somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

কষ্টের দাবানলে এখন আমিও, চোখের সামনে ঘোটে যাওয়া ঘটনা। আমরাই বুজি অপরাধী - মেয়েটির নাম .......

১৩ ই সেপ্টেম্বর, ২০১১ রাত ৩:৫৪
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

ঘটনাটি আজও ভুলতে পারিনি। মাঝে মাঝেই মনে পরে , তাই ভাবলাম আজ কে লিখেই ফেলি । জানি কখনই ভুলবো না , ভুলতে পারবও না। তবুও সেয়ার করে ভুলে থাকার মিথ্যা চেষ্টা ।

কোন এক দিন আমি স্কুল থেকে বাসায় ফিরছিলাম মামনির হাত ধরে। পেটে প্রচণ্ড খিদে । বাসায় এসেই খাবারের টেবিলের দিকে উকি মারতে মারতে আমার ঘরে ব্যাগ রেখেই ফ্রেশ হয়ে নিলাম তারাতারি কারন খুব খিদে পেয়েছে । আর একটু দেরি করলেই আমি মনে হয় শুঁটকী লেগে যাব, ভাবটা এমন। মামনি কে খুব তাড়া দিচ্ছিলাম আর বির বির করছিলাম কত কষ্ট করে আসলাম , মামনি আমার কষ্টটা একটুও বুজে না । খাবারের টেবিল এত পরিপাটি করবার কি দরকার আগে আমার পেটের কষ্টটা তো দূর করা হোক । আমার একটা খারাব অভ্যাস ছিল সেটা এখনও আছে ; খিদে পেলে সহ্য করতে পারি না। খাবার খেতে খেতে শুনতে পেলাম দরজায় কেউ জোরে জোরে ধাক্কা দিচ্ছে । মামনি দরজা খোলা মাত্রই কেউ ধিরে ধিরে অনেকটা অস্পষ্ট ভাবে কিছু একটা বলতে শুরু করল । মামনি কিছুই বুজলো না তার কথাবার্তা । আমি দরজার সামনে এসে দেখি "ওরে এতো ছোট একটা বাচ্চা" তখন আমি নবম শ্রেণী পড়ি আর বাচ্চাটার বয়স হতে পারে আট কি নয় বছর । মামনি আমাকে বলল “ তুমি খেতে যাও আমি দেখছি ”। এক দের মিনিট পরেই দেখি মামনি ওই পিচ্ছিটাকে নিয়ে খাবারের টেবিলে পাশের একটা চেয়ারে বসিয়ে দিল । ওকে দেখতে খুব নোংরা লাগছিল , বাজে ঘ্রান আসছিল ওর সামনে থেকে । কিন্তু চেহারাটা খুব মিষ্টি । এখনও আমার চোখে ভাসে ওই মিষ্টি মুখ খানি । আমার বিপরীতে বসে কয়েকবার আমার দিকে তাকাচ্ছিল । আমি কিছু না বলে খাবার খেয়ে চলে আসি আমার ঘরে । এরপর মামনি ওকে কি বলল কি করল আমি জানি না। রাতে খাবারের টেবিলে বসে বাবার সামনেই মামনি কে দুপুরের ঘটনার ব্যাপারে জানতে চাইলাম । আমি চাইছিলাম বাবাও জানুক , কারন দুপুরের পুরো ব্যাপারটি আমার পছন্দ হয়নি । মামনি সব কথা আমাদের কে বলার পর বাবা বলল ওকে রেখে দিলে না কেন ? এখানেই থাকতে পারত। মামনি মানা করল , কিছু সমস্যা আছে তাই পিচ্ছিটাকে রাখা যাবে না। এভাবে কয়েক দিন চলল। মেয়েটা প্রায় দিনই আমাদের বাসায় চলে আসতো খাবারের সময়ে। একদিন মামনি ওকে নতুন একটা সাবান দিয়ে বলল “যা এই বাথরুমে সাবান শেম্পু দিয়ে ভাল ভাবে পরিষ্কার হয়ে আয়”। সেই দিন আমি প্রথম খুব স্পষ্ট ভাবে ওই মেয়েটার কথা শুনেছিলাম। আমি আমার ঘরে শুয়ে ছিলাম , মেয়েটি এসেই বলল “ আমি আইসি , দেহেন নতুন জামা ফরসি , খালা আমারে ছিরুনি দিসে চুল আছরাইতাম বইলা । আয়না লাগব চুল আছড়াইতাম ।” আমি অবাক কি মিষ্টি চেহারা , কি পবিত্র মুখ খানি , পরীর মতো লাগছে ওকে। সে আমাদের বাসায় এখন আর শুধু দুপুরে না রাতের খাবার টাও খেতে আসে, কিন্তু রাত সাত টার মাঝেই ওর রাতের খাবার খেয়ে চলে যায় । ওর জন্য আমার মনে ঘৃণার যে পর্দা টি ছিল সেটা নিজের অজান্তেই নষ্ট হয়েছে সেই কবে।
