আল মাহমুদ
পঞ্চাশ দশকের গোড়ার দিকে আমি একটা টিনের সুটকেস নিয়ে ফুলবাড়িয়া স্টেশনে এসে নামলাম। সম্ভবত সেটা ছিল শীতকাল। সন্দেহ নেই আমি কবি হওয়ার প্রতিজ্ঞা নিয়ে এ প্রাচীন মোগলাই শহরে পা রেখেছিলাম।
চারদিকে ঘোড়ার গাড়ির ডাকাডাকি-হৈহুল্লোড়ের মধ্যে আমি কিছুক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে থেকে ভেবে নিলাম আমার গন্তব্যের কথা। আমি যাব ২৮১ নবাবপুর, একেবারে ধোলাইখালের পাশে যেখানে নবাবপুর গিয়ে একটি পুলের মাথায় শেষ হয়েছে এর পাশের একটি হোটেলে। পুলটা পেরোলেই জনসন রোডের শুরু। ডান দিকে কোর্ট হাউস স্ট্রিট, বাঁ দিকে মুকুল সিনেমা, খ্রিস্টানদের গির্জা এবং একটু এগিয়ে ভিক্টোরিয়া পার্ক। যে পার্কে সিপাহি বিদ্রোহের সময় কয়েকজন বিদ্রোহী সিপাহিকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে হত্যা করা হয়েছিল।
আমি একজন পথচারীকে নবাবপুর রোডেটা কোথায়, কোন দিকে গেলে নবাবপুরে পৌঁছতে পারব জিজ্ঞেস করলাম। এর আগেও আমি দু’একবার ঢাকায় এসেছিলাম। এসেছিলাম আমার খালার বাসায় উঠতে গিয়ে সে বার নবাবপুর রোডের মধ্য দিয়ে গিয়েছিলাম। আমার এক খালা ১২ নম্বর ইসলামপুর রোডে থাকতেন। তার স্বামী ছিলেন শিক্ষক। এ কারণে আমি নবাবপুর রোডটা চিনি না এমন তো নয়। কিন্তু ফুলবাড়িয়া স্টেশন পেরিয়ে কিভাবে নবাবপুর রোডে পৌঁছব সেটাও আমি ভালো করে জানতাম না।
পথচারী আমাকে বলল- ওই তো সামনে নবাবপুর রোডের মাথা। ডান দিকে গিয়ে নবাবপুর চলে যান। আমি সুটকেসটি হাতে তুলে হাঁটতে শুরু করলাম। সুটকেসটি আমার হালকাই ছিল। কিছু কবিতার জীর্ণ খাতা, একটি বই আর কিছু কাপড়। সে সময় আমি সবে হাফপ্যান্ট ছেড়ে পাজামা পরতে শুরু করেছি। আমার পরনে ছিল কুমিল্লার খদ্দরের মোটা হলুদ পাঞ্জাবি। পায়ে রাবারের স্যান্ডেল।
আমার কাছে মূল্যবান কোনো কিছুই ছিল না। অল্প কিছু টাকা ছিল। যা কষ্টে সংগ্রহ করে আমি বাড়ি থেকে রওনা হয়েছিলাম। তবে একটি দামী জিনিস আমার সাথে ছিল। সেটা হলো কলম- লাইফটাইম। আমার শরীরে মধ্যে ঝোলানো কাপড়-চোপড়, সুটকেস, জামা ও জুতো সব কিছুর মধ্যে অধিক মূল্যবান।
একটু হেঁটে গিয়ে আমি নবাবপুরে পড়লাম। এর চেয়ে প্রশস্ত রাস্তা ঢাকায় আর ছিল না। একটু এগোতেই দেখি ভিস্তিওয়ালারা তাদের চামড়ার মশক বহন করে রাস্তা ধুয়ে দিচ্ছে। তাদের পাশ দিয়ে চলে যাচ্ছে ঘোড়ার গাড়ি। গাড়োয়ানরা খোশ মেজাজে ঘোড়ার সাথে কথা বলতে বলতে ঘন্টি বাজিয়ে চলে যাচ্ছে। রাস্তায় বেরিয়েছে সালোয়ার-কামিজ পরা অনেক মেয়ে। কারো হাতে চায়ের কাপ, কারো হাতে সিগারেটের প্যাকেট বা পানের মোড়ক নিয়ে তারা আশপাশের বাড়িগুলোতে ঢুকছে। সারাটা রাস্তায় একটা অতিশয় প্রভাত বেলার গন্ধ ছড়ানো। গন্ধটা বিরিয়ানি, মুরগি পোলাও, তেহারি, নেহারির সাথে ঘোড়ার গায়ের গন্ধ এবং গরুর সদ্য রাঁধা গোশতের ঘ্রাণে সংমিশ্রিত। সবটাই যে নবাবপুরের