- ‘দ্যাখো, চার বছরে আমি ৩টা দেশে বৈধ্যতার জন্য চেষ্ঠা করেছি। সবাই রিজেক্ট করলে আমি কি-ই-বা করতে পারি বলো?’
রাতের ঘরে ফেরা ক্লান্ত মানুষগুলোকে বয়ে চলা মেট্রোর পরিবেশটা যেনো আরো ভারি হয়ে যাচ্ছে যুবকের কথার আকুলতায়।
- ‘আমি বুঝতে পারছি তোমার বয়স হচ্ছে কিন্তু কি করি বলো? কাগজের আশায় জমানো সবকিছুই তো শেষ। দেশে ফিরলে তো আগের চেয়ে নিঃস্ব হয়ে ফিরতে হবে। তখন তো তোমাকে পাওয়ার শেষ সম্ভাবনাও ফুরিয়ে যাবে।’
আমি চেষ্ঠা করছি যুবকের কথাগুলোর দিকে মনোযোগ না দেয়ার। কিন্তু হচ্ছে না। কথাগুলো যে খুবই পরিচিত আর ধেয়ে আসে মস্তিস্কের দিকে। অনেক কথার পর তার শেষ কথাগুলো ছিলো, ‘তুমি যদি মনে করো এখনকার প্রস্তাবটা ফেরাতে অসম্ভব, তাহলে তাই করো।’
যুবকটি ফোন কেটে দিলো। আমি অপ্রস্তুতের মতো তার দিকে তাকাতে গিয়ে তার চোখে চোখ পড়ে গেলো। তখন কিছু আশ্চর্য ঘটনা ঘটলো! আমার মনে হলো মেট্রো’র দৃশ্যটা খুব দ্রুত বদলে যাচ্ছে। এখানে আমি আর সেই বাঙালি যুবক ছাড়া অন্যরা সরে যাচ্ছে, ফাঁকা হয়ে যাচ্ছে রাতের ট্রেনটা। এবং হঠাৎ আমার মনে হলো সেই যুবকটা ফ্রেমে বাঁধানো কোনো ছবি হয়ে হঠাৎ খণ্ড-বিখণ্ড হয়ে ছড়িয়ে পড়লো!
মেট্রোতে আমি আর সেই যুবকের ছড়িয়ে পড়া টুকরোগুলো ছাড়া আর কাউকে চোখে পড়ছে না। এখানে সেখানে তার বিভিন্ন অঙ্গ ছবি হয়ে ভাসছে। কোথাও চোখ, কোথাও মস্তক কোথাও বা শরীরের বিভিন্ন অঙ্গপ্রতঙ্গগুলো হাওয়ায় ভাসছে। আমি কোনো ভাবেই এর মানে বুঝতে পারছিলাম না। মনে হচ্ছিলো মাথা যেনো আমার ঘাড়ের উপরে নেই। এবং আমি তখন বুঝতে পারলাম আমার হ্যালোসিনেশন হচ্ছে!
সেই অদ্ভুত ট্রেনে আমি যেনো এক কাল্পনিক জগতে চলে গেলাম। তখন আরো অবাক হয়ে লক্ষ্য করলাম ডাব্বার শেষ মাথায় কেউ একজন বসে আমার দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি করে হাসছে। আমার বিষ্ময় দেখে সেই ভদ্রলোক আমাকে জিজ্ঞেস করলেন তাকে চিনতে পেরেছি কি না। আমি তার হাসি দেখে চিনতে না পারলেও মাথার টাক দেখে চিনতে পারলাম। বল্লাম, মঁসিও (জনাব) আপনি? আরে এই মেট্রো-টা তো আপনার নামে যে স্টেশন আছে প্যারিসে সেখান থেকেই এলো, ববিনি পাবলো পিকাসো।
তিনি হাসলেন। তাকে দেখে তাড়াতাড়ি আমার মাথায় চলে আসলো যে, এই যে যুবকের অদ্ভুত ছবি আমি দেখতে পাচ্ছি, সেই প্রসঙ্গে তাকে জিজ্ঞেস করা দরকার। কারণ তিনি তো বিমূর্ত চিত্রকলার প্রবর্তক। অদ্ভুত সব ছবি এঁকে পৃথিবীকে তাঁক লাগিয়ে সেই যে গেছেন এখনও তা থেকে মানুষ বের হতে পারেনি। তার ছবিগুলোতে মানুষের অঙ্গ-প্রতঙ্গ যথাস্থানে থাকতো না। চোখের যায়গায় নাক, নাকের জায়গায় কান এমন অদ্ভুত ক্রিয়াকলাপ থাকতো পাবলো পিকাসোর ছবিতে! এই ট্রেনে যে যুবক ভাস্যমান তার সাথে বেশ মিল আছে পিকাসো সাহেবের চিত্রের। অবাক ব্যাপার তিনি আমার মনের কথা বুঝতে পারলেন! বল্লেন শোন, মানুষ ভেতরে বাহিরে বিদ্বস্থ হয়। যদি তার ভেতরের রূপটা ধরা যেতো তাহলে এই যুবকের ভাস্যমান দৃশ্যের মতো হতো! তোরা এসব বুঝবি না।
আমার আর ভালো লাগছিলো না। পেটের ভেতরে যে চুরমার প্রক্রিয়া চলছিলো সে এতোক্ষণে নাড়াছড়া দিয়ে উঠলো। তাই মনে মনে বল্লাম, পিকাসো বাবা তুমি বিদায় হও! আমার মাথা এমনিতেই আওলায়া গেছে আর আওলানো ঠিক হবে না। পিকাসো মুছকি হাসি দিয়ে ধূসর হতে থাকা ট্রেনটায় মিশে গেলেন।
আর তখন খেয়াল করলাম মেট্রোটা তার গন্তব্যে পৌঁছে গেছে। আমাকে নেমে যেতে হবে। কিন্তু এখনও আমার সেই আলো-আধারী ভাব কাটেনি। ট্রেন থেকে নেমে যাওয়ার সময় দেখলাম সিটের উপর সেই বাঙালি যুবকের একটা চোখ পড়ে আছে। আমি সেই চোখের দিকে তাকাতে দেখলাম সেও তাকিয়ে আছে। নেমে যেতে যেতে মনে হচ্ছিলো এই চোখটাকে আমি চিনি। কোথায় যেনো দেখেছি। এ যে অনেক দিনের চেনা কোনো মানুষের চোখ! আমি ভাবতে ভাবতে অবাক হয়ে আবিস্কার করলাম, এই চোখটাই তো আমি প্রতিদিন আয়নায় দেখি!
লেখাটি প্রবাসি ফেসবুকের এই পেজেও প্রকাশিত।
Click This Link

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




