০১
অফিসে যাওয়ার যোগাড়যন্ত্র করছি, বারান্দা থেকে রুমির গলা শোনা যাচ্ছে- এই, যাঃ যাঃ, বারান্দা নোংরা করবি না....। আমি আগ্রহ বোধ করলাম; রুমি কার সাথে কথা বলছে? বারান্দায় উঁকি দিয়ে দেখি এলাহি কারবার! বারান্দাময় ঘাস-পাতা-লতা ছড়ানো এবং সেগুলো নিয়ে একজোড়া চড়ুই ব্যাপক আনন্দে উত্থাল-পাতাল করছে।
বুঝতে পারলাম এই চড়ুই দম্পতি ঘর বাঁধতে চলেছে আমার বারান্দায়। এটা আমার জন্য নতুন কিছু না। কোনো এক অদ্ভুত কারণে ঢাকা শহরে যে কয়টি বাসায় আমি ছিলাম, সবগুলোতেই পাখি এসে বাসা করেছিলো। এগুলোর মধ্যে চড়ুই, দোয়েল, বুলবুলি, এমনকি শালিকও ছিলো।
আমার আগের বাসাতে বারান্দায় আমি মাটির ব্যাংক টানিয়ে দিয়েছিলাম; নতুন নতুন দোয়েল দম্পতি ওটা ভাড়া নিতো মাসখানেকের জন্য। তারপর সংসার করে ডিম-বাচ্চা ফুটিয়ে ভাড়াটাড়া পরিশোধ করে চলে যেতো। কিছুদিন পর আবার নতুন একজোড়া আসতো। এরপর আবার আরেক জোড়া। হয়তো দোয়েল সমাজে রুমি আর আমার একটা গুড রেপুটেশন (!!) ছড়িয়ে পড়েছিলো যে এরা ভালো আছে; পাখিদের ডিস্টার্ব করেনা। ব্যাপারটা আমার ভালোই লাগতো। উপরন্তু বেডরুমের সাথের বারান্দা হওয়ায় ভোরের আলো ফোটার সাথে সাথে দোয়েলের গান বেশ গ্রাম গ্রাম একটা আবেশ ছড়িয়ে দিতো।
ইদানিং পাখির জন্য বানানো মাটির বাসা কিনতে পাওয়া যায় দোকানে। মাস দুয়েক আগে আমার নতুন এই বাসায় ওঠার পর একবার ভেবেছিলাম ওরকম কয়েকটা মাটির বাসা এনে বারান্দায় টানিয়ে দেবো। কিন্তু এই বাসার বারান্দাটা এতই সুন্দর যে সে চিন্তা অগত্যা বাদ দিতে হয়েছিলো; পাখিগুলো বারান্দা বড্ড নোংরা করে। সে চিন্তা আমি বাদ দিলেও পাখিরা নিশ্চয় বাদ দেয়নি। ফলে যথাসময়ে খুঁজে খুঁজে ঠিকই আমার বারান্দায় এসে উপস্থিত!
কিন্তু এখন এই চড়ুই বাসাটা বাঁধলো কোথায়? বারান্দায়তো কোনো খাঁদ-খাঁজ বা ছিদ্র কিছুই নেই। খুঁজতে খুঁজতে দেখি- করোনার কারণে এখন অফিস থেকে ফিরে প্যান্ট-শার্ট বারান্দায় হ্যাঙারে ঝুলিয়ে রাখি, একদিন বিরতি দিয়ে ওটা আবার পরি; সেই হ্যাঙারে ঝুলে থাকা আমার জিন্স প্যান্টের মধ্যে তৈরী হওয়া কিঞ্চিত খাঁজের ভেতরেই কুটো-লতা-পাতা-ঘাস দিয়ে বাসা বানানোর চেষ্টা করছে...!!!
