জীবনানন্দ দাস লিখেছেন- সমস্ত দিনের শেষে শিশিরের শব্দের মতন সন্ধ্যা আসে...। 'বনলতা সেন' কবিতার অসাধারণ এই লাইনসহ শেষ প্যারাটা খুবই রোমান্টিক। বাংলা শিল্প-সাহিত্যের রোমান্টিসিজমে সন্ধ্যার আলাদা একটা যায়গাই রয়ে গেছে। একটা বাংলা গানে নারী ও পুরুষ শিল্পী খুবই আবেগী গলায় গায়- সন্ধ্যা নামুক না, জোনাকি জ্বলুক না, নির্জনে বসে আরো কিছুটা সময়...। এ ধরনের উদাহরণ ভুরিভুরি রয়েছে।
কিন্তু মানুষের জীবনে যখন বেলা শেষের গান বাজতে থাকে, তখন কোনো রোমান্টিসিজম কাজ করে না। একদমই বলতে ইচ্ছে হয় না ‘সন্ধ্যা নামুক না, জোনাকি জ্বলুক না...’। তবু সন্ধ্যা এসেই যায় মানুষের জীবনে। ঠিক শিশিরের শব্দের মতন। নিঃশব্দে। ইদানিং এজন্য খুব আতংক বোধ হয়।
অফিসের যে কিউবিকল-এ আমি বসি, সেখানে আমার সামনের চেয়ারে বসা একজনের মা গেল সপ্তাহে মারা গিয়েছেন চেন্নাইয়ের অ্যাপোলো হসপিটালে, গত পরশু তাঁর মৃতদেহ গ্রহণ করতে গিয়েছিলাম এয়ারপোর্টে। আমার জানা ছিলো না যে এয়ারপোর্ট থেকে মৃতদেহ বের করা হয় হ্যাঙ্গার গেটে কার্গো লাগেজের সাথে। তিনি গিয়েছিলেন মানুষ হিসেবে, বিমানে বসে আর আসলেন লাগেজ হিসেবে, বাক্সবন্দী হয়ে!
এরও মাস পাঁচেক আগে আমার বাঁ পাশে যিনি বসেন, তাঁর মা মারা গেলেন ঢাকার ল্যাবএইড হসপিটালে। মৃত্যুর কিছুদিন আগে আমি এই খালাম্মাকে রক্ত দিয়ে এসেছিলাম। ভর্তি থাকা অবস্থায় আরও বেশ কয়েকবার গিয়েছি হসপিটালে। যখন আইসিইউতে লাইফ সাপোর্টে ছিলেন, আমার সহকর্মী আমাকে বিশেষ ব্যবস্থায় আইসিইউতে নিয়ে গিয়েছিলেন। হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে সেটাই আমার প্রথমবার যাওয়া। খুব কাছ থেকে এই দুজনের মৃত্যু এবং মৃত্যুপরবর্তীতে স্বজনদের হাহাকার আমাকে নাড়িয়ে দিয়ে গিয়েছে। তাই অজানা এক আতংক আমাকে এখন সবসময় তাড়া করে, কারণ ঢাকার ব্যস্ততা ছাড়িয়ে বহুদূরের এক নিভৃত পল্লীতে আমার বৃদ্ধা মা, বাবাকে সঙ্গে নিয়ে অবসর জীবন যাপন করছেন।
আজ থেকে প্রায় ত্রিশ বছর আগে বাড়ি থেকে ঢাকায় পড়তে চলে এসেছিলাম। সে আসার পেছনে রাজধানীর চাকচিক্যময় জীবনের আকর্ষণ যতটুকু ছিলো, তারচেয়ে বেশি ছিলো বোধহয় বাবা-মায়ের কড়া শাসনের হাত থেকে বাঁচার সুযোগের আকর্ষণ। আমার বাবা সততা ও ন্যায়ের পক্ষে ন্যূনতম ছাঁড় দেয়ার পক্ষপাতি ছিলেন না, মা-ও বাবারই অনুগামী ছিলেন। অবস্থাদৃষ্টে মনে হতো যে অনেক ক’জন ভাইবোন হওয়াতে তাঁদের ভালোবাসা কমতে কমতে এখন বিরক্তির পর্যায়ে এসে ঠেকেছে আর বাসায় থাকা লাঠিগুলো আমার পিঠে বাদ্য বাঁজিয়ে তারই স্বাক্ষী দিয়েছে ইতিহাসের পাতায়। এই পরিপ্রেক্ষিতে তখন বাবা-মা একরকম প্রতিপক্ষ হিসেবেই গণ্য হয়েছেন।
