somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

হাসিনার ভারত সফর: যৌথ ঘোষণার সুক্ষ কারচুপি

১৭ ই জানুয়ারি, ২০১০ বিকাল ৫:২১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

প্রথম পর্বের জন্য Click This Link , দ্বিতীয় পর্বের জন্য Click This Link

তৃতীয় পর্ব:
"চট্টগ্রাম ও মংলা সমুদ্রবন্দর শুধু ভারতই নয়, নেপাল এবং ভুটানকেও ব্যবহার করতে দেওয়া হবে। আঞ্চলিক সহযোগিতার ভিত্তিতে যেভাবে করা উচিত"............. আজকের দিনে তো দরজা আটকে বসে থাকতে পারি না। সব ঘরে তো কাঁটা মেরে বসে থাকতে পারি না। আমাদের দুটি সম্পদ আছে—চট্টগ্রাম ও মংলা বন্দর। নেপাল ও ভুটানও যাতে এসব বন্দর ব্যবহার করতে পারে, সে ব্যবস্থাও নেওয়া হবে। ভারতও বাংলাদেশকে নেপাল ও ভুটানে ট্রানজিট দিচ্ছে। পারস্পরিক স্বার্থ অক্ষুণ্ন এবং দেশের স্বার্থ সমুন্নত রেখেই এটা করা হবে।" - শেখ হাসিনা, প্রেস কনফারেন্স, তারিখ: ১৪-০১-২০১০, প্রথম আলোর রাহীদ এজাজ, নয়াদিল্লি থেকে।

শেখ হাসিনা নিজেও জানেন বশ্যতা স্বীকার করে একতরফা ভাবে কেবল ভারতকে তিনি "কানেকটিভিটি" বা ট্রানজিট দিয়েছেন, যৌথ ঘোষণায় তিনি একথার উপরেই দাসখত দিয়েছেন। কিন্তু বাচ্চা পোলাপানের মত হাতপা ছুড়ে চেঁচিয়ে বেড়াচ্ছেন, "আঞ্চলিক সহযোগিতার ভিত্তিতে"ই নাকি তা দেয়া হয়েছে। অথচ আমাদের সমাজের কেউ বিতর্ক তুলে নাই বা প্রশ্ন এটা নয় যে "আঞ্চলিক সহযোগিতার ভিত্তিতে" ভারতকে দিলেই সব জায়েজ। বরং সবাই ঘোরতর আপত্তি করছে, যেসব বশ্যতামূলক শর্তে এবং আমাদের যেসব ন্যায্য পাওনা ভারত অন্যায় ভাবে ব্লক করে রেখেছে, বর্ডারে লোক মেরে চাপ সৃষ্টি করছে তা নিয়ে কোন সমাধান আদায় না করে পাশ কাটিয়েই ভারতকে একতরফা ট্রানজিট দেয়া হয়েছে।
তবু "ভারতও বাংলাদেশকে নেপাল ও ভুটানে ট্রানজিট দিচ্ছে" - শেখ হাসিনার এই গলাবাজি এক বড় মিথ্যা, জনগণের সাথে প্রতারণা তা নিয়ে এবারের পর্বে আলোচনা করব।

নেপাল, ভুটানকে বাংলাদেশের উপর দিয়ে মংলা পোর্টে পৌছাতে হলে আগে ভারতের উপর দিয়ে আসার ট্রানজিট তাদেরকে পেতে হবে। আমাদেরও নেপাল ভুটানে পণ্য নিয়ে হাজির হতে গেলে ভারতের উপর দিয়ে আসার ট্রানজিট পেতে হবে। কিন্তু এই ট্রানজিট ভারত দেবে এমন কথা যৌথ ঘোষণাতে কোথাও পরিস্কার করে লেখা নাই। ফলে শেখ হাসিনার "আঞ্চলিক সহযোগিতার ভিত্তিতে" ভারতকে ট্রানজিট দেয়া হয়েছে - এটা একটা ডাহা মিথ্যা কথা; নিজের দুষ্কর্ম, বেকুবিকে শাক দিয়ে মাছ ঢাকার মত আড়াল করার এক নির্লজ্জ প্রচেষ্টা।

