সেই ধর্মতাত্ত্বিক পারলৌকিক প্রজেক্ট। বাস্তব দুনিয়ার অসহায় মানুষের মত ধর্মও ওখানে অসহায়।
এখন এই পরিস্হিতিতে "নাস্তিক-কমিউনিষ্ট" বা নাস্তিক হিসাবে আপনি ধর্মের এই গায়েবিপনা ধর্মতাত্ত্বিক ব্যাখ্যা উদোম করে দিয়ে নিজেকে মহা বাহাদুর ভেবে নিজের দায় শেষ ভাবতে পারেন। ধর্মকে পরাস্ত করে খুব একচোট নিয়েছেন বলে মনে প্রশান্তি লাভ করতে পারেন। এমনকি ধর্মের এই বয়ানকে কাজে লাগিয়ে কোন মানুষ বা শ্রেণী নিজের স্বার্থে কিভাবে একে ব্যবহার করছে তার ভুরিভুরি উদাহরণ তুলে ধরে পারেন। কমিউনিষ্ট বা নাস্তিক হিসাবে এসব মুখোশ উন্মোচনের কর্তব্য শেষ করে একেকজন আরুজ আলী মাতুব্বরও হতে পারেন। এমনকি আপনি নারীবাদী বা নারী হলে ভাবতে পারেন ধর্মের এই বুজরকি মুখোশ উন্মোচনের কর্তব্য না করতে পারলে নারীবাদের আর কাজ কী!
আপনাদের সকলকে বিনীতভাবে তবে নিশ্চিত করে বলতে পারি ধর্মকে এই সংকীর্ণ পরিসরে দেখে ধর্ম কোনদিন পরাস্ত । হবে না কখনও। ধর্মের প্রয়োজন তাতে ফুরিয়ে যাবে না, মিটে যাবে না। ধর্ম যদি আপনার যথেচ্ছাচারে বাধা মনে হয় তবে এতে হয়ত আপনার কাজ চলবে। তবু ধর্ম আপনাকে ছাড়বে না।
কেন?
ধর্মতাত্ত্বিক বয়ানে ধর্মের পারলৌকিক জগতের আকাঙ্খা তৈরি করার কাজটা ফলাফল আনে নাই, উদ্দেশ্য সফল করতে পারে নাই একথা সত্য , উল্টা বুজরুকি অপব্যবহার বা সময়ে ব্যবসা হিসাবে হাজির হয়েছে - এটা জানা জানানোটাই ধর্মের (পশ্চাদপদ !) চিন্তা থেকে মুক্ত হওয়ার লড়াই বলে মনে করা হলেও এটা বড় জোড় ধর্মের বিরুদ্ধে এক ক্ষ্যাপাটে প্রতিক্রিয়া মাত্র, ধর্ম সম্পর্কে কিছুই জানা হয় না তাতে, ধর্মের গুমোরও খুলে না।
তাহলে, ধর্ম মানে এখানে কী বুঝব, ধর্মের পারলৌকিক প্রকল্পের তাৎপর্য কী - সেদিকে পাঠকদের নজর ফেরাব, দুটো পয়েন্টে:
১. মানুষের যে প্রয়োজনের তাগিদ থেকে ধর্মের পারলৌকিক প্রজেক্ট সেই প্রয়োজনের তাগিদ কী ধর্মের মুখোশ উন্মোচনের সাথে সাথে মিটে যায় বা মিথ্যা হয়ে যায়? অথবা ঐ প্রয়োজন তাগিদ কী পূরণ হয়ে মিটে যায়?
