somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

মানবাধিকারঃ প্রেক্ষিত বাংলাদেশ

২৬ শে জানুয়ারি, ২০১৫ রাত ৯:২৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

মানবাধিকার একটি বহুল আলোচিত বিষয়। মানুষের সহজাত অধিকারই মানবাধিকার হিসেবে বিবেচিত। আধুনিক সভ্য পৃথিবীতে মানবাধিকার একটি আবশ্যিক চেতনা। এটি মূলত ফরাসি শব্দ Droits de L’home থেকে উৎসারিত, যার অর্থ হলো মানুষের অধিকার।
মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) এর হাদিসে মানবাধিকারের প্রতিশব্দ হিসেবে 'হাক্কুন' শব্দটি অসংখ্যবার ব্যবহৃত হয়েছে। মানবাধিকার বলতে মানুষের সেই সব স্বার্থকে বোঝায়, যা অধিকারের নৈতিক বা আইনগত নিয়মনীতি দ্বারা সংরক্ষিত হয়। মানবাধিকার সম্পর্কে আলোচনা করার শুরুতে ‘মানবাধিকার’ শব্দটির ব্যাখ্যা প্রয়োজন। ‘মানবাধিকার’ পদটিতে ‘মানব’ ও ‘অধিকার’ এই দুটি শব্দ একিভূত হয়েছে । ‘মানব’ শব্দটি অবশ্যই সৃষ্টির সেরা জীব মানুষ কে বোঝায় আর ‘অধিকার’ হলো কিছু স্বার্থ যা আইনগত বা নৈতিক নিয়ম-নীতি দ্বারা সংরক্ষিত করা হয়। নিম্নে এতদুভয় সম্পর্কে সম্যক ধারণা দেওয়ার চেষ্টা করব।

অধিকার (Rights): আইন বিজ্ঞানের ভাষায়, অধিকার হলো মূলতঃ কিছু স্বার্থ যেগুলো অধিকারের নৈতিক বা আইনগত নীয়ম-নীতি দ্বারা সংরক্ষিত হয়। স্বার্থ হলো মানুষের কিছু সুবিধাজনক অবস্থা যার প্রেক্ষিতে অন্যদের কোন কর্তব্য নেই। কিন্তু যখন এই সুবিধাজনক অবস্থার প্রেক্ষিতে অন্যদের কর্তব্য থাকে তখন তাকে অধিকার বলা হয়।
টি. এইচ. গ্রীন বলেছেন-“অধিকার হলো কিছু বাহ্যিক অবস্থা যা ব্যক্তিত্ব বিকাশের জন্য অপরিহার্য”
Professor Laski বলেন- “My rights are built always upon my function to the well being of society; and the claim I make must, clearly enough, be claims that are necessary to the proper performance of my function. My demands upon society are demands which ought to receive recognition because a recognizable public interest is involved in their recognition.”

