সুজিত আর নন্দি হাঁপাতে হাঁপাতে আমার পাশে এসে বসে।ভয়ে দুজেনইএকেবারে নীলাভ হয়ে আছে। এই প্রখর দুপুরে আজো মনে হয় কোনো রোদেলা আকাশে ফেরারি চিল হয়ে উড়েছিলো সারাদিন ।এখন ক্লান্তি চূর্ণ করার ছলে,স্নেহসিক্ত হতে আমার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে।ছোট কবুতরের মতো দুরু দুরু কাঁপছে ওদের বুক। আমি অল্প চিন্তামগ্ন হই।
কিছুক্ষণ পরে একটু স্থিত হবার পর -দুজনেই একসাথে কথা বলা শুরু করে।যার সারমর্মঃ পাশের জংগলের একটু গহীনে একটা লুকলুকি গাছ আছে।গাছটি একটি ছোট টিলার উপর। সেখানে পাকা লুকলুকি পাড়তে গিয়ে দেখে-একটি বিদুঘটে গিরগিটি একেবারে লাল রক্তবর্ণ ধারণ করে আছে।আর পাশে একেবারে বর্ণহীন,শাদা,নিষ্প্রাণ একটি শিশু টিকটিকি পড়ে আছে। লাল গিরগিটি আর বর্ণহীন টিকটিকির ঘটনা দেখে নন্দি আমায় বলে-জানো চাচু, গিরগিটিটি না পুরা টিকটিকির রক্ত শুষে খেয়েছে,আর রক্ত ছাড়া কী কেউ বাঁচতে পারে বলো।আহারে,বেচারা টিকটিকি কেনো যে গিরগিটির কাছ থেকে জীবন নিয়ে পালালো না।
গ্রীষ্মের ছুটিতে দুই ভাইবোন সারা গ্রামময় এভাবে ঘুরে বেড়ায়।ওদের ছুটোছুটি দেখে মনে হয় জীবন রংয়ের দুটি প্রজাপতি ফুলের কাননেআপন মনে গুন্জরন করে যাচ্ছে অবিরত ।আর চির সবুজ কচি পাতার মতো ওদের নবীনতা দেখে আমার স্নেহ যেন ওদের ওপর স্ফটিক শিশির হয়ে ঝড়ে।এমন মিল দুজনের ,একজনকে রামধনু মনে হলে ,আরেক জনকে মনে হয়,সেই রামধনুর বিচ্ছুরিত শোভা।সারা দিনমান,এক জন আরেক জনের ছায়া হয়ে থাকে।
এভাবে নানা ছোট ছোট ঘটনায়,কখনো আনন্দে,কখনোবা বর্ণিল উত্তেজনায়,কৌতুহলি জীবনের মুখরতায় ওদের পৃথিবী বেশ আনন্দমুখর হয়ে ওঠে। ওদের দেখে আমিও নিশ্চিন্ত হই,অবসন্ন দিনের সব হেঁয়ালি ভুলে যাই।একদিন সন্ধ্যার পর বেদীয় অংকের কিছু কৌশল আর মজা নিয়ে আমি ওদের মনোরন্জন করছি।ঘরের ভিতরে ভ্যাপসা গরম পড়েছে,নন্দি বলে, চলো চাচু,বাইরে জোছনার মাঝে যাই।আমাদের উঠোনের লাগোয়া একটি মহুয়া গাছ,আর কিছু অরনীয় ঝোপ আছে।ঝিরঝিরে বাতাস,ফুরফুরে গন্ধ আর মন আবেশীত চন্দ্রিমার লোভে এতো রাতে বাইরে না যেতে আমি ও আর বারণ করিনা। ঝোপের অদূরে ,মহুয়া গাছের রুপালী ছায়ামাখা আলোয় আমরা একটি শতরন্চি বিছিয়ে বসি।হঠাৎ দেখি, নন্দি কেমন যেন করছে।কিছু বুঝে ওঠার আগেই বেচারি মূর্ছা গেলো।
গ্রামের ডাক্তার, বৈদ্য,কবিরাজের বাসায় নিরবিচ্ছিন্ন ছুটোছুটি করে,অবশেষে অকুল পাথারে নানাবিধ শংকায় ভাসতে ভাসতে একেবারে মফস্বলের হাসপাতালে শুরু হলো আমাদের উদ্ভ্রান্ত বেলোয়ারি নৈরাশ্য জীবনের পালা।
