মেয়েটা রিকশা থেকে নেমে এদিক ওদিক তাকাচ্ছে। দেখেই আমি বুঝে ফেললাম যে মেয়েটা সমস্যায় পড়েছে।
ছোটবেলা থেকেই আমার মধ্যে কিছু একটা আছে, যে কারণে অনেক কিছুই আগেভাগে টের পেয়ে যাই। তাতে করে অবশ্য ঝামেলা ছাড়া বিশেষ কোনো সুবিধা পাইনি কোনোদিনই।
ক্লাস সিক্সে থাকতে একবার এই অগ্রীম বোঝার দায় চুকাতে ওই স্কুলই ছেড়ে দিতে হয়েছিলো। ঘটনাটা এ রকম-
ছাত্র সংসদ থেকে বেশ কিছু প্রকাশনা বিক্রি করে। এই গ্রিটিংকার্ড, ডায়েরি, রাইটিং প্যাড, এ রকম ছোট ছোট কিছু বস্তু। এগুলো বিক্রির টাকা থেকে সংসদের কিছু আয় হয়। এক ছুটির আগে আগে গেলাম সংসদ রুমে। বাড়িতে যাচ্ছি, বন্ধুদের জন্য কিছু কার্ড টার্ড নেবো। ওগুলো নেয়ার পর আমার দেয়া টাকাটা ড্রয়ারে রাখতে গিয়েই রফিক ভায়ের মুখের ভাব বদলে গেলো।
আমি সঙ্গে সঙ্গে বুঝে ফেললাম যে কি হয়েছে, জিজ্ঞাসা করলাম-
: রফিক ভাই, টাকা চুরি হয়ে গেছে?
রফিক ভাই উত্তর না দিয়ে আমার দিকে কেমনভাবে যেনো তাকিয়ে থাকলেন ।
বাড়িতে আমার কার্ড পেয়ে বন্ধুরা খুশি। আমিও। এরপর আবার হোস্টেলে ফেরার পর ওইদিন রফিক ভায়ের ওভাবে তাকিয়ে থাকার হাকিকত বুঝতে পারলাম। রফিক ভাই মারফত সংসদের অন্যদেরও দৃঢ় বিশ্বাস জন্মেছে যে টাকাটা চুরির পেছনে আমিই আছি!!
এই ঘটনার রেশ সহসাই শেষ হলো না। বিরাট হাঙগামা শেষে হোস্টেল এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠান- দুটোই ছেড়ে আসলাম। এরপর কানে ধরেছিলাম, আর কোনোদিনই, কোনো অবস্থাতেই কোনোকিছুই অগ্রীম বুঝবো না।
কিন্তু এখন রেজিস্ট্রার বিল্ডিংয়ের পেছনে এই ভর দুপুরের তপ্তরোদে মেয়েটাকে দেখে পৌরুষত্ব না প্রেম জেগে উঠলো; বোঝা গেলো না, কিন্তু আস্তে আস্তে আমাকে রিকশার দিকে এগিয়ে যেতে দেখা গেলো। সম্ভবত মেয়েটা বাসের জন্য এসেছে, বাস মিস করার শংকায় আছে। আমি কাছে গিয়ে জানতে চাইলাম-
: কোনো প্রব্লেম হয়েছে আপু?
: হ্যাঁ, রিকশা ভাড়ার টাকা খুচরা নেই। এখানে কোনো দোকান টোকানও নেই যে খুচরা করবো। আপনার কাছে ১০০ টাকার খুচরা হবে?
আমি ওয়ালেট বের করে দেখি আমার কাছে ১০০ টাকার খুচরা নেই। আমি বললাম-
: ভাড়া কত?
: ২৫ টাকা।
: আমার কাছে ২৫ টাকা আছে, এই নেন।
: কিন্তু আমি আপনাকে টাকাটা ফেরত দেবো কিভাবে?
: ফেরত দিতে হবে না, আপনি কোন বাসে যাবেন?
: বৈশাখী। ওই যে আসছে বাসটা।
: ও হো হো, তাড়াতাড়ি যান।
মেয়েটা দৌঁড়ে গিয়ে বৈশাখীতে উঠে পড়লো। বাসটা শ্যাওড়াপাড়ার দিকে যায়। আমি বাসের দিকে তাকিয়ে থাকলাম।
মেয়েটার চেহারা বা গেটআপে কোনো বিশেষত্ব নেই, কিন্তু কথাবার্তা বা আচরণে একদমই জড়তাহীন। সাধারণত এ রকম ক্ষেত্রে মেয়েরা অপরিচিত কোনো ছেলের হেল্প নিতে চায়না বলেই আমি জানতাম, কিন্তু এই মেয়েটি অদ্ভুতভাবে টাকা ফেরত না দেয়ার বিষয়টাও মেনে নিয়ে সুন্দর চলে গেলো।
সপ্তাহ কয়েক পর সাদ স্যারের ক্লাস শেষ করে লেকচার থিয়েটার থেকে বের হয়েছি। একটা মেয়ে পেছন থেকে ডাক দিলো- ভাইয়া, ভাইয়া....
আমি দাঁড়ালাম। একটা হালকা গড়নের মেয়ে দৌঁড়ে আসলো-
: কেমন আছেন?