আইনগত অধিকার (Legal Rights): আইনগত অধিকার হলো সে অধিকার যা আইনের নীতিসমূহ দ্বারা স্বীকৃত ও সংরক্ষিত, যা ভঙ্গ করলে ঘটে যাবে আইনগত ত্রুটি এবং যাকে সম্মান দেখানো হবে আইনগত কর্তব্য। এটা রাষ্ট্র বা প্রতিষ্ঠান বা আন্তর্জাতিক কর্তৃপক্ষ কর্তৃক প্রণীত ও বাস্তবায়িত হয়। এটা কেউ লংঘন বা অমান্য করলে তা দন্ডনীয় অপরাধ বলে গণ্য হবে। যেমন- আমার পথ চলার অধিকার, ধর্মীয় কাজ সম্পন্ন করার অধিকার। এ কাজে কেউ বাধা দিলে তার প্রতিকার পাওয়া যাবে। কিন্তু কোন বিড়ালের সাথে নিষ্ঠুর আচারণ করা হলে বা ভিক্ষুকের সাথে যদি খারাপ আচরণ করা হয়, তবে তার কোন আইনগত প্রতিকার পাওয়ার কোন বাধ্যবাধকতা নেই। কাজেই বৃহত্তর অর্থে আইনগত অধিকার বলতে আমরা সেই অধিকারগুলোর কথা বলতে পারি যা কেবল রাষ্ট্রীয় কর্তৃপক্ষ কর্তৃক আইনের আওতায় রচিত।
মানবাধিকার (Human Rights): উপরে আলোচিত অধিকার এবং আইনগত অধিকারই মূলত মানবাধিকার। মানবাধিকার প্রতিটি মানুষের এক ধরনের অধিকার যেটা তার জন্মগত ও অবিচ্ছেদ্য। মানুষ এ অধিকার ভোগ করবে এবং চর্চা করবে। তবে এ চর্চা অন্যের ক্ষতিসাধন ও প্রশান্তি বিনষ্টের কারণ হতে পারবে না। মানবাধিকার সব জায়গায় এবং সবার জন্য সমানভাবে প্রযোজ্য। এ অধিকার একই সাথে সহজাত ও আইনগত অধিকার। স্থানীয়, জাতীয়, আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক আইনের অন্যতম দায়িত্ব হল এসব অধিকার রক্ষণাবেক্ষণ করা। যদিও অধিকার বলতে প্রকৃতপক্ষে কি বোঝানো হয় তা এখন পর্যন্ত একটি দর্শনগত বিতর্কের বিষয়।
Robert L. Barker বলেন, Human Rights are the opportunity to be accorded the some progressive and obligations as to race, sex, language, or religion. অর্থাৎ মানবাধিকার হলো কিছু সুযোগ-সুবিধা, যা জাতি, ধর্ম, বর্ণ, ভাষা নির্বিশেষে সকলের জন্য সমান।
উপরোক্ত আলোচনা থেকে বুঝা যায় যে, সমস্ত অধিকার মানুষের প্রকৃতিতে সহজাত ও হস্তান্তর অযোগ্য, যেগুলো পৃথিবীর সকল মানুষের জন্য জাতি, বর্ণ, গোত্র, নারী-পুরুষ, রাজনৈতিক বা অন্যান্য অভিমত ইত্যাদি নির্বিশেষে সমভাবে প্রযোজ্য ও উপভোগ্য, যেগুলো মানুষের ব্যক্তিত্ব ও মনুষ্যত্ব বিকাশের জন্য অপরিহার্য এবং যেগুলো ছাড়া মানুষ ‘মানুষ’ হিসাবে বেঁচে থাকতে পারে না সেগুলোই মানবাধিকার।

