আমাদের মত অলেখকদের লেখাহীন হতে কোনো উপলক্ষের দরকার হয়না। কোনো কারণ ছাড়াই হঠাৎ একদিন দেখি আর লিখতে পারছি না, আর কারণ থাকলেতো কথাই নেই। অন্যদিকে লেখায় ফিরতে প্রয়োজন হয় নানা ধরনের কসরত আর দেনদরবারের।
সম্প্রতি সপরিবারে করোনা আক্রান্ত হওয়র পর যতটা না অসুস্থতা, তার চেয়ে বেশি অবসাদের কারণে ব্লগে আসতে পারিনি, লেখাও হয়নি। তারপর ফের ঘুম ফের জাগা ব্যস্ততা’র নিয়ম ধরে আবারও ব্লগে ফেরার পর লেখা যখন আসবো আসবো করছে, তখুনি শুনি আবিদ ভাই করোনা আক্রান্ত!
আবিদ ভাইয়ের সাথে আমার পরিচয় কবে থেকে শুরু, কবে সেটা গাঢ় হলো, কবে আমরা আপনজনের বলয়ে ঢুকে গেলাম, সেটার দিন তারিখ টুকে রাখা হয়নি কোথাও। আমার শুধু মনে পড়ে- বেসরকারি উদ্যোগে দেশের প্রথম ক্রীড়া পুরস্কার প্রবর্তনের আয়োজনে জড়িত ছিলেন আবিদ ভাই। আমি অ্যাড ফার্মে থাকাকালীন এক লম্বা বিকেলে তিনি এসেছিলেন শিল্পকলা অ্যাকাডেমিতে আয়োজিত ওই অনুষ্ঠানসংশ্লিষ্ট কাজে। আমরা সারারাত জেগে কাজগুলো শেষ করেছিলাম। শেষরাতের দিকে আবিদ ভাই স্টুডিওর ফ্লোরে ম্যাটের উপরেই ঘুমিয়ে পড়েন। আমি কিছুক্ষণ ঘুমন্ত আবিদ ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে ভাবছিলাম, পেশায় ডাক্তার, মধ্যবয়স্ক এই ভদ্রলোক কিসের প্রেরণায় সারারাত জেগে অপেশাদার কাজ করছেন?
পরিচয় ঘনিষ্ঠতায় রূপ নেয়ার পরে অবশ্য বুঝতে পেরেছি যে ডাক্তারি করাটাই তাঁর কাছে অপ্রয়োজনীয়, বাকি যেসব কাজ তিনি করেন, সেগুলোই বরং তাঁর আত্মার খোরাক, ভালোলাগার যায়গা।
সাফল্যের সঙ্গে এমবিবিএস পাশ করা এবং বিসিএস স্বাস্থ্য ক্যাডার-এ যোগদান সূত্রে আবিদ ভাই ডাক্তার, কিন্তু আদতে তিনি একজন সুপার ক্রিয়েটিভ মানুষ। আবিদ ভাই লেখক, উপস্থাপক, একটা বাংলা দৈনিকের স্বাস্থ্যপাতার সাথে জড়িত, একই ধরনের একটা মাসিকের সম্পাদনা করেন, মঞ্চ নাটক বা সাংস্কৃতিক আয়োজনে যুক্ত থাকেন, টিভিতে কাজ করেন। শিশু সংগঠনের সাথেও আছেন। আবিদ ভাই বুদ্ধিবৃত্তিক বিভিন্ন উদ্যোগের সাথে যুক্ত থাকেন, সর্বোপরি তিনি ‘ঘরের খেয়ে পরের মোষ তাড়ানো’য় ওস্তাদ ধরনের বিরল একজন মানুষ।
এই চরিত্রের কারণে ডাক্তারিটাই আর করা হয়ে ওঠেনি ঠিকমত। যতদিন চাকুরিতে ছিলেন, তদ্দিন মিরপুরের সরকারি হোমিওপ্যাথি কলেজে ছিলেন অ্যালোপ্যাথিক ডাক্তারি কি সব বিষয়ে পড়ানোর জন্য। যেহেতু হোমিও কলেজ, অ্যালোপ্যাথিক সাবজেক্টের খুব একটা ‘বেইল’ হয়তো ছিলো না, আবিদ ভাইও সময় কাজে লাগিয়ে সমানে ভালোলাগার যায়গাগুলোতে সময় দিয়ে গিয়েছেন।
