ছবিঃ শিল্পীর তুলিতে একজন ‘আসাসিন’ (ইন্টারনেট থেকে সংগৃহীত)
আজ থেকে প্রায় হাজারখানেক বছর আগে, খ্রিস্টীয় ১১০০ সালের কিছু আগে (ইসলামের জন্মের তখন প্রায় ৪০০ বছর হয়ে গিয়েছে) মুসলিম দুনিয়ার শাসনক্ষমতা ছিল একাধিক সাম্রাজ্যের মধ্যে বিভক্ত। এদের মধ্যে মোটামোটি মাঝখানের জায়গাটা নিয়ে ছিল সেলজুক সাম্রাজ্য। সেলজুকরা ছিল তুর্কী বংশোদ্ভূত। [আজকে আমরা তুরস্ক নামক রাষ্ট্রের অধিবাসীদেরকে বলি তুর্কী। কিন্তু এরা আসলে এই অঞ্চলের আদি বাসিন্দা নয়। এদের পূর্বপুরুষরা ছিল মধ্য এশিয়ার বিস্তীর্ণ সমতলভুমিতে (আজকের ইরান এবং আফগানিস্তানের উত্তরে, প্রাক্তন সোভিয়েত মধ্য-এশিয় প্রজাতন্ত্রগুলোর এলাকা) বসবাসরত যাযাবর উপজাতি।] সেলজুক সাম্রাজ্যে সামরিক ক্ষমতা সম্রাটদের হলেও, প্রশাসনিক কর্তৃত্ব একসময় চলে আসে জাতিতে ফার্সি (ইরানী) প্রধান উজির ‘নিজাম-উল-মুলক’ এর কাছে। যাযাবর তুর্কীরা তুখোড় যোদ্ধা হিসাবে রাজ্য জয় করলেও বিশাল সাম্রাজ্য চালানোর মতো আমলাতান্ত্রিক কলাকৌশল তখনো খুব একটা শিখে উঠতে পারেনি।
মানচিত্রে সেলজুক সাম্রাজ্য (কালো তীর চিহ্নিত লাইন দিয়ে দেখানো হয়েছে তুর্কীরা কোন পথে মুসলিম এলাকায় অভিযান চলিয়েছিল)
তখনকার ইসলামী সমাজের তিনটি পরস্পরবিরোধী শক্তিকে নিয়ে একটি ভারসাম্যপূর্ণ রাষ্ট্র পরিচালনায় নিজাম-আল-মুলক চেষ্টা করে যাচ্ছিলেন। তাঁর ভিশন ছিল এরকম- সেলজুক সাম্রাজ্যে আইন শৃঙ্খলা বজায় রাখার কাজে থাকবে সামরিক দিক দিয়ে পারদর্শী তুর্কীরা। সাম্রাজ্যের ঐক্য ধরে রাখবে ইসলাম ধর্ম, আর সেই ধর্মীয় দিকনির্দেশনা প্রদানের দায়িত্বে থাকবে জাতিতে আরব ওলামা সম্প্রদায়। আর রাষ্ট্রের প্রশাসন, শিল্প, দর্শন, কাব্য, চিত্রকলা, আরকিটেকচার, বিজ্ঞান এসব ক্ষেত্রে সামনে থাকবে ফার্সিরা (পারস্য সভ্যতা তখন কয়েক হাজার বছরের ইতিহাসে সমৃদ্ধ)।
কিন্তু নিজাম-আল-মুলক এর সকল প্রচেষ্টাকে বিফল করে দিতে কাজ করছিল এক অশুভ শত্রু, এক নির্মম প্রতিভা যার নাম হলো হাসান সাব্বাহ। সে ছিল ‘আসাসিন’ নামক দলের প্রতিষ্ঠাতা। তারা ছিল শিয়া-ইজম থেকে বের হয়ে যাওয়া এক শাখার, উপশাখার এক প্রশাখা বিশেষ। এদেরকে মূলধারার কোন মতবাদ বলা যায় না।
