somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

বাংলাদেশ ও সাম্প্রদায়িকতাঃ একটি নতুন পাঠ ও বিশ্লেষণ

১০ ই ডিসেম্বর, ২০১৩ বিকাল ৫:৩৪
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

মাসুদ রানা তাঁর অসাম্প্রদায়িক চেতনা শিরোনামে দুই পর্বের লেখায় দেখিয়েছিলেন, “সাম্প্রদায়িক' হতে হলে বিভিন্ন ধর্মীয় ও জনজাতিক সম্প্রদায়ের মধ্যে ক্ষমতার দ্বন্দ্ব-সংঘাত প্রয়োজন। ভারতবর্ষে হিন্দু-মুসলমানের বাস অনেক দিনের। কিন্তু “কম্যুনাল” শব্দ তখনই রাজনৈতিক ভাষ্যে এসেছে, যখন ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনামলে সংখ্যাগুরু হিন্দুর সাথে সংখ্যালঘু মুসলমান ক্ষমতার প্রশ্নে বিরোধে লিপ্ত হয়েছে। এই ভূখণ্ডের সাম্প্রদায়িক সংঘাতের ইতিহাস বলতে গিয়ে তিনি বলেছেনঃ
"পাকিস্তান সৃষ্টির কালে এদেশে হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে যে-সাম্প্রদায়িক দ্বন্দ্ব ও সংঘাত হয়েছে, তাতে হিন্দুরা পরাস্ত হয়ে ব্যাপক সংখ্যায় দেশত্যাগ করেছেন। এমনকি ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়েও তাঁদের অবস্থার পরিবর্তন হয়নি। তাঁরা আর কখনও ১৯৪৭-পূর্ব অবস্থায় ফিরে যেতে পারেননি। স্বাধীন বাংলাদেশে হিন্দু ও অন্যান্য সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের অবস্থা দিন-দিন আরও প্রান্তিক হচ্ছে। সম্প্রদায়গত ভাবে রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব-সংঘাতে প্রবৃত্ত হবার মতো জনের ও মনের শক্তি এঁদের নেই।
পাকিস্তানী অভ্যন্তরীণ ঔপনিবেশিক আমলে সাম্প্রদায়িক সংঘাত হয়েছে প্রধানতঃ বাঙালীর সাথে বিহারীর। এর ভিত্তি ধর্ম নয়, কারণ বিহারী সম্প্রদায়ও ছিলো মুসলমান। বাঙালী-বিহারী সাম্প্রদায়িক সংঘাতের ভিত্তি ছিলো তাঁদের জনজাতিক ভিন্নতা। বিহারী সম্প্রদায় সংখ্যালঘু হলেও এঁদের পেছনে পাকিস্তান রাষ্ট্রের পক্ষপাত ছিলো। তাই, বিহারী সম্প্রদায়ের অধিকাংশ লোক ১৯৭১ সালের বাঙালীর মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর সহযোগী হিসেবে বাঙালী নিধনে ভূমিকা রেখেছেন। পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে বাঙালীর বিজয়ের মধ্য দিয়ে বিহারী সম্প্রদায় সম্পূর্ণ পরাস্ত হয়। এই সম্প্রদায়ের একটি ক্ষুদ্র অংশকে নিধন করা হয়েছে, একটি অংশ পাকিস্তানে চলে গিয়েছে, আর অবশিষ্টাংশ বাংলাদেশ প্রান্তিক হয়ে অবস্থান করছে।

বাংলাদেশে এই মুহূর্তে সাম্প্রদায়িক সংঘাত হচ্ছে প্রধানতঃ পার্ব্বত্য চট্টগ্রামে রাষ্ট্র-সমর্থিত বাঙালীর সাথে পাহাড়ী সম্প্রদায়গুলোর। এর মধ্যে জনজাতিক ও ধর্মীয়, এই দুটো উপাদনই বর্তমান, যদিও প্রথমটিই প্রধান। তবে এই সংঘাত ভৌগলিকভাবে পার্বত্য চট্টগ্রামে সীমাবদ্ধ। জাতীয় পর্যায়ে পরিব্যাপ্ত নয়। কারণ, পাহাড়ী সম্প্রদায়গুলো জাতীয় রাজনৈতিক ক্ষমতার প্রশ্নে বাঙালীর সাথে দ্বন্দ্বে লিপ্ত নয়।"

