এক
বোধকরি দু’ মাসেরও বেশি সময় ধরে ডয়েচেভেলের সৌজন্যে সংবাদ শিরোনামটা লটকে আছে সামহোয়্যারইনের ‘আলোচিত ব্লগ’ এর উপরের প্যানেলে। একটা আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের পোর্টালে এরকম একটা সংবাদ বিনাবিচারে দু’মাস ধরে ঝুলতে থাকাটা জঙ্গলে থাকা ওই বাংলাদেশিদের প্রতি বৈশ্বিক অমনোযোগিতার ক্ষুদ্র একটা নমুনাও হলেও হতে পারে। তা দু’মাস যখন বাংলাদেশিরা ওখানে থাকতে পেরেছে, আরও কিছুসময় না হয় থাকুক। এর মধ্যে আমরা চলুন বছর পনেরো আগের মনিরামপুর উপজেলার এক গ্রাম থেকে ঘুরে আসি।
ওই গ্রামের দুরন্ত কিশোর শফিক তখন ক্লাস ফোর ফাইভে পড়ে। পড়াশোনায় আগ্রহী শফিকের সারা দিনমান উচ্ছল উপস্থিতি দরিদ্র মা-বাবার চোখে নানারঙের স্বপ্ন এঁকে দিয়ে যায়। দুপুরে রান্নাঘরের বারান্দায় বসে মোটাচালের ভাতের সাথে বেগুন-বড়ি-খলসে মাছের লোকমা মুখে তুলতে তুলতে শফিকের কৃষক বাবা একদিন স্ত্রীকে ডেকে বললো- বউ, আমাগের শফিক একদিন ম্যালা বড় চাকরি করবে, আমি কয়ে রাখলাম। তখন তুমার জন্যি নাকের ফুল বানায়ে দিবানে....। বউ কিছু বলেনা, শুধু আশায় ভরা চোখে তাকিয়ে থাকে শফিকের দিকে।
শফিক যখন ক্লাশ এইটে ট্যালেন্টপুলে বৃত্তি পেলো, পুরো গ্রামে একটা সাড়া পড়ে গেলো। যশোর থেকে লোকসমাজ পত্রিকায় শফিকের একটা ছবিও ছাঁপা হয়েছিলো। গ্রামের মাতব্বর মুরুব্বীরা শফিকের বাবাকে বললো- রফিক, তুমার ছেলেডারে ভালো স্কুলে ভত্তি করে দেও। ম্যাট্টিকি ভালো কত্তি পাল্লি দ্যাকপা খুব ভালো হবেনে।
গ্রামে আর কোনো ভালো স্কুল না থাকায় অগত্যা সেখান থেকেই এসএসসি দিয়ে শফিক প্রত্যাশিতভাবেই গোল্ডেন জিপিএ নিয়ে পাশ করলো।
এরপর আর গ্রামে থাকা চলে না। শেষ পর্যন্ত বাবা-মায়ের ধারদেনার পরিমাণ বাড়িয়ে শফিক শহরের এক কলেজে ভর্তি হলো। শহরের এই নামী কলেজে একনিষ্ঠ ছাত্র শফিকের পড়াশোনাও ভালোই হচ্ছিলো। কিন্তু গোল বাধে সেকেন্ড ইয়ারের মাঝামাঝি এসে হঠাৎ করে বাবা মারা যাওয়ায়।
সেদিন শফিকের খুব আনন্দের দিন ছিলো। বাবা গ্রাম থেকে এসেছিলো শফিকের সাথে দেখা করার জন্য। সাথে ছিলো কয়েকটা নারকেল, মায়ের হাতে বানানো নাড়ু, মোয়া, রান্না করা তরকারি আর মায়ের হাতে বোনা একটা শীতের সোয়েটার। ছেলের অধ্যবসায় দেখে সেদিন শফিকের বাবার চোখে পানি এসে গিয়েছিলো। ছেলের খাওয়া দেখতে দেখতে গোপনে চোখ মুছে রফিক মনে মনে দোয়া করছিলো- আল্লাহ, তুমি আমার ছেলেডার ভালো কইরো...
শফিকের মেস থেকে বের হয়ে গ্রামে ফেরার পথে সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যায় ওর বাবা। দড়াটানা মোড় পার হতে গিয়ে ভোস করে ছুটে যাওয়া এক ধনীর দুলালের ১৬৫ সিসির বাইকের ধাক্কায় উড়ে গিয়ে হাসান বুক ডিপোর সামনে গিয়ে পড়ে রফিক। লোকজন ধরাধরি করে পাশের সরকারি হাসপাতালে দিয়ে আসে।
পরদিন শফিকের কাছে যখন খবর আসে, ততক্ষণে আর বেঁচে নেয় রফিক। এরপরের গল্প সংক্ষিপ্ত। নিজের পড়াশুনার খরচের পাশাপাশি মা এবং ছোট বোনটার খরচ জোগাতে কয়েকটা টিউশনির পাশাপাশি শুক্রবারগুলোতে বিভিন্ন বিয়ে অনুষ্ঠানে ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট টিমের সাথে কাজ করাই একমাত্র ভরসা হয়ে দাঁড়ায়।
এই উদয়াস্ত পরিশ্রমের বিপরীতে পড়াশুনোটাই আর হয়ে ওঠেনা, ইন্টারের রেজাল্টও তাই হলো জিপিএ ৩.৯৫। এই জিপিএ নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়ার প্রশ্নই ওঠেনা। তাছাড়াও পারিপার্শ্বিকতা তাকে আটকে ফেলে কঠিনভাবে। এ রকম সময়ে আবারও গ্রামের ময় মুরুব্বিদের আগমন, তার মাকে বলে- তোমার ছেলেকে বিদেশ পাঠায়ে দেও...