এক দিন ওকে বললাম ওর সাথে গল্প করব। সে দিন টি ছিল কোন একটা ছুটির দিন । ওর জীবনের খুঁটিনাটি জানতে চাইলাম । কি করে ? কোথায় থাকে ? কে কে আছে ? ওকে জানার পর বুজলাম ও গরিব না । গরিবের ও কিছু থাকে ;ওর সেটাও নেই । তবুও ওর মুখে কি সুন্দর হাঁসি । মনের মাঝে আছে মানুষের জন্য পবিত্র ভালবাসা । মেয়েটি কাগজ কুঁড়ায় । ওর বড় বোন আর দুলাভাই আছে। ওখানেই মেয়েটি থাকে। বোনের দুইটা বাচ্চা আছে। ওদের সাথে খেলা করে অবসর সময়ে। দুলাভাই রিক্সা চালক বোন ছাই বিক্রি করে । এই হল ওর সংসার। “বোন আর দুলাভাই খুব মারে এই যে দেহেন না সরিরে দাগ হালাইসে । আমি কাগজ টুকাইয়া যা টাকা পাই টা পুরাডাই হেরা লইয়া জায়গা, কয় এডা আমার থাহন খরচ। এক বেলা খাওন হেরা দেয় আর দুই বেলার আমার ভাগে, ভিক্ষা কইরা খাই । কোন দিন পাই কোন দিন পাই না। ওহন ভাল আসি। আপনেগো এহেন্তোন খাওন পাই। কিন্তু রাইতে দেরি হইলে আমারে মারে। আমিও চালাক কম না এহানে তাত্তারি আইয়া খাইয়া যাই আর রাইতে বুবুয়ে জেডা দেয় অইডা পলাইয়া রাইখা দেই সকালে খাই। ” আমি বললাম – তুমি থেকে জাও আমাদের বাসায় । পরাশুনা করবে , খেলবে , নতুন কিছু কাজ শিখবে । মেয়েটি থাকতে চায় না। কারন ওর বোনের মেয়েদের কে খুব পছন্দ করে। ওদের সাথে থাকতে ভালোবাসে।
আমারাও এক জন পরিচিত ছাইওয়ালির কাছ থেকে মাঝে মাঝে ছাই নেই । উনি আবার মানুষের বারিতে ছুটা বুয়ার মতো কাজ ও করে । ভেবেছিলাম উনি কি না ! মেয়েটি মানা করল কারন ওর বোন বুয়ার কাজ করে না। তিন থেকে চার মাসের মতো মেয়েটির এমন করেই আমাদের বাসায় যাওয়া আশা। মাজে মাজে মামনি কে বলতো ;মামনি যেন ওকে আর টাকা না দেয় কারন ওর টাকা গুলো নিয়ে যায় ওর দুলাভাই। মামনি বলল ঠিক আসে এগুলো আমার কাছেই জমা থাক। তোর যখন দরকার হবে আমকে বলিস কিন্তু।
আরো দু মাস পার হল। এরপর থেকেই ও খুব কম আশা যাওয়া করে। সপ্তাহে তিন দিন কি চার দিন , এমনটাই মনে হয় । এক দিন বাবা ওকে রাস্তা থেকে ডেকে বাসায় নিয়ে এসে খুব বকা দিলো। আমি খুব রেগে গিয়েছিলাম ওকে বকা দিচ্ছে কেন ! বাবা যে ওর ভালই জন্যই বকা দিচ্ছিলো এটা বুজিনি। মেয়েটির শরীর খুব খারাব শুকিয়ে কাঠ , কিন্তু পেট ফুলে গেসে। এই টকুন মেয়ের এতো বড় পেট! কি হয়েছে ওর ! জানতে চাইলে, ও বলে “ কিছু না জ্বরে এমন হইসে ”