মানবাধিকারের উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ: যতদূত জানা যায়, সর্বপ্রাচীন লিপিবদ্ধ আইন হচ্ছে রাজা হামুরাবি কর্তৃক প্রণীত বেবিলনীয় কোড (প্রায় ২১৩০-২০৮৮ খ্রীঃপূঃ) বা হামুরাবি কোড। লিখিত আইনের সূচনা হিসাবে এই ‘কোড’ খুব মূল্য বহন করে এবং পরবর্তীতে মানুষের অধিকার সংরক্ষণে রীতি-নীতি ও প্রথার চেয়ে লিপিবদ্ধ আইন অধিকতর ফলপ্রসূ হিসাবে বিবেচিত।
এরপর সর্বপ্রথম যে আইনে মানুষের অধিকার যৎকিঞ্চিত হলেও ব্যক্ত করা হয়, তা হলো সিংহরাজের রাজত্বকালে সাইবেরীয়ান ব-দ্বীপে প্রণীত আইন। তবে এই আইনে জনগণের মৌলিক অধিকারের কথা উল্লেখ না থাকলেও তার সামনে দেশে সামন্ত প্রভু ও অভিজাত ব্যক্তিদের একটি সভা ডাকা হতো, যা বর্তমান কালের সাথে কিছুটা তুলনাযোগ্য। ১১৮৮ খৃষ্টাব্দে রাজা নবম আলফানসের নিকট থেকে এই সভা অভিজাত শ্রেণীর জন্য বেশ কিছু অধিকার আদায় করে নেয়। এসব অধিকারের একটি তালিকা প্রণয়ন করা হয়। সেগুলোর মধ্যে ছিল ব্যক্তি স্বাধীনতা, জীবনের নিরাপত্তা, জীবনের মর্যাদা, বাসস্থান ও সম্পদের অলংঘনীয়তা। অর্থাৎ আইন ব্যতিরেকে তাদেরকে শারীরিকভাবে আটক, নির্যাতন, অসম্মান বা আইনানুগ বিচার ছাড়া কাউকে শাস্তি প্রদান বা কারও প্রাণ হরণ করা চলবে না; আইনসঙ্গত উপায় ব্যতিরেকে নিজ বসতবাটিতে তাদের বসবাসে অসুবিধা সৃষ্টি করা চলবে না বা উচ্ছেদ করা যাবে না ইত্যাদি।পরবর্তীতে হাঙ্গেরীর রাজা ২য় এন্ড্রু ১২২২ সালে স্বর্ণা আদেশ দ্বারা রাজকীয়ভাবে ‘সিংহসাম্রাজ্যের’ মত ঘোষণা দেন যে, কোন রাজা বা আমীরকে প্রথমে কোন আইনে অভিযুক্ত করা ছাড়া আটক বা হত্যা করা চলবে না। এখানে আদালত কর্তৃক নিরপেক্ষ তদন্তের মাধ্যমে আমীরকে বিচার কার্যের কথা স্বীকার করা হয়েছে। রুডলফ ভন ঝেরিং (১৮৫২-১৮৭৮) প্রায় সোয়াশ বছর আগে উল্লেখ করেছেন যে, প্রাচীন রিপাবলিকান রোমে রাষ্ট্র কর্তৃক রোমান নাগরিকদের (বিদেশী বা দাসদের জন্য এ আইন নয়) সরকারের অংশগ্রহণে, সরকার নির্বাচনে, ফৌজদারী বিচার ব্যবস্থায় অংশগ্রহণ করার, সরকারী কর্মকর্তা নির্বাচন করার এমনকি পুলিশ প্রশাসনে অংশগ্রহণ করার অধিকার দেয়া হয়েছিল। প্রখ্যাত আমেরিকান মনীষী ইয়ানটেমান (১৯৫৮) দেখিয়েছেন যে, রোমান আইন ব্যবস্থা রোমান পন্ডিত ও আইনজ্ঞদের দ্বারা প্রণীত। এ আইন ব্যবস্থায় মানুষের অধিকার প্রয়োগ ও সংরক্ষণের যৌক্তিক উপায় রাখা হয়েছিল, যাতে করে সর্বসাধারণ তাদের অধিকার বাস্তবায়নের জন্য আদালতের শরণাপন্ন হতে পারে। সর্বপ্রথম রোমান সমাজেই ব্যাপকভাবে সাধারণ মানুষের মৌলিক অধিকার সম্পর্কে কার্যকর ব্যবস্থা গৃহীত হয়েছিল। ইয়ানটেমানের এই অভিমত বর্তমানে ইউরোপ এবং যেসব দেশে কমন ‘ল’ চালু আছে সেসব দেশে গুরুত্ব সহকারে প্রযোজ্য। রোমান সমাজে যেগুলো মানুষের অধিকার বলে স্বীকৃত ছিল, তার প্রকাশ ও প্রতিফলন ইংলিশ ম্যাগনাকার্টাতে দেখা যায়। ইংল্যান্ডের রাজা জন রানীমেড নামক স্থানে ১২১৫ সালে এই ঐতিহাসিক দলীল গ্রহণ করতে বাধ্য হন।