মাসুদ রানার বিশ্লেষণের সাথে আমি একমত। তবে এতেই শেষ নয়, বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িকতা শুধু ধর্ম বা জনজাতি এই বলয়ে আবদ্ধ নেই। সাম্প্রদায়িকতা এবং সম্প্রদায়-ভিত্তিক বিভাজন আরো গভীরে প্রবেশ করেছে। বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িকতাকে বুঝতে হলে আমাদেরও তাই বিষয়টির আরও একটু গভীরে প্রবেশ করতে হবে।
এ-ভূখণ্ডের মানুষ এখন আত্মপরিচয়ের সংকটে ভুগেছে। ১৯৪৭-এ একবার 'মুসলিম' পরিচয়ে পরিচিত হয়েছে, ১৯৭১-এ আবার 'বাঙালী' পরিচয় গ্রহণ করেছে। বাঙালী আইডেণ্টিটির ঐতিহাসিক ব্যর্থতা ও ক্রাইসিস '৭১-এ তার আত্মপরিচয়কে থিতু হতে দেয়নি। মুক্তিযুদ্ধের পরে 'বাঙালী' প্রকরণ যে 'সেন্স' মেইক করার কথা ছিল, আমাদের রাষ্ট্রনায়কদের ঐতিহাসিক ভুলগুলোর কারণে সেটা আর হয়ে উঠতে পারেনি। বাঙালী আত্মপরিচয় দিয়ে বিশ্ব সংসারে যে-মর্যাদার আসন সে দাবী করতে পারতো সেটা তার হয়ে ওঠা হয়নি। মানুষ যেহেতু কগনিটিভ অনিশ্চিয়তা ও কফিউশনের মধ্যে থাকতে পারে না তাই সে তার আলাদা আত্মপরিচয় খুঁজে নিতে চায়। বৃহৎ-এর মধ্যে যখন উদ্দেশ্য সিদ্ধ হয় না, তখন আসে ক্ষুদ্রতর পরিচিতির প্রয়োজন।

একজন মানুষের নানা পরিচয়ের বৃত্ত থাকতে পারে, সে তার কোন একটা সুনির্দিষ্ট পরিচয়কে প্রধান এবং নির্ধারক পরিচয় মনে করবে সেই পরিচয়টাকে, যা তাকে তুলনামুলকভাবে একটা সুবিধাজনক পরিচয় দেবে। একটি আন্তর্জাতিক ভোজসভায় একজন বাঙ্গালী মুসলিম এবং একজন ইউরোপীয় ইহুদী যদি আবিষ্কার করেন যে দু'জনেই ডায়াবেটিক তবে সে-ভোজ পর্বে তাদের সব আত্মপরিচয় উবে গিয়ে তাঁরা দু'জনে ডায়াবেটিক হয়ে তাদের দু'জনের জন্য স্বাস্থ্যসম্মত খাবার খুঁজে নেয়ার ক্ষেত্রে এক অভূতপূর্ব মানসিক বন্ধন গড়ে তুলবেন।

