একটা বাস্তবিক ঘটনা দিয়ে শুরু করতে চাচ্ছি আপনাদেরকে কিছু ধারনা দেয়ার জন্য।
অফিসিয়াল এবং ব্যক্তিগত বিভিন্ন কারনে আমি বেশ কিছু পাবলিক "স্ল্যাক" চ্যানেলের সদস্য। চ্যানেলগুলোর মূল উদ্দেশ্যই হলো বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে-ছিঁটিয়ে থাকা প্রযুক্তি সংক্রান্ত সুর্নিদিষ্ট কিছু বিষয়ে আলোচনা করা। পৃথিবীর যে কোন দেশ থেকে যে কোন ব্যক্তি এইসব চ্যানেলে যোগ দিয়ে তাদের সমস্যা, ভাবনা, উপদেশ ইত্যাদি বিষয়গুলো শেয়ার করতে পারেন। এখানে উৎসাহী দাদু টাইপ লোক থেকে শুরু করে প্রোগ্রামিং জগতের মহাজ্ঞাণী ব্যক্তিকেও ছদ্মনামে খুঁজে পেতে পারেন। আমি যেহেতু ছোটখাটো মানুষ আমার আসল নাম শেয়ার করলেও সমস্যা নেই। কারণ আমার আনাগোণা মূলত জ্ঞানী বা বিজ্ঞরা কি বলছেন তা জানার চেষ্টা করা, আলোচনায় অংশ নেয়া এবং সম্ভব হলে কাউকে সাহায্য করা। তবে এখানে ভাব আদান-প্রদানের মূল ভাষা হলো ইংরেজী।
যাইহোক, কিছু চ্যানেলে দীর্ঘদিন ধরে অবস্থানের কারনে কমবেশী কিছু মানুষ হয়তো আমাকে চেনেন বা জানেন। যাদের বেশীরভাগ অংশই মূলত নন-আমেরিকান লোকজন। বছরখানেক আগে হঠাৎ করে একটা মেসেজ পাই অচেনা-অজানা কারো কাছ থেকে। যা ভাষ্য হলো, তিনি আমাকে বেশ কিছু সময় ধরে চেনেন বা চ্যানেলে দেখেছেন (আসলে তিনি আমার ব্যাপারে মোটামুটি গবেষণাও করে ফেলেছেন)। তিনি আমার সাহায্য চাচ্ছেন। জিজ্ঞেস করলাম কি ধরনের সাহায্য চাচ্ছেন? তিনি সারমর্মতে যা বোঝাতে চাইলেন তা হলো, তিনি বিরাট প্রোগ্রামার, সবকিছু তিনি চুটকিতে করে ফেলতে পারেন। তিনি আমেরিকায় পড়াশোনা করেছেন কিন্তু তিনি তাইওয়ানের নাগরিক এবং আমেরিকায় কাজ করার অনুমতি তার নেই। কিন্তু তিনি চান আমেরিকান ভালো বেতনের প্রোগ্রামিং চাকুরি করবেন। তিনি আমার নাম, তথ্য ব্যবহার করে তিনিই আবেদন করে চাকুরি জোগাড় করবেন, আমিই আমার বাংকে মাস শেষে বেতন পাবো শুধু তাকে বেতনের ৬০% দিতে হবে আর আমি আমার তথ্য ব্যবহারের জন্য ৪০% টাকা ফ্রিতে পাবো। মনে রাখুন এখানে ৪০% বলতে বাৎসরিক হিসেবে বাংলাদেশী টাকায় ৪০ লক্ষকে বোঝানো হয়েছে। ব্যাপারটা বেশ লাভজনক মনে হচ্ছে না? সুযোগটা আমার স্থানে আপনি হলে লুফে নিতেন?