যৌথ ঘোষণার ২৩ নম্বর পয়েন্টে মংলা ও চট্টগ্রাম পোর্ট ভারতের ব্যবহার জন্য উন্মুক্ত ঘোষণা করা হয়েছে। পুরা যৌথ ঘোষণা Click This Link এখানে দেখা যাবে। এখন এখানে আমি কেবল ২৩ নম্বর পয়েন্ট বাংলায় লিখছি।

২৩. বাংলাদেশ মংলা ও চট্টগ্রাম নৌ-পোর্ট দিয়ে ভারত থেকে ও ভারতের দিকে রেলওয়ে এবং সড়ক পথে মালামাল চলাচলের জন্য অনুমতি দিবে বলে একমত হয়েছে। বাংলাদেশ অবশ্য মংলা ও চট্টগ্রাম পোর্টে নেপাল ও ভুটানকে প্রবেশ করতে (give access) দেওয়ার অভিপ্রায় জানিয়েছে।

এই হলো বাংলায় পুরা ২৩ নম্বর পয়েন্ট। পাঠক নিশ্চয় বুঝে গেছেন চাতুরিটা কোথায়। মংলা ও চট্টগ্রাম নৌ-পোর্ট ব্যবহারের ভারতের বেলায় পরিস্কার শব্দ allow use বা ব্যবহারের অনুমতির কথা বলা হয়েছে এবং আরও সুনির্দিষ্ট করে বলা হচ্ছে এক. to and from India, দুই. through road and rail; অথচ নেপাল ভুটানের প্রসঙ্গে লেখা হচ্ছে বাংলাদেশ conveyed their intention, অর্থাৎ বাংলাদেশের অভিপ্রায় আছে এমন এক কথা ভারত শুনল মাত্র। শুনার পর ভারতের কী প্রতিক্রিয়া হলো, হ্যা বা না, বলল যৌথ ঘোষণা এক্ষেত্রে নীরব কবি, কিছু জানে না; ফলে ওথেকে আমাদেরও জানার কোন সুযোগ নাই। এমনকি বাংলাদেশের অভিপ্রায় জানার পর ভারত এটা নিয়ে ভাবছে বা ভাববে কি না তাও আমরা জানি না। ভারত ভাববে, সহানুভুতি বা প্রতিদানের কথা বিবেচনা করবে - না! এমন কিছুও নাই।

বরং উল্টা কিছু হবার সম্ভাবনার ইঙ্গিত আছে। এজন্য ২৬ ও ৩৮ নম্বর পয়েন্ট মনোযোগ দিয়ে পড়া গুরুত্ত্বপূর্ণ। ২৬ নম্বর পয়েন্ট পড়ে মনে হতে পারে নেপালকে কেবল একটা রেল ট্রানজিট যেনবা ভারতে দিতেও পারে। ভারতের কাছ থেকে এটা "would be available" হবে বটে কিন্তু তা "allow use" দিবে কিনা এটা জানা যায় না। এছাড়া আরও কিছু ভাষাগত চাতুরি স্পষ্টতই এখানে আছে, সেখানে প্রবেশ করতে ২৬ নম্বরের বাংলা অনুবাদ করে নিচ্ছি নীচে।

২৬. দুই প্রধানমন্ত্রী একমত হয়েছেন যে রোহনপুর-সিঙ্গাবাদ ব্রডগেজ রেলওয়ে লাইন নেপালে ট্রানজিটের জন্য (for transit to Nepal) পাওয়া যেতে পারে (would be available)। বাংলাদেশ তাদের অভিপ্রায় জানিয়েছে যে রাধিকাপুর- বিরল রেলওয়ে লাইন ব্রডগেজে রূপান্তর করা হবে এবং ভুটানকে রেলওয়ে ট্রানজিট লিঙ্ক দেবার জন্যও অনুরোধ করেছে।

