শুনলাম মোহাম্মদপুরে সেজমামার বাসায় যশোর থেকে নানি এসেছেন।
হলে থাকাকালীন সুযোগ পেলেই এই মামার বাসায় যেতাম সেজমামীর হাতের রান্না খাওয়ার লোভে। মামী অসাধারণ রান্না করেন। মামীর সাথে প্রতিযোগিতায় কেকা ফেরদৌসী নিশ্চিত দশম হয়ে যাবেন।
সেই রান্নার ঘ্রাণ আর নানির সাথে দেখা করা; অতএব এক সন্ধ্যায় ছুটলাম মোহাম্মদপুরে। বাসায় ঢুকতেই দেখি চাঁদের হাট বসে গেছে। নানির সাথে আমার একমাত্র খালা এবং খালার বড়কন্যাও উপস্থিত। ঘরময় কেমন একটা গুজুর গুজুর ফুসুর ফুসুর চলছে কিন্তু আমাকে দেখলেই বাতচিত একদম বন্ধ!
বুঝলাম না কিছুই।
রাতে খাওয়ার টেবিলেই আসল ঘটনাটা শুনলাম। খালার বড়কন্যা মিমির বিয়ের কথাবার্তা চলছে। এখানে একটা দেখাদেখি পর্বের ব্যবস্থা হচ্ছে। আমি আঁড়চোখে মিমির দিকে তাকালাম, এই সেদিনও দেখলাম ফ্রক পড়ে লজেন্স খাওয়ার জন্য প্যানপ্যান করে কেঁদে বাড়ি উদ্ধার করছে, এখন নাকি সেই মিমির বিয়ে! নানিকে বললাম- এইটুকুন মেয়ের বিয়ে কিসের?
নানি বললেন, এই তুই কোনো কথা বলবি না, চুপ কর। এই জন্যেই তোর সামনে বলতে চাইনি। নিজেতো বসে বসে ধাঙর হচ্ছিস, তার কোনো খোঁজ নেই, বোনের বিয়ের বয়স হচ্ছে, তারও কোনো খেয়াল নেই.. ..
আগের শান শওকত এখন না থাকলেও বনেদি রাগটা নানির ঠিকই রয়ে গেছে। আমি মানে মানে করে থেমে গিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম ছেলে কোথায় কি করে?
খালা বললেন- ছেলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ল-তে পড়ে...
: ল-য়ে পড়ে? কি নাম?
: নাহিদ
: কোন হলের স্টুডেন্ট, জানেন?
: মুহসীন হলের।
আমি হো হো করে হেসে ফেললাম। নানি আর খালার বিস্মিত চোখের দিকে তাকিয়ে বললাম- আরে, ওকেতো আমি খুবই ভালো করে চিনি, শুধু ওকে না, ওর বন্ধুবান্ধব চৌদ্দগুষ্ঠিকেই চিনি। এইবার সাব জুডিশিয়াল ম্যাজিস্টেট হওয়ার জন্য ভাইভা দিয়ে বসে আছে। রেজাল্ট হলেই জয়েনিং। হলমেট, আমার দুই ইয়ার জুনিয়র এবং আমার বন্ধু মুকুলের এলাকার হওয়ায় নিয়মিতই নাহিদের দেখা সাক্ষাৎ হয়। না চেনার কোনো কারণই নেই।
নানি বললেন- শোন, তুই যেহেতু ভালো চিনিস, তাহলে তুইই একটু যোগাযোগ কর...
আমিও বিপুল উদ্যমে ঝাঁপিয়ে পড়লাম। আরে, জীবনে ঘটকালী করতে না পারলে বাঙালির জীবনে সার্থকতা কোথায়? যদিও নিজের বিয়েরই কোনো খোঁজ নেই, তাতে কি...
এরপর বাকি কাজ খুব সহজ আমার জন্য। ছেলে এবং মেয়ে, দুজনেই আমার নিতান্তই কাছের মানুষ। ক্যাম্পাসে দেখাদেখি, ইত্যাদি ইত্যাদির পর একদিন আংটিবদলও হয়ে গেলো। এখন সুবিধামত একটা ডেট ঠিক করে বিয়েটা হলেই আমার সফলতার হার হান্ড্রেড এ হান্ড্রেড!
