ছোটবেলা থেকেই ‘আউট বই’ পড়ার মারাত্মক নেশা ছিলো। সে নেশা এমনই যে এসএসসি পরীক্ষা চলাকালীন এক সন্ধ্যায় হুমায়ূনের নতুন একটা বই হাতে আসলো, যেটা আবার পরদিনই ফেরত দিতে হবে, অতএব বাংলা পরীক্ষা প্রায়োরিটি-তালিকায় দ্বিতীয়তে নেমে গেলো কোনোরকম সংকোচ দ্বিধা ছাড়াই!
কিন্তু আম্মা তা মানবেন কেন! গুণধর পুত্রের উপর ব্যাপক পরিমাণ বিশ্বাসের কারণে কিছুক্ষণ পরপর এসে দেখে যাচ্ছিলেন ঠিকঠাক পড়ছি কি না। প্রথম কয়েকবার উৎরিয়ে গেলেও শেষমেষ ধরা পড়লাম এবং যথারীতি পিঠের উপর ধুরুম ধারাম পড়ার পর ‘সড়’ হয়ে গেলাম।
ওই জীবনে এরকম বহু মারটার খেয়ে বাড়ি ছাড়লেও বই পড়ার নেশা ছাড়তে পারিনি। পাশাপাশি বই কেনার বাতিকও ছিলো। ইউনিভার্সিটি জীবনে নীলক্ষেতের ফুটপাথ এবং নজরুলের মাজারের সামনে থেকে পুরোনো বই কিনে হলের আলমারি ভরিয়ে ফেলেছিলাম, হল ছাড়ার সময়ে যেগুলো নিয়ে আসতেই সবচেয়ে বেশি হ্যাপা পোহাতে হয়েছে।
তারপর কর্মস্থলে যোগ দিলাম। খটোমটো আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মধ্যেও এটা এমন এক ডিপার্টমেন্ট, যেখানে বইপত্তুরের সাথেই বসবাস। লোকজন প্রচুর বই দিয়ে যায়, সেগুলোই জমতে জমতে লাইব্রেরি হয়ে যায়। কিন্তু পড়ার সময় আর পাই না, ওগুলো এখন সৌন্দর্যই বৃদ্ধি করে কেবল। অতএব ব্যস্ততার অযুহাতের কাছে কমপ্লিটলি হার মেনে বই কেনা বন্ধ এখন।
তারপরও সোহানী আপার ‘জীবন ও জীবিকার গল্প’ কিনে ফেললাম তিনটা কারণে-
প্রথমত: আমি ব্লগে সোহানী আপার গল্প খুব একটা পড়েছি বলে মনে করতে পারছি না, বরং ফিচারধর্মী লেখাই বেশি পড়েছি। সে হিসেবে আমি ভেবেছিলাম- গল্প নাম হলেও এটা হয়তো ফিচারধর্মী লেখা হবে.. .. আমার এ ধরনের লেখাই ভালো লাগে; তাছাড়া আমি নিজেও ফিচার ছাড়া আর কিছুই লিখতে পারি না।
দ্বিতীয়ত: সোহানী আপা তাঁর বইয়ের প্রচারণা পোস্টে যে ক’জনের নাম নিয়েছিলেন, সেখানে আমিও যায়গা পেয়েছিলাম, ফলে বইটার সাথে এক ধরনের আত্মীয়তা বোধ হচ্ছিল।
তৃতীয়ত: এবং সবচে গুরুত্বপূর্ণ হলো অফিসে আমার বাঁ পাশে যিনি বসেন, সহপেশায় তিনি একটি টিভি চ্যানেলের স্বনামধন্য সংবাদ উপস্থাপক। সবকিছু তিনি এত সুন্দর করে বলেন যে অসত্য জেনেও সত্য হিসেবে বিশ্বাস হয়ে যায়। সেই উপস্থাপক মহোদয় বছর দেড়েক ধরে আমাকে ফুসলাচ্ছেন- আপনার লেখাগুলোকে মলাটবদ্ধ করে ফেলেন...