মুক্তিযুদ্ধের পর থেকে বাঙ্গালী আত্মপরিচয়কে প্রধান এবং অন্যান্য পরিচয় হিসেবে তৈরি করার বদলে, আমরা ক্রমাগত ক্ষুদ্র এবং ক্ষুদ্রতর আত্মপরিচয় গড়ে তুলেছি। তৈরি করেছি অসংখ্য সম্প্রদায়। এই সম্প্রদায় সৃষ্টিতে বিস্ময়জনক ভাবে রাষ্ট্র সহায়ক ভুমিকা নিয়েছে। জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এলাকা ভিত্তিক আসনে নির্বাচিত হয়ে এসে একজন এমপি কার্যতঃ সেই এলাকার গোষ্ঠীপতির মতো আচরণ করেন, রাষ্ট্র ও তাকে প্রয়োজনীয় লজিস্টিক সাপোর্ট দিয়ে যায়; দুঃস্থ মাতার গম, স্কুল কলেজের পরিচালনা কমিটির সভাপতি, এলাকার উন্নয়নে সম্পৃক্তি ইত্যাদি। একজন এমপির বাংলাদেশ নামের ভূখণ্ডের সকল মানুষের প্রতিনিধিত্ব করার নৈতিক জমিনটুকু তাঁর পায়ের নিচ থেকে সরিয়ে ফেলা হয়। নতুন সরকার গঠিত হলে প্রায়শই দেখা যায় কোন জেলা কয়টা মন্ত্রী পেয়েছে সেটার হিসাব। কম মন্ত্রী পাওয়া জেলাগুলির বিক্ষোভ উস্কে দেয়ার কাজে লিপ্ত থাকেন ক্ষমতা প্রত্যাশী নেতা। যিনি একজন আঞ্চলিক নেতা হয়ে গিয়ে বৃহত্তর রাষ্ট্রে তার ক্ষমতার হিস্যা নেবার জন্য নিজস্ব সম্প্রদায় গড়ে তোলেন। সেই সম্প্রদায়ের সাম্প্রদায়িক ঐক্যকে এবং অন্য সম্প্রদায়ের সাথে তার সাম্প্রদায়িক বিভাজনের উপাদান গুলোকে নিজের ক্ষুদ্র স্বার্থ-সিদ্ধিতে ক্রমাগত ব্যবহার করার জন্য টিকিয়ে রাখেন এবং সময়ে-সময়ে উস্কে দেন।

এভাবেই গড়ে ওঠে কখনো বগুড়াবাসী বা কখনো চাদপুরবাসীদের নামে অসংখ্য সংগঠন। লক্ষ্য করার বিষয় যে, এ-সংগঠনগুলো সামাজিকতার জন্য নয় বরং রাজনৈতিক শক্তি সংহত এবং বৃদ্ধি করার উদ্দেশ্যেই ব্যবহার করা হয়। এবং প্রায়শঃই এ-সংগঠনগুলোর উদ্যোক্তা একজন রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষী ব্যক্তি হয়ে থাকেন।

সাম্প্রতিক সময়ে শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ে সিলেটবাসীদের জেলা কোটার দাবীতে সিলেটবাসী সকল রাজনৈতিক দলের একটি সাম্প্রদায়িক ঐক্য দেখেছি। যেই সিলেটী সম্প্রদায় একসাথে বাংলাদেশ নামের রাষ্ট্রের কাছে তার সম্প্রদায়ের হিস্যা আদায়ের জন্য একজোট হয়েছে।

এ-বিষয়টা আরো একটু গভীরে বোঝার জন্য, একটা প্রাসঙ্গিক সাক্ষ্য অত্যন্ত প্রণিধানযোগ্য; কয়েকদিন আগে মানবতা-বিরোধী অপরাধের দায়ে দণ্ডিত আসামী সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীকে জেরা করেন রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলি জেয়াদ আল-মালুম। জেরায় রাষ্ট্রপক্ষের কৌসুলি মতামত (সাজেশন) দেন, "চট্টগ্রামের রাউজান থানার গহিরা গ্রামে ১৯৪৯ সালের ১৩ মার্চ বাঙালি মুসলিম পরিবারে আপনার জন্ম।" সাকা চৌধুরী বলেন, "এটা সত্য নয়। আমার জন্ম চট্টগ্রাম শহরের একটি মুসলিম পরিবারে, বাঙালি পরিবারে নয়।" মালুম বলেন, "আপনার মাতৃভাষা বাংলা।" সাকা চৌধুরী বলেন, এটা সত্য নয়। আমার মাতৃভাষা চাটগাইয়া।’