আমার মনটাই খারাপ হয়ে গেলো। আহারে, বেচারাদের বোধহয় ডিম পাড়ার সময় ঘনিয়ে এসেছে কিন্তু এই পোড়া শহরে একটু বাসা বাঁধার যায়গাটুকুও মিলছে না। অগত্যা একদিনের জন্য ঝুলে থাকা প্যান্টের ভেতরেই বাসা তৈরীর কাজ শুরু করে দিয়েছে।
আমি দ্রুতই একটা হার্ড কাগজের বাক্স নিয়ে বারান্দায় গ্রিলের সাথে বেঁধে লতাপাতাগুলো ওখানে দিয়ে প্যান্টটা সরিয়ে নিলাম। একটু টেনশনে অবশ্য ছিলাম যে পাখিগুলো কি ওখানে যাবে? বাসা থেকে বের হওয়ার আগে একবার উঁকি দিয়ে দেখলাম বাক্সের ভেতর থেকে ফুরুৎ করে একটা চড়ুই বের হয়ে ডানা মেললো। আমিও মনে আনন্দ নিয়ে অফিসের দিকে চললাম।
০২
একটা নগর বা জনপদের অনুষঙ্গ শুধু মানুষ বা শিল্প-কলকারখানা, আকাশ ছোঁয়া ভবন বা দ্রুতগামী শকটরাজী নয়; বরং জনপদে আমাদের বেঁচে থাকার অংশীদার হয় নির্মল প্রকৃতি, জলাধার, সবুজ বৃক্ষরাজী, আমাদের আশেপাশেই থাকা প্রাণীজগত এবং অতি অবশ্যই এই পক্ষীকুল। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখজনক যে আমরা নিজেদের জীবন বাঁচাতে, না; বরং বলা ভালো নিজেদের জীবন বাঁচানোর বাহানায় এসবকিছুকে ধ্বংস করে ফেলছি নির্দ্বিধায়। বুঝতেও পারছি না যে এসব ধ্বংস করার মধ্য দিয়ে আমরা আসলে নিজেদের ধ্বংসকেই তরাণ্বিত করছি মাত্র।
এই ধ্বংসের প্রক্রিয়ায় আমরা কি পরিমাণ নৃশংস-নির্মম হতে পারি, তা ডয়েচেভেলের একটা প্রতিবেদনে দেখা যায়। ডয়েচেভেলে বলছে- সম্প্রতি একটি খবর খুব আলোড়ন তুলেছে। সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত সেই খবরে জানা যায়, শিকারীরা পাখি ধরার পর চোখ অন্ধ করে দিচ্ছে। পাখি ধরার পর চোখ অন্ধ করে দেয়ার কারণ, পাখি আর উড়ে পালিয়ে যেতে পারবে না। দৃষ্টশক্তি না থাকলে পাখি ক্রেতাতের ঠোকর বা আঘাতও করতে পারে না এবং যদি আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী আটক করে, তাহলে ওই পাখি অবমুক্ত করতে পারে না। বাধ্য হয়ে পাখি অবমুক্ত না করেই আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে চলে যেতে হয়। পাখির প্রতি কী ভয়াবহ এই মির্মমতা! সাধারণত শামুকখোলসহ বড় আকারের পাখি শিকারে এই নির্মম পদ্ধতি ব্যবহার করে শিকারীরা।
বলা হয়ে থাকে একটি দেশের মানুষ কতটা পরিবেশবান্ধব, কতটা মানবিক, তা বোঝা যায় সেই দেশে কত পাখি আছে, পাখিরা কেমন আছে, তা দেখে। পাখি হলো প্রকৃতির অলঙ্কার। পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষাকারী। পাখি প্রকৃতি ও মানুষের বন্ধু। পাখির ডাকে ঘুম ভাঙে যে জনপদের মানুষের, তারা সত্যিই ভাগ্যবান।
কিন্তু প্রকৃতিগতভাবে মুফতে সে ভাগ্যে ভাগ্যবান হয়েও কেবল খাছলতের কারণে আমরা তা হারাচ্ছি বেকুবীর চুড়ান্ত পারাকাষ্ঠা দেখিয়ে। উইকিপিডিয়া বলছে- বাংলাদেশে ৮০৯ প্রজাতির পাখি আছে যার মধ্যে ৫১টি আবার বিপন্ন প্রজাতি হিসেবে তালিকাভূক্ত। ২৯টি প্রজাতি ইতোমধ্যেই বিলুপ্ত হয়ে গেছে দেশ থেকে। আর ঢাকায়তো আছেই বোধ হয় ২৯ প্রজাতির পাখি!
