somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

অপরাজেয় বাংলার স্মৃতিকাব্য

০৩ রা জুলাই, ২০২১ রাত ১:০৭
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



নাদিরা কিরণ

অপরাজেয় বাংলা। এই ভাস্কর্য নির্মাণের পেছনে মূলত স্বাধীনতার চেতনা কাজ করেছিল— এর নির্মাতা ভাষ্কর ও চিত্রশিল্পী সৈয়দ আব্দুল্লাহ খালিদ তিনি নিজেও একজন মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে বীরশ্রেষ্ঠ হিসেবে সামরিক বাহিনীর সাত বীরকে বেছে নেওয়া হয়, তখন সৈয়দ আব্দুল্লাহ খালিদের মনে এক ভিন্ন অনুভূতির জন্ম হয়। তিনি ভাবেন, যে কৃষকের সন্তান লাঙল ফেলে হাতে বন্দুক তুলে নিয়েছিল, যে কোনো দিন চোখে দেখেনি এমন কোনো জিনিস, তেমন একজন সাধারণ মানুষ সেই অস্ত্র দিয়েই প্রশিক্ষিত সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে মরণপণ লড়াই করে জাতিকে স্বাধীনতার স্বাদ পাইয়ে দিল। সেই ত্যাগের কোনো মূল্যায়ন না হওয়ায় তিনি এমন কিছুর কথা ভাবতে থাকেন, যা এই মানুষদের অবদানের স্বাক্ষর বহন করবে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা ভবনের সামনে আজ যেখানে স্বাধীনতার স্মারক ভাস্কর্য ‘অপরাজেয় বাংলা’ দাঁড়িয়ে আছে, সেই স্থানটির একটি ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট রয়েছে। একাত্তরের সেই অগ্নিঝরা দিনগুলোতে এখানেই বাংলাদেশের প্রস্তাবিত পতাকা উত্তোলন করেছিলেন তৎকালীন ছাত্রনেতারা। স্বাধীনতা পরবর্তী পর্যায়ে ১৯৭৩ সালে ওই স্থানেই একটি স্মারক ভাস্কর্য তৈরি করা হয়েছিল। কিন্তু নির্মাণ শৈলীতে ত্রুটি রয়েছে মর্মে তা ভেঙে ফেলা হয়। নতুন করে স্থানটিতে আরেকটি ভাস্কর্য নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদের (ডাকসু) তৎকালীন নেতৃবৃন্দ।

সময় ১৯৭৪ সাল। যেকোনো কারণেই হোক, তখন সৈয়দ আব্দুল্লাহ খালিদের নামটা সামনে চলে আসে। তিনি তখন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করছেন। এমন একটি কাজের সুযোগের অপেক্ষাতেই ছিলেন খালিদ। তিনি কোনো পারিশ্রমিক ছাড়াই শুধু স্মারক তৈরির খরচ হিসেবে ৫০ হাজার টাকার একটি প্রকল্পের দলিল দাখিল করেন। সিদ্ধান্ত হলো এই টাকার অর্ধেক দেবে ডাকসু, বাকি অংশ বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।


ছবিটি অপরাজেয় বাংলা নির্মাণকালীন হঠাৎ থমকে যাওয়া অনিশ্চয়তায় স্থবিরকালীন সময়ের কোনও একদিনের

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য তখন অধ্যাপক আবদুল মতিন চৌধুরী। ১৯৭৪ সালের মাঝামাঝি নাগাদ কাজ শুরু হলো। কাজে শুরুর আগে খালিদ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতা থেকে ডেপুটেশন নিলেন। এই কাজের জন্য বাজেট ঘোষণা করা হলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তিনজন শিক্ষক এবং ডাকসু প্রতিনিধি ম হামিদকে নিয়ে একটি কমিটি গঠন করা হয়। মাঝে কয়েকবার অর্থ সংকটের অজুহাতে কাজ বন্ধ করতে হয়েছিল। তারপর ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির জনক শেখ মুজিবুর রহমানের সপরিবারে নিহত হওয়ার ঘটনার পর কার্যত বন্ধই হয়ে যায় ভাস্কর্য নির্মাণের কাজ। ১৯৭৭ সালে স্বাধীনতাবিরোধী শক্তির হাতে অর্ধসমাপ্ত ভাস্কর্যটি ক্ষতিগ্রস্তও হয়। ওই বছরের আগস্টে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাঙ্গণে ভাস্কর্যটি থাকবে কি থাকবে না এমন বিতণ্ডা থেকে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়েন ছাত্ররা। এতে অন্তত ৩০ জন আহত হন। ফলে অর্ধসমাপ্ত অবস্থাতেই দীর্ঘদিন দাঁড়িয়ে থাকতে হয় অপরাজেয় বাংলাকে।