বাবা ওকে ১,০০০ টাকা দিয়ে ডাক্তার দেখাইতে বলে , ওর বোন যেন ওকে নিয়ে যায় । বাবা জানতো না ওর বোন টা খারাব , মেয়েটিও বাবা কে কিছু বলেনি টাকা গুলো নিয়ে ভাত না খেয়ে ভাত নিয়ে চলে গেলো। তিন সপ্তাহ পর মামনি ওকে খুজে কথা থেকে জানি নিয়ে আসে বাসায়। তখন ওর অবস্থা খুব খারাব। মামনি ডাক্তারের কাসে নিয়ে যায় । পর পর কয়েক দিন ওকে হাসপাতালে নিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষা করায় ধরা পরে লিভারে সমস্যা। অনেক বেশি খারাব অবস্থা । বেড রেস্ট নিতে হবে। খুব সাবধানে চলতে হবে। আমরা খুব চিন্তায় পরলাম ওকে নিয়ে। কি করা যায় !!
মেয়েটিকে গ্রামে ওর মায়ের কাছে পাঠাতে চাইলাম । সে যাবে না। কারন ওর স্টেপ মাদার । ও বুবুর কাসেই থাকবে। মেয়েটি মামনির কাসে ওর জমানো টাকা গুলো চাইল মামনি দিয়ে দিলো । হাতে নিবে না “ খালা আমার জামায় লুকাইয়া সিলাইয়া দেন , বুবু দেখ নিয়া যাইব ।” মামনি তাই করে । মেয়ে টি বলে গেলো “আমি আবার আসুম , ভালা হইয়া লই। আপনাগরে খুব মনে পরব। আমি মনে হয় আমার ফুপুর বাড়ি জামুগা, তয় পলাইয়া জামু । আমার ফুপু খুব ভাল, গার্মেন্টসে কাম করে। বুবুর লগে বনে না দেইখা আমারে জাইবার দেয় না। এইবার যামু। এই নাম্বারে একটা ফউন কইরা দিবেন ? হ্যালো ফুপু , আমারে লইতে আইও । আমি, আমারে চিন নাই! , বকুলের মাইয়া ছোট মাইয়া।” এই বলেই মেয়েটি কি কান্না । ওর কান্না দেখে মামনিও কান্না করছিল । আমিও কান্না করতে থাকলাম। ওকে আবার বুজালাম আমদের বাসায় থেকে যাও সে থাকবে না।
অনেক দিন হল মেয়েটির কোন দেখা নাই। অনেক খুজা খুজির পর খবর পেলাম মেয়েটির বুবু কে আমরা চিনি। ওই ছাইওয়ালি , যার কাছ থেকে আমরা ছাই নেই। ওকে ধরলাম , জিজ্ঞাসা করলাম বলল বোন টা অনেক অসুস্থত টাকার জন্য ডাক্তার দেখাতে পারে না। মামনি সাথে সাথে ৩০০ টাকা দিলো। এমন করে এক মাস মামনি আর বাবা টাকা দিতে থাকলো। এক দিন মামনি ওই মহিলা কে অনেক অনুরোধ করল টার বাসায় নিয়ে যাওয়ার জন্য। কিন্তু সে নিল না। আর টাকাও চায় নাই। এর ও দু’ মাস পর মামনি খোঁজ পেলো মেয়েটি তিন মাস আগেই মারা গিয়েছিল । মেয়েটির নাম বলে বলে ওর বুবু শুধু আমদের কাছ থেকেই না আরও অনেকের কাস থেকে টাকা তুলত।
ভীষণ বড় একটা ধাক্কা খেলাম মনের মাঝে । মামনি এমন ভাবে কান্না করতে শুরু করল মনে হচ্ছিলো টার নিজের সন্তান মারা গিয়েছে। আমার আজ ও মনে হয় , আর একটু খেয়াল করলে হয়ত মেয়েটাকে বাঁচাতে পারতাম।
মেয়েটির নাম আমার এখন আর মনে পরে না । আমি ওর নাম ধরে কখন ডাকিনী । সব সময় “ ওই পুচকি” বলেই ডাকতাম।
খুব মনে পরে । মাঝে মাঝে ইচ্ছে হয় আবারও এক সাথে দুপুরের খাবার খাই। কিন্তু কথায় ? কথায় সেই মিষ্টি মেয়েটা? সে তো আর নেই আমাদের মাঝে।
( ব্লগের সব ভাই ও বোনেরা এই ছোট পরীর মতো মেয়েটির পবিত্র আত্মার জন্য মঙ্গল প্রার্থনা করবেন )