শহরে পর্যাপ্ত খাবার না থাকাটাই ঢাকা থেকে পাখি কমার কারণ বলে আমার ধারণা ছিলো, কিন্তু আমার সে ধারণাকে ভুল প্রমাণ করে প্রথম আলোর একটা প্রতিবেদন বলছে- ঢাকা শহরে কিছু পাখির জন্য বেশ ভালো খাবার আছে। কিন্তু বাসা বানানোর জায়গা নেই। থাকবে কিভাবে? যেনতেনভাবে মানুষের বাসা তৈরীই যে দেশে সবচে লাভজনক ব্যবসা, সেখানে পাখির বাসার খোঁজ কে রাখে! অগত্যা পাখি শিকার তাই আমাদের কাছে আনন্দের বিষয় হয়ে দাঁড়ায় আর পাখির গোশতো হয় উপাদেয় খাবার। ফলাফল- এখন আমাদের প্রতিবেশি পাখিগুলো আর দেখা যাচ্ছে না।
তবুও কিছু ব্যতিক্রম আছে। সম্প্রতি রাজশাহীর এক বাগানে পাখিদের আবাস না ভাংতে আদালত থেকে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। ব্যক্তিগত পর্যায়ে কুষ্টিয়ার ইসা হক বা নীলফামারীর আলমগীরের মত বিভিন্ন ব্যক্তি এবং সংগঠন পাখিদের জন্য কাজ করে যাচ্ছে। কিন্তু অবিবেচক মানুষের তুলনায় বিবেচক মানুষের পরিমাণ কম হওয়ায় দিনে দিনে সারাদেশেই কমছে পাখি, আর ঢাকার কথাতো বলাই বাহুল্য।
অথচ ঢাকা শহরে এক সময় প্রচুর পাখি দেখা যেতো। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও বাংলা একাডেমি এলাকায় ঘাস কাটার সময়ও এক সময় প্রচুর পাখি জড়ো হতে। এমনকি ৯০ এর মাঝামাঝি সময়েও আমি ফার্মগেটের ফুটওভারব্রিজের নিচে পাখির দল দেখেছি, ডিম-বাচ্চা দিয়ে সংসার পেতেছে। সে সময় পিজি এবং যাদুঘরের কার্নিসে থাকতো হাজার হাজার কবুতর । মাঝেমধ্যেই শাহবাগের আকাশ ঢেকে দিয়ে দল বেঁধে উড়তো। এখন কাক ছাড়া কোনো পাখিই খুব একটা দেখা যায় না। পাখিদের জন্য এই শহরে পর্যাপ্ত খাবার থাকলেও নিজেরাই মানুষের খাবারে পরিণত হওয়া এবং বাস্তুভিটা থেকে উচ্ছেদ হয়ে যাওয়ায় এই পাখিরা এখন বাধ্য হচ্ছে শুকাতে দেয়া জিন্সের প্যান্টের মত অস্থায়ী আবাসে ঘর বাঁধতে।
০৩
বাবা-মায়ের চাকুরির সুবাদে আমার শৈশব-কৈশোর কেটেছে দেশের বিভিন্ন শহরে। এর পাশাপাশি শীত-গরমে, স্কুলের বার্ষিক ছুটিতে গ্রামে দাদাবাড়িতে থাকার অভিজ্ঞতাও রয়েছে। আনন্দময় শৈশব-কৈশোরের সাথি ছিলো নিবিড় সবুজ গাছপালা, টলটলে পানির নদী-খলবিল আর বিচিত্র সব পাখির কলকাকলী। বিভিন্ন যায়গায় দেখা এসব পাখিদের কথা আমার মনে পড়ে। শীতের কুয়াশাভেজা সকালে লাউয়ের মাচায় দোয়েলের শীষ, বসন্তে কোকিলের গান, লজ্জাবতি শ্যামা, দিনে দুপুরে ভাতশালিক আর ধুসর পেচার নাছোড় ঝগড়া, চৈত্রের লম্বা দুপুরে আমের ডালে হলুদ পাখির ক্লান্ত চাহনি আর কাঠঠোকরার একঘেয়ে কাঠঠোকানি, ডুমুরের পাতা সেলাই করে বাসা বানানো টুনটুনি, টিয়া, মাছরাঙা, নাগরিক পাখি চড়ুই.. .. .. কত কি!