শেষ পর্যন্ত ১৯৭৯ সালে অনেক ঝড়ঝাপটা মোকাবিলা করে নির্মাণ শেষ হয় অপরাজেয় বাংলার। ১৬ ডিসেম্বর সকাল ৯টায় এ ভাস্কর্যটির উদ্বোধন করেন যুদ্ধাহত কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবনের সামনে ত্রিকোণাকৃতির একটি বেদি, মাটি থেকে যার উচ্চতা ১৮ ফুট বেদির ওপরই স্থাপন করা হয় ভাস্কর্যটি।

স্থপতি রবিউল হোসেন অপরাজেয় বাংলার কম্পোজিশনের সঙ্গে সামঞ্জস্য বজায় রেখে ভাস্কর্যের পাদভূমী ও ফিগারের সমন্বয়ে একটি পিরামিডাল কম্পোজিশনের ইঙ্গিত দিয়েছেন। সৈয়দ আব্দুল্লাহ খালিদ তাঁর সহযোগী বদরুল আলম বেনুকে নিয়ে দীর্ঘ কয়েকটি বছরের অক্লান্ত পরিশ্রমের মাধ্যমে তৈরি করেন স্বাধীনতার এ স্মারক। প্রথম দিকে তাঁরা বারো থেকে তেরো ঘণ্টার মতো কাজ করে তিন ফুট উঁচু একটি মডেল তৈরি করেন। মডেলটি তৈরি করা হয়েছিল কাদামাটি দিয়ে। সেই তিন ফুটকে চারগুণ বড় করার সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করতে গিয়ে ব্যবহার করলেন মাটি, বালু, কংক্রিট ও পাথর।

ভাস্কর্যের মূল উদ্দেশ্য ছিল একাত্তরের স্বাধীনতা সংগ্রামের একটি প্রতিনিধিত্বমূলক উপস্থাপন। মূলত মুক্তিযুদ্ধে সিপাহি জনতার পাশাপাশি কৃষক ও সাধারণ মানুষ নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সবাই সমানভাবে অংশ নিয়েছিলেন, তা তুলে ধরাই ছিল এর উদ্দেশ্য। সৈয়দ আব্দুল্লাহ খালিদ নিজে ছিলেন একজন মুক্তিযোদ্ধা। তাঁর সহযোগী বদরুল আলম বেনুও ছিলেন একজন মুক্তিযোদ্ধা। এই দুই মুক্তিযোদ্ধা স্বাধীনতার চেতনাকে চিরদিনের জন্য মানুষের মনে জাগরুক রাখতে রোদ-বৃষ্টি উপেক্ষা করে বাটালি চালিয়েছেন নিরলসভাবে।

শেষ পর্যন্ত তিনটি ফিগারের সমন্বয়ে তৈরি করা হয় অপরাজেয় বাংলা। মাঝখানের ফিগারটি গ্রামের এক তরুণ মুক্তিযোদ্ধা, যে বাম হাতে ধরে রেখেছে একটি গ্রেনেড, আর ডান হাতে উদ্ধত রাইফেল। ওই তরুণের মডেল হলেন বদরুল আলম বেনু। এর বাম দিকের ফিগারটি থ্রি নট থ্রি রাইফেল হাতে দাঁড়িয়ে আছেন, যা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রের প্রতিনিধিত্ব করে। এর মডেল হলেন সৈয়দ হামিদ মকসুদ ফজলে। আর ফার্স্ট এইড বক্স হাতে যে সেবাদানকারী তরুণী, তার মডেল হয়েছিলেন প্রথমে খালিদের খালাতো বোন হাসিনা আহমেদ, শেষ পর্যায়ে এসে ম হামিদের স্ত্রী ফাল্গুনী হামিদ। তিন ফুট উঁচু যে মডেল প্রথমে তৈরি করা হয়, পরে তার ওপর কংক্রিটের ঢালাই দিয়ে ভাস্কর্যের উচ্চতা বারো ফুটে উন্নীত করা হয়। এরপর শুরু হয় খোদাইয়ের কাজ। আস্তে আস্তে বেরিয়ে আসে তিনটি মানুষের ফিগার।