মূলত তাঁর উস্কানিতেই নিজেকে নজরুলের প্রোপৌত্র টাইপের কিছু একটা ভাবতে ভাবতে জীবন ও জীবিকার গল্পটা অর্ডার করলাম, যেহেতু আমি ধারণা করেছিলাম যে বইটা আমার লেখার টাইপের হবে। এবং কিনেই ‘বাঁশ’টা খাইলাম!!! কিভাবে, সেটাতে পরে আসছি, তার আগে একটু জীবন ও জীবিকার আলাপন হয়ে যাক।
জীবন ও জীবিকার গল্প নাম হলেও চৌদ্দটা গল্পের প্রতিটিতেই মানবমনের কুটিল, অন্ধকার দিককে দেখানো হয়েছে, সে হিসেবে ‘অন্ধকারের গল্প’ নাম হলে হয়তো আরও বেশি মানিয়ে যেতো। ব্যক্তিগতভাবে এত নেতিবাচকতা আমার ভালো লাগেনি। কয়েকটা গল্পে ফিনিক্স পাখির মত নায়ক-নায়িকার জেগে ওঠার বার্তা আছে বটে, তবে তাও সেই অন্ধকারের গল্পকে ছাঁপিয়ে যায়নি। হতে পারে সোহানী আপা ডিভেলপমেন্ট সেকটরে কাজ করাতেই এ ধরনের গল্পগুলো বেশি দেখেছেন, কিন্তু সাধারণ পাঠক হিসেবে কিছু গল্প মিলনাত্মক হলে হয়তো আমার কাছে ভালো লাগতো।
পুস্তক সমালোচনা আমার কম্ম নয়, তাই এ প্রসঙ্গে আর আগে বাড়ছি না। তাছাড়া ব্লগার মাঈনউদ্দিন মইনুল জীবন ও জীবিকার গল্প'র সুন্দর একটা রিভিউ আগেই করে ফেলেছেন। আমি বরং এখানে আমার লাইনেই যাই।
আমার সহকর্মীর প্ররোচনায় কিছুটা ‘মুই কি হনু’ ভাবের কারণে পরখ করার জন্যই বইটা কিনলাম যে সামহ্যোয়ারইনে তৈরী হওয়া ব্লগাররা বই বের করলে সেটা আসলে কেমন হয়। পড়া শুরু করে দেখি মাগো! কোথায় বীর আলেকজান্ডার আর কোথায় চর আলেকজান্ডার! কোথায় ব্লগার সোহানী আর কোথায় বিয়েবাড়ির বোরহানী!!
লেখার সাবজেক্টে আমার কিছু অবজেকশন আছে বটে, কিন্তু লেখায় ‘ধার’ নিয়ে কোনো কথা বলার মত পর্যায়ে আমি নেই, ওটা বরং সাজিদ আবির বা মোস্তাফিজুর রহমান তমাল এর মত বিদগ্ধজনেরা বলতে পারে...
অতএব আমাকে লেখক বানানোর জন্য আমার সহকর্মীর চক্রান্ত মাঠে মারা গেলো, আমারও মনের কোণে উদয় হওয়া স্বপ্নটা ফুড়ুৎ করে মিলিয়ে গেলো। বুঝলাম, এ জন্মে আর মলাটবদ্ধ বইয়ের লেখক হওয়া হবে না। তাতে করে আমার অবশ্য ক্ষতি-বৃদ্ধি কিছু হলো না, কিন্তু এই জাতি জানলো না, সে কি হারালো.. ..ভবিষ্যৎ নোবেল আসার পথ রুদ্ধ হওয়ার পুরো দায় সোহানী আপার!!!
ভালোকথা, বইয়ের প্রচ্ছদটা ভালো লেগেছে কিন্তু বাইন্ডার বাজে ধরনের আঠা ব্যবহার করেছে, কটু গন্ধ আসছে... একটা লাভ অবশ্য হয়েছে, আমি যে করোনামুক্ত, তা প্রমাণ হয়েছে ওই গন্ধে....
সর্বশেষ এডিট : ২৫ শে জানুয়ারি, ২০২১ বিকাল ৩:৪৭