ভাষার চাতুরির যে কথা বলছিলাম, ভারতের বেলায় স্পষ্ট করে - বাংলাদেশ allow use বা ব্যবহারের অনুমতি দিবে - একথা বলা হয়েছিল এবং একে আরও সুনির্দিষ্ট করে বলা হয়েছিল, এক. to and from India, দুই. through road and rail - অথচ নেপালের বেলায় allow use এর মত কোন সিদ্ধান্তমূলক শব্দের বদলে would be available বলা আবছা করে রাখা হয়েছে; কেন? সেই চাতুরিটা এখানে স্পষ্ট।
এই চাতুরি আরও ভাল ধরা পরে পরের বাক্যে, Rohonpur-Singabad লাইন ব্রডগেজে রূপান্তরের কথায়। ভারত জানে এই পথে নেপালে যেতে আসতে বাস্তবে ট্রানজিট পাওয়া অসম্ভব। কারণ, অবকাঠামোগত দুটো বিরাট বাধা আছে তা সহসা দূর হবে না। নীট ফলাফল: শেখ হাসিনা যে মুলা দেখাতে চান, ভারত সে মুলা দেখানোর মত কোন প্রতিশ্রুতিতে যেতেও রাজী না, তাই নেপালে ট্রানজিট বলতে এই পথে রেল ট্রানজিটের বাগড়ম্বরা করে রাখা হয়েছে।

এই গাছে কাঁঠাল গোঁফে তেল অথবা মুলা ঝুলিয়ে রাখার মত আঁকশির সুবিধা যৌথ ঘোষণা আবিস্কার করতে পারলো কেন?

