০১
মন নিয়ে পৃথিবীর শুরু থেকে গবেষণাতো আর কম হলো না, কিন্তু স্থির সিদ্ধান্তে কে-ই-বা কবে আসতে পারলো! আর পারেনি বলেই মনের গাণিতিক-জ্যামিতিক, বৈজ্ঞানিক-অবৈজ্ঞানিক, কাব্যিক-মনস্তাত্বিক বিশ্লেষণ সাহিত্যের অন্যতম উপাদান হয়ে আছে এখনও।
প্রফেসর জাফর ইকবালের সায়েন্স ফিকশন ‘ওমিক্রণিক রুপান্তর’-এ ‘গ্রুনো রোবট’ নামে একটা গল্প আছে। এ গল্পে দেখা যায়, রোবোটিক্সের চূড়ান্ত উৎকর্ষের সময়ে বাহ্যিকভাবে দেখে মানুষ এবং মনুষ্যাকৃতির রোবটের মধ্যকার পার্থক্য বুঝতে পারা যখন অসম্ভব হয়ে পড়েছিলো, তখন এ ক্যাটেগরির রোবট উৎপাদনকারী একটা প্রতিষ্ঠানের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় একজন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক তার তরুণী ছাত্রী লানার মনজাগতিক স্টেটমেন্টের পরিবর্তন ঘটিয়ে সে চ্যালেঞ্জ জিতেছিলেন।
মানবমনের অকস্মাৎ স্টেটমেন্ট পরিবর্তিত হলে তা আরেকজন মানবসন্তানের পক্ষেই কেবল অনুধাবন করা সম্ভব, রোবট বা কোনো যন্ত্রের পক্ষে নয়। এক্ষেত্রে জরুরী এটা নয় যে সে পরিবর্তনের প্রকাশ তার মুখের আদলে বা ব্যবহারে ফুটে উঠবে।
যদিও ওই গল্পে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর ওই চ্যালেঞ্জে জিতে গিয়েছিলেন, কিন্তু মানবমন সম্পর্কে শেষ কথা বলার কোনো প্রফেসর আজও তৈরী হয়নি। এ কারণেই ‘চন্দ্রবিন্দু’র অনিন্দ্য যখন গেয়ে ওঠেন ‘মন, হাওয়ায় পেয়েছি তোর নাম...’ তখন বেশ আবেগের বৃষ্টিতে ভেজা চলে কিছুক্ষণ; মন তো হাওয়াতেই পাওয়া যায়, হাওয়ার গান দিয়েই তো মনকে চিনতে পারা যায়।
এরকমই দখিনা হাওয়ায় অবগাহন করে, মনমহাজন যখন মনের কারিগর হয়ে ভেবেই নেয় যে মনের হদিস সে বের করে ফেলেছে, তখনই মনের গহীন কোণে নিরবে, নিভৃতে বেড়ে ওঠা কিছু অব্যক্ত কথারা জানিয়ে দেয়- রসো! এ যাত্রায় বহু রাস্তা এখনও বাকি আছে হে! পিকচার আভি বাকি হ্যয়।
মনের এ প্রচ্ছন্ন হুমকিতে থমকে গিয়ে তখন সত্যিই দেখা যায় কিছু মন রয়ে যায় রেললাইনের মত.... বহে সমান্তরাল। আজীবন চলে পাশাপাশি, হাসি-আনন্দ-ভালোলাগা ভাগাভাগি করে, কিন্তু ছোঁয়া হয়ে ওঠেনা কোনোদিনই। তখন অগত্যা বলাই যায়- ‘ভালো থেকো রেললাইন, প্রিয় সহযাত্রী আমার।’
এ রকম রেললাইন হয়ে যাওয়া মনের এক মিছিল তৈরী হয় তারুণ্যের শেষলগ্নে। কিছু কিছু তারা এ পৃথিবীর আকাশ ছেড়ে তখন হয়ে যায় অন্যজগতের। হয়ে যায় ‘স্বপ্নীল পৃথিবীর তারা’ বা ‘আকাশ গঙ্গার তারা’।