হসপিটালের নিষ্প্রাণ বেডে নন্দি জীবন্মৃত শুয়ে আছে।স্যালাইন থেকে ফোটা ফোটা ঔষধ ওর দেহে প্রবেশ করছে। সুজিত বোনের কপালে হাত রেখে বসে আছে চুপচাপ।দিদি চোখ আড়াল করে আছেন,বুঝতে পারছি অবিরল বাধঁনহীন অশ্রুধারা বইছে। এ কুহকময় রাত যেন আর শেষ হয়না। ডাক্তার বাবুরা কিছু বলেন না। বোনের পাশ থেকে সুজিতের আর বাড়ি ফিরা হয়না। দু হাত দিয়ে আলতো করে জড়িয়ে রাখে বোনের মুখ।হসপিটালই যেন আজ ওর বসতবাটি, খেলাঘর,নিজের পৃথিবী,নিজের আপন ভূবন। আর আমাদের উৎকন্ঠা ও রাতের সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়তে থাকে। এক উচ্ছ্বল বহমান অনুপম জীবন অকস্মাত এমনি কঠিন এক যতির সামনে এভাবে থমকে দাঁড়াবে টেরই পাইনি।আর কিছু বুঝে ওঠার আগেই এক অপরুপ স্বর্গীয় রুপালি চাঁদ যেন আঁধারে পুন্জিভূত হলো।
অবশেষে , ডাক্তার বাবু আমাকে উনার অফিসঘরে নিয়ে যান।নানাবিদ ভয় আর শংকায় আমি নিথর বসে থাকি। ভাবি,বিশ্বাসের সব দুয়ার যেন এবার বন্ধ হয়ে এলো। এবার বুঝি ভালোবাসার অদেখা সুতোয় টান পড়লো।
করুণাময়ের কাছে মিনতি করি,রাতের পর যেন এক স্বর্ণালী ভোর আসে।ডাক্তারবাবু,কিছু কাগজপত্রাদি আমার সামনে রাখেন।তারপর এই প্রথমবারের মতো বলেন, ভয়ের কিছুই নেই।সব ঠিক হয়ে যাবে। তবে,ওর জন্য অতি শীঘ্র কয়েক ব্যাগ রক্তের বড় বেশী প্রয়োজন।
একেতো মফস্বল।তারপর গভীর রাত।আশে পাশে সব নিস্তব্ধ হয়ে আছে।মাঝে মাঝে শুধু ভেসে আসছে রক্ত হিম করা এক তক্ষকের ডাক।বাইরের আকাশও মেঘাচ্ছন্ন।পৃথিবীর সব আলো যেন একেবারে নিভে গেছে আজ।শুধু আমরা শংকায় দুলছি আর আশার ভেলায় ভেসে আছি।রক্তের গ্রুপ মিলানো বেশ কঠিন হয়ে পড়েছে।বেশ কয়েক জায়গায় ফোন করেও কোনোও আশার বানী পাওয়া গেলোনা। আর এ রুপহীন রাতের নিপতিত অন্ধকারে আলোর স্পর্শ পাওয়া যে বড়ই কঠিন।এক অদেখা পৃথিবীর ফুলের মতো শিশুর জীবন সলতে জ্বলতে না জ্বলতেই এবার বুঝি সত্যিই নিঃশেষ হয়ে এলো।
জীবনে চলার পথে দু জনের যেমন মিল,বাহিরে মিল, অন্তরে মিল, রক্তও যেন বুঝে ওঠে তা।সবাই চুপচাপ। শুধু সুজিতের রক্তই যেন বুঝতে পারে অসাড় শুয়ে থাকা নন্দির বেঁচে থাকার এক অব্যক্ত আকুল আহ্বানের কথা।
ছোট সুজিত ,কতই বা ওর বয়স। ডাক্তার রক্ত দেয়ার কথা বলার সাথে সাথেই মুহুর্তেই রাজী হয়ে যায় সে।
পাশাপাশি বেডে সুজিত আর নন্দি শুয়ে আছে। সুজিতের রক্তে ধীরে ধীরে লাল হতে থাকে স্বচ্ছ ব্যাগ।এরপর একটু একটু করে সে রক্ত প্রবেশ করে নন্দীর দেহে। সুজিত পাশের সীটে চেয়ে দেখে নন্দী ধীরে ,অতি ধীরে যেন রক্তে ডাকে সাড়া দিয়ে প্রাণের সজীবতায় ফিরে আসছে।
এবার আমি রুমের জানালাটা একটু আলগা করে দেই। হালকা শীতল বাতাস এসে আমাদের স্পর্শ করে। ভোরের আলো এতক্ষণে আমাদের দিকে মুখ ফিরিয়েছে।
ছোট সুজিতের মনে কত কিছু দোলা দিয়ে যায়। দিদির সাথে তার কত মধুমাখা স্মৃতি,হাসির,আনন্দের,অভিমানের,নিটোল সৌন্দর্য্যের ।মনে পড়ে সেই লুকলুকি বনে মরা টিকটিকির কথা।দিদি বলেছিলো -রক্ত ছাড়া শুধু টিকটিকি কেন রে, কোনো প্রাণীইতো বাঁচতে পারেনা।