কারণ, বাংলাদেশে রেলওয়ের উপস্হিত অবকাঠামো। বাংলাদেশের উত্তর-দক্ষিণ জুড়ে বিস্তৃত রেললাইন দক্ষিণে মংলা থেকে উত্তরে লালমনিরহাট চিলাহাটি পর্যন্ত - এর পুরাটাই ব্রডগেজ লাইন। আর পূর্ব-পশ্চিমের রেল লাইন হলো মিটারগেজের। এদুয়ের মাঝখানে হলো, পার্বতীপুর (সৈয়দপুর) যেখানে এই দুই মূল রেল লাইন পরস্পর করে ক্রস করেছে, জংশন। এখানে উত্তর-দক্ষিণের ব্রডগেজ ট্রেনের যাত্রী (ট্রেন নয়) ও পূর্ব-পশ্চিমের মিটারগেজে ট্রেনের যাত্রী (ট্রেন নয়) বদল হতে পারে; কিন্তু মনে রাখতে হবে এটা যাত্রীর জংশন পয়েন্ট, ট্রেনের নয়; উত্তর-দক্ষিণের ব্রডগেজ ট্রেন, পূর্ব-পশ্চিমের মিটারগেজে লাইনে যেতে পারবে না, এবং ভাইস-ভারসা। কেবল যাত্রীর বেলায় সে ট্রেন বদল করে নিতে পারবে। এই অর্থে পার্বতীপুর ট্রেনগাড়ীর জংশন নয়, যাত্রীর জংশন পয়েন্ট।
তাহলে, মালামাল? একেবারেই অসম্ভব, শুধু তাই নয়, কাষ্টমস আইনেও মানা করতে হবে। নেপাল থেকে কোন মালামাল সীল করা ট্রেনের কামরা খুলে অন্য ট্রেনে লোড-আনলোড - কাষ্টমস আইন ও নিরাপত্তার জন্য এক সাংঘাতিক ঝুঁকিপূর্ণ, এছাড়া বাড়তি খরচের দিকটা তো আছেই - তাই এই ভাবনার কোন ভিত্তি নাই, পরিত্যাজ্য। কোন আমদানি-রপ্তানিকারক এই ঝুঁকি নিবে না। ফলে যৌথ ঘোষণায় এপ্রসঙ্গে যেখানে বলা হচ্ছে , হাসিনা "তাদের অভিপ্রায় জানিয়েছে যে রাধিকাপুর বিরল রেলওয়ে লাইন ব্রডগেজে রূপান্তর করা হবে" - এটা বাস্তবায়ন হলেও মংলা থেকে নেপালে ট্রেন যাতায়াতের কোন সুযোগ নাই; কারণ, যদি ধরা যায় রাধিকাপুর বিরল উপস্হিত মিটারগেজ লাইন ব্রডগেজে রূপান্তরিত করেই ফেলা গেল তবুও এর পর বিরল থেকে পার্বতীপুরে (প্রায় ৫০ কিলোমিটার) রেল লাইন তো মিটার গেজ লাইন হয়েও আছে, এর কী ব্যবস্হা? নেপালের ব্রডগেজ ট্রেন বিরল থেকে পার্বতীপুর পৌছাতে পারলে তবেই এরপর মংলা যাবার ব্রডগেজ লাইন পাবে।
তাহলে এসব ছলচাতুরির সিধা মানে হলো, যৌথ ঘোষণা অনুসারে ব্রডগেজ ট্রেন নেপাল-ভারত পেরিয়ে বাংলাদেশই ঢুকতে পারবে না, ভারতের শেষ ষ্টেশন রাধিকাপুরেই আটকে থাকবে, মংলা অনেক দূরের ব্যাপার। নীট ফলাফল, নেপাল বা বাংলাদেশ ভারতের কাছ থেকে কোন রেল ট্রানজিট সুবিধা পাচ্ছে না। তবে অবশ্যই এসব কথা যৌথ ঘোষণার কাগুজে দলিল হয়ে থাকবে মাত্র আর শেখ হাসিনাকে "আঞ্চলিক সহযোগিতার ভিত্তিতে" ভারতকে ট্রানজিট দিয়েছি - এই চাপাবাজি করতে কাজে লাগবে।
ওদিকে ভুটানের রেল ট্রানজিট প্রসঙ্গ, নেপালের মত অবস্হাতেও নাই। তাই দায়সারা করে একটা অর্থহীন বাক্য, "ভুটানকে রেলওয়ে ট্রানজিট লিঙ্ক দেবার জন্যও (বাংলাদেশ) অনুরোধ করেছে" - এটা দিয়ে শেষ করা হয়েছে। অর্থাৎ এটা মাত্র অনুরোধের পর্যায়ে আছে। হাসিনার লক্ষ্য যদি হয়, "দ্বিপাক্ষিক নয়, আঞ্চলিক ভিত্তিতে ভারতকে ট্রানজিট দেয়া হচ্ছে" - এই চাপাবাজি যেন সে করতে পারে বাক্যে এর প্রতিফলন তো এমনই হবার কথা।

পাঠককে খেয়াল করতে বলব, নেপাল, ভুটানকে ট্রানজিটের মানে দাঁড় করানো হয়েছে কেবল রেলওয়ে ট্রানজিট বলে, তাও এমন পথে যেটার বাস্তবায়ন অসম্ভব, এবং তাও আবার ভারতের কাছে তা বাংলাদেশের "অনুরোধের" পর্যায়ে; কেন? কারণ, এই পথে ভারত পরিস্কার করে ভারতের উপর দিয়ে নেপাল বাংলাদেশকে রেল-ট্রানজিট দিতে যৌথ ঘোষণার কাগজে লিখে দিলেও তো বাস্তবে তাকে তা দিতে হবে না। এই হলো ট্রানজিট বলতে রেল-ট্রানজিট লেখার ভারতের সুবিধা, আর হাসিনার চাপাবাজির, জনগণের সাথে শঠতা করার সুবিধা।