০২
সম্প্রতি ব্লগার মলাসইলমুইনা (ড.খন্দকার নাইমুল ইসলাম) এর প্রকাশিত ‘আকাশ গঙ্গার তারা’ বইটা কিনলাম এবং পড়লাম। কেনার কথা এজন্যই বলছি যে অনেকদিন কোনও বই কেনা হয়না, দীর্ঘবিরতির পর যখন দুটো বই কিনলাম, দুটোই এই ব্লগের দুজন সেরা ব্লগারের, যারা আমার কাছে অনেকটা ওই রেললাইনের মতই এবং আকাশ গঙ্গার তারা'র বেশ কয়েকটা গল্প আমাকে ওই মনোজাগতিক বিশ্লেষণ মনে করিয়ে দিয়ে রেললাইনে নিয়ে ঠেকালো।
আকাশ গঙ্গার তারা’য় বারোটা গল্প রয়েছে, যার বেশিরভাগই শেষবিচারে মানববনের রেললাইন হয়ে যাওয়ার গল্প। সে গল্পে ‘শ্বেতা’ নামটি বিভিন্ন চরিত্রে ঘুরেফিরে এসেছে। সাথে ‘স্বপ্নীল’ নামটাও এসেছে তিনটে গল্পে। প্রসঙ্গত এই নামটা আমার পছন্দের একটি নাম। নব্বুইয়ের দশকে যখন প্রথম লেখালেখিতে কিছুটা সাহস অর্জন করলাম; কিন্তু নাম প্রকাশের ভীরুতা বিদ্যমান, তখন আমি ‘স্বপ্নীল রিশান’ নামে ইনকিলাবে গল্প লিখতাম।
যাই হোক, ব্লগে ধুন্ধুমার টাইপের ফিচার বা নিবন্ধ লিখলেও আকাশ গঙ্গার তারা’য় গল্পগুলো যথেষ্ঠ শক্তিশালী; আমার গল্পের মত শুধু হাড্ডিচর্মসার নয় বরং গল্পে মাংশের পেলবতা ভালোই আছে বলেই আমার মনে হয়েছে। অনেকগুলো গল্প আমার ভালো লেগেছে, যেমন ‘জ্যোতিষি’। এ গল্পে কাহিনীর বিন্যাসে মুন্সীয়ানা আছে। জ্যোতিষী পড়তে পড়তে কিছুটা হুমায়ূনের ছায়া এসে পড়ে।
‘জাঙ্ক ইমেইল’ গল্পেও হুমায়ূনের প্রভাব স্পষ্ট; এমনকি হুমায়ূনের সম্ভবত ‘হোটেল গ্রেভার ইন’-এ ‘জাঙ্ক মেইল’ নামে একটা ছোটগল্পও আছে। 'হ্যালুসিনেশন’-এও হুমায়ূন চিঠিসহ প্রবলভাবে উপস্থিত। আমার কাছে এ গল্পটা ভালো লেগেছে। ‘উৎসব’ গল্পটা খারাপ না, কিন্তু সেটা খানিকটা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত মনে হওয়ায় ভালো লাগেনি। একইভাবে কয়েকটি গল্পে সামহ্যোয়ারইন ব্লগ বা ব্লগে লেখালেখির কথা এসেছে, আমার কাছে সেটা আরোপিত মনে হয়েছে; যদিও ’জলছবি’ ওয়ান অব দ্য বেস্ট ইন দ্য বুক।
‘সেলফোন’ গল্পের স্বপ্নীলকে ভালো লেগেছে, যেহেতু ডিপার্টমেন্টাল ক্রিকেট খেলতে গিয়ে জগন্নাথ হল মাঠে হাত পা ছড়ে ফেলার রেকর্ড আমার নিজেরই আছে। সর্বশেষ ‘ভালোবাসার ঘ্রাণ’ গল্পের থিমটাই ব্যতিক্রমী। একদমেই পড়ে যাওয়ার মত এই গল্পটা সবচে ভালো লেগেছে আমার।
০৩
