“ওই পান্না! কই গেলি? আবার একটা বডি আইছে”- বলে চেচিয়ে উঠল ডিউটি অফিসার। ডাকশুনে মাথাতুলে তাকাল পান্না। মদের নেশায় বিভোর সে। সবকিছুই কেমন জানো ফাকা ফাকা লাগছে।
পান্নালাল দাস। আজ ৫৬ বছর যাবত এই একই জায়গায় কাজ করছে সে। বয়ষ যখন ১১, ঠিক তখন ই বাবার হাত ধরে এই ঘরে এসেছিল সে। যে বয়সে তার বই হাতে স্কুলে যাওয়ার কথা, বিকেলে পাড়ার মাঠে দাপিয়ে বেড়াবার কথা, সেই বয়সেই সে হাতে তুলে নিয়েছে ছুরি, কাচি। ফুটবলে লাথি মারার বদলে অবলিলায় ছুরি চালিয়েছে মৃতের শরীরে। পেশায় সে ডোম। বংশ পরম্পরায় ডোমের ঘরে জন্ম নিয়ে ডোম হয়েই বেড়ে উঠতে হয়েছে তাকে। সমাজের চোখে অস্পৃশ্য, ছোট জাত।
‘ওই শালা ডোমের বাচ্চা ডোম, এতক্ষন কি করস? জমিদারী পাইতা বইছ নিকি? তারাতারি আয় খানকিরপোলা’। ডিউটি অফিসার এর কথাগুলো বুকে সেলেরমত বিধে পান্নার। কিন্তু কিছুই বলার নেই তার। সে যে ছোট জাত। গালি খাওয়াই তার জীবনের অমোঘ বিধান।
--কি হইছে? এত চিল্লাইতেছেন ক্যা? অফিসারের দিকে তাকিয়ে একটু রুক্ষভাবেই কথাগুলো বলল পান্নালাল।
--‘চিল্লাবনা তো কি তোমারে চুমা দিব মাদারচোদ? নতুন একটা বডি আইছে, সেই দিকে খেয়াল নাই, শালা বইসা বইসা ধ্যান করতাছে’। যা তারাতারি কামে হাত লাগা।
উঠে যায় পান্নালাল। ডেডবডি পাঁজকোলে করে ট্রলিতে শুইয়ে দেয় সে। একাজে তাকে সহযোগিতা করে তারই ছেলে চয়ন। চয়ন ও এপেশায় নেমেছে পান্নালালের হাতধরে। যেমনটি করেছিল পান্নার বাবা হরিচরন, এটাইতো নিয়ম। তিনটি ছেলে জন্মেছে। বড় ও মেঝ ছেলে অন্য জেলায় এ পেশায় আছে।
‘নে তারাতারি হাত লাগা, নাইলে ওই শালা অফিসার আবার চিল্লাচিল্লি করবো, হারামিরবাচ্চারা লাশ নিয়া বাণিজ্য করে, আর মরতে আসে আমাগো কাছে’। ছেলেকে উদ্দেশ্য করে আনমনেই কথাগুলো বলে পান্নালাল।
মধ্য বয়সী গৃহবধূর বডি এসেছে আজ। আত্মহত্যা করে মরেছে। না জানি কি দুঃখও ছিল তার! হয়ত স্বামীর সাথে বনিবনা হচ্ছিল না, অথবা ব্যাক্তিগত কোন কষ্ট। আহারে বেচারি! নিজের অজান্তেই দীর্ঘশ্বাস বেড়িয়ে আসলো পান্নালালের মন থেকে। কিন্তু সে যে ডোম। নির্মমতায় তার চলার পথের সঙ্গি। তাই সমস্ত দুঃখও-কষ্ট দূরে সরিয়ে মদের বোতলে চুমুক দিয়ে কাজ শুরু করল সে, সাথে চয়ন। কাটাকুটি শেষ করে ডেড বডি বুঝিয়ে দিয়ে বের হল তারা। আজ আর কাজ নেই। বাসার পথ ধরল দুজন।
হরিজন পল্লীর এক ঘরেই জীবনের ৬৭ বছর কাতিয়ে দিল পান্নালাল। এই সময়ের মধ্যে অসংখ্যবার সূর্য উঠেছে আবার অস্ত গিয়েছে। কিন্তু পান্নাদের জীবন অন্ধকারই থেকে গিয়েছে। জীবনের দীর্ঘ সময়ে লাশের কাটাছেড়া করলেও সমাজের চাপিয়ে দেয়া নিয়ম কাটতে পারেনি পান্নালালরা। হয়তবা তাদের কাটতে দেওয়া হয় নি। সমাজের ভাগ্য বিধাতাদের চিত্রনাট্যে পান্নালালদের দলিত করেই রাখা হয়েছে। শহরবাসীরা পান্নালালদের রাস্তা দিয়ে হাঁটতে দেখলে ইতস্তত বোধ করে, জাত যাওয়ার ভয়ে দূরে সরে যায়।
এই সমাজে তাদের না পাওয়ার আর্তনাদ কারো কাছেই পৌঁছায় না। দুনিয়ায় মানুষের উঁচু-নিচু ভেদাভেদ বদলাচ্ছে, শুধু বদলাচ্ছেনা পন্নালালদের ঘুণে ধরা অস্পৃশ্য জীবন। ময়লা আবর্জনার স্তুপের মধ্যেই তাদের নিত্য দিনের বসবাস। জন্মই যেন তাদের আজন্ম পাপ।
সর্বশেষ এডিট : ০২ রা ডিসেম্বর, ২০১৪ বিকাল ৩:৪৪