বিশ্ববিদ্যালয়ে পা রাখার আনুষ্ঠানিক অনুমতির আগে থেকেই ক্যাম্পাসে আমার আক্ষরিক পদচারণা শুরু হয়েছিলো। মধ্য নব্বুইয়ে আমরা সোহরাওয়ার্দীতে ফুটবল খেলতে যেতাম। তরুছায়াঘেরা সোহরাওয়ার্দী জুড়ে সে সময় গলফ কোর্ট ছিলো, তারই পাশের সবুজ জমীনে আমরা খেলতাম। যেদিন ওখানে যায়গা পাওয়া যেতো না, সেদিন আমরা যেতাম মলচত্বর বা মোহসীন হলের মাঠে। সে সময় রমনা-সোহরাওয়ার্দী আর এদিকে ঢাকা বিশ্বদ্যিালয়-বুয়েট মিলিয়ে এ এলাকা ছিলো সবুজের গহীন গল্পরাজ্য। রাজধানীর ব্যস্ততা-গদ্যের মধ্যেও প্রবল বৈপরীত্যের এক শান্ত কবিতা।
এরপর নব্বুইয়ের শেষভাগে যখন বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন হলাম, তখনও বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা ছিলো আভিজাত্য আর ইতিহাসের মিশেলে ঘেরা এক বিস্ময়। কলাভবন তখন তিনতলা। উচ্চতায় পাশের রাধাচুঁড়াকেও ছুঁতে পারেনা; আর সামনের ইউক্যালিপটাসগুলোর কাছেতো রীতিমত বামন!! পুরো এলাকার বৃক্ষরাজীর ফাঁকফোকর গলে শিল্পিত ভবনগুলোর অবস্থান একরকম মায়াময় প্রশান্তি ছড়িয়ে দিতো। সৌম্য-সমাহিত এক দ্যোতনা বিরাজ করতো এ এলাকা জুড়ে। আর তার ভরকেন্দ্রে ছিলো টিএসসি।
আহ্ টিএসসি! কত মেঘের ঘনঘটা, কত স্মৃতিকাতরতা, কত কত প্রিয় কথা জড়িয়ে আছে এই টিএসসির সাথে! কত সম্পর্ক ভাঙা আর গড়ার সাক্ষী এই টিএসসি। ষাটের দশকে গ্রিক স্থপতি কনস্ট্যান্টিন ডক্সিয়াডেস এর নকশায় নির্মিত টিএসসির ভাঙা লাল ইটগুলোর সাথে যে ভালোবাসা মিশে আছে, তার দখল নিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা জীবনের অনেক কিছুই ছাড়তে রাজি থাকবে বলেই আমার বিশ্বাস।
কিন্তু সে বিশ্বাসকে পাত্তা না দিয়েই আমরা চলে এলাম উন্নয়নের কালে। এখানে এখন উন্নয়ন মানেই দৃষ্টিসীমা আটকে দেয়া স্থাপনার সারি। বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার রাস্তাগুলোয় মাঝের ডিভাইডার উচুনিচু করার পরীক্ষণকে জারি রেখে আমাদের চোখের সামনেই ধাঁইধাঁই করে ত্রিতল কলাভবন চতুর্থতলা পূর্ণ করে পঞ্চম তলায় পৌঁছে গেলো। আমাদের আবেগ আর প্রতিবাদকে মথিত করে তাবৎ সবুজকে নিকেশ করে এখানে সেখানে ধমাধম একটার পর একটা বিল্ডিং উঠে আমাদের দৃষ্টির সামনে প্রতিবন্ধকতা তুলে দিলো। তবুও টিকে ছিলো টিএসসি। বহুজাতিক কোম্পানি টেলকোগুলোর মোক্ষম আর্থিক প্রস্তাবও কোনক্রমে এড়াতে পেরেছিলো এ শতাব্দীর প্রথম দিকে। কিন্তু এবার আর টিকবে বলে মনে হচ্ছে না। এবার স্বয়ং রক্ষকবৃন্দরাই চাইছে এর উন্নয়ন। উন্নয়ন না করে এবার আর ছাড়া হবে না, রক্তের কসম! অর্থের মবিলিটি বন্ধ হলে কি আর উন্নয়ন ধরে রাখা যাবে!!