গন্ধ এটা কিন্তু ঠিক নয়। নবাবপুর থেকে বেরিয়ে যাওয়া ঠাটারিবাজার এবং আরো কয়েকটি রাস্তার আশপাশের নাস্তা রন্ধনশালার উপচেপড়া গন্ধ নাকে টের পাচ্ছিলাম। এই গন্ধ আমি যেখানে যাব সে রথখোলা পর্যন্ত প্রসারিত। তারপরই বাতাস অন্যরকম। কারণ ধোলাইখাল পর্যন্ত নবাবপুরের যে আমেজ তা পুলটা পেরোলেই আর থাকছে না। আমি রথখোলার মোড়ে গিয়ে সুটকেসটা একবার নিচে নামিয়ে একটা সিগারেট ধরাবার চিন্তা করলাম। এখানে অকপটে স্বীকার করে নিচ্ছি যে আমি খুব অল্প বয়সেই ধূমপানে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছিলাম। যে অভ্যাস সত্তরে এসেও ছাড়তে পারিনি। কিংবা ছাড়িনি। ছাড়িনি এ কারণে যে আমার বুকে কোনো কফ-কাশি, হাঁপানির মতো দুরারোগ্য ব্যাধি আমাকে কখনো অবশ করেনি। আর এখন তো জীবনের শেষ মাথায় এসে যখন আমার প্রভু আল্লাহর নামে সপ্তাহের একদিন বৃহস্পতিবার জিকির শুরু করি তখন এ বিশ্বাস কেমনভাবে যেন হয়েছে যে আমার বুকটা আর গোলযোগপূর্ণ বোধ হবে না। প্রত্যেক মানুষেরই কিছু না কিছু সংস্কার থাকে। অদৃশ্যের ওপর যুক্তিহীন ভরসা থাকে। আমারও আছে। কত দেখলাম, কত পড়লাম, কত কিছু ঘাঁটলাম আর বেছে নিলাম নিজের দুর্ভোগ। কিন্তু প্রায় অন্তিমে এসে এখন এমন বহু বিষয়ে বিশ্বাসী হয়ে পড়েছি যা দেখা যায় না। হাত বাড়ালে ধরা যায় না। কিন্তু আমার কাছে চিন্তিতভাবে তা বিদ্যমান।
কেউ যদি বলে আমি কুসংস্কারে বিশ্বাসী, বলতে পারে। আমি আমার অভিজ্ঞতার অন্ধকার অঞ্চল পার হতে হতে আলোর মধ্যে এসে দাঁড়িয়েছি। এই আলোর ঝলকানিতে এখন আর কিছুই দেখতে পাচ্ছি না। আলোর ভেতরে আলো দেখতে পাচ্ছি। এ অবস্থাটিকে ব্যাখ্যা করার জন্য আমার কবিত্ব শক্তি আমার প্রভু যেটুকু অনুমোদন করেছেন তা দুঃসাহসীর মতন বলে যাওয়ার প্রতিজ্ঞা নিয়ে এই রচনা শুরু করলাম। সাধ্যমতো সত্য-মিথ্যা-স্বপ্ন-দৃশ্য-অদৃশ্য সব লিখে যাওয়ার বাসনা রাখি। আমি বলছি না আমার জীবনের এ অংশ আমি যা বলব এর সবটুকু সত্য। আমি স্বপ্ন জগতের মানুষ, আমার কাছে নিরেট সত্য দাবি করা নির্দয়তা ছাড়া কিছু নয়। আমি বলব আমার কাহিনী। বলব আমি এভাবে জীবন কাটিয়েছি। কেউ বিশ্বাস করার ইচ্ছে থাকলে তিনি করবেন। কেউ মিথ্যার অভিযোগ উত্থাপন করলে আমি বলব যে কবির চেয়ে সত্যবাদী সমাজে খুব বেশি জন্মায় না।
আমি টিনের সুটকেসটার উপর রথখোলার মোড়ে যেখানে দুধ বিক্রেতাদের সারি জমে উঠেছে এর এক প্রান্তে চুপচাপ বসে পড়ে একটা সিগারেট ধরালাম। আমার শখের সিগারেট বার্কলে। সাধারণত এটি খাওয়ার মতন পয়সা আমার থাকত না। সিজারই টানতাম। কিন্তু আমার এ মহানগরীতে কবি হওয়ার বাসনা নিয়ে নতুন অতিথি। সে জন্য দু’একটি বার্কলে সিগারেট অন্য প্যাকেটে ঢুকিয়ে এসেছিলাম। আরামে সুখটান মারছি।
একজনকে, আমার সমবয়সি হবে এক তরুণকে জিজ্ঞেস করলাম, আচ্ছা ঐ তো সমজিদ। আমি ২৮১ নং বাড়িতে যাব। ছেলেটি চমকে উঠল। বুড়ির হোটেলে?