আমার মনে পড়ে আব্বার অফিসে বাস করা নাম না জানা এক দঙ্গল কালো রঙের পাখি; যেগুলো আকৃতিতে চড়ুইয়ের চেয়ে একটু বড় এবং পেটের দিকটা সাদা ছিলো। নাটোরে থাকাকালীন বছরের একটা নির্দিষ্ট সময়ে কলোনীর মাঠে দল বেঁধে হুদহুদ পাখি আসতো, আমরা সেগুলো দেখতে যেতাম। মেটে রঙের উপর সাদা ছোপ দেয়া ঝুঁটিওয়ালা এই পাখিগুলো তাদের লম্বা এবং শক্ত ঠোট দিয়ে মাটি খুঁচে খুঁচে কিছু একটা খেতো।
আমার আরও মনে পড়ে চুয়াডাঙ্গায় আমাদের বাংলোর পাশের আমগাছটায় নিয়মিত আসা হাড়িচাচা পাখির কথা, যেটাকে আমরা স্থানীয়ভাবে কুটুমপাখি বলতাম। সম্ভবত ওটাকে লেজঝোলাও বলে। অথবা বাসার সামনের জামরুলগাছের নির্দিষ্ট ডালে বসে প্রতিদিন রাতে কিছুটা খাওয়া বিভিন্ন ফল ফেলে যাওয়া না দেখা পাখিটা... আমরা সকালে যেতাম যেন সবার আগে সে ফলটা আমি নিতে পারি।
ঝিকরগাছাতে বর্ষার সময়ে গাঢ় নীলরঙের একটা পাখি দেখতাম, যেটার আবার রঙ বদলাতো। দাদাবাড়িতে গেলে দেখতাম মাটির রাস্তার দুইপাশে গর্তের মধ্যে এক ধরনের পাখি থাকতো, নাম জানিনা। চলতি পথে তৈরী হওয়া ধুলোয় এই পাখিগুলো স্নান করতো আমাদের দু’হাত দুরত্বেই।
পরিচিত পাখিদের ঘোরাফেরা আর ডাকাডাকিতো ছিলোই সাথে ছিলো বিচিত্র সব স্মৃতি। একবার কাঠাল পাড়তে এক গাছে উঠেছিলাম, কপাল গুণে ওই গাছে সদ্য বাচ্চা হওয়া শালিকের বাসা ছিলো। ব্যস! এলাকার পাখিদের দায়িত্বে থাকা ফিঙেরাজা দল বেঁধে আমাদের দুজনের উপর মুহর্মূহু আক্রমণের মাধ্যমে গাছ থেকে নামতে বাধ্য করলো......
সেসব পাখিও নেই, ফিঙের রাজত্বও নেই এখন। এখন বরং পাখিদের ‘ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি’ অবস্থা। সারা দেশেই আমার-আপনার মত মানুষের লোভে-ক্ষোভে পাখিরা সব দেশছাড়া-পৃথিবীছাড়া হয়ে যাচ্ছে চিরদিনের মত। পাখির ভাষা বুঝতে পারার মত যন্ত্র যদি আবিস্কৃত হতো, হয়তো আমি শুনতে পেতাম ওই চড়ুই দম্পতি আর্তনাদ করে বলছে- আমাদের একটু থাকতে দিন, আমরা আপনার বারান্দা নোংরা করবো না, আপনার কোনো ক্ষতি করবো না। আমরা শুধু বাঁচতে চাই আমাদের আগামী প্রজন্মের জন্য, আমাদের একটু বাঁচতে দিন প্লিজ...
সংযোজন: ওই হার্ড কাগজের বাক্সের পাশাপাশি দোকান থেকে মাটির বাসা এনে ঝুলিয়ে দিয়েছি বারান্দায়। আপনিও দিতে পারেন এক দুইটা।
ছবিসূত্র
২০১৫ সালের মার্চে উত্তরা থেকে কাজল পাখিটির (Brown Shrike) ছবি তুলেছেন আতিক রহমান এবং একই সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা থেকে প্যাঁচার ছানার ছবিটি ক্যামেরায় ধরেছেন ফটোগ্রাফার ইজহার হোসেন। ছবি দুটো নেয়া হয়েছে ‘আমার ঢাকা’ নামের ফেসবুক পেইজ থেকে।
আর তৃতীয় ছবিটি নেয়া হয়েছে http://hairybirders.blogspot.com সাইট থেকে
ফিচারটি তৈরীতে সহায়তা নেয়া হয়েছে-
১. পাখির শত্রু-মিত্র, ডয়েচেভেলে অনলাইন, প্রকাশ ২২ জানুয়ারি ২০১৯
২. বাংলাদেশ থেকে বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া পাখি, http://www.roddure.com, প্রকাশ ২ এপ্রিল ২০১২
৩. নীরব ঢাকায় পাখির কাকলি, দৈনিক প্রথম আলো, প্রকাশ ১ জুন ২০২০
৪. উইকিপিডিয়া ও বাংলাপিডিয়া
৫. পাখি, শরীফ খান
সর্বশেষ এডিট : ১৪ ই জানুয়ারি, ২০২১ সকাল ১০:৩৭