তারপর একদিন সরকারি চাকুরির ধারাবাহিকতায় ঢাকার বাইরে বদলি করে দিলে আবিদ ভাইও সিদ্ধান্ত নিতে দেরি করেননি। অবলীলায় চাকুরি ছেড়ে দিয়ে ঢাকায় থেকে গিয়েছেন আর মোষ তাড়িয়ে চলেছেন। এই মোষ তাড়ানোর সুবাদে তার বন্ধু-শুভাকাঙ্খির সংখ্যাও চোখ কপালে তোলাম মত। যে কারণে নিজে করোনা আক্রান্ত হওয়ার সাথে সাথেই দেশের সেরা চিকিৎসার পাশাপাশি অসংখ্য মানুষের দোয়া, শুভকামনা পাচ্ছেন।
পেশাদার ডাক্তার না হলেও ডাক্তারি পরামর্শ নিতে আবিদ ভাই-ই আমার মত অনেকের জন্য সেরা বিকল্প। গত মাসে আমি করোনা আক্রান্ত হওয়ার পর আবিদ ভাই প্রত্যেকদিন ফোনে খোঁজ নিয়েছেন, করণীয় বাতলেছেন। সেভাবেই চলছিলো। মাসের শেষের দিকে আমরা তো নেগেটিভ হলাম, কিন্তু এর দুদিন পরই জানলাম- আবিদ ভাই নিজেই করোনা আক্রান্ত। ৩০ শতাংশ অকার্যকর ফুসফুস নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন প্লাস অক্সিজেন সাপ্লিমেন্ট লাগছে!
মনটা বিষাদাক্রান্ত হয়ে আছে। আবিদ ভাই আমার চেয়ে কমপক্ষে ১৫ বছরের বড় হয়েও যেভাবে স্নেহ-ভালোবাসার বন্ধনে আবদ্ধ করে রেখেছেন, সে বন্ধন থেকে মুক্ত হওয়ার কোনো সুযোগ বা ইচ্ছে আমার নেই। আমার মত এরকম আরও অনেকেই আছেন, যাদের একজন ফেসবুকে পোস্ট দিয়েছেন- “আমার বেড়ে ওঠার বেলায় মেন্টরদের একজন। ব্যতিক্রমী মেধার একজন মহীরুহ- যার সাথে আমার শৈশব কৈশোরের কত কত স্মৃতি! একজন ডাক্তার হয়ে নিজ হাতে চিনিয়েছেন প্রিন্টিং পাড়ার অলিগলি- বুনে দিয়েছেন শিল্পীত স্বপ্ন দেখার বীজ। কম্পিউটার গ্রাফিকস যখন তেমন কেউই জানতো না, তার হাত ধরে ঘুরে ঘুরে জানলাম, চিনলাম! কত কত প্রোগ্রামের স্টেজ, ব্যাকড্রপ আর নাটকের শিল্পনির্দেশক এই আবিদ ভাই...
ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানো'র মত পরোপকারী এই আবিদ ভাই আজ হাসপাতালে ভর্তি, করোনা আক্রান্ত হয়ে। আমার অন্তর বলছে, তার ব্যস্ততার মাঝে এটা একটা ঐশী ইন্টারভেনশন, ইনশাআল্লাহ তিনি দ্রুতই আরোগ্য হয়ে ফিরে আসবেন- যাতে আমরা আমাদের সামান্য খুঁটিনাটি অসুবিধায় ওনাকে বার বার জ্বালাতে পারি- যাতে এক বসায় ঘন্টা দুয়েক (মিনিমাম!) সরেস আলাপন চালাতে পারি। যারা আবিদ ভাইকে চেনেন, প্লিজ কল দেবেন না- দোয়া করুন, আর বেশী মনে চাইলে মেসেজ করুন! ওনার খুবই বিশ্রাম দরকার!”
ছবিসূত্র: গুগল
সর্বশেষ এডিট : ১০ ই ডিসেম্বর, ২০২০ বিকাল ৫:১০