মালুম মত দেন, "আপনার ও আপনার বাবার জন্মের বহু আগে থেকে চট্টগ্রাম বাংলার অংশ ছিল, কখনোই চট্টগ্রাম বা চট্টগ্রামবাসী আলাদা জাতিসত্তা হিসেবে স্বীকৃত ছিল না। এই ঐতিহাসিক বাস্তবতা জানা সত্ত্বেও সত্য গোপন করে আপনি ট্রাইব্যুনালে উদ্দেশ্য প্রণোদিতভাবে অসত্য বক্তব্য দিয়েছেন।" সাকা চৌধুরী বলেন, "এটা সত্য নয়। আইনের মাধ্যমে জাতিসত্তার স্বীকৃতি পাওয়া যায়, এ ধরনের বক্তব্য গ্রহণযোগ্য নয়।"

এই সাক্ষ্যটি বেশ কৌতূহল উদ্দীপক। এখানে সাকা চৌধুরী সম্পূর্ণ আলাদা একটি সম্প্রদায়ভুক্ত বলে নিজেকে দাবী করছেন, যা বাঙালী তো নয়ই, এমনকি বাংলাদেশীও নয় - তা হচ্ছে 'চাঁটগাইয়া' এবং তার ভাষা বাংলা নয়, চাঁটগাইয়া। এটি বাংলাদেশের আদালতে দেয়া সাক্ষ্য এবং সাক্ষ্যদান-কালে তিনি বাংলাদেশের জাতীয় সংসদের সদস্য ছিলেন। তার অপরাধ এমনই ঘৃণ্য আর ক্ষমাহীন যে তার কোন ধরণের সঙ্ঘভুক্তি তাকে শাস্তি থেকে রক্ষা করতে পারবেনা। তার নিজের দল বিএনপি; যে-দল থেকে তিনি এমপি নির্বাচিত হয়েছিলেন তারাও তার পাশ দাঁড়াতে দ্বিধান্বিত। এ-ক্ষেত্রে তিনি স্বাভাবিকভাবেই আঞ্চলিকতার আশ্রয় নিতে চেয়েছেন। যে-ভাবে আরেক ঘৃণ্য স্বৈরশাসক 'হামার ছাওয়াল' উপাধি পেয়ে রংপুরবাসীর নিরাপদ আশ্রয় পেয়ে রাজনীতিতে পুনর্বাসিত হয়েছিলেন।

মুক্তিযুদ্ধের পর থেকেই এ-দেশের রাজনীতিবিদরা সর্বজনীন আবেদন সৃষ্টি করতে পারে এমন আত্মপরিচয়কে শক্তিশালী করার কৌশল না নিয়ে আঞ্চলিক নেতা হয়েই তৃপ্ত থেকেছেন। সাম্প্রদায়িক ক্ষুদ্রায়নের বিরুদ্ধে সচেতন ছিলেন মহাত্মা গান্ধী। এই প্রসঙ্গে একটি ঘটনার উল্লখ করা যায়; ১৯৩১ সালে ব্রিটিশ সরকারের ডাকা ইণ্ডিয়ান রাউন্ড টেবিল কনফারেন্সে যোগ দিতে মহাত্মা গান্ধী লণ্ডনে গিয়ে আবিষ্কার করেন তাঁকে বসানো হচ্ছে বর্ণ হিন্দু'-দের জন্য নির্ধারিত আসনে। গান্ধী ক্ষুব্ধ হয়ে বলেন, তিনি হিন্দু, কিন্তু তিনি যে-রাজনৈতিক আন্দোলনের নেতা তা আপোষহীন ভাবে সর্বজনীন এবং কোনো সম্প্রদায়-ভিত্তিক আন্দোলন নয়।

আত্মপরিচয়ের ক্ষুদ্রায়ন আরেক সমস্যার জন্ম দিয়েছে। এই ক্ষুদ্র আত্মপরিচয় নিয়ে রাষ্ট্রের সীমানায় সফল হলেও সেটা দিয়ে বৃহতের সাথে মোকাবেলা করা যায় না। চাঁটগাইয়া পরিচয়ে পৃথিবীর সামনে দাড়িয়ে কিছুই দাবী করা যায়না। তখন প্রয়োজন পড়ে আরেকটি বৃহৎ আত্মপরিচয়ের যেটা বাঙালী নয়, এমনকি বাংলাদেশীও নয়; যা সাকার ভাষায় 'মুসলিম পরিবার'। এভাবেই ক্ষুদ্র এবং ক্ষুদ্রতর আত্মপরিচয়ের পাশে শক্তিশালী হয়ে উঠতে থাকে ধর্মীয় আত্মপরিচয়।