এখানে এখন উন্নয়ন মানে ঝাঁ চকচকে রাস্তা, রাস্তায় যাতায়াতকারীদের নিরাপত্তা বিধান নয়। এখানে এখন নীল আকাশকে ঢেকে দেয়া স্থাপনাগুলোই উন্নয়ন; তারই নিচে শীতার্ত রাতে গুটিশুটি মেরে পলিথিন গায়ে কুকুরের সাথে জীবন ভাগাভাগি করা শিশুর জগৎটা ফিরিয়ে দেয়ার মধ্যে নয়। এখানে এখন পুরোনোকে দুমড়ে মুচড়ে ভেঙে ফেলাটাই উন্নয়ন, ঐতিহ্য রক্ষণে নয়। সেখানে টিএসসি কোন ছার। তাকে তো ভাংতেই হবে। ইতিহাসকে অস্বীকার করার মধ্যেই তো বাঙালির বীরত্ব।
এদেশের জন্মের ইতিহাসের পরতে পরতে যার স্থান অবিচ্ছেদ্য- হে টিএসসি, আজ তোমার আশু প্রয়াণ সংবাদে আমি ব্যথিত। একদা যে ব্যাপীত ভালোবাসায় আমাদেরকে আপন করে নিয়েছিলে, সে ভালোবাসার ঘ্রাণ আর নিতে পারবো না, তার বদলে সেখানে মুখ ব্যাদান করে দাঁত কেলিয়ে থাকবে উন্নয়নের স্মারক। সে উন্নয়ন অবগাহন করে তুমি ইতিহাস বইয়ের পাতাতেই ঘুমাও শান্তিতে, ভীষণ চুপচাপভাবে।।
প্রথম ছবি: উইকিপিডিয়া:
দ্বিতীয় ও শেষ ছবি কৃতজ্ঞতা: প্রথমআলো
নিচে ব্লগার তমাল মন্তব্যে প্রথমআলোর লিংক কাজ করছে না বলে বলেছেন। ইদানিং প্রথমআলোর লিংক দিলে কেন জানিনা, ঠিকঠাক কাজ করে না। তাই নিউজটাই উঠিয়ে দিলাম: আজকের অনলাইনে প্রকাশিত।
ভাঙা হবে টিএসসি ভবন, নকশার কাজ চলছে
প্রকাশ: ২১ ডিসেম্বর ২০২০, ১৯: ০৫
ভেঙে সম্পূর্ণ নতুন রূপে গড়া হবে। তবে ষাটের দশকে নির্মিত টিএসসির দৃষ্টিনন্দন স্থাপনাটির নতুন রূপ কেমন হবে, সে বিষয়ে এখনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়নি বলে জানিয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকৌশল দপ্তর ও সরকারের গণপূর্ত অধিদপ্তরের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা। গ্রিক স্থপতি কনস্ট্যান্টিন ডক্সিয়াডেস ষাটের দশকের শুরুতে টিএসসির নকশা করেছিলেন। পূর্ব পাকিস্তানের তৎকালীন সামরিক শাসক জেনারেল আইয়ুব খানের আমলে ভবনটির নির্মাণকাজ শেষ হয়।
গত ২ সেপ্টেম্বর ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে এক অনুষ্ঠানে যোগ দিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি ভবনটিকে তিনি আধুনিক ভবন হিসেবে দেখতে চান। সেই লক্ষ্যে তিনি ইতিমধ্যেই সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে ভবনের নকশা প্রস্তুত করার নির্দেশ দিয়েছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থী শেখ হাসিনা সেদিন বলেছিলেন, ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়। যেহেতু টিএসসি ছাত্র ও শিক্ষকদের কেন্দ্র, তাই আমরা টিএসসি ভবনকে আধুনিক পদ্ধতিতে নতুন করে গড়তে চাই।’ প্রধানমন্ত্রীর ওই বক্তব্যের পর টিএসসি ভবন নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের মধ্যে আলোচনা শুরু হয়। গত ৩০ সেপ্টেম্বর এক ভার্চ্যুয়াল আলোচনা সভায় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য মো. আখতারুজ্জামান বলেন, ‘১৯৬৪ সালে টিএসসি নির্মিত হয়েছিল। তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীর সংখ্যা ছিল ৩ হাজার ৮০০, শিক্ষকের সংখ্যা ছিল ২০০ থেকে কিছু বেশি। এটাকে বিবেচনায় রেখে এটুকু জায়গায় টিএসসির ভবন, মিলনায়তন ও ফ্যাসিলিটিজ তৈরি করা হয়েছিল। আজ বিশ্ববিদ্যালয়ে ২ হাজারের বেশি শিক্ষক আর ৪০ হাজারের বেশি শিক্ষার্থী আছেন। কিন্তু টিএসসি আগের মতোই আছে। প্রধানমন্ত্রী সে জন্যই আমাদের এটা পুনর্বিন্যাস করার নির্দেশনা দিলেন।’
এদিকে শিক্ষকদের কেউ কেউ টিএসসির দৃষ্টিনন্দন ভবনটি ভেঙে ফেলার সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করেছেন। তবে টিএসসিকে নতুন করে গড়ার লক্ষ্যে এরই মধ্যে কাজ শুরু করেছে সরকারের গণপূর্ত অধিদপ্তর। নকশা প্রস্তুত প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে গণপূর্ত অধিদপ্তর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছ থেকে চাহিদাপত্র নিয়েছে। টিএসসির ভারপ্রাপ্ত পরিচালক সৈয়দ আলী আকবর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকৌশল দপ্তরকে টিএসসির নতুন অবয়বে কী কী সুযোগ-সুবিধা থাকতে পারে, তার একটি তালিকা দিয়েছেন। সম্প্রতি তালিকাটি গণপূর্তের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের কাছে জমা দিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকৌশল দপ্তর। টিএসসির ভারপ্রাপ্ত পরিচালক সৈয়দ আলী আকবরের দেওয়া তালিকায় যেসব সুযোগ-সুবিধার কথা বলা হয়েছে, সেগুলো হলো সাংস্কৃতিক কার্যক্রম পরিচালনার জন্য মহড়াকক্ষ, ব্যায়ামাগার, টিএসসিভিত্তিক সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোর জন্য আধুনিক সুবিধাসংবলিত কক্ষ, আন্তক্রীড়াকক্ষ, পৃথক ক্যাফেটেরিয়া, শিক্ষক মিলনায়তন, গাড়ি পার্কিংয়ের জন্য তিন তলাবিশিষ্ট স্থান, অতিথিকক্ষসহ বেশ কিছু আধুনিক সুবিধা। সৈয়দ আলী আকবর বলেছেন, তাঁদের দেওয়া তালিকা অনুযায়ী নতুন অবয়বে টিএসসিতে তিনটি মিলনায়তন থাকবে, যেগুলোর একটিতে প্রায় দেড় হাজার ও অন্য দুটির প্রতিটিতে ৩০০ জনের ধারণক্ষমতা থাকবে। কমপ্লেক্সের দ্বিতীয় বা তৃতীয় তলায় নতুন একটি সুইমিংপুল নির্মাণ করা হবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্বাহী প্রকৌশলী (সিভিল) মো. আবদুল মান্নান আজ সোমবার প্রথম আলোকে বলেন, ‘টিএসসির নকশার বিষয়টি নিয়ে আমাদের অন্ধকারেই রাখা হয়েছে। তবে গণপূর্তের কর্মকর্তাদের সঙ্গে যখন কথা হয়েছে, তখন তাঁরা আমাদের বলেছেন যে এটি হবে সম্পূর্ণ নতুন আঙ্গিকের একটি প্রকল্প। টিএসসিতে আধুনিক সুবিধাসংবলিত একটি নান্দনিক বহুতল কমপ্লেক্স (ভবন) হতে পারে। গণপূর্তের কাছে আমরা প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধার তালিকা জমা দিয়েছি। কিন্তু কাজের অগ্রগতি সম্পর্কে আমাদের এখনো কিছু জানানো হয়নি। নকশা অনুমোদিত হয়ে আসার পর কাজ শুরু হবে।’ আবদুল মান্নানের দেওয়া তথ্যের সূত্র ধরে যোগাযোগ করা হয় গণপূর্ত অধিদপ্তরের ঢাকা সার্কেল-১৪-এর নির্বাহী প্রকৌশলী মো. মাহাবুবুর রহমানের সঙ্গে৷ তিনি প্রথম আলোকে বলেন, টিএসসি ভেঙে নতুন কমপ্লেক্স নির্মাণ করা হবে। নকশার কাজ চলছে। নকশার দায়িত্বপ্রাপ্ত গণপূর্তের কর্মকর্তা আলী আশরাফ দেওয়ান প্রথম আলোকে বলেন, নকশা তৈরির জন্য তাঁকে প্রস্তুতি নিতে বলা হয়েছে। এ বিষয়ে আনুষ্ঠানিক সিদ্ধান্ত আকারে কিছুই এখনো হয়নি বলে জানান তিনি। বিরোধিতায় শিক্ষকেরা টিএসসির বর্তমান ভবনটিকে ‘আধুনিক স্থাপত্যের সুন্দর নিদর্শন’ উল্লেখ করে এটিকে ভেঙে ফেলার সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের কেউ কেউ৷
বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ ফেসবুকে লিখেছেন, ‘পৃথিবীর নামকরা সব বিশ্ববিদ্যালয়কে ছবি দেখেই চেনা যায় কিছু ঐতিহ্য ধারণ করা স্থাপনার মাধ্যমে। শত শত বছরের পুরোনো হয়ে গেলেও এগুলোকে সযত্নে সংরক্ষণ করা হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এমন স্থাপনার মধ্যে আছে কার্জন হল, এসএম হল ও টিএসসি। এর মধ্যে টিএসসি ষাটের দশকে নির্মিত অপেক্ষাকৃত আধুনিক স্থাপত্যের একটি সুন্দর নিদর্শন। বাংলাদেশের স্বাধীনতাসংগ্রামের পূর্ববর্তী সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের ঐতিহ্য ধারণ করে এই টিএসসি। রক্ষণাবেক্ষণের বদলে এটিকে ভেঙে এখন বহুতল ভবন নির্মাণের আয়োজন চলছে। শুধু শুধু অর্থনীতিবিদদেরই সমালোচনা করা হয় যে তাঁরা সবকিছুর বাজারদর বোঝে, কিন্তু কোনো কিছুর প্রকৃত মূল্য বোঝে না!’
পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক কামরুল হাসান লিখেছেন, ‘বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে টিএসসির সামাজিক–রাজনৈতিক গুরুত্ব ও ঐতিহ্য আছে। এটি ভেঙে নাকি এখন বহুতল ভবন বানানো হবে! এমনিতেই মেট্রোরেল দিয়ে টিএসসির সৌন্দর্য নষ্ট হওয়ার ঝুঁকি চোখে ভাসছে, আর এখন বহুতল ভবন। আমরা উন্নয়ন বলতে যখন বহুতল ভবন বুঝি, তখন “ইতিহাস ঐতিহ্যের খেতা পুরি টাইপের”কার্যক্রম মনটা ভারাক্রান্ত করে দিল। লাইব্রেরি ভেঙে বহুতল ভবন বানানোর কথা শুনলে তা–ও মনটা খুশি হতো। যেটা দরকার, সেটা করা হয় না। যেটা প্রায়োরিটি, সেটাকে গুরুত্ব দেওয়া হয় না।’
এছাড়াও আরও কয়েকটা সম্পুরক নিউজ আজকের অনলাইনেই আছে।
সর্বশেষ এডিট : ২৩ শে ডিসেম্বর, ২০২০ সকাল ১০:৩৫