পাঠক মনে হতে পারে যে রেলওয়ে ট্রানজিটের আসল মানে যে অশ্বডিম্ব তা বুঝলাম, এরপরেও হাসিনা যখন এত বড় গলায় প্রকাশ্যে বলছেন, নিশ্চয় সড়ক পথে নেপাল, ভুটানকে ট্রানজিটের কোন একটা ব্যবস্হা থাকতে পারে। চলুন, আমরা এখন তা পরীক্ষা করার জন্য যৌথ ঘোষণার ৩৮ নম্বর পয়েন্টে যাব। এখানে বাকচাতুরি অবশ্য আর একটু উন্নতমানের এবং ভারতের এক অনধিকার চর্চাও বটে। পুরা ইংরেজিটাসহ এরপর বাংলায় লিখছি।

38. It was agreed that trucks for movement from Bhutan and Nepal be allowed to enter about 200 meters into Zero Point at Banglabandh at Banglabandh-Phulbari land customs station. Necessary arrangements shall be mutually agreed and put in place by both countries.
৩৮. এটা একমত হওয়া যাচ্ছে যে, ভুটান ও নেপাল থেকে ট্রাক চলাচলে জিরো পয়েন্ট থেকে ২০০ মিটার বাংলাবান্ধায় বাংলাবান্ধা-ফুলবাড়ী স্হল কাষ্টমস স্টেশন পর্যন্ত প্রবেশ করতে অনুমতি দেয়া হবে। প্রয়োজনীয় ব্যবস্হা পারস্পরিক একমত হয়ে দুই দেশের জায়গামত বসিয়ে নেয়া হবে।

এইবার "allowed to enter বা অনুমতি" শব্দটা দেখে আমরা নড়েচড়ে বসার তাগিদ অনুভব করতে পারি। পাঠককে হতাশ করার জন্য দুঃখিত। আগেই বলেছি এখানে বাকচাতুরি উন্নতমানের, সুক্ষ কারচুপির। এর উপর পুরা ক্লজটাই লেখা হয়েছে দায়সারা গোছের ভাবে এবং সম্ভবত তা হাসিনার হাতে একটা ললিপপ ধরায় দেবার জন্য যাতে বাংলাদেশে গিয়ে মুখরক্ষায় একটা চাপাবাজি তিনি করতে পারেন।

সুক্ষ কারচুপি এক. ট্রাক:
আগের ২৩ নম্বরে ভারতের ট্রানজিটের সাথে তুলনা করলে, দেখবে ওখানে "কী ধরণের যানবাহন" চলাচল করবে তা সীমিত না করে বরং বড় সুযোগ রাখতে সাধারণভাবে movement of goods উল্লেখ করে তা বলা হয়েছিল। এখানে নেপাল ভুটানের বেলায় কেবল trucks for movement বলে একে একেবারে সীমিত ও সুনির্দিষ্ট করে আনা হয়েছে।

কারচুপি দুই. খোদ বাংলাদেশই নাই:
ভারতের বেলায় স্পষ্ট করে to and from India বলা ছিল, এখানে কেবল from Bhutan and Nepal বলা হয়েছে। অর্থাৎ কেবল ভুটান ও নেপাল থেকেই ট্রাক আসতে পারবে, বাংলাদেশ থেকেও মালামাল/ট্রাক ভুটান ও নেপালে যেতে পারবে এমন সুযোগই ওখানে রাখা হয় নাই। ভারতের বেলায় যে বাক্য গঠনরীতি আছে তা অনুসরণ করলে তা To and from Bangladesh কথাটা থাকার কথা। অর্থাৎ যৌথ ঘোষণা অনুসারে ভুটান ও নেপালই কেবল ভারতের সড়ক ট্রানজিট পাবে, বাংলাদেশ পাবে না - এমন অর্থ হয়ে আছে।