তাই কম বয়সে ঢাকা চলে আসার পেছনে অনেকগুলো অনিবার্যতা ছিলো নিশ্চিতভাবেই। কিন্তু ক্রমেই সময় পার হয়েছে। একে একে অনেক বসন্ত পেরিয়ে গিয়েছে, আর তার সাথে দৌর্দণ্ড প্রতাপশালী আমার মা-বাবা যৌবন থেকে পৌঢ়, সেখান থেকে অবসর, তারপর বার্ধক্যে এসে পৌঁছে গিয়েছেন। তাঁদের দৃষ্টিতে এখন কুয়াশা জমেছে, মনের গভীরে লুকিয়ে রাখা আদ্রতা নানারকম ছিদ্র খুঁজে নিয়ে এখন ঠিকই বেরিয়ে পড়ছে। আর আমি দেখছি কাঠিণ্যর একেকটা পরত খুলতে খুলতে আমাদের জন্য বাবা-মায়ের জমিয়ে রাখা আসমুদ্র ভালোবাসা, যা দেখার চোখ আমার ছিলোই না সে সময়।
নিউটনের তৃতীয় সূত্র অনুযায়ী শৃঙ্খলমুক্তির পরবর্তী সময়ে ঢাকায় এসে বেশ অনেকদিন বিহঙ্গের মত উড়েছি, ইচ্ছেমত, মনের খুশীতে। পেছনে ফেলে আসা মা-বাবা তখন অনেকটাই এসএসসি’র ফোর্থ সাবজেক্টের মত। তারপর একে একে সব পাখি ঘরে আসে-সব নদী-ফুরায় এ-জীবনের লেনদেন...। অতএব অনুভব করতে শুরু করি শিশিরের এই শব্দ। অগত্যা ফিরতে হয় মা বাবারই কাছে।
আমার বাবা-মায়ের নানারকম সীমাবদ্ধতা ছিলো। যে কঠিন বাস্তবতার মধ্য দিয়ে তাঁরা বেড়ে উঠেছিলেন, প্রতিকুলতার সাথে সংগ্রাম করে জীবনকে এগিয়ে নিচ্ছিলেন, সেখানে বাহুল্য কোনো কিছু করার সুযোগতো ছিলোই না, নিত্যদিনের প্রয়োজন মেটানোই ছিলো কষ্টকর। আমার মা কোনোদিন আমাদেরকে নিয়ে একসাথে খেতে বসার সুযোগ পেয়েছিলেন কি না আমার মনে পড়ে না। কিন্তু খুব মনে পড়ে, নিজের অফিসে যাওয়ার আগে অন্য সবাইকে অফিস/স্কুলে পাঠাবার জন্য প্রতিদিন অতি সকালে উঠে মাটির চুলায় আগুন জ্বালানোর জন্য বাঁশের চুঙোয় ফুঁ দিতে দিতে ধোঁয়ায় চোখের পানি ফেলছেন মা। আগুনের আঁচে আমার মায়ের ফর্সা মুখটা তখন রাঙা হয়ে যেতো। দিনের পর দিন এভাবে সংসারের একঘেয়ে কাজ করতে করতে ভালোবাসার প্রকাশটাও তাই হয়ে গিয়েছিলো রুক্ষ। খুব স্বাভাবিক।
আমার বাবাও কোনোদিন আমাদের হাত ধরে কোথাও বেড়াতে নিয়ে যাওয়ার সুযোগ পাননি। কিন্তু নিত্য পরিশ্রমে শক্ত হয়ে যাওয়া বাবার ওই হাত থেকে আমাদের কাছে নিয়মিত চিঠি আসতো ‘পড়াশোনায় কোনো গাফলতি যেনো করবে না। আল্লাহকে ভয় করবে, কোনো অন্যায় করবে না।’ বাবার বাংলা এবং ইংলিশ হাতের লেখা ছিলো খুব সুন্দর।
আমাদের মা-বাবাকে কোনোদিন ‘তুমি’ বলা হয়নি, তার সাহসই পাইনি কখনও। ‘আপনি’র আবরণে এক দুরত্ব নিয়েই দেখেছি বাবা-মাকে সবসময়। এখন সেই দুরত্বটুকু নেই কিন্তু প্রিয়জনের মত ‘তুমি’ বলা হয়না তবুও। ভালোবেসে কখনও মা বাবার হাত ধরা হয়নি সেবেলায়, হয়তো বাবা বা মা আমাদের হাত ধরেছেন, তবে তা কঠিনভাবে, যেনো ছুটতে না পারি। এখন বাবা মা আর আমার হাত ধরেন না, সুযোগ পেলে আমিই বরং বিভিন্ন ছুতোয় বাবা-মায়ের হাত ধরি মমতার সাথে। এখন আর বাবা-মাকে কোনোভাবেই প্রতিপক্ষ ভাবতে পারি না।
এত এত পরিবর্তন তবু কোনোদিন বলা হয়নি মনের ছোট্ট একটা কথা। হয়তো অস্পষ্ট আড়ষ্টতা কোনো দিনই মুখ ফুটে বলতে দেবে না যেহেতু আমি লিখতে যাও পারি, বলতে কিছুই পারি না। আজ তাই লিখে যেতে চাই একটা কথা- প্রিয় মা-বাবা, এই পৃথিবীতে আপনাদেরকেই সবচে বেশি ভালোবাসি।
সর্বশেষ এডিট : ১৮ ই ফেব্রুয়ারি, ২০২০ সকাল ১১:৩৩