আমি চিনতে পারলাম না। আমার চোখের দৃষ্টি দেখে মেয়েটা বললো-
: চিনতে পারেননি, তাইতো?
: না
: আরে, ওই যে রেজিস্ট্রার বিল্ডিংয়ের পেছনে.... রিকশা ভাড়া খুচরা ছিলো না...
: ও হ্যাঁ, মনে পড়েছে, মনে পড়েছে। কিন্তু আজ আপনাকে অন্যরকম লাগছে, একদম চিনতে পারিনি।
: কি রকম?
: বলতে পারছি না, কিন্তু কিছু একটা আলাদা আছে।
: যাকগে, আপনি আবার ভাববেন না যে আপনার ২৫টাকা এখন ফেরত দেবো। ওটা আমার কাছেই থাক। যেদিন আপনি এরকম সমস্যায় পড়বেন, সেদিন ফেরত দিতে আমি উপস্থিত হবো.. মেয়েটা হাসতে হাসতে বললো।
আমিও হেসে ফেললাম। আরে লাগবে না, রেখে দেন আপনার কাছে।
এরপর পরিচিত সাইনবোর্ডের মতই মেয়েটি বিভিন্ন সময় বিভিন্নস্থানে চোখে পড়তে লাগলো। সাংবাদিকতায় পড়ে, আমারই ইয়ারমেট। নাম রাধু।
রাধু? আমি প্রশ্নবোধকভাবে তাকালাম মেয়েটার দিকে। রাধু বললো, এটা আমার আসল নাম না, ছোটবেলায় মাদারীপুর থাকতে 'চাঁদের হাটে'র নাটকে রাধু নামের এক ছেলে চরিত্রে অভিনয় করেছিলাম, এরপর আমার নামই হয়ে গেছে রাধু। আমিও এখন সবাইকে ওটাই বলি।
এরপর রাধুর সাথে ঘনঘন দেখা হওয়ায় সম্পর্কটা আপনি থেকে তুমিতে এসেছে, কিছুটা সখ্যতাও তৈরী হয়েছে। এটাকে অবশ্য প্রেম বলার কোনো সুযোগ ছিলোনা।
সেকেন্ড ইয়ারের পরিক্ষার আগে আগে একদিন সন্ধ্যার পর হলে ফিরছি। বসুনিয়ার ওখানে আতিক ভাই আমাকে মাঠের কোণায় ডাক দিলেন। আমি আবার বিপদ বুঝে গেলাম। আতিক ভাই আমার হলে পলিটিক্স করেন। অনেক আগেই বাংলায় মাস্টার্স শেষ করেও কি হিসেবে হলে থাকেন, কে জানে..
আমি কাছে যেতেই আতিক ভাই বললেন-
: কি রে তোর তো আজকাল পাখা গজাইছে..
: ভাই, বুঝলাম না..
: বুঝোছ নাই, রাধুর সাথে তোর সম্পর্ক কি?
: কোন রাধু, ভাই? ও; জার্নালিজমের ওই মেয়ে? ভাই আমার সাথে কোনো সম্পর্ক নেই...
পাশ থেকে মিলন বললো- না ভাই, কিছু একটা অবশ্যই আছে। আমি দুইজনকে একসাথে বৃষ্টিতে ভিজতে দেখেছি।
মিলন আমার ইয়ারমেট, অ্যানথ্রোতে পড়ে। ফার্স্ট ইয়ারে একবার আমার সাথে ঝামেলা হওয়ায় বিপ্লবের হাতে মাইর খাইছিলো। সেই থেকে আমার উপর একটা রাগ আছে। এখন চান্স নিচ্ছে।
কিন্তু রাধুর সাথে কোনোদিনই আমি বৃষ্টিতে ভিজিনি। আমার সাথে ওইরকম সম্পর্কই না। মিলন বললো- ভাই মাইর লাগাবো? আপ্নের জিনিসের উপরে চোখ দেয়..
আমি বলতে গেলাম- না ভাই, এই রকম কিচ্ছু না.... কিন্তু তার আগেই আতিক ভায়ের চোখের ইশারায় মিলন আমার কপাল বরাবর এক ঘুঁষি বসিয়ে দিয়েছে। আমি ওর দিকে তাকানোর সুযোগই পেলাম না, অন্যদিক থেকে মাসুদ, হাসান আরও কে কে যেনো আমাকে সমানে মেরে মাঠের কোণায় ফেলে রেখে চলে গেলো।
মোহসীন হলের মাঠের অন্ধকার ওই কোণায় অনেকক্ষণ পড়ে থেকে কোনো কিছু আগেভাগে বোঝার বিপত্তিটা আরেকবার টের পেলাম... ..
ছবিসূত্র
অপু তানভীর, গিয়াসউদ্দিন লিটন, সোনাবীজ....... এবং গেছোদাদাসহ আরও অনেকের সুন্দর সুন্দর গল্প পড়ে পড়ে ইদানিং একটু গল্প লেখার চেষ্টা করছি। হচ্ছে অবশ্য কচু হাতি ঘন্টা, তারপরও...
সর্বশেষ এডিট : ১০ ই সেপ্টেম্বর, ২০২০ বিকাল ৫:৩৫