আসুন তিনি কেন আমার সাথে যোগাযোগ করেছেন সেটা বোঝার চেষ্টা করি।
- প্রথমত আর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা হলো তার আইনগতভাবে আমেরিকায় কাজ করার অনুমতি নেই কিন্তু তিনি জেনেছেন আমার সেটা রয়েছে।
- তার শারীরিক অবস্থান তাইওয়ানে যদিও তিনি আমাকে মিথ্যে বলেছেন যে তিনি আমেরিকায় পড়াশোনা করেছেন। আমি অনলাইন ঘেঁটে তাকে খুঁজে বের করে যা বুঝতে পেরেছি তা হলো তিনি সম্ভবত কখনো আমেরিকায় বেড়াতে এসেছিলেন, হয়তো ইংরেজী শেখার জন্য কিছুদিন এখানে অবস্থানও করেছেন। তবে তিনি অনলাইন ঘেঁটে জেনেছেন যে আমি আমেরিকায় বসবাস করছি এবং এখানকার একজন নাগরিক, পাশাপাশি এখানেই পড়াশোনা করেছি। একটা সামাজিক সাইটে গিয়ে তিনি আমার প্রোফাইল চেক করেছেন আর সেখান থেকেই আমি তাকে খুঁজে বের করতে পেরেছি।
- তার ইংরেজী জ্ঞান অত্যন্ত দুর্বল যে কারনে তিনি আমার সাথে ফোনে আলাপ করতে রাজি হন নি। তিনি আমার ব্যাপারে ঘাটাঘাঁটি করে অনলাইন থেকে আমার ইংরেজী বলার ক্যাপাসিটি সম্পর্কে জেনেছেন। আর্ন্তজালে আমার ব্লগ ঘুরেছেন, পড়েছেন, ই্উটিউব চ্যানেলও ঘুরে এসেছেন।
মানে হলো সে ভালো করে জেনেই মূলত আমার সাথে যোগযোগ করেছেন এই উদ্দেশ্যে যে, তিনি আমেরিকার কোন বড় কোম্পানীতে চাকুরি করে বেশ ভালো টাকা-পয়সা আয় করতে চান। এখানে বলে রাখা ভালো যে "ভালো বেতন" ব্যক্তি বিশেষে নির্ভর করে। তবে তার দৃষ্টিকোণ থেকে ভালো বেতন বলতে মোটামুটিভাবে বাৎসরিক ১ লাখ ডলারের চাকুরি। বর্তমান রেটে সেটা বাংলাদেশী টাকায় এক কোটি টাকারও বেশী।
জেনে রাখা ভালো যে আমেরিকার নিউ ইয়র্ক রাজ্যের একজন উপার্জনক্ষম ব্যক্তির মিডিয়ান ইনকাম বাৎসরিক ৬৩ হাজার ডলারের মত (সূত্র)। তবে পরিবারের সদস্য সংখ্যা ৪ জন হলে সেটা প্রায় ১ লক্ষ ১২ হাজার ডলার। তবে ব্যক্তিগতভাবে আমার মনে হয় নূন্যতম ২ লাখ ডলার বা তার অধিক আয় থাকলে তাকে ভালো আয় বলা যায়।
এবার মূল আলোচনায় আসা যাক।
অনলাইনে বাংলাদেশীরা কি "ভালো টাকা" আয় করতে পারবেন?
এর সহজ কোন উত্তর নেই। পুরো বিষয়টাই নির্ভর করছে বাৎসরিক কত টাকা আর করলে সেটাকে আপনি ভালো আয় বলবেন সেটার উপর যা ব্যক্তি বিশেষে নির্ভর করে। তবে আয় করা সম্ভব। বিভিন্ন ফ্রি ল্যান্সিং সাইট থেকে কম বেশী কাজ করে অনেকেই বাংলাদেশী টাকায় হয়তো ভালো আর করছেন। এর সঠিক অংক আমি আপনাকে দেখাতে পারবো না। তবে আমার দৃষ্টিতে বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই আপনাকে তুলনামূলকভাবে কম টাকায় কাজ করতে হবে। ফ্রি ল্যান্সিং সাইটগুলোই বানানো হয়েছে মূলত এই উদ্দেশ্যেই।
কি ভাবে বাংলাদেশী টাকায় ভালো আয় করা সম্ভব?
আমেরিকায় অবস্থানরত কোন ব্যক্তি বা কোম্পানীর সাথে সরাসরি কাজ করতে পারলে এই সমস্যার অনেকটাই ঘুঁচানো সম্ভব। মধ্যবর্তী কোম্পানী বা প্রতিষ্ঠান থাকলে তারা বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই আয়ের বিরাট অংশ খেয়ে ফেলবে। সরাসরি কাজের ক্ষেত্রেও বেশ কিছু বিষয় মাথায় রাখা প্রয়োজন। ঘন্টায় কত রেটে আপনাকে কাজ দেয়া হচ্ছে বা সাথে কোন বেনেফিট প্যাকেজ দেয়া হচ্ছে কিনা ইত্যাদি বিষয়গুলোর উপর। তবে বিষয়গুলো এখন আগের চেয়ে অনেক বেশী কঠিন হয়ে গেছে।
কি ধরনের যোগ্যতা প্রয়োজন?
