somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

মুক্তিযুদ্ধের শহীদ ৩ লক্ষ নাকি ৩ মিলিয়ন?

১৪ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৩ রাত ৮:৫৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

জামাতের পক্ষ থেকে একটা বিতর্ক চালু করা হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের শহীদের সংখ্যা নিয়ে। এর ফলে তাদের অপরাধ লঘু করে দেখানোর একটা প্রচেষ্টা করা হয়।

আবার সংখ্যায় অল্প হলেও কেউ কেউ দুম করে মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের তালিকা চেয়ে বসেন। একটা গণযুদ্ধে শহীদদের নামের তালিকা করা হয় কিনা সে বিষয়ে অসম্পূর্ণ ধারণা থাকার কারণে খুব সুকৌশলে তারা এই তালিকা তত্ত্ব হাজির করে।

পৃথিবীতে যত যুদ্ধ হয়েছে সে যুদ্ধ গুলোর কোনটাতেই বেসামরিক মৃত্যুর কোন নাম ধরে তালিকা নাই। এমন তালিকা এখনো করা হয়না। কারণ এটা করা সম্ভব না। যুদ্ধ একটা অস্বাভাবিক অবস্থা, এটা রোড ট্র্যাফিক অ্যাকসিডেন্ট নয়। এসময় শুধু তথ্য সংগ্রহের সমস্যা নয়, এই অস্বাভাবিক অবস্থায় আরো অনেক ঘটনা ঘটে। যেমন, ব্যাপক সংখ্যক মানুষ দেশ ত্যাগ করে, তাঁদের মধ্যে অনেকেই ফেরেনা, অনেকে পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যান, পরিবার-সমাজ বিহীন ভবঘুরে মানুষরাও নিহত হন যাদের খোঁজ পাওয়া সম্ভব হয়না। এছাড়াও আছে যুদ্ধের কারণে পরোক্ষ মৃত্যু। যারা হত্যা করে তারাও অপরাধ ঢাকার জন্য মৃতদেহ লুকিয়ে ফেলে। এসব কারণেই যুদ্ধে নিহতের পরিসংখ্যান সব সময় একটা সংখ্যা; একটা নামসহ পুর্নাঙ্গ তালিকা নয়। এটাই পৃথিবীব্যাপী গৃহীত নিয়ম। যারা মুক্তিযুদ্ধের শহীদদের তালিকা চায় তাদের যে কোন একটা গণযুদ্ধের বেসামরিক নিহত নাগরিকদের তালিকা দেখাতে বলুন। যুদ্ধে মৃত বা নিখোঁজ সামরিক ব্যাক্তিদের তালিকা করা সম্ভব কিন্তু বেসামরিক ব্যাক্তিদের নয়।