কারচুপি তিন. এখানে বাংলাদেশকে নিয়ে এক সাংঘাতিক অনধিকার চর্চা:
বলা হয়েছে ভুটান ও নেপাল থেকে ট্রাক বাংলাদেশের জিরো পয়েন্ট পেরিয়ে ২০০ মিটার ভিতরে কাস্টমস স্টেশন পর্যন্ত যেতে পারবে।
প্রশ্ন হলো, সীমান্তের জিরো পয়েন্ট যদি পার হতেই পারে তবে এরপর তা তো বাংলাদেশের ভিতরে, এখান থেকে ভিতরে এটা কতদূর যেতে পারবে এটা কি ভারতের ঠিক করে দেওয়ার কথা, না বলবার এক্তিয়ার? ভারতের এই অনধিকার চর্চার ক্ষমতা হাসিনা ভারতকে দেবার কে? এই ক্ষমতা আমাদের সংবিধান হাসিনাকেও দেয়নি।

কিন্তু ভারতইবা এই অনধিকার চর্চার তাগিদ কেন বোধ করলো? এই প্রশ্ন ধরে যদি আগাই, ভারত সুনির্দিষ্ট করে কাষ্টম ষ্টেশন পর্যন্ত বলে অনধিকার চর্চা করতে গেছে এজন্য যে, "সারাক্ষণ সীমাপার কী আতঙ্কবাদের" মধ্যে বসবাস করে বলে, এর মধ্যে এবার আমাদের কাস্টম হাউসে ভারতীয় নিরাপত্তা বাহিনী বসাবার মতলব আছে নাকি? সেজন্যই কী Necessary arrangements পরে ঠিক করা যাবে বলে যৌথ ঘোষণায় স্পষ্ট করে কিছু বলতে চায়নি, ঝুলিয়ে রেখে দিয়েছে? পরে সুবিধাজনক সময়ে আওয়াজ উঠাবে? এর উপর আবার এক মারাত্মক শব্দ লাগিয়ে রেখেছে "mutually agreed"; এর মানে বাংলাদেশ কী শর্তে ভুটানী নেপালী ট্রাক চলাচল করতে দিবে এটাও কী ভারতের মতামত নিয়ে ঠিক করতে নিতে হবে?
অনেক পাঠকের মনে হতে পারে, ভারতের ভিতর দিয়ে একটা ট্রাক বাংলাদেশের উপর দিয়ে চলাচল করবে ফলে ভারতের নিরাপত্তা তো সে নিশ্চিত করতে চাইবেই - এটাই স্বাভাবিক। দুঃখিত। না, এটা স্বাভাবিক নয়। কারণ আসা বা যাওয়ার সময় ভারতের ভুখন্ডে প্রবেশ করা মাত্রই যেকোন ট্রাকের উপরে ভারতের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ভারত যা মনে চায় তাই নিয়মকানুন আরোপ সে করতেই পারে, সেসুযোগ তার থাকছেই - সেই কাজ বাংলাদেশের সীমানার ভিতরে বসে করার চেষ্টা তাকে করতে হবে কেন? আর আমরাই বা তা করতে দিব কেন?
আমাদের ভুখন্ডের মধ্যে আমরা কি করে ট্রাক চলাচলে আমাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করব - এটা একান্তই আমাদের ব্যাপার।

সড়ক ট্রানজিটের ক্ষেত্রেও এসব অস্পষ্টতা, কিন্তু ইঙ্গিতপূর্ণ কথাবার্তা, পরে দেখা যাবে বলে ফেলে রাখা, এবং পরবর্তীতে মিউচুয়ালী একমত হওয়া যাবে বলে vague করে রাখাটার - নীট মানে হলো, পরবর্তীতে সড়ক ট্রানজিট বাস্তবায়নের সময়, ঐ "পারস্পরিক একমত" কখনই হওয়া যাবে না - নীট ফলাফল: সড়ক ট্রানজিটও রেল ট্রানজিটের মত কাগজেই থেকে যাবে।
যৌথ ঘোষণার এখনকার মানে অনুসারে, কথা দাড়িয়েছে, Necessary arrangements বিষয়ে কিছুই ভারত এখনও প্রতিশ্রুতি দেয়নি। ভবিষ্যতে "mutually agreed" হওয়া সাপেক্ষে সড়ক ট্রানজিট দিচ্ছে এটাই এর নীট মানে। অর্থাৎ এটাকে নীতিগত একমতও বলা যাচ্ছে না। কারণ, ভাইটাল বিষয় ঐ "mutually agreed" কখনই না হতে পারার সম্ভবনা ওখানে রেখে দেয়া হয়েছে।