আমরা অবশ্যই বিভিন্ন মানুষ, এবং পছন্দ অপছন্দের নানা সমষ্টির অংশ। আমাদের ধর্ম, নাগরিকত্ব, বাসস্থান, ভাষা, জন্মসুত্র, লিঙ্গ, শ্রেণী, রাজনীতি, জীবিকা, খাদ্যাভ্যাস, প্রিয় খেলা, অবসর কাটানোর উপায় ইত্যাদি নানা পরিচয়মাত্রায় আমরা বিভিন্ন গোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত। একজন ব্যক্তি একই সময় অনেক পরিচয়ের সাথে একই সাথে যুক্ত। এর মধ্যে যখন কোন একটি পরিচিতি ব্যক্তির আত্মপরিচয়ের অনন্য এবং একক উপাদান হয়ে যায় তখন তার আত্মপরিচয়ের অন্যান্য উপাদানগুলি উপেক্ষিত হয়, সেগুলোর বিকাশ ব্যহত হয়। পরিণতিতে পূর্নাঙ্গ মানুষ হয়ে ওঠা কষ্টকর হয়ে পড়ে।
প্রশ্ন আসা স্বাভাবিক, 'বাঙালী' পরিচয় ধারণ করে মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ী হয়ে জাতি-রাষ্ট্র গঠনের পরও 'বাঙালী' প্রকরণ কেন নতুন রাষ্ট্রে 'সেন্স' মেইক করতে পারলো না? কারণ, বাঙালী পরিচয়ের মধ্যে ধর্মনিরপেক্ষতার উপাদান শাসকদের জন্য সবসময়েই বিপদ্‌জনক। ইতিহাস প্রমাণ করেছে, বাঙালী শাসকরা নাগরিকগণের উপরে সর্বজনীন রাজনৈতিক আদর্শের আধিপত্য বা 'হেজিমনি' তৈরিতে সফল হননি। যেহেতু, ধর্মের একটি আপাতঃ সর্বজনীন আবেদন আছে তাই হেজিমনিক টুল হিসেবে ধর্মের ব্যবহার এই ভূখণ্ডের শাসকদলের কাছে একটা জনপ্রিয় এবং কার্যকর মাধ্যম হিসেবে বিবেচিত হয়েছে। যখনই শাসক হেজিমনির সংকটে পড়েছে তখন আশ্রয় খুঁজেছে ধর্মের কাছে। উদাহরণ হিসেবে মুজিব, জিয়া, এরশাদ এবং হাল আমলের হাসিনা-খালেদার শাসনকাল থেকে অসংখ্য দৃষ্টান্ত টানা সম্ভব। তাই, ধর্মনিরপেক্ষ বাঙালী আত্মপরিচয় হিসেবে সফল এবং কার্যকর হলে ধর্মকে হেজিমনিক টুল হিসেবে ব্যবহার করার উপায় বন্ধ হয়ে যায়। সেটা শাসকেরা কখনো চায়নি।

এই ভূখণ্ডে সাম্প্রদায়িকতা নিয়ে রাজনীতি চলেছে গত শতাব্দীর প্রথম ভাগ থেকেই কিন্তু এর সঠিক তত্ত্ব-তালাশ করতে বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে 'সিরিয়াস' কোনো ডিস্‌কৌর্স নেই। সাম্প্রদায়িতা বলতে এখানে শুধু মোটা দাগে হিন্দু-মুসলিম সমস্যাকেই বুঝানো হয়ে থাকে। কিন্তু উপরের আলোচনায় আমরা দেখালাম, সাম্প্রদায়িকতার অনেক রূপ আছে - আছে ক্ষমতা-কাঠামোর সাথে তার ঘনিষ্ট সম্পর্ক। ক্ষমতার প্রশ্নে নানা ধরনের প্রচ্ছন্ন সাম্প্রদায়িকতা আমাদের ক্রমশ আচ্ছন্ন করছে, নানা ধরণের ক্ষুদ্র সাম্প্রদায়িক পরিচয়ের জন্ম নিচ্ছে আর তার বিকাশও ঘটছে। আমাদের উদ্ভাবিত স্থানিক সাম্প্রদায়িকতা আভ্যন্তরীন রাজনীতিতিকে আঞ্চলিকতাবাদের দিকে ধাবিত করছে এবং বৃহত্তর পরিসরে সেই স্থানিক সাম্প্রদায়িকতা কার্যকর থাকতে না পেরে নাগরিকদের ধর্মীয় পরিচয়কে প্রধান করে তুলছে।