মায়ের কাছে এরচে ভালো বিকল্প আর ছিলো না তখন। এদিকে ঢাকাতে গ্রামের ছেলে ওবাইদুলের খোঁজ পাওয়া গেলো। বিদেশে লোক পাঠায়, খুবই নাকি বিশ্বস্ত। শেষ পর্যন্ত তাদের শেষ সম্বল কয়েক কাঠা কৃষিজমি বিক্রির টাকার বিনিময়ে সেই বিশ্বস্ত ওবাইদুলের হাত ধরে শফিক ইউরোপের পথে পাড়ি জমায়।
তারপর বিভিন্ন সাগরপথ, নদীপথ, হাটাপথ, জঙ্গলপথ পেরিয়ে মায়ের চোখের জল ঝরিয়ে শফিক এখন শীতের আতঙ্কে বসনিয়ার জঙ্গলে রাত কাটাচ্ছে।
দুই
আচ্ছা, শফিক আরও একটা রাত না হয় থাকুক বসনিয়ার জঙ্গলে। আমরা এবার আজ থেকে কুড়ি বছর পরের সুইজারল্যান্ডের এক শহর, লুজন থেকে ঘুরে আসি। সম্প্রতি লুজনে একটা একটা বাংলাদেশী কারি রেস্টুরেন্টচেইন খুবই জনপ্রিয় হয়েছে। ‘মনিরামপুর কারি’ নামের এই রেস্টুরেন্টের সুনাম সুইজারল্যান্ড ছাড়িয়ে ইউরোপের প্রতিটা দেশেই ছড়িয়ে গিয়েছে। বাংলাদেশি ছাড়াও স্থানীয় মানুষদের মধ্যেও একই গতিতে প্রসার ঘটছে মনিরামপুর কারির।
এমনকি জার্মান ভাষায় প্রকাশিত সুইজারল্যান্ডের সর্বাধিক প্রচারিত দৈনিক- ‘20 Minuten’-এ মনিরামপুর কারি নিয়ে একটা বিশেষ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে- মনিরামপুর কারির প্রভাবে স্থানীয় অধিবাসীদের খাদ্যাভ্যাসে পরিবর্তন হচ্ছে। ওই প্রতিবেদনে বক্স ট্রিটমেন্টে মনিরামপুর কারির সত্তাধিকারী শফিকুর রহমানের সচিত্র সাক্ষাতকারও প্রকাশিত হয়। শফিকুর রহমান বলেন- মনিরামপুর কারি মানেই বাংলাদেশি স্বাদ, মনিরামপুর কারি মানেই বাংলাদেশ। আমরা ইতোমধ্যেই ইউরোপের বিভিন্ন শহরে বাংলাদেশি বিভিন্ন ফুডের চেইন আউটলেট প্রতিষ্ঠা করেছি। সামনের ১৬ ডিসেম্বর একযোগে এগুলোর উদ্বোধন করা হবে।
তিন
এই ঘটনার প্রায় পাঁচবছর পেরিয়ে গিয়েছে। মনিরামপুর কারি এখন ইউরোপের সেরা ফুড চেইন। প্রায় ১ লক্ষ বাংলাদেশি প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে এই চেইনের সাথে জড়িয়ে আছে। সম্প্রতি দেশের অর্থনীতিতে ব্যাপক অবদান রাখায় শফিকুর রহমান প্রথম প্রবাসী বাংলাদেশি হিসেবে স্বাধীনতা পুরস্কার পেয়েছেন। দেশের টেলিভিশনে এই খবর শুনে মনিরামপুরের সেই গ্রামের নজরুল মাতুব্বরের এক সুযোগ্য (!) পুত্র থুক করে একদলা থুথু ফেলে মুখ কুঁচকে বললো- শালা ছোটলোকের বাচ্চা ছোটলোক, দেশে খাতি পাত্তিসনে, এখন বিদেশ যেয়ে হোটেলের থাল-গামলা ধুয়ে বড়লোক হইছিস, আবার পুরুসকারও মারাচ্ছিস, শালা তৃতীয়শ্রেণী...
উৎসর্গ: প্রিয় ব্লগার ভুয়া মফিজ ভাই। উৎসর্গসূত্র বুঝতে এই লেখাটা দেখতে পারেন।
** ছবিটা iconshots.com ওয়েবসাইট থেকে নেয়া। ফটোগ্রাফারের নামটা খুঁজে পেলাম না।
সর্বশেষ এডিট : ২৮ শে জানুয়ারি, ২০২১ বিকাল ৩:২৯