উপরে সেসব বাকচাতুরি আর কারচুপি শঠতার বিষয় দেখালাম - এখান থেকে সেই আশঙ্কা করি, ফলে রেল ট্রানজিটের মত সড়ক ট্রানজিটও একটা মুলা মাত্র। অতএব, সার কথায়, এখন পর্যন্ত সড়ক ট্রানজিট নিয়ে নীতিগতভাবেও কোনকিছুই কনক্লুডেড নয় - এটাই আমরা বলতে পারি। এর উপর আবার ট্রানজিটের এই আবছা ইঙ্গিতে নেপাল ভুটানের জন্য যা হয়ত আছে, হয়ত নাই - তবে বাংলাদেশ জন্য এটা একেবারেই নাই।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ শিল্প ও বণিক সমিতি ফেডারেশনের (এফবিসিসিআই) উপদেষ্টা মনজুর আহমেদ ঠিক একই প্রশ্ন তুলেছেন, বলছেন:
"নেপাল ও ভুটানকে বাংলাদেশে প্রবেশের জন্য ট্রানজিট দিতে ভারতের সম্মতিকেও ইতিবাচক বলে উল্লেখ করেন তিনি। তবে এর বিপরীতে বাংলাদেশও একইভাবে ভারত হয়ে নেপাল বা ভুটানে যেতে পারবে কি না, তার কোনো উল্লেখ না থাকায় বিষয়টি শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশের জন্য লাভজনক নাও হতে পারে বলে মনে করছেন মনজুর আহমেদ। আবার নেপাল ও ভুটানে পণ্যবাহী যান সীমান্তের জিরো পয়েন্ট থেকে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ২০০ মিটার পর্যন্ত প্রবেশ করতে দিতে ভারতের সম্মতিকে এই সুবিধার কার্যকারিতা সীমিত করে ফেলবে বলে মনে করেন তিনি।
বিষয়টি ব্যাখ্যা করে মনজুর আহমেদ বলেন, ‘বাংলাদেশের ভেতরে কোন স্থান পর্যন্ত নেপাল-ভুটানের গাড়ি যাবে, তা নির্ধারণের এখতিয়ার এককভাবে বাংলাদেশের। এখানে ভারত কোনো সীমা টেনে দিতে পারে না। আমাদের পক্ষে যাঁরা এ বিষয়ে সমঝোতা করেছেন, তাঁরা এ ক্ষেত্রে দক্ষতা দেখাতে পারেননি।’ - প্রথম আলো, নিজস্ব প্রতিবেদক | তারিখ: ১৪-০১-২০১০

ভেবেছিলাম, এই পর্যন্ত লিখেই joint communique বা যৌথ ঘোষণায় হাসিনার দুষ্কর্মের বয়ান শেষ করব। অনেকেই ভারতের এই আগ্রাসন ও চাপের মুখে আমাদের অনেকে, "আমরা কি আর ভারতের সঙ্গে লড়াইয়ে পারবে" - এটা আগেই ধরে নিয়ে হারু হতাশ মনে ট্রানজিট থেকে অর্থনৈতিক কী লাভালাভ বের করা যায় তা দেখানোর দিকে আমাদের সবাইকে মনোযোগী করতে চায়। নিজেও আগ বাড়িয়ে সে লাভালাভের হিসাব করতে আগিয়ে যায়। হীনমন্নতায় ভরা এই ধরণের মনকে চাবুক মেরে জাগানোর জন্য আর এক পর্ব আমাকে লিখতেই হবে। যৌথ ঘোষণার ৩৩ নম্বর পয়েন্ট নিয়ে সে প্রসঙ্গে কি সুক্ষ কারচুপি করে রাখা হয়েছে তা নিয়ে পরের চতুর্থ পর্ব শুরু করবো।
আজ এখানেই সবার জন্য শুভ কামনা করে শেষ করছি।
সর্বশেষ এডিট : ১৮ ই জানুয়ারি, ২০১০ ভোর ৬:৫২
২৮টি মন্তব্য ২৮টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

