somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

কেন বাংলাদেশী রোগীরা ভারতীয় চিকিৎসকের চিকিৎসায় অধিকতর সন্তস্ট হয়? একটি ব্যক্তিগত অনুসন্ধান।

২৩ শে মে, ২০১৫ রাত ১:৫১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

আমার কাছে সব সময়ই এটা একটা ধাঁধা ছিল কেন বাংলাদেশের রোগীরা ভারতে চিকিৎসা করতে যায়? কেন বাংলাদেশের চিকিৎসকদের নামে এতো অভিযোগ? কেনই বা চিকিৎসা প্রার্থী রোগীদের বিদেশ গামী মিছিল ক্রমবর্ধমান?


এই বিষয়ে একটা ইন্টারেস্টিং আলাপ করার সুযোগ হল আমার দুই সহপাঠীর সঙ্গে। যারা বাংলাদেশে চিকিৎসক হিসেবে প্রশিক্ষিত, বাংলাদেশেও ডাক্তারি করেছে এবং এখন ভারতে ডাক্তারি করছে। এই দারুণ অভিজ্ঞতা পরিস্থিতির মূল্যায়নে কাজে লাগতে পারে জন্য ওদের এই একই প্রশ্ন জিজ্ঞেস করলাম। দুজনেই দুই দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা এবং চিকিৎসার মান নিয়ে সম্পূর্ণ ওয়াকিবহাল। আমি দুজনের নাম উল্লেখ করছিনা, দুজনেই ক্যান্সার বিশেষজ্ঞ। একজন ভারতের একটি নামকরা ক্যান্সার হাসপাতালের বোন ম্যারো ট্র্যান্সপ্লান্ট ইউনিটের প্রধান এবং আরেকজন হেড অ্যান্ড নেক ক্যান্সার বিশেষজ্ঞ।

প্রথমেই দুজন বলে নিল, "যে সাধারণভাবে পশ্চিমবঙ্গে বাঙালি চিকিৎসকদের মান সর্বভারতীয় মান থেকে অনেক পিছিয়ে। তারপরেও সেটা বাংলাদেশের সার্বিক মান থেকে ভালো।" আমি জানতে চাই, ঠিক কোথায় কোথায় ভালো? কেন ভালো?

আমার হেড অ্যান্ড নেক ক্যান্সার বিশেষজ্ঞ বন্ধু বলতে শুরু করলো।

১/ আমরা এখানে এককভাবে কোন চিকিৎসা সিদ্ধান্ত নেই না। হেড অ্যান্ড নেক ক্যান্সারে সেটা নেয়ার সুযোগ নেই। আমরা একসাথে রেডিয়েশন অনকোলজি, মেডিক্যাল অনকোলজি আর সার্জিক্যাল অনকোলজি বিশেষজ্ঞ একসাথে রোগী দেখি প্ল্যান অব ট্রিটমেন্ট একসাথে করি আর রোগী এবং রোগীর সাথের মানুষকে একসাথে কাউন্সেল করি। আমরা ব্যাড নিউজ চেপে রাখিনা। যেই রোগীর ভালো হওয়ার সম্ভাবনা আছে তাঁর চিকিৎসা শুরু করার জন্য উৎসাহিত করি, আর যেই রোগী ভালো হবেনা তাঁর শুধু ব্যাথা বেদনা উপশমের চিকিৎসা করার উপদেশ দেই। সেকারনেই রোগী একেকজনের কাছে থেকে একেকরকম সাজেশন পায়না। ফলে রোগী বা রোগীর মানুষ বিভ্রান্ত হয়না।

২/ রোগীর পুর্নাংগ চিকিৎসায় কত টাকা খরচ হবে সেটার ধারনা দেই। রোগীর যদি সেই আর্থিক সামর্থ্য না থাকে তবে আমরা সেই রোগীর চিকিৎসা শুরু করিনা। কারণ চিকিৎসা শুরু করে মাঝপথে থেমে যাওয়ার কোন অর্থ নেই।