মানুষের প্রয়োজনের তাগিদটা কী? তাগিদটা হলো, বাস্তব দুনিয়ার যত অবিচার, বে-ইনসাফি, অমানবিকতা আছে যার বিচার দুনিয়াতে হয় না, মানুষের দুঃখ কষ্টের কোন হাল হয় না - এর একটা হাল করা। এটাই সেই বৈষয়িক ভিত্তি যেটার কারণে ধর্মের পারলৌকিক প্রজেক্ট জেগে উঠতে পাচ্ছে। মানুষ প্রয়োজনের তাগিদটারই আর এক নামপ্রকাশ হলো ধর্মের পারলৌকিক প্রজেক্ট। ধর্মের মুখোশ উন্মোচনের সাথে ধর্ম একটা ভুয়া জিনিষ প্রমাণ হতে পারে কিন্তু পরলোকের আকাঙ্খার উৎস, সেই বৈষয়িক শর্ত পরিস্হিতির কোন হেরফের হয়না তাতে। মানুষ প্রয়োজনের তাগিদ মেটার সাথে এর কোন সম্পর্কই নাই।
অতএব দেখা যাচ্ছে, বাস্তব দুনিয়ার দুনিয়াদারিতে যত অবিচার, বে-ইনসাফি, অমানবিকতা আছে যার বিচার সে পায় না, দুঃখ কষ্টের ভিতরে তাঁর দিনানিপাত - এর হাল না হওয়া পর্যন্ত ধর্ম থেকে যাবার শর্ত থেকে যাচ্ছে। "এটা অন্যায় বে-ইনসাফি , আল্লায় এর বিচার করবে" - অসহায় মানুষ এই ফরিয়াদটুকুও যদি জানাতে প্রকাশ করতে না পারত, তাহলে সম্ভবত আত্মহত্যা করা ছাড়া মানুষের আর কোন উপায় থাকত না। বাস্তব দুনিয়ার দুনিয়াদারিতে দুঃখ কষ্টের অবিচারের ঘটনায় ধর্ম এর কোন সুরাহা করতে পারে না সন্দেহ নাই। কিন্তু ক্ষোভ জ্বালায় সাময়িক উপষমের একটু আরাম দেবার শান্তনা - এখানে ধর্ম এই ভুমিকাটাই পালন করে। আবার, এটা ভাবাও ভুল হবে, এটা যে শান্তনা মাত্র সাধারণ মানুষ তা বুঝতে পারে না। ঠান্ডা মাথায় সে জানে এটা সান্তনা। কিন্তু বিপদের মাথায় এই সান্তনাটুকু তাঁর দরকার, কারণ নইলে অনিরসিত ক্ষোভ জ্বালা সইতে না পেরে সে মারা যাবে অথবা পাগল হতে হবে।
ধর্মের আফিম:
ডাক্তারি অপারেশনে মানুষকে শরীর কাটাছেঁড়া সহ্য করতে হয়। প্যাথিডিন ইনজেকশন দিয়ে ব্যাথা ভুলানোর চেষ্টা ডাক্তারেরা করে, এতে ব্যাথা বেদনা সাময়িক ভুলে যাওয়া যায় হয়ত, কিন্তু বেদনা বেদনাই থেকে যায়। ওষুধের প্রভাব যতই কমে বেদনা ততই প্রবল হয়ে জানান দেয় সে আছে মরে নাই। আগের দিনে যখন আজকের এ্যানেসথিসিয়ার মত সাময়িক চেতনানাশক আবিস্কার দূরে থাক ইনজেকশনের যুগ ছিল না, তখনও কিন্তু শল্য চিকিৎসা, কাটাছেঁড়া হতো। একাজে জনপ্রিয়ভাবে তখন ব্যবহার হত আফিম, আফিম গুলে খাওয়ান হত। প্যাথডিন যেমন চিকিৎসায় বেদনানাশক ওষুধ তেমনি অনেকে বেপথে এটা নেশা করার ড্রাগ হিসাবেও ব্যবহার করে ফেলে। আফিমের ক্ষেত্রেও একই সমস্যা, একই ঘটনা চালু ছিল। শরৎচন্দ্রের উপন্যাসে আফিম খাওয়ার ঘটনার বর্ণনা অহরহ। আফিম সম্পর্কে এই বিস্তারি দিক আমাদের অনেকের জানা নাই। আমাদের পপুলার ধারণা হলো, আফিম নেশার বস্তু, বেদনানাশক নয়। আপনি যদি নাস্তিক-কমিউনিষ্ট হন তবে মার্কস সাহেব ধর্মকে আফিম বলার মানে আপনার কাছে হবে আফিম মানে নেশা, নেশায় বুঁদ হবার বষ্তু বা উপায়। আর যদি কমিউনিষ্ট বা অ-কমিউনিষ্ট যাই হন তবে নাস্তিক না হন, তবে আফিম মানে বেদনানাশক বুঝবেন। মানুষের কষ্ট বুঝতে চেষ্টা করলে, অনুভব করতে পারলে, এত মুখোশ উন্মোচনের পরেও ধর্ম কেন টিকে আছে এটা বুঝা কোন সমস্যাই না।
২. ধর্ম অমানবিক সমাজের বিরুদ্ধে মানবিক সমাজের আকুতি:
ধর্ম যে পারলৌকিক জগতের আকাঙ্খা তৈরি করে বাস্তব দুনিয়ার যত অবিচার, বে-ইনসাফি, অমানবিকতা দুঃখ কষ্টের নিরসনের প্রতিশ্রুতি দেয় এটা একজামিন করলে দেখা যাবে ওটার সারকথা হলো, একটা মানবিক দুনিয়া পাবার আকুতি। কিন্তু এই মানবিক দুনিয়ার আকুতি পরলোকে কেন? কারণ এই বাস্তব দুনিয়ায় সে পরিস্কার দেখতে পায় এটা অসম্ভব, এটা কায়েমের কোন শর্ত সে দেখে না। মানবিক দুনিয়ার স্বপ্ন যার ভেতর দিয়ে দেখছে আর যে দেখছে উভয়েই পরোক্ষে চাচ্ছে এরকমটাই হোক তাদের এই দুনিয়াদারিতে, কিন্তু পরক্ষণেই বাস্তবতায় মনে পড়ছে এটা সম্ভব না।
অতএব মানুষ যদি এই জগতেই অবিচার, বে-ইনসাফি, অমানবিকতা দুঃখ কষ্টের দূর করে এক ইনসাফের ন্যয়বিচারের জগত প্রতিষ্ঠা করতে পারে তবেই তার আকাঙ্খার সুরাহা হবে। এই হলো মূল কথা। এর খাস মানে হলো, ধর্মের পরলোকের প্রজেক্টটা ইহলোকেই বাস্তবায়ন করতে হবে। এটাই বিপ্লবীর কাছে পরলোকের মানে। যতটুকু আমরা সেই মানবিক ইনসাফের ন্যয়বিচারের জগত এই দুনিয়ায় কায়েমের পথে অগ্রসর হব ততটুকু আমরা সত্যিকারের অর্থেই ধর্মের প্রয়োজন থেকে মুক্ত হতে পারব। বা বলা যায় ইহলোকে পরলোক কায়েম হবে। দুনিয়ায় মানুষের ধর্ম কায়েম।
বুঝা যাচ্ছে, একটা লম্বা জার্নি। প্রস্তুতিও। এবং ততদিন ধর্মের প্রয়োজন থেকে যাচ্ছে। না এ'পর্যন্ত দেখা কমিউনিষ্ট কায়দায় আমরা যা বলতে বা দেখতে অভ্যস্ত কেবল সেই বৈষয়িক ভাত-কাপড়ের মুক্তির কথা আমি বলছি না; একইসাথে সাংস্কৃতিক মানসিক বা স্পিরিচুয়াল মুক্তির কাজটা এই দুনিয়াতেই হতে হবে, এই দুনিয়াতেই পরলোক প্রতিষ্ঠা করতে হবে।
তাহলে এর আগে অন্তবর্তীকালীন পর্যায়ে আমরা কোন রাষ্ট্র গড়ব না বা সমর্থন করবো না?
অবশ্যই করব। কেবল "ধর্ম ব্যাক্তিগত বিষয়" এই মিথ্যা বয়ানে ঘোর আপত্তি করব। আধুনিক রাষ্ট্র যদি "ধর্ম ব্যাক্তিগত বিষয়" বলে ঘোষণা করে, একথাটার নীট মানে হোল ধর্মের পারলৌকিক প্রজেক্টটা অক্ষত যেমন ছিল তেমন রেখে দিতে চাওয়া। বাস্তব জীবনের সাথে রেল লাইনের মত পাশপাশি হেঁটে চলা আর এক জীবন, পারলৌকিক জীবন রেখে দেওয়া। বাস্তব জীবনে সমস্ত আকাম-কুকাম, অন্যায় অবিচারের যে সৌধ সে গড়বে - এর গ্লানি থেকে মুক্ত হবার জন্য পারলৌকিক জীবন তার দরকার। পারলৌকিক জীবনকর্ম হিসাবে আলাদাভাবে ওটা করে যাবে। অথবা, তখনও যে মানুষ অন্যায় অবিচারের বলি হতে থাকবে এর বিরুদ্ধে ঐ পারলৌকিক জগতে কাছে কেঁদে কেঁদে ফরিয়াদ করে ফিরবে। এর আর এক মানে হলো, এগুলো চলতে দিয়ে বহাল-তবিয়তে রেখে "আমি"র অধিকারের গান শুনানো।
তাই, পারলৌকিক জগত তৈরির ধর্মের প্রজেক্ট আর "ধর্ম ব্যাক্তিগত বিষয়" বলে আধুনিক রাষ্ট্র পক্ষে দাঁড়ানো - একই কথা।
এবার সারকথায় বলি,
ক. "ধর্ম ব্যাক্তিগত বিষয়" এই ধর্মতাত্ত্বিক প্রকল্পটাকে চালিয়ে দেবার পক্ষে ঢেঁড়া পিটানো বিপ্লবীপনা নয়।
খ. "ধর্ম ব্যাক্তিগত বিষয়" একথাটা রাষ্ট্রের ভিত্তি হতে পারে না। এটা ধর্মতাত্ত্বিক ধর্মের পারলৌকিক প্রজেক্ট।
গ. রাষ্ট্র যেন ধর্ম, বর্ণ, গোত্র ইত্যাদি নির্বিশেষে নাগরিকের উপর কোন বৈষম্যমূলক আচরণ বা শর্ত না সৃষ্টি করে এই অর্থে এ'থেকে রক্ষাকবচ দরকারে তা গঠনতন্ত্রে উল্লেখ ও চিন্তায় স্পষ্ট রাখার দরকার অবশ্যই। কিন্তু এর মানে "ধর্ম ব্যাক্তিগত বিষয়"কে ভিত্তি করে রাষ্ট্র গঠন নয়। এই ফারাক বজায় রাখতে হবে, গুলিয়ে ফেলা যাবে না।
গুরুচরণ ভরসা।
সর্বশেষ এডিট : ২৩ শে ডিসেম্বর, ২০০৮ রাত ৩:৫৫