সম্প্রতি বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশ করেছি। কলাভবনের চারতলায় এক জায়গায় মেয়েদের কমনরুম প্লাস ক্যান্টিনের খোঁজ পাওয়া গেলো, যেখানকার চা-সমুচা০সিঙ্গারা (এইটা দশটাকায় পাওয়া যেতো কিনা এখন আর মনে করতে পারছি না) আমাদের পছন্দের ছিলো। প্রায় ওখানে যেতাম খেতে। একদিন দেখি কমনরুমের সামনের করিডোরে ছোটখাটো একজন মানুষ আরেকজনের সাথে গল্প করছে। খেয়াল করতেই দেখি ‘দুর্জয়’। খুব সম্ভবত উনি তখন স্টুডেন্ট না। কিন্তু আমার বড় ভাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পাবলিক অ্যাড-এ দুর্জয়ের সমসাময়িক, এবং নিজেও ডিপার্টমেন্টের খেলোয়াড় ছিলেন। তাই আমি জানতাম যে দুর্জয় পাবলিক অ্যাডে পড়তেন। সেলফোন গল্পে লেখা ইন্টার-ডিপার্টমেন্ট ক্রিকেটে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার গল্প পড়ে দুর্জয়কে দেখার কথাটা মনে পড়ে গেলো।
দুর্জয়ের ওই স্মৃতি, সাথে লেখকের আমার নিজের ভাইয়ের ডিপার্টমেন্টের স্টুডেন্ট হওয়া এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের হাওয়ায় পাওয়া মন নিয়ে লেখা গল্পগুলো তাই বেশ আপন আঙিনায় গেঁথে থাকলো। কিছুটা আত্মীয়তাবোধ পাওয়া গেলো। সবমিলিয়ে আকাশ গঙ্গার তারাও উপভোগ্যই হয়ে থাকলো।
গতকাল প্রিয় ব্লগার 'নীল আকাশ' এর একটা বুকরিভিউ দেখলাম। টিপিক্যাল বুকরিভিউ বলতে যা বোঝায়, সেরকমই। এমনকি তিনি বইয়ের কনটেন্ট ধরে ধরে মার্কিংও করেছেন। এই পোস্টটা 'আকাশ গঙ্গার তারা'র ওরকম কোনো রিভিউ না ধরে বরং পঠন পরবর্তী কথন ধরলেই ভালো হয়।
০৪
আগ্রহীদের জন্য চন্দ্রবিন্দু’র মন, আমার খুব বেশি পছন্দের একটা গান।
মন, হাওয়ায় পেয়েছি তোর নাম
মন, হাওয়ায় হারিয়ে ফেললাম
হাওয়া দিলো শিশিরানিটা, হাওয়া দিলো ডানা
হাওয়া দিলো ছেঁড়া স্যান্ডল, ভুল ঠিকানা, মন রে
হলুদ আলোয় হাওয়ার আবীর মাখলাম
মন, আলেয়া পরালো খালি হাত
মন, জাগেনা জাগেনা সারা রাত
জেগে থাকে ঘুম পাহাড়ের মন, কেমন আলো
দূরদেশে ফিকে হওয়া রাত, ডাক পাঠালো। মন রে
ঘুমের গোপনে তোমাকে আবার ডাকলাম
আদরের ডাক যদি মুছে
এই নাও কিছু ঘুম পাড়ানি গান আলগোছে
বোঝনা এটুকু শিলালিপি, মন রে..
ব্যাথার আদরে অবুঝ আঙ্গুল রাখলাম
মন, বুকের ভিতরে যে নরম
মন, ছুঁয়ো না ছুঁয়ো না এরকম
ছুঁয়ে দিলে বুক কুরে কুরে খায়, সোনা পোকা
বেপাড়ায় কাঁদবেনা এমা ছিঃ ছিঃ বোকা, মন রে
নাহয় পকেটে খুচরো পাথর রাখলাম
ছবিকৃতজ্ঞতা: www.pikist.com
ফটোগ্রাফার, অনাবিষ্কৃত
সর্বশেষ এডিট : ১১ ই ফেব্রুয়ারি, ২০২১ সকাল ১১:২০