কীভাবে আর কেন যে কালিম পাখিটি আমাদের বাসার বারান্দায় এল, তার সঠিক কারণ এখন পর্যন্ত বের করতে পারলাম না। সেদিন ১০ আগস্ট, সকাল ১০:৩০। ভার্সিটি যাবার পথে পোষা বিড়ালের মুখ থেকে অদ্ভূত শব্দ শুনে বারান্দা গেলাম, গিয়ে দেখি টবে বসে আছে ইয়াব্বড় পাখি ! আমি তো পুরোপুরি থতমত খেয়ে গেলাম। মা আর কলেজ পড়ুয়া ছোট ভাই কে ডাকাডাকি করলাম। মা পাখিটির পা দু'টো সুন্দর করে ধরে মেঝেতে নামালেন। মাছ, বিস্কুট, চাল, পানি- কী না খেল সে ! আহারে, অনেক ক্ষুধার্ত ছিল বোধয় সেটি। পাখিটিকে দেখে আমার বিড়ালের উত্তেজনা ছিল দেখার মত। হিন্দুদের বিয়েতে যেমন আগুনের চারপাশে বর-বধুকে সাত-পাক দিতে হয়, আমার বিড়ালগুলোও পাখিটির চারপাশে এভাবে পাক দিচ্ছিলো। পাখিটির জন্য বাসার স্টোর রুম থেকে বিশাল খাঁচা নামানো হল অটাকে ওখানে রাখা হবে বলে। পাখিটি সেখানে আটলেও, ওখানে সে যেন থাকবার নয়। যাই হোক, আমি ভার্সিটি চলে যাই।
বাসায় ফিরে পাখিটিকে দেখি সে এরি মধ্যে অনেক কিছু খেয়েছে, আর মেয়ে বিড়ালটি নাকি সারাদিন কিছুই খাইনি, শুধু পাখিটির খাঁচার কাছে বসে আছে। আমি বাসায় এসেই প্রথম আলোর অফিসে ফোন করি, যেন তারা পাখিটি আসলে কোন প্রজাতির, তা চিহ্নিত করে। কিন্তু কোন সদুত্তর না পাওয়ায় বড় দুঃখ পাই, আর শংকায় পড়ে যাই অমন সুন্দর বড় পাখিটিকে কি করা যায় ভেবে। ফেইসবুকে সবার কাছে পাখিটির বেগুনি-সবুজ বর্ণের ছবি প্রকাশ করি, সবাই বোকা বনে যায়। সন্ধ্যার দিকে আমার এক বান্ধবীর সহায়তায় এটিএন নিউজ এর "জলে জঙ্গলে" অনুষ্ঠানের হর্তাকর্তার নাগাল পাই। উনাকে ফোন করতেই কাহিনী বদলে যায়। ততক্ষণে আমরা পাখিটিকে অবমুক্ত করে দিয়েছি আমাদের ঘরে, সে আমাদের পোষা পাখির মত নির্বিঘ্নে সারা ঘর হেঁটে বেড়ায়। আমার মা-বাবা-ভাই-বোন আর আমার অপার ভালোবাসায় সে হয় সিক্ত।
পরদিন আমার বাসায় আসে এটিএন নিউজ এর রিপোর্টার। তারা পাখিটির ভিডিও ফুটেজ প্রচার করতেই সারা দেশে সাড়া পড়ে যায়। ওনাদের পরামর্শে পাখিটিকে ফেনীর উদ্দেশ্যে পাঠিয়ে দেই আমার খালার বাড়ি কুমিল্লায়। সেখানে গিয়ে সে নাকি কিছুই খায় না। ১২ তারিখ আমার মায়ের অনুরোধে আবার তাকে কষ্ট দিয়ে ঢাকাতে ফেরত আনা হয়, এবং আমাদের বাসায় এসে আবার সে অনেক খাওয়া দাওয়া করে। তার হাবভাব এমন ছিল, যেন সে আমাদের কতদিনের পোষা পাখি।
রিপোর্টার সাহেব আমাকে জানালেন, বনানী গল্ফ ক্লাবে আরো কালিম পাখি আছে, আর্মিদের চিড়িয়াখানা, অনেক নিরাপদ এবং মুক্ত। ওখানে পাখিটিকে দেয়া যেতে পারে, ওখানকার কর্তৃপক্ষ পাখিটি চেয়েছেন। আর্মিদের করা চিড়িয়াখানা বলে খানিকটা আস্বস্ত হই। অন্তত মিরপুর চিড়িয়াখানার মত জঘন্য কিছু হবে না ভেবে সিদ্ধান্ত নেই পাখিটিকে তার বন্ধুদের কাছেই ফিরিয়ে দিব।
১৫ তারিখ রবিবার অবশেষে পাখিটিকে গল্ফ ক্লাবের হেড, মেজর সাহেবের কাছে হস্তান্তর করি। সেখানে এটিএন এর সহায়তায় যাই আমি। ওখানকার পরিবেশ আমি খুব খুটিয়ে খটিয়ে পর্যবেক্ষণ করি। খাঁচাটি এত বড় ছিল যে আমার মনেই হচ্ছিল না আমি খাঁচার ভেতরে দাঁড়িয়ে আছি। পাখিটি দিতে গিয়ে আমি অনেক কষ্ট পাই, তাই কেঁদে ফেলি ওখানকার সবার সামনে। আর পরদিন নিউজ এ সেটা দেখে আমাকে সহমর্মিতা জানাতে ফোন করেন কবি নির্মলেন্দু গুণ !!!! এটা আমার জীবনের অনেক বড় পাওয়া ছিল। ১৬ তারিখ রাতটিতে আমি অনেক অবাক হলাম, এক কালিম পাখির জন্য এত কিছু ??!! আমি ভাবতাম পাখিটি হয়ত শুধু আমাকে এবং আমার পরিবারটিকে কাঁদিয়েছে, কিন্তু এটির বিদায় যে দুর-দুরান্তের আরো মানুষকে কাঁদিয়েছে, তা আমি ফেইসবুকের মাধ্যমে জানতে পারি।
পশুপাখির প্রতি আমার ভালোবাসা সবসময়ের জন্য থাকবে ইনশাল্লাহ। আমি চাই, এটিএন নিউজ এর কালিম পাখি বিষয়ক রিপোর্টির মাধ্যমে মানুষ পাখিকে খাঁচায় বন্দী কিংবা খাবার হিসেবে নয়, মুক্তির প্রতীক হিসেবে দেখবে, আর পশুকে শিকার হিসেবে দেখবে না,পিটিয়ে মেরে ফেলবে না, আল্লাহ্র অসীম সুন্দর সৃষ্টি হিসেবে ভালোবাসবে ।
সর্বশেষ এডিট : ১৭ ই আগস্ট, ২০১০ সন্ধ্যা ৭:৪৫