এবার দুজনেই বলতে শুরু করলো। আরো কিছু বিষয় আছে যেগুলো ভারতীয় চিকিৎসকদের আলাদা দক্ষতা তৈরি করেছে। যেমন সুপার স্পেসালাইজেশন। ধরা যাক একজন ক্যান্সার সার্জন বা অনকোলজি সার্জন হতে চান। তাঁকে আগে জেনারেল সার্জারিতে পৌস্ট গ্রাজুয়েশন করে তার পরে ক্যান্সার সার্জারিতে সুপার স্পেসালাইজেশন করতে হবে। এম বি বি এসের পর মোট সময় লাগবে কমপক্ষে ছয় বছর। বাংলাদেশে সুপার স্পেসালাইজেশনের এই ব্যবস্থা নেই। কেউ কেউ ব্যাক্তিগতভাবে এভাবেই সুপার স্পেসালাইজেশন করে থাকেলও প্রাতিষ্ঠানিক ভাবে জেনারেল সার্জারি না করেও কেউ কেউ ইউরোলজি সার্জন হয়ে যেতে পারে। এবং সেটাই হচ্ছে। যেমন বাংলাদেশে মেডিসিনে স্পেসালাইজেশন না করেও যে কেউ বক্ষ ব্যাধি বিশেষজ্ঞ হয়ে যেতে পারেন। এর ফলে যেটা হয়; সেটা হচ্ছে সুপার স্পেসালাইজেশনের সুফল বাংলাদেশের রোগী বেশীর ভাগ ক্ষেত্রেই পায়না। পৃথিবীর কোন দেশে এভাবে কেউ সুপার স্পেসালাইজেশন ডিগ্রি নিতে পারেনা, বাংলাদেশ ছাড়া। আগে মেডিসিন স্পেশালিষ্ট না হয়ে কার্ডিওলজিতে ডিগ্রি নেয়া পৃথিবীর যে কোন দেশে এখন অসম্ভব।

বাংলাদেশে এম বি বি এসের পরে রাষ্ট্র ডাক্তারদের লেখাপড়ার কোন দায়িত্ব নেয়না। যারা সরকারি চাকরিতে ঢুকল তারা বাধ্যতামূলক দুই বছর গ্রামে কাটানোর পরে পৌস্ট গ্রাজুয়েশনে ঢোকার সুযোগ পায়। আর ভারতে যারা নিজস্ব মেধায় পৌস্ট গ্রাজুয়েশনে ভর্তির সুযোগ পায় তাঁরা মাসে ভারতীয় টাকায় ৫০ হাজার রুপি ভাতা পায়। তাই লেখাপড়া ছাড়া আর কোন কিছুর চিন্তা করতে হয়না তাঁদের। আর বাংলাদেশে বেসরকারি ডাক্তাররা রাত্রে নাইট ডিউটি করে সকালে পৌস্ট গ্রাজুয়েশনের ক্লাস করতে যায়। দুই জনের আউট কাম তো একরকম হবেনা।

ভারতে সদ্য পাশ করা ডাক্তার যদি একটা যে সে ক্লিনিকেও কাজ করে তবে তাঁর বেতন হয় মাসে ৪০ হাজার রুপি। বাংলাদেশে কোথাও সদ্য পাশ করা ডাক্তার এই বেতন পায়না। আমার পাওয়া তথ্য যদি সঠিক হয়ে থাকে তবে বাংলাদেশী মুদ্রামানে ভারতীয় চিকিৎসকদের এক তৃতীয়াংশ টাকা বেতন পায় বাংলাদেশের সদ্য পাশ করা মেডিক্যাল গ্র্যাজুয়েটরা।

ভারতে মেডিক্যাল এডুকেশনের কোয়ালিটি কন্ট্রোল আরেকটা বিষয়। সরকারি মেডিক্যাল কলেজ গুলোকেও দুই বছরের জন্য মাত্র ছাত্র ভর্তির অনুমতি দেয়া হয়। দুই বছর পরে আবার ইন্সপেকশন হবে, সেই ইন্সপেকশনে কোয়ালিফাই করলে আবার পরবর্তী দুই বছরের জন্য ছাত্র ভর্তির অনুমতি দেয়া হবে। ভারতে অনেক নামকরা সরকারি মেডিক্যাল কলেজের ছাত্র ভর্তির অনুমতি মাঝে মাঝেই বাতিল হয়ে যায়।

আরেকটা বিষয় হচ্ছে ভারতের ডাক্তারদের অ্যাকাউন্টেবিলিটি। ভোক্তা অধিকার সেখানে রাষ্ট্র দারুনভাবে সংরক্ষণ করে। চিকিৎসা অবহেলার অভিযোগে রাষ্ট্র রোগী বান্ধব অবস্থান নেয়, ফলে চিকিৎসকেরা একটা নিয়ত চাপের মধ্যে থাকে এবং নলেইজ আপ ডেইট থেকে শুরু করে ও অতি সতর্কতার সঙ্গে রোগীর চিকিৎসা চালায়। আমার সেই বন্ধুদের হাসপাতালে সেই সময়ে ডাক্তারদের বিরুদ্ধে চলমান মামলা ছিল ১১ টি। একটি হাসপাতালেই এই সংখ্যা। সারা ভারতে তাহলে কতগুলি? বাংলাদেশে চিকিৎসা অবহেলায় স্বাধীনতার পরে মাত্র একজন চিকিৎসক শাস্তি পেয়েছে, তাও একজন চাকমা চিকিৎসক। সবচেয়ে ক্ষমতাহীন সম্প্রদায়ের মানুষ, তাই শাস্তি দেয়া সহজ। ভারতে প্রত্যেক বছর অসংখ্য চিকিৎসক শাস্তি পায়।