আমি বুঝতে পারলাম ছেলেটি আমার গন্তব্য সম্পর্কে নির্ভুল কৌতূহল প্রকাশ করছে। হ্যাঁ ভাই।
কার কাছে যাব!
কবি লুৎফর রহমানের কাছে।
তাড়াতাড়ি যান। একটু পরেই উনি তো অফিসে চলে যাবেন। আমি দেখে এসেছি উনি নিচে খেতে বসেছেন।
আমি কালবিলম্ব না করে সিগারেটে দু’তিনটা সুখটান মেরে সুটকেস নিয়ে দ্রুত পা ফেলে মসজিদের পাশের গলি দিয়ে ভেতরে ঢুকে গেলাম।
বাঁ দিকে তাকাতেই বুড়ির খোয়া ওঠা অতিশয় প্রাচীন দোতলা ইমারত। আমি ঢুকেই দেখলাম লুৎফর রহমান, একদা যিনি আমার দাদার বাড়ির গৃহশিক্ষক ছিলেন এবং দীর্ঘকাল কলকাতায় গ্র্যান্ড হোটেলে বেয়ারার চাকরি করে কলকাতার বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় লিখে সামান্য পরিচিতি অর্জন করেছিলেন সেই প্রসন্ন মুখচ্ছবি লুৎফর কাকু।
আমাকে দেখে খুবই যে বিম্মিত হয়েছেন এমনভাব তার চেহারায় ফুটে উঠল না।
এই তো সকালের গাড়িতে।
তিনি আমার কথায় আমার হাত থেকে সুটকেসটি নিয়ে যেখানে চাটাই বিছিয়ে খাওয়া-দাওয়া হচ্ছিল এর পাশে রেখে বললেন, আগে নাস্তা করে নাও। উপরে গিয়ে কথাবার্তা হবে। তিনি মোটা বিশাল আকৃতির এক বৃদ্ধা মহিলার দিকে ইঙ্গিত করে আমাকে খেতে দিতে বললেন। বৃদ্ধা আমাকে এ সকালবেলাতেই গরম ভাত এবং কাঁচকি মেশানো আলুর ভাজি প্লেটে ভরে দিয়ে ঠেলে সামনে রাখতে গিয়ে বললেন, কোত্থেকে? শাহবাজপুর থেকে? শাহবাজপুর আমার শ্বশুরবাড়ি।
মুখে প্রসন্ন হাসি।
আমি বললাম, না নানী। আমার বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়। বুড়ি আর কথা বাড়ালেন না।
আমি সকালবেলার গরম প্রাতরাশ পেট ভরে খেয়ে নিলাম। তারপর ধুয়েমুছে কুলকুচা করে সুটকেসটি নিয়ে উপরে চলে এলাম। লুৎফর কাকু তখন অফিসে যাওয়ার জন্য পাঞ্জাবি পরে নিয়েছে আমাকে পাশের খালি সিটটা দেখিয়ে দিয়ে বললেন, এখানে বসো। কেন এসেছ?
একটা কাজের জন্য।
তোমার বাপ-মা জানেন?