তবে একথা অবশ্যই স্বীকার করতে হবে যে, মানুষের অধিকার সংরক্ষণের ক্ষেত্রে ৬ষ্ঠ ও ৭ম শতকে ইসলাম ধর্ম অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। অর্থাৎ মানবাধিকার বিকাশে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক হল ৬২২ খ্রিষ্টাব্দ। এসময় সাম্য, ভ্রাতৃত্ব ও ন্যায়বিচারের ভিত্তিতে রচিত হয় বিশ্ব ইতিহাসে সর্বপ্রথম মানবাধিকার সংরক্ষণ সংবলিত লিখিত সনদ মদীনা সনদ এবং প্রতিষ্ঠিত হয় পৃথিবীর ইতিহাসের প্রথম কল্যাণ রাষ্ট্র, যেখানে প্রত্যেকের মৌলিক অধিকারসহ মানবাধিকার ছিল সুরক্ষিত। এ সম্পর্কে Professor Brifault বলেন ‘ The ideals of freedom for all human beings, of human brotherhood of the equality of all men before law of democratic government by constitution and universal suffrage. The ideals that inspired the French Revolution and the declaration of Rights that guided the Framing of American Constitution and enflamed the struggle of independence in Latin American countries were not invention of the west. They find their ultimate inspiration a source in Quran....’
অতঃপর ১৭ এবং ১৮ শতকে মানবাধিকারের দাবি উচ্চারিত হয় ফ্রান্সের লেখক বোঁদিন এবং ইংল্যান্ডের দার্শনিক জনলক ও ফ্রান্সের দার্শনিক রুশোর লেখায়। ১২১৫ সালে ব্রিটেনের ম্যাগনাকার্টা, ১৬৮৯ সালে অধিকার বিল, ১৭৭৬ সালে ভার্জিনিয়া অধিকার বিল মানবাধিকারের ক্ষেত্রে মাইলফলক।
বাংলাদেশে মানবাধিকার: মানবাধিকার বিষয়টা বাংলাদেশে অনেক ক্ষেত্রে কাগজে-কলমে রয়েছে। যেমনঃ বাংলাদেশের সংবিধান, মানবাধিকারের সার্বজনীন ঘোষণাপত্র ইত্যাদি। এদেশে মানবাধিকার অনেকটাই রুগ্ন আর অপ্রতিষ্ঠিত। নিম্নে সংক্ষেপে এদেশের বর্তমান মানবাধিকার পরিস্থিতি তুলে ধরা হলঃ
বাংলাদেশের সংবিধানে মানবাধিকারঃ কতিপয় মানবাধিকারকে যখন সাংবিধানিক ভাবে সংরক্ষণ করা হয় তখন সেগুলো মৌলিক অধিকারের পর্যায়ভুক্ত হয়। বাংলাদেশের সংবিধানের তৃতীয় ভাগে এরূপ ১৮টি মৌলিক অধিকারের কথা বলা হয়েছে। সংবিধানের ২৭ থেকে ৪৪ অনুচ্ছেদ পর্যন্ত এ সকল অধিকার সমূহ সম্পর্কে বিস্তারিত বর্ণনা রয়েছে। সংবিধানে উল্লিখিত মৌলিক অধিকারসমূহ রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ আইন। অন্য যেকোন আইন এর পরিপন্থী হলে বা অসামঞ্জস্যপূর্ণ হলে তা বাতিল হয়। এই অধিকার গুলোর সংক্ষিপ্ত বিবরণ নিম্নে বর্ণিত হল:
অনুচ্ছেদ-২৭: আইনের দৃষ্টিতে সমতা; অনুচ্ছেদ-২৮: ধর্ম প্রভৃতি কারণে বৈষম্য; অনুচ্ছেদ-২৮: সরকারী নিয়োগলাভের সুযোগের সমতা; অনুচ্ছেদ-৩০: বিদেশী খেতাব প্রভৃতি গ্রহণ নিষিদ্ধকরণ; অনুচ্ছেদ-৩১: আইনের আশ্রয় লাভের অধিকার; অনুচ্ছেদ-৩২: জীবন ও ব্যক্তি-স্বাধীনতার অধিকার রক্ষণ; অনুচ্ছেদ-৩৩: গ্রেপ্তার ও আটক সম্পর্কে রক্ষাকবচ; অনুচ্ছেদ-৩৪: জবরদস্তি শ্রম নিষিদ্ধকরণ; অনুচ্ছেদ-৩৫: বিচার ও দন্ড সম্পর্কে রক্ষণ; অনুচ্ছেদ-৩৬: চলাফেরার স্বাধীনতা; অনুচ্ছেদ-৩৭: সমাবেশের স্বাধীনতা; অনুচ্ছেদ-৩৮: সংগঠনের স্বাধীনতা; অনুচ্ছেদ-৩৯: চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতা এবং বাক স্বাধীনতা; অনুচ্ছেদ-৪০: পেশা বা বৃত্তির স্বাধীনতা; অনুচ্ছেদ-৪১: ধর্মীয় স্বাধীনতা; অনুচ্ছেদ-৪২: সম্পত্তির অধিকার;অনুচ্ছেদ-৪৩: গৃহ ও যোগাযোগের রক্ষণ;এবং অনুচ্ছেদ-৪৪: মৌলিক অধিকার বলবৎকরণ।
এগুলোর মধ্যে ছয়টি অর্থাৎ অনুচ্ছেদ ৩২,৩৩,৩৪,৩৫,৪১ ও ৪৪ মৌলিক অধিকার বাংলাদেশে অবস্থানরত নাগরিক ও বিদেশীরা ভোগ করতে পারে এবং অবশিষ্ট বারটি অর্থাৎ অনুচ্ছেদ ২৭,২৮,২৯,৩০,৩১,৩৬,৩৭,৩৮,৩৯,৪০,৪২, এবং ৪৩ শুধুমাত্র বাংলাদেশের নাগরিকগণ ভোগ করতে পারবে।