শিয়ারা বিশ্বাস করতো যে মোহাম্মদ (সঃ) এর পর আর কোন নবী-রাসুলের পৃথিবীতে আগমন বন্ধ হয়ে গেলেও পৃথিবীতে তাদেরকে সঠিক পথ দেখানোর জন্য সবসময়ই একজন কেন্দ্রীয় ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব বর্তমান থাকেন, যাকে তারা তাদের ‘ইমাম’ বলে ডাকে। এক ইমাম মারা যাওয়ার সাথে সাথে তাঁর বিশেষ ক্ষমতা তাঁর ছেলেদের মধ্যে একজনের উপর বর্তায় এবং তিনি হন নতুন ইমাম। সমস্যা হল, যখনই একজন ইমাম ইন্তেকাল করেন তখনই মতবিরোধ দেখা দেয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়। ইমামের ছেলেদের মধ্যে কোনজন নতুন ইমাম হওয়ার দাবিদার, সেটা নিয়ে। আর এরকম কোন্দল যতবার হয় ততবারই শিয়াদের ঐ শাখার মধ্যে বিভক্তি এসে নতুন করে একেকটা প্রশাখার জন্ম হতে পারে।
মানচিত্রে সেলজুক, ফাতিমি এবং বাইজানটাইন সাম্রাজ্য
(ইন্টারনেট থেকে সংগৃহীত, এখানে সেলজুকদের সাম্রাজ্য অনেক ছোট করে দেখানো হয়েছে। হয়ত প্রথম মানচিত্র আর এটি ভিন্ন ভিন্ন সময়ের কথা বলছে)
শিয়াদের পঞ্চম ইমাম হওয়ার দাবিদার কে, তাই নিয়ে ঠিক এরকম একটি মতানৈক্যের ফলেই তৈরি হয় জায়ীদী নামক উপদল, যারা Fivers নামেও পরিচিত। আরও গুরুতর মতভেদ দেখা দেয় ষষ্ঠ ইমামের মৃত্যুর পর। সেখান থেকে তৈরি হয় ইসমাঈলী নামক এক সম্প্রদায়ের। এই ইসমাঈলীরা বেশ কিছু সময়ের জন্য শিয়াদের মধ্যে প্রভাবশালী শাখা হয়ে ওঠে। এদের একদল মিশর দখল করে নেয় এবং ফাতিমী সাম্রাজ্যের জন্ম দেয়। ফাতিমীরা ছিল সেলজুকদের প্রতিদ্বন্দ্বী।
একাদশ শতাব্দীর শেষ দিকে ইসমাঈলীদের মাঝে দুটি শাখা তৈরি হয়। এদের মধ্যে ছোট যে শাখাটি সেটি ছিল একটি বিপ্লবী দল, যারা তখনকার পরাক্রমশালী ফাতেমীয় সাম্রাজ্যের জাঁকজমক এবং সম্পদের চাকচিক্কে খুব বিরক্ত হয়ে উঠে। তাদের লক্ষ্য হয়ে উঠে ধনী ও দরিদ্রদের ব্যাবধান কমানো, নিপীড়িতদের ক্ষমতায়ন, এবং মোটের উপর ইসলামী সমাজের আদর্শগুলোকে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা। এই আন্দোলনের নেতারা হাসান সাব্বাহ নামে এক লোককে পারস্যে পাঠায় অনুসারী জোগাড় করার দায়িত্ব দিয়ে।
পারস্যে এসে সাব্বাহ তার নিজের এক ক্ষমতাবলয় গড়ে তোলে। সে আলামুত (এই শব্দের অর্থ হল ‘ঈগলের বাসা’) নামক এক দুর্গের নিয়ন্ত্রন নিয়ে নেয়। আলামুত ছিল উত্তর ইরানের এলবুরজ পর্বতের এক উঁচু জায়গায়। কেউ তাকে সেখানে স্পর্শ করতে পারতো না। কারণ সেই দুর্গে যাওয়ার রাস্তা ছিল একটাই আর সেটি ছিল এতই সরু যে সেখানে কোনও সেনা বাহিনী নিয়ে আক্রমণ করা সম্ভব ছিল না। সাব্বাহ ঠিক কি কৌশলে