আপনার কাছে আসব এ কথা বলে চলে এসেছি।
তিনি কিছুক্ষণ আমার দিকে নিঃশব্দে তাকিয়ে রইলেন। তারপর অত্যন্ত মৃদু শব্দে বললেন, গতকাল কাফেলায় তোমার একটি গল্প ছাপা হয়েছে- ‘জীবন’। ভালো লেখা। ডাকে পাঠিয়েছিলে? আমি নেড়ে সম্মতি জানালাম।
তিনি কাগজের ভাঁজ থেকে সাপ্তাহিক কাফেলার একটি সংখ্যা আমার হাতে দিয়ে বললেন, সুন্দর করে ছেপেছে। এখন কাফেলা দেখছেন কবি ওয়াছেকপুরী, আবদুর রশিদ ওয়াছেকপুরী। তার কবিতা তো নিশ্চয় দেখে থাকবে। ইচ্ছে করলে আমি অফিস থেকে না ফেরা পর্যন্ত তুমি একবার ইসলামপুর থেকে ঘুরে আসতে পারো। ২৫ নম্বর ইসলামপুরের দোতলায় কাফেলা অফিস। গেলেই তাকে পাবে। শোনো, তোমার অনেকগুলো কবিতা কলকাতার কাগজে ছাপা হয়েছে। নতুন সাহিত্য, চতুরঙ্গ ইত্যাদিতে।
কাফেলা থেকে রাস্তায় নেমে আমার মনে হলো ঢাকা শহর থেকে সুন্দর শহর আর বুঝি জগতে নেই। আমি এর আগেও ঢাকায় এসেছি। কিন্তু এবারের আসাটা ফিরে যাওয়ার জন্য নয়। যতটুকু মন পড়ে, ঋতুটা ছিল বসন্তের আমেজে ভরপুর। মীতের প্রকোপ শেষ না হলেও রাস্তার আশপাশে কৃষ্ণচূড়া গাছের উপরিভাগটা সহসা যেন লাল ফুলে ভরে গেছে। আমি ওই কাফেলার রাস্তা ধরেই ওয়াইজঘাটের দিকে হাঁটা দিলাম। ওয়াইজঘাটের অলিগলি পার হয়ে উপস্থিত হলাম বার্কলেন বাঁধের ওপর। অর্থাৎ বুড়িগঙ্গার তীরে। তো বাঁ হাতি রাস্তা ধরে চলতে চলতে এসে উপস্থিত হলাম সদরঘাট। সেখানে বিশাল কামানটি দর্শনীয় বস্তু হিসেবে পাথরের মঞ্চের ওপর বসানো ছিল। অনেকে বলতেন কালো খাঁ কামান। কামানটির নাম ছিল বিবি মরিয়ম। মনে হয় কোনো যুদ্ধের সময় কামানটি বুড়িগঙ্গার তীরচ্যুত হয়ে পানিতে পড়ে গিয়েছিল। কামানটিতে গ্রাম থেকে আসা হিন্দু বধূরা সিঁদুর দিয়ে পূজা করত। হয়তো তারা এটাকে তাদের শিবলিঙ্গ হিসেবে বিবেচনা করত। আমি কামানটির ওপর হাত দিয়ে এর বিশাল আকার ও লৌহ গহ্বর দেখে নিলাম। এ কামানটিকে নিয়ে আমার একটি কবিতাও আছে। কবিতাটির নাম ‘মায়াবী পর্দা দুলে ওঠো’। আমি যখন ‘মায়াবী পর্দা দুলে ওঠো’ লিখি তখন কামানটি সদরঘাটে ছিল না। তুলে আনা হয়েছিল গুলিস্তান মোড়ে। সেটা অনেক পরের কথা।
আমি যখনকার কথা বলছি তখন গুলিস্তান অঞ্চলটির আশপাশে খানাখন্দ, কচুঘেঁচু এবং অনাবাদি খালি জমি পড়ে ছিল। এর মধ্যে বিটুনিয়া বলে একটি সিনেমা হলের কথা মনে পড়ে। এই সিনেমা হলে ইংরেজি ছবি দেখানো হতো। দর্শক ছিল ইংরেজরা। পাকিস্তান হওয়ার পর এ হলটি ইংরেজি শিক্ষিত পূর্ব পাকিস্তানের সুবিধাভোগী একটি শ্রেণীর বিদেশী সিনেমা দেখার হল রূপে বিবেচিত হচ্ছিল।