বাংলাদেশে মানবাধিকার লঙ্ঘনঃ বাংলাদেশ একটি গণতান্ত্রিক দেশ। গণতন্ত্র সুপ্রতিষ্ঠিত থাকলে মানবাধিকার সুপ্রতিষ্ঠিত থাকবে এবং গণতন্ত্র ধ্বংস হলে মানবাধিকারের ভিত্তি নড়বড়ে হয়ে লঙ্ঘিত হবে মানবাধিকার। আমাদের দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি খুব একটা সুখকর নয়। গৃহকোণ থেকে রাষ্ট্রীয় আওতা পর্যন্ত নানা ক্ষেত্রে নানাভাবে মানবাধিকার লংঘিত হচ্ছে। মানবাধিকার পরিস্থিতি এখানে সব সময়ই উদ্বেগজনক। বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রতিবেদনঃ
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক)প্রতিবেদন: বাংলাদেশে ২০১৪ সালের মানবাধিকার পরিস্থিতিকে উদ্বেগজনক বলেছে আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক)। প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১৪ সালেও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড অব্যাহত ছিল। ২০১৩ সালে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছে ৭২ জন। ২০১৪ সালে এই সংখ্যা বেড়ে ১২৮- এ দাঁড়িয়েছে। ২০১৪ সালে গুম ও গুপ্তহত্যার শিকার হয়েছে ৮৮ জন। এর মধ্যে ১২ জন মুক্তি পেয়েছে। ২৩ জনের লাশ উদ্ধার হয়েছে। দুজন কারাগারে এবং বাকিদের কোনো খোঁজ মেলেনি। ২০১৪ সালে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নির্যাতনে মারা গিয়েছে ১৩ জন। গ্রেপ্তারের আগে মারা গিয়েছে দুজন। আত্মহত্যা করেছে একজন। ৫ জানুয়ারির নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ৬৬৪টি রাজনৈতিক সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে। এতে নিহত হয়েছে ১৪৭ জন। আহত ৮ হাজার ৩৭৩ জন। বছরটিতে মতপ্রকাশের ক্ষেত্রে বিভিন্ন সময় বাধা পাওয়ার অভিযোগ এসেছে। এ সময় দুজন সাংবাদিক খুন হয়েছেন। নির্যাতনের শিকার হয়েছেন ২৩৯ জন। এ বছর হিন্দু সম্প্রদায়ের ৭৬১টি বাড়ি-ঘরে ভাঙচুর ও আগুন দেওয়া হয়েছে। ১৯৩টি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে আগুন ও ভাঙচুর চালানো হয়েছে। ২৪৭টি মন্দির ও প্রতিমা ভাঙচুর করা হয়েছে। ২০১৪ সালে সীমান্তহত্যা, নির্যাতনসহ ২৭৩টি ঘটনা ঘটে। এ সময় গুলিতে ১৬ জন ও নির্যাতনে ১৬ জন নিহত হয়। বছরটিতে নারী নির্যাতন আশঙ্কাজনকভাবে বেড়েছে। ৭০৭ জন নারী ও শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে। ২০১৪ সালে অভিবাসী শ্রমিক ও মানব পাচারও বেড়েছে।
মানবাধিকার সংস্থা অধিকারের মতেঃ ৩০টি নিখোজের ঘটনায় নিরাপত্তা বাহিনী জড়িত আছে। ২০১০ সালে এই সংখ্যা ছিল ৯। নিরাপত্তা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা অনেক বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ড ঘটিয়েছে। পুলিশ, বিজিবি ও র্যা ব এ সময়ে অপ্রত্যাশিত শক্তি ব্যবহার করেছে। র্যাারের খেয়াল খুশিমত কার্যক্রমের ঘটনা অনেক। এতে বলা হয়েছে, সংবিধানে নির্যাতন, নিষ্ঠুরতা, অমানবিকতা ও নিষ্ঠুর শাস্তি সংবিধান রহিত করলেও র্যােব ও পুলিশসহ নিরাপত্তা রক্ষাকারীরা ঘন-ঘন নির্যাতন । আটক ও জিজ্ঞাসাবাদের সময় মারাত্মক শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করছে । তারা এখন হুমকি দিচ্ছে, প্রহার করছে, এমনকি বৈদ্যুতিক শর্ট পর্যন্ত দিচ্ছে। অধিকারের মতে, নিরাপত্তা বাহিনী কমপক্ষে ৪৬ জনকে নির্যাতন করেছে।