ওই দুর্গ দখল করল তা কেউ ঠিক জানে না। কোন কোন কিংবদন্তীতে বলে সে প্রতারণার আশ্রয় নিয়েছিল, কেউ বলে সাব্বাহ-র কোন অলৌকিক ক্ষমতা ছিল, কারও মতে সে দুর্গের কর্মীদের তার মতে দীক্ষিত করতে সক্ষম হয়েছিল আর এরপর দুর্গের মালিকের কাছ থেকে অল্প দামে সেটা কিনে নিয়েছিল। তা সে যেভাবেই দখল করুক না কেন, সেই আলামুত-এ বসে সাব্বাহ ‘আসাসিন’ (Assassin) নামক বাহিনী গঠন করার কাজে জোরেশোরে নেমে পড়ল।
ছবিতেঃ আলামুত দুর্গ যেখানে ছিল এবং সেখান থেকে আশেপাশের এলাকার ভিউ
আজকের দিনে ইংরেজি ভাষায় ‘এসাসিন’ শব্দ দিয়ে বোঝায় এমন লোক যারা রাজনৈতিক বা অন্য কোন কারণে গুরুত্বপূর্ণ মানুষকে হত্যা করে। এ থেকে আমরা হয়তো ভেবে বসতে পারি যে সাব্বাহ তার দলের নাম আসাসিন দিয়েছিল কারণ তাদের লক্ষ্যই ছিল রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করা। কিন্তু ঘটনা সম্পূর্ণ উল্টা। এই ‘এসাসিন’ শব্দটি অভিধানে যোগই হয়েছে কারণ গোপন রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড ছিল আসাসিন নামক এই দলটির যুদ্ধকৌশল। কয়েকশত বছর পর বিখ্যাত পর্যটক মার্কো পোলো দাবি করে বসেন যে সাব্বাহ’র লোকেরা হত্যাকান্ডের আগে নিজেদের শক্তি বাড়ানোর জন্য হাশিশ (ভাং) সেবন করত, আর সে কারণেই নাকি ‘হাশিশ’ থেকে ‘হাসাসিন’ (হাশিশ খোর) হয়ে এদের নাম হয়েছিল আসাসিন। কিন্তু এই থিওরি যে ভুল তা আমি আপনাকে প্রমাণ করে দিতে পারব।
সাব্বাহ ছিল একদম আদর্শ হবু-টেররিষ্ট। হত্যাকাণ্ডকে সে কাজে লাগাত প্রধানত প্রচারণার অস্ত্র হিসাবে। যুদ্ধ করে শহর জয় করার মতো সৈন্য সামন্ত বা অন্য কোন সম্বল তার ছিল না। তাই সে একজন মানুষ কিংবা খুব ছোট্ট একটি দলকে কাজে লাগিয়ে খুব বাছাই করা মানুষদেরকে হত্যা করার পথ বেছে নেয়। কাকে হত্যা করা হবে তা নির্ধারণ করা হতো ঐ লোকের মৃত্যুর ফলে জনমনে কত বেশী শক বা আতঙ্ক তৈরি হবে সেটার উপর ভিত্তি করে। আসাসিনরা একেকটি হত্যাকাণ্ডের পরিকল্পনা করত মাসের পর মাস সময় নিয়ে, কখনও বা বছরের পর বছর ধরে। অনেক সময় তারা তাদের শিকারের সাথে বন্ধুত্ব গড়ে তুলত, কিংবা শিকারের অধীনে চাকরিতে যোগ দিত এবং ধৈর্যের সাথে কাজ করে ওই লোকের আস্থাভাজন একটি অবস্থানে নিজেদেরকে নিয়ে যেত। এটি ছিল অনেক দীর্ঘ এক প্রক্রিয়া।