শেষে আমার বন্ধুটি কয়েকদিন আগেই পাওয়া রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজের একজন প্যাথলজির অধ্যাপকের দেয়া লিম্ফোমার রিপৌর্টের কথা জানালো। তিনি আমাদের দুজনেরই শিক্ষক ছিলেন। তিনি এফ এন এ সি করে লিম্ফোমা বলে রায় দিয়েছেন। আমার বন্ধুটি বলল, “ স্যার এটা জানেন না যে এফ এন এ সি করে লিম্ফোমা ডায়াগনোসিস করা যায়না, ইম্মিউনোহিস্টোকেমিস্ট্রি করতে হয়, এটা আমি মানতে পারিনা। স্যার কে এই কথা কে বুঝাবে?”

আজকের দিনে কোন মানুষ বদ্ধ দুনিয়ায় বাস করেনা। সারা পৃথিবী তাঁর জন্য খোলা। ইন্টারনেট উন্মুক্ত করে দিয়েছে তাঁর সামনে পুরো পৃথিবী। সে নিজেই বিচার করে নিতে পারবে সেরা চিকিৎসাটি সে পাচ্ছে কিনা? বিন্দুমাত্র সন্দেহ দেখা দিলে সে আর সেই চিকিৎসকের কাছে ফিরেও আসবে না। এই হতাশা জনক অবস্থা থেকে পরিত্রাণ পেতে হলে জরুরি ভিত্তিতে বাংলাদেশে চিকিৎসা শিক্ষার এবং সাথে সাথে চিকিৎসা সেবার মান বাড়াতে হবে। আর সেটা না পারলে রোগীর বিদেশ মুখিন মিছিল ঠেকানোর সাধ্য কারো নেই।
সর্বশেষ এডিট : ২৩ শে মে, ২০১৫ বিকাল ৫:২২
২৫টি মন্তব্য ৬টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

হার জিত চ্যাপ্টার ৩০

লিখেছেন স্প্যানকড, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:৩৩



তোমার হুটহাট
চলে আসার অপেক্ষায় থাকি
কি যে এক ছটফটানি
তোমার ফিরে আসা
যেন প্রিয় কারো সনে
কোথাও ঘুরতে যাবার মতো আনন্দ
বারবার ঘড়ি দেখা
বারবার অস্থির হতে হতে
ঘুম ছুটে... ...বাকিটুকু পড়ুন

জীবনাস্ত

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:৪৪



ভোরবেলা তুমি নিশ্চুপ হয়ে গেলে একদম,
তোমার বাম হাত আমার গলায় পেঁচিয়ে নেই,
ভাবলাম,তুমি অতিনিদ্রায় আচ্ছন্ন ,
কিন্তু এমন তো কখনো হয়নি
তুমি বরফ জমা নিথর হয়ে আছ ,
আমি... ...বাকিটুকু পড়ুন

যে দেশে সকাল শুরু হয় দুর্ঘটনার খবর দেখে

লিখেছেন এম ডি মুসা, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:১১

প্রতি মিনিটে দুর্ঘটনার খবর দেখে অভ্যস্ত। প্রতিনিয়ত বন্যা জলোচ্ছ্বাস আসে না, প্রতিনিয়ত দুর্ঘটনার খবর আসে। আগে খুব ভোরে হকার এসে বাসায় পত্রিকা দিয়ে যেত। বর্তমানেও প্রচলিত আছে তবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমাদের দাদার দাদা।

লিখেছেন নাহল তরকারি, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:৫৫

বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১, ০৮ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী।

আমার দাদার জন্মসাল আনুমানিক ১৯৫৮ সাল। যদি তার জন্মতারিখ ০১-০১-১৯৫৮ সাল হয় তাহলে আজ তার বয়স... ...বাকিটুকু পড়ুন

জেনে নিন আপনি স্বাভাবিক মানুষ নাকি সাইকো?

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:১৮


আপনার কি কারো ভালো সহ্য হয়না? আপনার পোস্ট কেউ পড়েনা কিন্তু আরিফ আর হুসাইন এর পোস্ট সবাই পড়ে তাই বলে আরিফ ভাইকে হিংসা হয়?কেউ একজন মানুষকে হাসাতে পারে, মানুষ তাকে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×