সুজিত বিছানায় শুয়ে আস্তে করে আমার হাত ধরে।একবার আমার দিকে থাকায়,একবার বোনের দিকে,আরেকবার আড় চোখে নিজের শরীর দেখে ।চোখের ভাষা বুঝা দায়,বেচারাকে দেখে মনে হলো এই প্রথম অল্প ভয় পেলো।আমি পরম স্নেহে আর মমতায় ওর শিয়রের পাশে বসি। আমার স্নেহের কণা যেন ওর কপোল বেয়ে আসা অশ্রুদানার সাথে একাকার হয়ে যায়। সুজিত,আমাকে,ওর আরোও কাছে টানে।আমার মাথাটা ওর মুখের পাশে নিয়ে যায়। কষ্টে না আনন্দে বুঝা যায় না।চেয়ে দেখি নিদারুন শংকায় ছলছল করছে ওর চোখ।দেখি, ওর শরীর যেন কেমন মলিন আর নিষ্প্রভ ।তারপর,কানে কানে আমায় বলে, চাচু, দিদি কখন ভালো হয়ে ওঠবে,আর আমি কি রক্ত দেয়ার পর পরই মারা যাবো?দিদিকে বলো,আমি জীবনে যেমন ওর পাশে পাশে ছিলাম,মৃত্যুর পরও ওর সাথে মিশে থাকবো। দিদির সেরে ওঠা কি দেখে যেতে পারবোনা একটিবার। আমি মারা যাওয়ার আগে দিদিকে চুমু দেয়ার সময়টুকু যেন অন্ততঃ একটিবার পাই।
আসলে ছোট সুজিত এতুটুকু বুঝতে পারেনি যে, ওকে মাত্র এক ব্যাগ রক্তই দিতে বলেছিলেন ডাক্তার বাবু। ও মনে করেছিলো-ওকে দিদির জন্য শরীরের সব রক্তই দিয়ে দিতে হবে, আর রক্ত দেয়ার পর পরই সে একেবারে রক্তহীন হয়ে মারা যাবে সেই টিকটিকিটার মতো।তবুও তার আদরের দিদি জীবন ফিরে পাবে,এই আশায় মুহুর্তমাত্র দেরী না করেই সে রাজি হয়েছিলো নিজের শরীরের সব রক্তই দিদিকে দিয়ে দিতে।
আর নন্দি সেদিন রাতের জোছনার লুকোচুরিতেও ভাইয়ের ওপর সদা চোখ রেখেছিলো।শতরন্চির যে জায়গায় সেদিন রাতে সুজিত বসেছিলো,সেখানে নন্দি হঠাত খেয়াল করে,একটি বিষধর সাপ,মরণ কামড় বসিয়ে দেয় যেকোন সময় সুজিতের পীটে ।নন্দি আর এক মুহুর্তও অপচয় করেনি, নিজের জীবন বাজি রেখেই ভাইকে আগলে নিয়েছিলো।
অনেকদিন পর,নন্দি বিদেশ থেকে দেশের বাড়ি এসেছে। সুজিতের ঘরে প্রবেশ করে, কী যেন মনে করে একটি ডায়েরির পৃষ্ঠা উল্টোয়।সেখানে সুজিত লিখেছে, জীবনে প্রাপ্তির আর পূণ্যের ঘর একেবারে ফাঁকা।সারা জীবনের যতুটুকু সন্চয় তা হলো-প্রিয় দিদির জন্য এক ব্যাগ রক্ত।
আরেকদিন, বেখেয়ালে নন্দির ডায়েরির একটি পাতায় কেমন করে যেন ,আমার চোখ আটকে যায় ।নন্দি লিখেছে- এই আমি নন্দি, পথ থেকে কুড়িয়ে এনে প্রিয় চাচু জীবন দিয়েছিলেন একবার, আর মৃত্যপথ যাত্রী সাপে কাটা রোগীকে রক্ত দিয়ে সুজিত জীবন দিলো আরেকবার। এমন সৌভাগ্যবতি এক পরাশ্রিতা মেয়ে এই মহাসমূদ্র ভালোবাসার প্রতিদান দেয় কেমন করে?
ঘটেতো এক বিন্দু জলও নেই।
এর প্রত্যুত্তরে আমার আর কিছু লিখা হয়না কোনো ডায়েরির পাতায়-শুধু মনে মনে বলি,বিদেশের সবঐশ্বর্য,সুখের স্বপ্নীল ভূবন ছেড়ে এক নিঃসঙগ বুড়োর টানে এভাবে ছুটে এসেছো,যার মাঝে আমি হিমালয়ের মতো অবিচল নির্ভরতা খুঁজে পাই,এর চেয়ে বড় প্রতিদান আর কী হতে পারে,বলো,মা।
নন্দি,তুমি নিজেই যে সবচেয়ে বড় প্রতিদান ।
সর্বশেষ এডিট : ১০ ই আগস্ট, ২০০৮ রাত ১১:২২