এখন এই দীর্ঘ জটিল প্রক্রিয়ায় ঠিক কোন পর্যায়টাতে গিয়ে তারা কথিত সেই হাশিশ সেবনকার্জে নিয়োজিত হতো? এটা যুক্তিতে ঠিক মেলে না। লেবানীজ লেখক আমীন মালুফ মনে করেন ‘আসাসিন’ শব্দটি এসেছে ফার্সি শব্দ ‘আসাস’ থেকে, যার মানে ‘ভিত্তি’ (ফাউন্ডেশন) থেকে। অধিকাংশ ধর্মীয় বিচ্ছিন্নতাবাদিদের মতই সাব্বাহ ভাবত যে ইসলামের মূল বাণীগুলোতে ভেজাল ঢুকে গেছে। সে আর তার দলবল মিলে মানুষকে ধর্মের ভিত্তিমূলে ফিরিয়ে নিয়ে যাবে, একেবারে ‘খাঁটি’ ইসলামে আরকি। অবশ্য এই ‘খাঁটি ধর্ম’ বস্তুটা যে আসলে কি তা নিয়ে আবার সব মৌলবাদীদের ধারণা আলাদা আলাদা। সাব্বাহ’র মতবাদ এতই ভিন্নরকম ছিল যে অধিকাংশ ইসলামী পণ্ডিত ই এটাকে ইসলাম হিসাবে স্বীকৃতি দিতে পারেননি। উদাহরণস্বরূপ, সাব্বাহ প্রচার করত যে যদিও মোহাম্মদ (সঃ) আল্লাহর রসূল, আলী (র) এর মধ্যে দিয়ে নাকি আল্লাহ নিজেই দেখা দিয়েছিলেন!
সাব্বাহ আরও দাবি করত যে কোরানের নাকি বাহ্যিক এক ধরণের অর্থ ছিল আর কয়েক স্তরে লুকানো অনেক অর্থ ছিল। বাহ্যিক রূপটা ছিল আম আদমিদের জন্য। আর সাব্বাহ’র মতো কিছু পণ্ডিতদের জন্য নাকি কোরানের প্রত্যেকটা শব্দের পিছনে লুকানো সঙ্কেত এর মাধ্যমে সৃষ্টিজগতের সব গুপ্ত রহসের চাবিকাঠি বলা ছিল।
আসাসিনরা ছিল চরমতম গুপ্ত সংগঠন। বাইরের দুনিয়ায় কেউ তাদের পরিচয় বা তাদের বিশ্বাস কি ছিল তা জানত না। সুতরাং কেউই জানতো না আসাসিনদের সংখ্যা কত ছিল বা হাটে, ঘাটে, মসজিদে কোন মুহূর্তে কোন আসাসিন উপস্থিত ছিল কিনা। নতুন রিক্রুটদের কঠিন প্রশিক্ষণ এবং মগজ ধোলাই এর মধ্যে দিয়ে যেতে হতো। পাশ করলে তারপর যোগ্যতা অনুযায়ী র্যাঙ্ক এ নিয়োগ দেয়া হতো। (আর যারা ফেল করতো তাদেরকে কি করত সেটা পাঠক নিজেই ভেবে নিন, অভিজ্ঞতা বর্ণনা করার জন্য বাড়িতে ফেরত সম্ভবত পাঠাতো না)।
আসাসিনরা পরিকল্পনা করত অত্যন্ত গোপনে, কিন্তু হত্যাকাণ্ডটা ঘটাত এমনভাবে যাতে সবচেয়ে বেশী পাব্লিসিটি হয়। অমুক বা তমুক কে ক্ষমতা থেকে সরানো তাদের উদ্দেশ্য ছিল না। বরং তারা চাইত যে সমগ্র সভ্য দুনিয়ার মানুষের মনে এই ভয় ঢুকে যাক যে আসাসিনরা চাইলেই যখন তখন যে কোন মানুষকে মেরে ফেলতে পারে, সে যেই হোক আর যেখানেই থাকুক। সাব্বাহ চাইত মানুষের মনে যেন এই বিশ্বাস ঢুকে যায় যে তার অজান্তে তার সেরা বন্ধুটি, তার সবচেয়ে বিশ্বস্ত দাসটি, এমনকি তাদের স্বামী বা স্ত্রীও আসলে হতে পারে আসাসিন দলের এক সদস্য। আর সাব্বাহ আশা করত যে এই ভয়কে পুঁজি করেই সে ক্ষমতাশালী লোকদেরকে নিয়ন্ত্রন করতে পারবে- সেরকম লোকদেরকে যারা সম্পদ বা রাজ্য বা জমিদারির মালিক ছিল বা যাদের অধীনে সৈন্য সামন্ত ছিল। মোদ্দা কথা তার উদ্দেশ্য ছিল সমাজের মাথাগুলোকে তার হুকুম মতো চলতে বাধ্য করা।