হিউম্যান রাইটস ওয়াচের প্রতিবেদনঃ বিচারবহির্ভূত হত্যাসহ ব্যাপক মানবাধিকার লঙ্গনের দায়ে অভিযুক্ত র্যাসবকে কুখ্যাত বাহিনী আখ্যা দিয়ে র্যাাবকে ভেঙ্গে দেয়ার জন্য আবারও দাবি জানিয়েছে সংস্থাটি। রিপোর্টে বলা হয়, বিডিআর বিদ্রোহের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে আটক বিডিআর সদস্যদের ওপর সেনাবাহিনী, র্যা ব ডিজিএফ আই, এন এস আই সহ অন্য বাহিনীর সদস্যরা অমানবিক নির্যাতন চালিয়েছে। আটক অবস্থায় অন্তত ৪৭ জনের মৃত্যু হয়েছে। ২০০৯ সালের বিডিআর বিদ্রোহের সঙ্গে জড়িত সন্দেহভাজনদের ওপর আটক অবস্থায় প্রচন্ড এবং অমানবিক নির্যাতন চালানো হয়েছে। প্রায় ৬ হাজার অভিযুক্তের গণবিচার চলছে। যারা নির্যাতিত হয়েছেন এবং নির্যাতনে যাদের মৃত্যু হয়েছে তাদের আত্মীয়-স্বজন, আইনজীবী এবং পোস্টমর্টেম রিপোর্ট থেকে প্রয়োজনীয় তথ্য সংগ্রহ। ২০ থেকে ৩০ জনের জন্য একজন আইনজীবী। বিডিয়ার বিদ্রোহের সময় পদস্থ সেনা কর্মকর্তাসহ যে ৪৭ ব্যক্তিকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে তার বিচার অবশ্যই হতে হবে বলে মন্তব্য করেন ব্রাড অ্যাডামস।
মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্টের রিপোর্টঃ বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতির তীব্র সমালোচনা করেছে যুক্তরাষ্ট্র। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বার্ষিক মানবাধিকার বিষয়ক রিপোর্টে বলা হয়েছে, বিচার বিভাগকে অতিমাত্রায় রাজনীতিকরণ করা হয়েছে। এর ফলে বিরোধীদের ন্যায়বিচার পাওয়ার পথকে সংকুচিত করা হয়েছে। রিপোর্টে বলা হয়েছে, সরকারি পর্যায়ে দূর্নীতি একটি মারাত্মক সমস্যা। সংবাদপত্রের স্বাধীনতা ও মত প্রকাশের স্বাধীনতাকে সীমিত করেছে সরকার। এ ক্ষেত্রে সেলফ সেন্সর চলছেই। গুম, নিরাপত্তা হেফাজতে মৃত্যু, খেয়াল খুশিমত গ্রেফতার ও আটক রাখার জন্য দায়ী নিরাপত্তা বাহিনী। তারাই মানবাধিকারের বড় সমস্যা।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে সবচেয়ে বেশী মানবাধিকার লংঘন হয়েছে সাতটি বিভাগে তা হলঃ
১) বিচার বিভাগ; ২) নিরাপত্তা বাহিনী; ৩) বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ড; ৪) রাজনৈতিক অধিকার; ৫) সরকারের দূর্নীতি; ৬) গণমাধ্যম ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা; এবং ৭) শ্রমিকের অধিকার ।
অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের রিপোর্টঃ অ্যামনেস্টির ২০১২ সালের মানবাধিকার রিপোর্ট এ উদ্বেগ প্রকাশ করে বলা হয়, বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ডে বাংলাদেশ সরকার তার প্রতিশ্রুতি রাখেনি। বিনাবিচারে আটক, নিরাপত্তা হেফাজতে নির্যাতন এবং মৃত্যুর ঘটনা বেড়েই চলেছে। রিপোর্টে বলা হয়, দৈনিক আমার দেশ পত্রিকার সম্পাদক মাহবুবুর রহমানকে গ্রেফতার করে তার উপর নিষ্ঠুর নির্যাতন চালানো হয়েছে। মাছরাঙগা টিভি ও এটিএন নিউজের সাংবাদিক সাগর,রুনি হত্যা ও দৈনিক প্রথম আলোর সাংবাদিকদের উপর পুলশিরে নর্যিাতন ও হামলা । বর্তমান সরকারের আমলে নারী নির্যাতনের ঘটনা বেড়েছে সবচেয়ে বেশি। ২০১১ সালে অসংখ্য নারী এবং শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে। মানবাধিকার সংগঠনগুলোর হিসাব অনুযায়ী ২০১১ সালে মোট ৫৪ জনেরও বেশি মানুষকে র্যা ব এবং পুলিশসহ অন্য আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা বিচারবহির্ভূত হত্যা করেছে। ২০০৪ সালে র্যা ব গঠনের পর এ পর্যন্ত তাদের হাতে বিচার বহির্ভূত হত্যার শিকার হয়েছে অন্তত ৭০০ জন।
বিচার বহির্ভূত হত্যা ও হেফাজতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্থঃ-
১. বিএনপি নেতা এম ইলিয়াস আলী গুম; ২. শ্রমিক নেতা আমিনুল হত্যা; ৩. নরসিংদী পৌরমেয়র লোকমান হত্যা; ৪. ঢাকা সিটি কর্পোরেশন কাউন্সিলর চৌধুরী আলম গুম।
উল্লেখ্য, ১০ ডিসেম্বর বিশ্বব্যাপী পালিত হয় বিশ্ব মানবাধিকার দিবস হিসাবে। বাংলাদেশে সরকারিভাবে দিবসটি পালিত না হলেও মানবাধিকার সংস্থাগুলোসহ অনেক বেসরকারি সংগঠন দিবসটি পালন করে। এ বছরে(২০১৪)বিশ্ব মানবাধিকার দিবসের প্রতিপাদ্য বিষয় ছিল ‘হিউম্যান রাইটস ৩৬৫’ অর্থাৎ বছরের ৩৬৫ দিনই মানবাধিকার দিবস। প্রত্যেক মানুষের মানবাধিকার নিশ্চিত করার লক্ষ্য নিয়ে ১৯৪৮ সালের ১০ ডিসেম্বর জাতিসংঘের সদস্য রাষ্ট্রগুলোর সমন্বয়ে ঘোষিত হয় The Universal Declaration of Human Rights বা সর্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণা। তবে ১৯৫০ সালের ৪ ডিসেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে এক রেজুলেশনের মাধ্যমে ১০ ডিসেম্বর মানবাধিকার দিবস হিসেবে আনুষ্ঠানিক প্রতিষ্ঠা পায়।
পরিশেষে বলতে চাই, আমরা তৃতীয় বিশ্বের একটি উন্নয়নশীল দেশ। এখানে শিক্ষার হার যেমন কম, তেমন বেশিরভাগ লোকই দারিদ্র্য সীমার নিচে বসবাস করে। মানবাধিকার বিষয়টি অনেকেরই অজানা, অচেনা। তাই মানবাধিকার বিষয়টি সরকারি কিংবা বেসরকারিভাবে মাঠ পর্যায়ে নিয়ে যেতে হবে। সকলকে অবগত করতে হবে তাদের অধিকার সম্পর্কে। এজন্য আমাদের সুশীল সমাজ, মানবাধিকারকর্মী, আইনের সাথে জড়িত ব্যক্তিবর্গ ও মিডিয়াগুলোকেও এগিয়ে আসতে হবে। সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টাই পারে মানবাধিকার সম্পর্কে জনসাধারণকে অবগত করতে ও অধিকার সচেতন করতে। আর যখনই সাধারণ মানুষ তাদের অধিকার সম্পর্কে অবগত ও সচেতন হবে তখনই প্রকৃত অর্থে প্রতিষ্ঠা পাবে মানবাধিকার।