এই এস্টিমেসন কিভাবে করা হয়? আর জে রুমেল তার চায়নাস ব্লাডি পলিটিক্স বইয়ে এবং লিথাল পলিটিক্স বইয়ের পরিশিষ্টে গণহত্যার পরিসংখ্যান কিভাবে করতে হয় সেটার একটা মেথডোলজি দিয়েছেন আগ্রহীরা পুরোটা পড়তে পারেন http ESTIMATING DEMOCIDE: METHODS AND PROCEDURES রুমেলের পদ্ধতি অনুসারে প্রাপ্ত মৃতের সংখ্যাকে আরো সাব গ্রুপে ভাগ করতে হবে যেমন জেলা ওয়ারী, নারী পুরুষ অনুযায়ী এরপর প্রয়োজনে ধর্ম বা জাতি অনুযায়ী; ফলে একটা গ্রহণযোগ্য সংখ্যায় উপনিত হওয়া যায়। এটা অনেক সময়েই একটা রেঞ্জ, যেমন হলোকাস্টে মৃতের সংখ্যা ৪২ লক্ষ থেকে ৬০ লক্ষ। রুমেল যদিও তিনটা রেঞ্জ দিয়েছেন লো, মিডিয়াম, হাই। কিন্তু সাধারনভাবে দুইটা রেঞ্জ ব্যবহার করা হয়। আমেরিকান সিভিল ওয়ারে ৬-৭ লক্ষ মানুষ নিহত হয়েছিলো। রুমেল তার পদ্ধতিতে কিভাবে এই রেঞ্জটা করা হয় সেটারও একটা মেথড বলে দিয়েছেন। সাম্প্রতিক সিরিয়া যুদ্ধেও এভাবেই মৃতের সংখ্যার হিসাব করা হচ্ছে। ইরাকেও সেভাবেই করা হয়েছে। ইরাক যুদ্ধের নিহতের সংখ্যা নিয়ে গবেষণা পত্র Civilian Death and Injury in the Iraq War, 2003-2013 এই শিরোনামে ২০১৩ তেই প্রকাশিত হয়েছে। আজকে এই ধরণের গবেষণার জন্য ডেটা কালেকশন অনেক সহজ, ৪২ বছর আগে সেটা ছিল না। তবুও সে সময় এই রকম গবেষণার ফলাফলেই ৩০ লক্ষ সংখ্যাটা গ্রহণ করা হয়েছে। তবে ইতিহাসের প্রয়োজনে এবং জনগোষ্ঠীর আবেগের সাথে তাল মিলিয়ে যুদ্ধে মৃতের একটা আইকনিক ফিগার বলা হয় যেমন আমেরিকান গৃহ যুদ্ধে মৃতের সংখ্যা বলা হয় ৬ লক্ষ ২০ হাজার। এটা প্রকৃত সংখ্যা নয়, একটা আইকনিক ফিগার।


বাংলাদেশে অনেকে বলার চেষ্টা করেন যে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ৩০ লক্ষ সংখ্যাটা আন্দাজে বলা হয়েছে। এই অভিযোগটা আসে মুলত জামাত ঘরানার মানুষদের কাছে থেকে। মুক্তিযুদ্ধ সংক্রান্ত কোন আলোচনায় তারা বৈধতা বের করতে পারেনা। কোন যুক্তিতেই তারা কাউকে কনভিন্স করতে পারেনা। তাই তারা মুক্তিযুদ্ধের প্রসঙ্গে মানুষকে কনফিউজ করে দিতে চায়।


মুক্তিযুদ্ধে নিহতের সংখ্যা প্রথমে বিশ্ববাসী জানতে পারে প্রভদায় ৩রা জানুয়ারি ১৯৭২ এ প্রকাশিত রিপোর্ট থেকে।




প্রাভদার সেদিনের পত্রিকা



দুদিন পর এই খবর দৈনিক আজাদিতে ছাপা হয়। শেখ মুজিব লন্ডনে এই সংখ্যাই উল্লেখ করেছিলেন। আর সেটাই হয়ে উঠেছে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের আইকনিক ফিগার।



শেখ মুজিব দেশে ফিরে দলের নেতাদের গণহত্যার তথ্য জমা দিতে বলেছিলেন। সেই তথ্য কোথায় জমা পড়েছিল বা আদৌ কোথাও জমা আছে কিনা সেটা কারো আজ জানা নেই।



তবে ৩০ লক্ষের হিসাব নিখুতভাবে দেয়া আছে একটি বইয়ে যেটা আন্তর্জাতিকভাবে গৃহীত। আসুন আমরা দেখি।




রুমেল তার STATISTICS স্টাটিস্টিক্স অব ডোমিসাইড বইয়েরStatistics Of Pakistan's Democide Estimates, Calculations, And Sources ৮ম চ্যাপ্টারে মুক্তিযুদ্ধে জেলাওয়ারি শহীদের সংখ্যা, পর্যাপ্ত রেফারেন্স সহ গ্রথিত করেছেন। এই ৩০ লক্ষের বিষয়টা সেখানেই আছে। এই বইটিতে শুধু বাংলাদেশ নয় ভিয়েতনাম যুদ্ধ পর্যন্ত সকল গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক যুদ্ধের পরিসংখ্যান দেয়া আছে। এবং এই বইটি একটা বিশ্বব্যাপী গৃহীত গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক রেফারেন্স।