সাব্বাহ এর খুনীদলের সদস্যদের বলা হত ‘ফেদায়ীন’, যার অর্থ হল ‘আত্মদানকারী’। তারা জানত যে প্রকাশ্যে খুন করতে গেলে তারা ধরা পড়বে এবং সাথে সাথেই মারা পড়বে। কিন্তু তারা পালানর কথা চিন্তাও করত না। বরং মিশন শেষ করে নিজেরাই মরে যাওয়াটা ছিল তাদের ঐতিহ্যের একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশ। তারা নিজেদেরকে দেখত আত্মঘাতী অস্ত্রের মতো। মৃত্যুকে বরণ করে নিয়ে তারা সবাইকে এই মেসেজ দিতে চাইত যে তারা কোন শাস্তির ভয় করে না, এমনকি ফাঁসিও তাদের কাছে তুচ্ছ।
তখনকার পৃথিবী এমনিতেই অনেক অস্থিরতার মধ্যে ছিল। সুন্নি আর শিয়াদের মধ্যে ঝামেলা চলছিল। বাগদাদের আব্বাসিয় খিলাফতের সাথে লড়াই চলছিল কায়রোর ফাতিমী খিলাফতের। শতাব্দীকালের তুর্কী আক্রমনে পুরো মুসলিম সমাজ হয়ে ছিল ক্ষতবিক্ষত। আর এসবের মধ্যেই আসাসিন নামক এই নতুন খুনির দল গোপনে তাদের শুঁড় বিস্তার করা শুরু করল পুরো মধ্যপ্রাচ্য জুড়ে, সমাজে যোগ হল আরেক ভয়াবহ সার্বক্ষণিক দুঃস্বপ্ন।
আসাসিনরা তাদের উপস্থিতি জানান দিল একটার পর একটা চমকপ্রদ হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে। তারা বেশ কিছু উচ্চপদস্থ সেলজুক কর্মকর্তা এবং সুপরিচিত সুন্নি আলেমদেরকে হত্যা করল। এমনকি দুইজন খলিফাও তাদের হাতে প্রাণ হারায়। তারা চেষ্টা করত যতটা সম্ভব খুনগুলো জুম্মার দিনে সবচেয়ে বড় বড় মসজিদে ঘটানোর, যাতে সবচেয়ে বেশী সংখ্যক মানুষ এই ঘটনার সাক্ষী হতে পারে।
তারপর ১০৯২ সালে তারা সদ্য অবসরে যাওয়া নিজাম-আল-মুলক’কে হত্যা করে। এর এক মাসের মাথায় তারা নিজাম এর বস, খোদ সুলতান মালিক শাহ কে হত্যা করে। এভাবেই মাত্র কয়েক সপ্তাহের ব্যাবধানে যে দুইজন মানুষ সেই অস্থির সেলজুক সাম্রাজ্যের একতার জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিল তাদেরকে আসাসিনরা মেরে ফেললো। এর ফলে সেলজুক রাজপরিবারের ভাই-বেরাদরদের মাঝে ক্ষমতার জন্য ধ্বংসাত্মক হানাহানি শুরু হয়ে গেলো আর তাতে যোগ দিল বাইরের নানান ধরণের সুযোগসন্ধানি চরিত্ররা। ফলস্বরূপ সাম্রাজ্যের পশ্চিম অংশটি ভেঙ্গে টুকরো টুকরো হয়ে গেলো। এশিয়া