আবার কামানের কথায় ফিরে আসি। কামানটি ছিল অসাধারণ গুরুত্বপূর্ণ প্রতœ সম্পদ। এটি নিয়ে তখন ঢাকার পৌর কর্তৃপক্ষ কিংবা যারা প্রতœ সম্পদের রক্ষক তারা মনে হয় এর সঠিক স্থান নির্ণয় করতে পারছিলেন না। এখানে-ওখানে ঘুরেফিরে বিবি মরিয়ম এখন ওসমানী উদ্যানের গৌরব বৃদ্ধি করছে।
যা হোক আমি সদরঘাটে কিছুক্ষণ ঘুরেফিরে যাওয়ার সময় অবাার মজলিশ ভাইয়ের দোকানের সামনে এসে দাঁড়াতেই তিনি বললেন, আরে আপনি এসেছেন। দেখুন কীর্তিবাসের প্যাকেট এসে গেছে। তিনি একটি প্যাকেট থোকে গাঢ় নীল রঙের প্রচ্ছদের ওপর লাইনো টাইপে কীর্তিবাস লেস পত্রিকাটি আমার হাতে দিলেন। পত্রিকার খোঁজে এর মধ্যে মজলিজ ভাইয়ের সঙ্গে আমার পরিচয় হয়ে গিয়েছিল। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় সম্পাদিত পত্রিকাটি দেখে আমার মন ভরে গেল। কাগজ দেখেই এই পত্রিকাটিতে লেখা পাঠাব বলে মনস্থির করে ফেললাম।
আমি যখন কাগজটি দেখছি, তখন আমার পেছনে পিঠের সাথে প্রায় বুক লাগিয়ে আরো একজন কীর্তিবাসের ভেতরটা দেখার চেষ্টা করছিল। আমি মুখ ফিরিয়ে যুবকটিকে দেখলাম। আমি মুখ ফেরাতেই সে বলল, আমার নাম দেবব্রত চৌধুরী। তখন আমি আমার নিজের পরিচয় দিতে বাধ্য হলাম। বললাম, আল মাহমুদ।
হ্যাঁ কলকাতার কাগজে আপনার কবিতা আমি দেখেছি। আপনার বাড়ি তো ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়। আমি হবিগঞ্জের লোক। আমিও কবিতা লিখি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ি।
ওই নামে কারো কবিতা কোনো পত্রিকায় পড়িনি। হয়তো তিনি ঢাকার পত্র-পত্রিকায় লেখেন। আমার চোখ এড়িয়ে গেছে। আমি মজলিশ ভাইকে কীর্তিবাসের দাম পরিশোধ করা মাত্র তিনি আরো একটি প্যাকেট থেকে খুব সুন্দর সাদা আর্ট পেপারের প্রচছদওয়ালা একটি পত্রিকা আমার হাতে দিলেন। পত্রিকাটির নাম ময়ূখ। এটিও কবিতা পত্রিকা। আমি এবং দেবব্রত দু’জনে খুব উৎসুক হয়ে পত্রিকাটি দেখলাম। সম্পাদক জগদীন্দ্র মন্ডল। পাতা উল্টিয়েই দেখলাম, এতে বুদ্ধদেব বসুর কবিতা দিয়ে শুরু। দারুণ আকৃষ্ট হলাম ময়ূখ পত্রিকাটির প্রতি। আমি ও দেবব্রত হাঁটতে হাঁটতে সদরঘাটের মোড় পার হয়ে ধোলাইখালের ব্রিজের ওপর এসে দাঁড়ালাম। দেবব্রতকে বললাম, আমি এখানে এই মসজিদের পাশে থাকি।
এটা তো নবাবপুর রোডে পড়ে। নম্বর কত?