ছবিটা বড় করে দেখতে চাইলে ক্লিক করুন

সেই বইয়ের হিসাবের ৮২ নং রো এর ১১ নম্বর কলামে দেখুন ৩০ লক্ষ সংখ্যাটা জ্বলজ্বল করছে। এই টেবিলের প্রত্যেকটা সংখ্যার রেফারেন্স দেয়া আছে। এই সংখ্যাটা হাওয়া থেকে আসেনি। এই মাটিতেই মিশে আছে তাদের রক্ত, এই মাটিতেই তাঁরা কান পেতে আছে মানুষের মুক্তির সংবাদ আর সংগ্রামের বিজয়ের বিউগল ধ্বনি শোনার জন্য।

শান্তিতে ঘুমাও প্রিয় শহীদ, আমরা আমাদের কর্তব্য বিস্মৃত হইনি।
সর্বশেষ এডিট : ২৩ শে ডিসেম্বর, ২০১৫ রাত ১১:৩৫
৩২টি মন্তব্য ৫টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ছি , অবৈধ দখলদার॥ আজকের প্রতিটি অন‍্যায়ের বিচার হবে একদিন।

লিখেছেন ক্লোন রাফা, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:১০



ধিক ‼️বর্তমান অবৈধভাবে দখলদার বর্তমান নরাধমদের। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশে । বীর মুক্তিযোদ্ধাদের ক্ষমা চাইতে হলো ! রাজাকার তাজুলের অবৈধ আদালতে। এর চাইতে অবমাননা আর কিছুই হোতে পারেনা।... ...বাকিটুকু পড়ুন

আম্লিগকে স্থায়ীভাবে নিষিদ্ধে আর কোন বাধা নেই

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:২২


মঈন উদ্দিন ফখর উদ্দিনের ওয়ান-ইলেভেনে সরকারের ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে ভারতের সহায়তায় পাতানো নির্বাচনে হাসিনা ক্ষমতায় বসে। এরপরই পরিকল্পিত উপায়ে মাত্র দুই মাসের মধ্যে দেশপ্রেমিক সেনা অফিসারদের পর্যায়ক্রমে বিডিআরে পদায়ন... ...বাকিটুকু পড়ুন

মিশন: কাঁসার থালা–বাটি

লিখেছেন কলিমুদ্দি দফাদার, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৯:২৭

বড় ভাই–ভাবীর ম্যারেজ ডে। কিছু একটা উপহার দেওয়া দরকার। কিন্তু সমস্যা হলো—ভাই আমার পোশাক–আশাক বা লাইফস্টাইল নিয়ে খুবই উদাসীন। এসব কিনে দেওয়া মানে পুরো টাকা জ্বলে ঠালা! আগের দেওয়া অনেক... ...বাকিটুকু পড়ুন

আওয়ামী লীগের পাশাপাশি জামায়াতে ইসলামীকেও নিষিদ্ধ করা যেতে পারে ।

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১২:৪৫


বাংলাদেশে আসলে দুইটা পক্ষের লোকজনই মূলত রাজনীতিটা নিয়ন্ত্রণ করে। একটা হলো স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি এবং অন্যটি হলো স্বাধীনতার বিপক্ষ শক্তি। এর মাঝে আধা পক্ষ-বিপক্ষ শক্তি হিসেবে একটা রাজনৈতিক দল... ...বাকিটুকু পড়ুন

J K and Our liberation war১৯৭১

লিখেছেন ক্লোন রাফা, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:০৯



জ্যাঁ ক্যুয়ে ছিলেন একজন ফরাসি মানবতাবাদী যিনি ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইন্সের একটি বিমান হাইজ্যাক করেছিলেন। তিনি ৩ ডিসেম্বর, ১৯৭১ তারিখে প্যারিসের অরলি... ...বাকিটুকু পড়ুন

×