তথ্যসূত্রঃ
 বাংলাদেশের সংবিধান;
 ড. রেবা মন্ডল ও ড. মোঃ শাহজাহান মন্ডল, মানবাধিকার আইন সংবিধান ইসলাম এনজি;
 মোঃ আব্দুল হালিম, সংবিধান, সাংবিধানিক আইন ও রাজনীতিঃ বাংলাদেশ প্রসঙ্গ;
 জার্নাল এবং
 সংবাদপত্র।
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আইনের ফাঁকফোকর-০৩

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ০৪ ঠা মে, ২০২৪ দুপুর ১২:৪২

যেকোনো চাকরির নিয়োগের পরীক্ষা চলছে। সেটা পাবলিক সার্ভিস কমিশন, বিভিন্ন সংস্থা, বিভাগীয় কমিশনার, জেলা প্রশাসক বা উপজেলা পর্যায়ের কোনো কার্যালয়ে হতে পারে। এই নিয়োগ পরীক্ষায় প্রশ্নপত্র ফাঁস হতে পারে। একজন... ...বাকিটুকু পড়ুন

গল্পঃ অনাকাঙ্ক্ষিত অতিথি

লিখেছেন ইসিয়াক, ০৪ ঠা মে, ২০২৪ দুপুর ১:১২

(১)
মাছ বাজারে ঢোকার মুখে "মায়া" মাছগুলোর উপর আমার  চোখ আটকে গেল।বেশ তাজা মাছ। মনে পড়লো আব্বা "মায়া" মাছ চচ্চড়ি দারুণ পছন্দ করেন। মাসের শেষ যদিও হাতটানাটানি চলছে তবুও একশো কুড়ি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ব্লগে বিরোধী মতের কাউকে নীতি মালায় নিলে কি সত্যি আনন্দ পাওয়া যায়।

লিখেছেন লেখার খাতা, ০৪ ঠা মে, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:১৮

ব্লগ এমন এক স্থান, যেখানে মতের অমিলের কারণে, চকলেটের কারণে, ভিন্ন রাজনৈতিক মতাদর্শের কারণে অনেক তর্কাতর্কি বিতর্ক কাটা কাটি মারামারি মন্তব্যে প্রতিমন্তব্যে আঘাত এগুলো যেনো নিত্য নৈমিত্তিক বিষয়। ব্লগটি... ...বাকিটুকু পড়ুন

সিকান্দার রাজার চেয়ে একজন পতিতাও ভালো।

লিখেছেন ...নিপুণ কথন..., ০৪ ঠা মে, ২০২৪ রাত ৮:০৭

সিকান্দার রাজা কোকের বোতল সামনে থেকে সরিয়ে রাতারাতি হিরো বনে গেছেন! কিন্তু তাকে যারা হিরো বানিয়েছেন, তারা কেউ দেখছেন না তিনি কত বড় নেমকহারামি করেছেন। তারা নিজেদেরকে ধার্মিক বলে দাবি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ব্লগার'স ইন্টারভিউঃ আজকের অতিথি ব্লগার শায়মা

লিখেছেন অপু তানভীর, ০৪ ঠা মে, ২০২৪ রাত ১১:০৫



সামুতে ব্লগারদের ইন্টারভিউ নেওয়াটা নতুন না । অনেক ব্লগারই সিরিজ আকারে এই ধরণের পোস্ট করেছেন । যদিও সেগুলো বেশ আগের ঘটনা । ইন্টারভিউ মূলক পোস্ট অনেক দিন... ...বাকিটুকু পড়ুন

×