এখানেই মূলত বেশীরভাগ মানুষ কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি হবে। ইংরেজীতে পারদর্শীতার অন্যথা হওয়ার সুযোগ নেই। যে কোন কাজে আপনাকে দক্ষতার পরিচয় দিতেই হবে। মনে রাখবেন কাজের পোর্টফোলিও থাকা জরুরী যা আপনি আপনার সম্ভাব্য চাকুরীদাতাকে দেখাতে পারবেন। নিজের ব্যক্তিগত সাইট এ ক্ষেত্রে বিরাট ভূমিকা রাখতে পারে। মনে রাখতে হবে আপনার সাইট আপনার দর্পন। আপনার জ্ঞান অভিজ্ঞতা আপনার সাইট দেখে বুঝতে পারার মতো হতে হবে। যে ধরনের কাজ করতে চাচ্ছেন, সেই ইন্ডাস্ট্রি নিয়ে বা কাজের বিষয়বস্তু নিয়ে আপনার পাণ্ডিত্য প্রদর্শন জরুরী। অফিসিয়াল কাজের জন্য অবশ্যই সংশ্লিষ্ট বিষয়ে নূন্যতম ব্যাচেলর ডিগ্রী থাকা উচিত। অভিজ্ঞতাও শেয়ার করতে ভুলবেন না। প্রয়োজনে পরীক্ষার জন্য প্রস্তুত থাকুন।
বাসায় ভালো গতির ইন্টারনেট সংযোগের ব্যবস্থা রাখুন, ভালো ওয়েব ক্যাম, মাইক্রোফোন জরুরী। সর্বপোরি অড টাইমে (রাত্রে) কাজ করার মানসিকতা থাকতে হবে। আপনার কথায় আর কাজে মিল থাকতে হবে। প্রয়োজনে নিজের সীমাবদ্ধতার গণ্ডির বাইরে যাওয়ার মতো এবং নতুন কিছু শেখার মানসিকতা থাকতে হবে।
কি ধরনের বেতন পাওয়া সম্ভব?
পুরো বিষয়টাই নির্ভর করছে কি ধরনের কাজের জন্য আপনি এ্যাপ্লাই করতে চাচ্ছেন। যত বেশী টেকনিক্যাল কাজ তত বেশী বেতন আশা করা সম্ভব তবে সেটা কখনোই একজন আমেরিকায় অবস্থানরত ব্যক্তির সম পরিমাণ হবে না। তেমনটা হলে বাংলাদেশীকে চাকুরী দেয়ার কোন মানে নেই।
প্রফেশনালিজম
নিজেকে কুল বা আধুনিক বোঝাতে গিয়ে আমেরিকানদের মতো আফিসের কারো সাথে আলাপ আলোচনায় "হোয়াটস আপ", "ডুড", "শিট", "ইয়ো" ইত্যাদি শব্দ ব্যবহার করা থেকে বিরত থাকুন। ইন্টারভিউতে মার্জিত পোশাক (শার্ট/স্যুট) পরে আসাটা কাম্য। সময়কে মূল্যায়ণ করুন এবং "ধন্যবাদ" বলতে শিখুন। যারা ইন্টারভিউ নিবেন তাদের কথা মনোযোগ দিয়ে শুনেই উত্তর দিন। যা জিজ্ঞেস করা হচ্ছে তার উত্তর সংক্ষেপে দিন, গল্প বলার দরকার নেই। গল্প বলতেই যদি হয় সেটা ছোট হোক।
যাইহোক, অনেক কিছু বলা হলো। পুরো বিষয়টিই মূলত প্রযুক্তি সংক্রান্ত চাকুরির বিষয়টি মাথায় রেখে আলোচনা করার চেষ্টা করেছি। এ ব্যাপারে আপনাদের সুর্নিদিষ্ট কোন প্রশ্ন থাকলে করতে পারবেন। আমি উত্তর দেয়ার চেষ্টা করবো সাধ্যমত। ধন্যবাদ।
ছবি কপিরাইট: স্মার্ট ব্লগার
সর্বশেষ এডিট : ১২ ই আগস্ট, ২০২২ সন্ধ্যা ৬:৫২