সাম্প্রদায়িকতার অচলায়তন ভাঙ্গতে হলে এ-ভূখণ্ডের মানুষের বৃহত্তর ধর্মনিরপেক্ষ মহৎ আত্মপরিচয়ের উপাদানগুলোকে শক্তিশালী করা ছাড়া আর কোন সহজ পথ নেই। এই কাজটিই বাঙালী পরিচয়ের সকল প্রগতিশীল শক্তির প্রধান কর্তব্য হবার উপযোগিতা রাখে।

(লেখাটি ১ লা ডিসেম্বর ইউ কে বেঙ্গলিতে প্রকাশিত। লিঙ্ক Click This Link)
সর্বশেষ এডিট : ১০ ই ডিসেম্বর, ২০১৩ বিকাল ৫:৩৫
১টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

সবুজের মাঝে বড় হলেন, বাচ্চার জন্যে সবুজ রাখবেন না?

লিখেছেন অপলক , ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:১৮

যাদের বয়স ৩০এর বেশি, তারা যতনা সবুজ গাছপালা দেখেছে শৈশবে, তার ৫ বছরের কম বয়সী শিশুও ১০% সবুজ দেখেনা। এটা বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থা।



নব্বয়ের দশকে দেশের বনভূমি ছিল ১৬... ...বাকিটুকু পড়ুন

আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে লীগ আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে জামাত

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৪৬


বাংলাদেশে রাজনৈতিক ছদ্মবেশের প্রথম কারিগর জামাত-শিবির। নিরাপত্তার অজুহাতে উনারা এটি করে থাকেন। আইনী কোন বাঁধা নেই এতে,তবে নৈতিক ব্যাপারটা তো অবশ্যই থাকে, রাজনৈতিক সংহিতার কারণেই এটি বেশি হয়ে থাকে। বাংলাদেশে... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাঙ্গালির আরব হওয়ার প্রাণান্ত চেষ্টা!

লিখেছেন কাল্পনিক সত্ত্বা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:১০



কিছুদিন আগে এক হুজুরকে বলতে শুনলাম ২০৪০ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে নাকি তারা আমূল বদলে ফেলবেন। প্রধানমন্ত্রী হতে হলে সূরা ফাতেহার তরজমা করতে জানতে হবে,থানার ওসি হতে হলে জানতে হবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

সেকালের পাঠকপ্রিয় রম্য গল্প "অদ্ভূত চা খোর" প্রসঙ্গে

লিখেছেন নতুন নকিব, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:৪৩

সেকালের পাঠকপ্রিয় রম্য গল্প "অদ্ভূত চা খোর" প্রসঙ্গে

চা বাগানের ছবি কৃতজ্ঞতা: http://www.peakpx.com এর প্রতি।

আমাদের সময় একাডেমিক পড়াশোনার একটা আলাদা বৈশিষ্ট্য ছিল। চয়নিকা বইয়ের গল্পগুলো বেশ আনন্দদায়ক ছিল। যেমন, চাষীর... ...বাকিটুকু পড়ুন

অবিশ্বাসের কি প্রমাণ আছে?

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩১



এক অবিশ্বাসী বলল, বিশ্বাসের প্রমাণ নাই, বিজ্ঞানের প্রমাণ আছে।কিন্তু অবিশ্বাসের প্রমাণ আছে কি? যদি অবিশ্বাসের প্রমাণ না থাকে তাহলে বিজ্ঞানের প্রমাণ থেকে অবিশ্বাসীর লাভ কি? এক স্যার... ...বাকিটুকু পড়ুন

×