শোনা গেলো, খালু তবলিগের চিল্লা দিতে গিয়েছেন, হপ্তাহখানেক পর চিল্লা শেষ করে খালু ঢাকা আসলে তারপর বিয়ের ডেট ঠিক হবে।
এই ঘটকালিজনিত কারণে প্রায় মামার বাসায় যাই। সাফল্যের ঝলকে আমার কদরও খানিকটা বেড়ে গেছে। আমি গেলেই মিমি আমার দিকে গরুর মত বড় বড় চোখে কেমনভাবে যেন তাকায়। আমি অবশ্য ঠিক বুঝতে পারি না; এটা কি তার হবু বর ঠিক করে দেয়ায় কৃতজ্ঞতা না কি অন্য কিছু.... মেয়েটা কেমন দ্রুতই বড় হয়ে যাচ্ছে।
একদিন শুনলাম খালু ঢাকায় এসেছেন। যাক, এবার কাহিনী খতম, পয়সা হজম।
বিয়ে হয়ে গেলে গিফট টিফট কি পাবো সে হিসেব কঁষতে কঁষতে মামার বাসায় ঢুকতেই আবহাওয়া অধিদপ্তরের ১০ নম্বর মহাবিপদ সংকেত শুনতে পেলাম। উত্তর পূবের আকাশ পুরো থমথমে। ঘটনা কি বুঝলাম না। কেউ কিছু বলছেও না। এক সময় পিচ্চি নিশাত বললো- আপু বিয়ে করবে না...
আমি পুরো তব্ধা খেয়ে গেলাম। পাশের রুমে মিমি গ্যাঁট হয়ে বসে ছিলো, ওর কাছে গিয়ে চেয়ার টেনে বসলাম।
: সত্যি করে বলতো ঘটনা কি? কাউকে পছন্দ করিস?
: হ্যাঁ
: তাইলে আগে বলিসনি ক্যান? আর আগে যেহেতু বলিসনি তো এখন বলে ঝামেলা পাকাচ্ছিস ক্যান?
মিমি চুপ করে আছে, কোনো কথা বলছে না। আমি জিজ্ঞাসা করলাম-
: তো সে রত্নটা কে?
: আপনি।
: !!!!!
আমি চেয়ার থেকে প্রায় পড়েই যাচ্ছিলাম। এ, এই মেয়ে বলে কি!!
আমাদের ফ্যামিলি কালচার এমন যে এই ঘটনা জানতে পারলে উথালপাতাল হয়ে যাবে.... কিছুক্ষণ বেকুবের মত মিমির দিকে তাকিয়ে থেকে উঠে পড়লাম, এখানে বসে থেকে লাভ নেই। পেছন থেকে মিমি বললো-
: আমি আপনাকে ছাড়া কাউকে বিয়ে করবো না।
: তুই কি এ কথা বলেছিস কাউকে?
: না বলিনি এখনও
: আচ্ছা ঠিকাছে, দেখি কি করা যায়। চিন্তিত মুখে বাসায় চলে আসলাম।
এরপর কয়েকদিন আর ওমুখো হইনি। সপ্তাহখানেক পর মামার ফোন পেয়ে মোহাম্মদপুর গেলাম, যেতেই সেজমামি নেকলেসটা হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললেন- এটা নাহিদকে ফেরত দিয়ে দিয়ো....
আমি ওটা পকেটে ফেলে আস্তে আস্তে বাসার দিকে পা বাড়ালাম।
গল্প এখানেই শেষ। তাইলে গা হিম করা ভুতের গল্প কই? আরে ভাই কোনো ভুত ফুতই নেই তার গল্প আসবে কোত্থেকে। তবে ইউটিউবে দেখেছি ট্রেন্ডি কোনো কনটেন্ট সার্চ দিলে ওই একই নামে প্রচুর রেজাল্ট আসে, যেগুলো ক্লিক করলেই দেখা যায় পুরোনো, অচল অন্য কিছু কনটেন্ট....। এখন সবাই যেহেতু ভুতের গল্প দিচ্ছে, আমিও ওই টেকনিক অ্যাপ্লাই করে আমার এই রদ্দিমাল চালিয়ে দিলাম আর কি!!!
ও ভালো কথা, এই গল্পের আসল নাম হবে- ঘটকালী করতে গিয়ে যেভাবে ফেঁসে গেলাম।
ছবিসূত্র
সর্বশেষ এডিট : ২৮ শে আগস্ট, ২০২০ সকাল ১০:৪০