একুশে পদকপ্রাপ্ত ভাষ্কর সৈয়দ আব্দুলাহ খালিদ সৃষ্টি করলেন এক ইতিহাস যা আজও এই বিদ্যাপীঠের প্রতিটি শিক্ষক, শিক্ষার্থীর গর্বের, প্রাণের পাদপীঠ। ছবিটি, অপরাজেয় বাংলা নির্মাণকালীন হঠাৎ থমকে যাওয়া অনিশ্চয়তায় স্থবিরকালীন সময়ের কোনও একদিনের চিত্র। স্মৃতিকাতর করে।

লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক

নিউজ লিংক: অপরাজেয় বাংলার স্মৃতিকাব্য
সর্বশেষ এডিট : ০৩ রা জুলাই, ২০২১ রাত ১:০৮
১টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

পানির অপচয় রোধ: ইসলামের চিরন্তন শিক্ষা এবং সমকালীন বিশ্বের গভীর সংকট

লিখেছেন নতুন নকিব, ১৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৮:৪৬

পানির অপচয় রোধ: ইসলামের চিরন্তন শিক্ষা এবং সমকালীন বিশ্বের গভীর সংকট



পানি জীবনের মূল উৎস। এটি ছাড়া কোনো প্রাণের অস্তিত্ব সম্ভব নয়। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তা'আলা ইরশাদ করেন:

وَجَعَلۡنَا... ...বাকিটুকু পড়ুন

মায়াময় স্মৃতি, পবিত্র হজ্জ্ব- ২০২৫….(৭)

লিখেছেন খায়রুল আহসান, ১৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:০৭

ষষ্ঠ পর্বের লিঙ্কঃ মায়াময় স্মৃতি, পবিত্র হজ্জ্ব- ২০২৫-….(৬)

০৬ জুন ২০২৫ তারিখে সূর্যোদয়ের পরে পরেই আমাদেরকে বাসে করে আরাফাতের ময়দানে নিয়ে আসা হলো। এই দিনটি বছরের পবিত্রতম দিন।... ...বাকিটুকু পড়ুন

হাদিকে shoot করে লাভবান হলো কে?

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ১৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৩:২৪


শরিফ ওসমান হাদি যিনি সাধারণত ওসমান হাদি নামে পরিচিত একজন বাংলাদেশি রাজনৈতিক কর্মী ও বক্তা, যিনি জুলাই গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে গঠিত রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র হিসেবে পরিচিত। তিনি ত্রয়োদশ... ...বাকিটুকু পড়ুন

আধা রাজাকারি পোষ্ট ......

লিখেছেন কলিমুদ্দি দফাদার, ১৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৩:৫৬


আমি স্বাধীন বাংলাদেশে জন্মগ্রহণ করেছি। আমার কাছে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতা, বা পূর্ব পাকিস্তানের সঙ্গে আজকের বাংলাদেশের তুলনা—এসব নিয়ে কোনো আবেগ বা নস্টালজিয়া নেই। আমি জন্মগতভাবেই স্বাধীন দেশের নাগরিক, কিন্তু... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইন্দিরা কেন ভারতীয় বাহিনীকে বাংলাদেশে দীর্ঘদিন রাখেনি?

লিখেছেন জেন একাত্তর, ১৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৫:২০



কারণ, কোল্ডওয়ারের সেই যুগে (১৯৭১সাল ), আমেরিকা ও চীন পাকিস্তানের পক্ষে ছিলো; ইন্দিরা বাংলাদেশে সৈন্য রেখে বিশ্বের বড় শক্তিগুলোর সাথে বিতন্ডায় জড়াতে চাহেনি।

ব্লগে নতুন পাগলের উদ্ভব ঘটেছে;... ...বাকিটুকু পড়ুন

×