মাইনর (আজকের তুরস্ক) থেকে সিনাই (আজকের মিশরে) পর্যন্ত সবগুলো শহরই এক একজন স্থানীয় রাজপুত্রের হাতে চলে গেলো। জেরুজালেম, দামাস্কাস, আলেপ্পো, অ্যান্টিওক, ত্রিপলি, এডেসা- সবাই কার্যত স্বাধীন রাষ্ট্রে পরিণত হল, বাগদাদের খলিফার কাছে যাদের নামমাত্র একটা আনুগত্য ছিল। সব ছোট ছোট রাজপুত্ররা নিজেদের দখলে যেটুকু জায়গাজমি ছিল সেটাকে ক্ষুধার্ত কুকুরের মতো পাহারা দিতে লাগল আর আশে পাশের বাকিদের দিকে সন্দেহ আর অবিশ্বাস নিয়ে তাকাতে লাগল।
মাত্র তিন বছরের মাথায়, খ্রিস্টীয় ১০৯৫ সালের দিকে, সার্বজনীন ইসলামী রাষ্ট্রের স্বপ্নটি রাজনৈতিকভাবে ব্যার্থতায় পর্যবসিত হল। কোরান, হাদিস আর শরীয়া অবলম্বন করে ওলামারা কোনোমতে সমাজকে একসুতায় ধরে রাখতে চেষ্টা করছিলেন। মুসলিম দার্শনিকরা তখন ছড়ানো ছিটানো এক ছিন্নভিন্ন প্রজাতিতে পরিণত হল। তখনো তারা কিছু কিছু কাজ করছিলেন কিন্তু তাদের আওয়াজ ক্রমশই মিলিয়ে যেতে লাগল। এই হল সেই সমাজ এবং সময় যখন বিখ্যাত মুসলিম মনিষী ইমাম ঘাজ্জালি কাজ করছিলেন। এটা ছিল এমন এক সময় যখন যুক্তি খুঁজতে যাওয়াটাই মনে হতে পারত সবচেয়ে অযৌক্তিক এক কাজ।
আর এর পর পরই মুসলিম দুনিয়ার উপর নেমে আসলো মহাপ্রলয় (মঙ্গোল হামলা, যা কিনা পুরো মুসলিম বিশ্বকে জ্বালিয়ে ছাই বানিয়ে দিয়েছিল। কিন্তু সেটা আরেক গল্প। আপাতত আমি সেদিকে যাব না। পরবর্তী পর্বে আবার আসাসিন-দের গল্পেই ফিরে যাবার ইচ্ছা, তাদের কীর্তিকলাপ বেঁচে ছিল আরও বহুদিন, বহু দূরদুরান্তে)
[আফগান বংশোদ্ভূত আমেরিকান লেখক তামিম আনসারী’র লিখা Destiny Disrupted: A History of the World Through Islamic Eyes বইয়ের পৃষ্ঠা ১২৯-১৩২ এর অনুবাদ। মাত্র ১-২% আমার নিজের যোগ করা- অনুবাদ করতে গিয়ে ব্যাখ্যার প্রয়োজন মনে করায়। ইতিহাস এবং ইসলামের ইতিহাস নিয়ে যাদের আগ্রহ আছে তাদের কাছে বইটি ভালো লাগবে। শুধু গল্প (নন-ফিকশন) হিসাবেও এটা বেশ দারুন।
https://www.goodreads.com/book/show/6240926-destiny-disrupted
https://www.amazon.com/Destiny-Disrupted-History-Through-Islamic/dp/1586488139]
০৪/০৪/২০২১ এডিটঃ দেখতে পাচ্ছি বইটি ২০১৮ সালে কেউ একজন বাংলায় অনুবাদ করে প্রকাশ করেছেন। আগ্রহী হলে জোগাড় করে পড়ে নিতে পারেন। আমি পড়ে দেখিনি কেমন অনুবাদ। রকমারি'র লিঙ্ক এখানে
সর্বশেষ এডিট : ০৪ ঠা এপ্রিল, ২০২১ দুপুর ২:০০