আমি বললাম ২৮১।
ঠিকানাটি একটি কাগজে টুকে নিল দেবব্রত চৌধুরী এবং একটু অবজ্ঞার দৃষ্টিতে সেদিকে তাকিয়ে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে বলল, তাহলে আমি আসি।
দেবু চলে গেলে আমি ভেতরে গিয়ে লক্ষ্য করলাম, চার-পাঁচ জন লোককে বুড়ি খাওয়াচ্ছে। আমার দিকে চোখ পড়তেই বলল, ওই মিয়া, জলদি আহো।
এ কথায় আমি দ্রুত উপরে উঠে গিয়ে পরনের পাজামা ও শার্ট ছেড়ে লুঙ্গি পরে নিলাম এবং নিচে এসে কুয়ার পানিতে হাত-মুখ ধুয়ে খেতে বসে গেলাম।
ততক্ষণে সবাই প্রায় উঠে গিয়েছিল। বুড়ি আমার দিকে একটা টিনের থালা এগিয়ে দিল এবং একটি বড় টিনের চামচ দিয়ে ঝাঁকা থেকে ভাত তুলে পাতে ঢেলে দিল। দেখলাম, এক টুকরা মাছ ও আলুসহ ঝোলভরা একটা বাটি আমার সামনে। আমি ঢেলে নিয়ে খেতে শুরু করলে কোত্থেকে একটা লম্বামতো ফর্সা লোক এসে দাঁড়াল। বুড়ি ওই লোকের মুখের দিকে তাকিয়ে একটা বাক্স থেকে মুঠ করে কী যেন বের করে তাকে দিল। আমার মনে হয় পয়সা-কড়ি হবে। আমি আপন মনে খাচ্ছিলাম। আর আড় চোখে লোকটাকে দেখছিলাম। বেশ ছিমছাম স্বাস্থ্য এবং বেশ একটু লম্বাও বটে। চোখ দু’টি রক্তবর্ণ। ফিরে যাওয়ার সময় বুড়ি বলল, খাবি?
না।
লোকটা বেরিয়ে গেল
আমি এবার বুড়ির দিকে তাকালাম।
আমার ছেলে।
আমি কোনো কথা না বলে খাওয়া শেষ করে উঠে দাঁড়াতেই বুড়ি বলল, শীতের লেপকাঁথা আনছ?
আমি হাসলাম। আনিনি, তবে একটা ব্যবস্থা তো হবে। লুৎফর কাকু আসুক।
ওমা একেবারে মুক্ত সুরত! লুৎফর মিয়া তো কইল বড় ঘরের ছেলে।
আমি একটু লজ্জা পেয়ে কেটে পড়লাম। উপরে এসে খাটে শুয়ে পড়লাম। ঘুমটুম কিছু হলো না। মন পড়ে আছে কীর্ত্তিবাস ও ময়ূখের দিকে। পত্রিকা দুটো খুলে অত্যন্ত মনোযোগ সহকারে খুঁটিয়ে পড়লাম। যেন এক অনাবিষ্কৃত নতুন জগতে প্রবেশ করেছি। যেখানে পৌঁছতে না পারলে আর শান্তি নেই।
কিভাবে একজন মানুষ বালক বয়সেই কিংবা বয়োসন্ধিকালে কবি হয়ে ওঠে তা আমার এই নেশাগ্রস্ত অবস্থা থেকে খানিকটা আন্দাজ করতে পারি। মনে হচ্ছে, কবিতা ছাড়া আমার আর কোনো পাঠ্য নেই। আর কিছু করতে যেন মনের কোনো সায় নেই। তাছাড়া সবচেয়ে বড় যে দুর্ভাগ্য ওই বয়সে আমার মনে যে বাসা বেঁধেছিল আমার যেন কারো প্রতি কোনো দায়িত্ব নেই। এমনকি আমার নিজের প্রতিও কোনো দায়িত্ব অনুভূতি নেই। যদি থাকত তাহলে এই শীতের সময় বাড়ি থেকে লেপ-তোষক নিয়ে আসতাম। হায় আল্লাহ্ আমার একটি বালিশও ছিল না। আমি এসে পড়েছি প্রাচীন একটি মোগলাই শহরে। যে শহর সহসা-এর সামন্ততান্ত্রিক খোলস ফাটিয়ে এক দশকের মধ্যেই বেরিয়ে আসবে। হয়ে উঠবে ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, অর্থনীতি এবং ধর্মসহ যুদ্ধের জন্য ব্যাকুল।
দৈনিক ইত্তেফাকের সৌজন্যে।
সর্বশেষ এডিট : ২৫ শে এপ্রিল, ২০০৯ ভোর ৫:০৭