মুসলিম কি সাহাবায়ে কেরামের (রা.) অনুরূপ মতভেদে লিপ্ত হয়ে পরস্পর যুদ্ধ করবে?

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ০৪ ঠা মে, ২০২৪ সকাল ৯:৪৯




সূরাঃ ৩ আলে-ইমরান, ১০৫ নং আয়াতের অনুবাদ-
১০৫। তোমরা তাদের মত হবে না যারা তাদের নিকট সুস্পষ্ট প্রমাণ আসার পর বিচ্ছিন্ন হয়েছে ও নিজেদের মাঝে মতভেদ সৃষ্টি করেছে।... ...বাকিটুকু পড়ুন

মসজিদে মসজিদে মোল্লা,ও কমিটি নতুন আইনে চালাচ্ছে সমাজ.

লিখেছেন এম ডি মুসা, ০৪ ঠা মে, ২০২৪ সকাল ১০:২৩

গত সপ্তাহে ভোলার জাহানপুর ইউনিয়নের চরফ্যাশন ওমরাবাজ গ্রামের এক ব্যক্তির মৃত্যু হয়েছে। লোকটি নিয়মিত মসজিদে যেত না, মসজিদে গিয়ে নামাজ পড়েনি, জানা গেল সে আল্লাহর প্রতি বিশ্বাসী ছিল, স্বীকারোক্তিতে সে... ...বাকিটুকু পড়ুন

গল্পঃ অনাকাঙ্ক্ষিত অতিথি

লিখেছেন ইসিয়াক, ০৪ ঠা মে, ২০২৪ দুপুর ১:১২

(১)
মাছ বাজারে ঢোকার মুখে "মায়া" মাছগুলোর উপর আমার  চোখ আটকে গেল।বেশ তাজা মাছ। মনে পড়লো আব্বা "মায়া" মাছ চচ্চড়ি দারুণ পছন্দ করেন। মাসের শেষ যদিও হাতটানাটানি চলছে তবুও একশো কুড়ি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ব্লগে বিরোধী মতের কাউকে নীতি মালায় নিলে কি সত্যি আনন্দ পাওয়া যায়।

লিখেছেন লেখার খাতা, ০৪ ঠা মে, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:১৮

ব্লগ এমন এক স্থান, যেখানে মতের অমিলের কারণে, চকলেটের কারণে, ভিন্ন রাজনৈতিক মতাদর্শের কারণে অনেক তর্কাতর্কি বিতর্ক কাটা কাটি মারামারি মন্তব্যে প্রতিমন্তব্যে আঘাত এগুলো যেনো নিত্য নৈমিত্তিক বিষয়। ব্লগটি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ব্লগার'স ইন্টারভিউঃ আজকের অতিথি ব্লগার শায়মা

লিখেছেন অপু তানভীর, ০৪ ঠা মে, ২০২৪ রাত ১১:০৫



সামুতে ব্লগারদের ইন্টারভিউ নেওয়াটা নতুন না । অনেক ব্লগারই সিরিজ আকারে এই ধরণের পোস্ট করেছেন । যদিও সেগুলো বেশ আগের ঘটনা । ইন্টারভিউ মূলক পোস্ট অনেক দিন... ...বাকিটুকু পড়ুন

×