সর্বশেষ এডিট : ১৪ ই সেপ্টেম্বর, ২০১১ দুপুর ২:৫৪
৭টি মন্তব্য ৬টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

=আকাশে তাকিয়ে ডাকি আল্লাহকে=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ১৪ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৪:০১


জীবনে দুঃখ... আসলে নেমে
শান্তি গেলে থেমে;
আমি বারান্দায় দাঁড়িয়ে হই উর্ধ্বমুখী,
আল্লাহকে বলি সব খুলে, কমে যায় কষ্টের ঝুঁকি।

আমি আল্লাহকে বলি আকাশে চেয়ে,
জীবন নাজেহাল প্রভু দুনিয়ায় কিঞ্চিত কষ্ট পেয়ে;
দূর করে দাও সব... ...বাকিটুকু পড়ুন

"ছাত্র-জনতার বেপ্লবের" ১৮ মাস পরে, আপনার ভাবনাচিন্তা ঠিক আগের মতোই আছে?

লিখেছেন জেন একাত্তর, ১৪ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৫:৫৭



২০২৪ সালের পহেলা জুলাই "ছাত্র-জনতার বেপ্লব শুরু হয়, "৩৬শে জুলাই" উহা বাংলাদেশে "নতুন বাংলাদেশ" আনে; তখন আপনি ইহাকে ব্যাখ্যা করেছেন, ইহার উপর পোষ্ট লিখেছেন, কমেন্ট করেছেন; আপনার... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমাদের হাদিকে গুলি করা, আর আওয়ামী শুয়োরদের উল্লাস। আমাদের ভুল কোথায়?

লিখেছেন তানভির জুমার, ১৪ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৯:৫৩



৩০ জনের একটা হিটলিস্ট দেখলাম। সেখানে আমার ও আমার স্নেহের-পরিচিত অনেকের নাম আছে। খুব বিশ্বাস করেছি তা না, আবার খুব অবিশ্বাস করারও সুযোগ নাই। এটাই আমার প্রথম... ...বাকিটুকু পড়ুন

এ যুগের বুদ্ধিজীবীরা !

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ১৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১:৪০


ডিসেম্বর মাসের চৌদ্দ তারিখ বাংলাদেশে বুদ্ধিজীবী দিবস পালন করা হয়। পাকিস্তান মিলিটারী ও তাদের সহযোগীরা মিলে ঘর থেকে ডেকে নিয়ে হত্যা করেন লেখক, ডাক্তার, চিকিৎসক সহ নানান পেশার বাংলাদেশপন্থী বুদ্ধিজীবীদের!... ...বাকিটুকু পড়ুন

টাঙ্গাইল শাড়িঃ অবশেষে মিললো ইউনস্কর স্বীকৃতি

লিখেছেন কিরকুট, ১৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ১০:৫৭



চারিদিকে যে পরিমান দুঃসংবাদ ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে এর মধ্যে নতুন এক গৌরবময় অধ্যায়ের সূচনা হলো বাংলাদেশের টাঙ্গাইলের তাতের শাড়ি এর জন্য, ইউনেস্কো এই প্রাচীন হ্যান্ডলুম বুননের শিল্পকে Intangible Cultural... ...বাকিটুকু পড়ুন

×